সোমবার, ১৯ জুন, ২০২৩

রাহুল দাশগুপ্ত

 

ধারাবাহিক উপন্যাস


একটি অপরিকল্পিত হত্যার কাহিনী

 


(২৯)              

একটু বেশীই যেন তাড়াহুড়ো করতে চাইছে সে। সামান্য খটকা লাগলেও তাকে আমল দিল না হৃদয়। দশ মিনিটের বদলে প্রায় একঘন্টা হতে চলল। অতলান্ত ধৈর্য ধরে বসে আছে, হৃদয় থামাতে পারছিল না। পুরোপুরি সন্তুষ্ট হয়ে তবেই সে থামল। অতলান্তের মুখের ভাব এখন পালটে গেছে। স্কেচটার দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে আছে সে...

হৃদয় বুঝতে পারল, অতলান্ত কিছু না বললেও চলবে। ওর মুখের ভাবেই ওর প্রতিক্রিয়া স্পষ্ট। কিন্তু গলার স্বরটাও যে অতলান্তের একটা বড় সম্পদ। অসম্ভব নাটকীয়ভাবে সে বলে উঠল, বাঃ চমৎকার চমৎকার, কিছু বলার নেই, সত্যি কিছু বলার নেই, অপূর্ব, অসাধারণ, কী যে হচ্ছে আমার ভেতরে, নাঃ শব্দ দিয়ে ভাষা দিয়ে প্রকাশ করা যায় না, সত্যিই এ এক সাধনার ফসল, সত্যি, সাধনার ফসল তো এরকমই হয়...

হৃদয়ও যেন মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। অতলান্তের গলার স্বর ভাসছে ওর কানে। থরথর করে কাঁপছে সেই স্বর। জোরালো থেকে ক্রমে খাদে নেমে গেছে। শেষ দিকটায় কেমন যেন অস্পষ্ট শুনিয়েছে। আর সেটাই কথাগুলির আবেদনকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রতিটা শব্দ যেন গেঁথে গেছে হৃদয়ের মনে। মুহূর্তগুলি হয়ে উঠেছে অমূল্য। অতলান্ত সত্যিই জাদু জানে। নিমেষে একটা মামুলি পরিবেশকে পালটে দিতে পারে। তাকে ভিন্ন এক উচ্চতায় পৌঁছে দিতে পারে।

হৃদয় স্কেচটি করেছিল ওদের সাংস্কৃতিক উৎসবের জন্য। ওরা প্রত্যেকেই কিছু না কিছু জমা দিয়েছিল। আগ্নেয় কার্টুন, অনির্বেদ চিঠি, অতলান্ত জোকস, সমধা একটা তথ্যচিত্রের স্ক্রিপ্ট, শ্রমণ জাদুর বর্ণনা, বিশ্রুত নাচের ফোটোগ্রাফ, বিহান শ্লোক, এইরকম সব। তারপর চলেছিল উৎসব উপলক্ষে বইপ্রকাশের পর্ব। দিনের পর দিন ফাইল নিয়ে প্রেসে যাওয়া, প্রুফ দেখা, একবার নয়, বারবার কাগজ কিনে দেওয়া, বাঁধাইখানায় গিয়ে পড়ে থাকা, বাঁধাই করা বই নিয়ে আসা, দেড়মাস ধরে চলল এসব। হৃদয় আর বিশ্রুতই সব করল। কখনও কদাচিৎ বাকিদেরও পাওয়া গেল। কিন্তু অতলান্ত খুব অসুস্থ হয়ে পড়ল সেই সময়ে। ওকে একদিনও পাওয়া গেল না।

অতলান্তের জোকসের তিনটে প্রুফই হৃদয় দেখল। কোথাও সমস্যা মনে হলে ফোন করে জেনে নিল। শেষ প্রুফটিও চলে গেছে। হৃদয় আর বিশ্রুত প্রেস থেকে বেরিয়ে এসেছে। বাইরে তুমুল বৃষ্টি। ওদের কাছে কোনও ছাতা নেই। দুজনে একটা পুরনো বাড়ির শেডের নীচে গিয়ে দাঁড়াল।

ঠিক এই সময়ে অতলান্তের ফোন। সে বলল, আমি আরও দুটো জোকস লিখেছি হৃদয়। আমি ফোনেই বলছি। তুই লিখে নিতে পারবি?

এখন? এই অবস্থায়? অসম্ভব! হৃদয় নিরুপায় হয়েই বলল।

প্লিজ হৃদয়, এটা খুব জরুরী।

কিন্তু কোথায় কাগজ? পেন? তাছাড়া সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। আকাশে মেঘ। অন্ধকারে কিছুই ভালো দেখা যাচ্ছে না।

হৃদয় তার সব সময়ের ভরসা বিশ্রুতর মুখের দিকে তাকাল। ভাবটা এমন, কী করি এখন? তুমিই পরিত্রাণ করো।

বিশ্রুত একটা ময়লা কাগজ আর ভোঁতা পেনসিল বার করে দিল। তাই দিয়েই লিখতে শুরু করল হৃদয়।  

ভালো করে দেখএ পাচ্ছে না সে। আর এক হাতে ফোন ধরে লিখতেও খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু তবু যাতে কোনও ভুল না থেকে যায় বারবার জিজ্ঞেস করে জেনে নিচ্ছিল সে। এক সময়ে লেখা শেষ হল। অনেকটা লেখা। পুরোটা আবার পড়ে শোনাল হৃদয়। ভোঁটা পেনসিলে লেখা। বহু জায়গায় অস্পষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু ভুল থাকলে কোনওভাবেই চলবে না। তারপর দু’জনে মিলে প্রেসে ছুটল। অতলান্তের লেখার আরও একটা প্রুফ দেখে তবে ওরা বাড়ি ফিরবে।

সাংস্কৃতিক উৎসবের আগেই অতলান্ত সুস্থ হয়ে উঠল। প্রায় তিনশো বই বাঁধাইখানা থেকে বয়ে নিয়ে এল হৃদয় আর বিশ্রুত। তার একটু পরেই নাকে ড্রপ দিতে দিতে ঢুকল অতলান্ত। প্রথম কথাই বলল, বই এসে গেছে? ওঃ এই মুহূর্ত কোনওদিন ভোলার নয়...

পরশু আমরা প্রাইভেট সেক্রেটারির কাছে যাচ্ছি।

তাই নাকি? অতলান্তের মুখ উজ্জ্বল হয়ে রইল।

হ্যাঁ আমাদের উৎসবের প্রধান অতিথি হতে উনি রাজি হয়েছেন।

চমৎকার! অতলান্তের গলা খাদে নেমে এল। সত্যিই এ এক আনন্দের কথা...

ওকে গিয়ে আমরা চিঠি আর বই দিয়ে আসব। তুই কি যেতে পারবি?

নাকের ড্রপটা দ্রুত পাঞ্জাবির পকেটে ঢুকিয়ে বলল, আমি তো এখন সুস্থ।   

সুস্থ! বিশ্রুত একটা খোঁচা দিয়ে বলল, তুই তো এখনও নাকে ড্রপ দিচ্ছিস...

সে তো আমাকে দিতেই হয়। কিন্তু কী সৌভাগ্য আমার! কতদিন ওকে কাছ থেকে দেখার কথা ভেবেছি। ওর মতো মানুষ...

আর কিছু বলতে পারল না সে, আবেগে তার গলা বুজে এল। হৃদয় বলল, ঠিক আছে। অবশ্যই যাবি।

সেদিন নিজের একটা ডায়েরি ফেলে গেছিল অতলান্ত। প্রায় ফাঁকা একটা ডায়েরি। প্রথমদিকে কয়েকটা পৃষ্ঠায় কিছু জোকস লেখা। সবগুলিই প্রকাশিত।

পরদিন অতলান্ত আসার সঙ্গে সঙ্গে হৃদয় বলে উঠেছিল, তোর ডায়েরিটা আমি নিয়ে নিয়েছি অতলান্ত...

মানে?

কাল গভীর রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেছে। মাথার মধ্যে কয়েকটা স্কেচ ঘুরছে। হাতের কাছে দেখি তোর ডায়েরিটা। ওতেই আঁকতে শুরু করেছি। সারারাত এঁকে গেছি বুঝলি? একটুও ঘুম আসেনি। একটার পর একটা, একদম ঘোরের মধ্যে। ডাআআআআয়েরি প্রায় শেষ। কিছু মনে করিস না তুই...

হৃদয় ভেবেছিল অতলান্ত খুব খুশী হবে। হৃদয় যা করেছে, বন্ধুত্বের অধিকারেই করেছে। অতলান্তের ডায়েরি ব্যবহার করবে, তার জন্য আবার অনুমতি নিতে হবে নাকি? এ তো তার নিজেরই! তাছাড়া ওর স্কেচের সবচেয়ে বড়ো সমঝদার অতলান্ত। ঘোরের মধ্যে এইভাবে সারা রাত ধরে একটার পর একটা ওর স্কেচ আঁকার কথা শুনলে অতলান্ত যা খুশী হবে, তার তুলনায় তুচ্ছ হয়ে যাবে না সামান্য একটা ডায়েরি না পাওয়ার ঘটনা?

অতলান্তর মুখ খুশীতে উজ্জ্বল হয়ে উঠবে নিশ্চয়ই। হৃদয় এরকমই ভেবেছিল। কিন্তু অতলান্তের মুখ দেখে ও চমকে উঠল। ওর সারা মুখ থমথম করছে, চোখদুটো যেন জ্বলছে, ভীষণ হিংস্র হয়ে উঠেছে সেই মুখ। পরে হৃদয় বিশ্রুতকে বলেছিল, ও যে ভেতরে ভেতরে আসলে কতটা নিষ্ঠুর আর হিংস্র, সেদিনই আমি প্রথম টের পেয়েছিলাম। কিন্তু বিশ্বাস করতে পারিনি। চোখের ভুল বলেই নিজেকে বুঝিয়েছিলাম।

হৃদয়ের স্কেচ নিয়ে সেদিন আর কিছুই বলল না অতলান্ত। কেমন গম্ভীর হয়ে গেল। হৃদয়ের সামান্য খটকা লেগেছিল ঠিকই। কিন্তু তলিয়ে ভাবার সময় ছিল না। সেদিন ওর ঘরে এ-সি বসছে। বন্ধুরা সবাই জড়ো হয়েছে সেই ঠাণ্ডার আমেজ নিতে। সবাই মিলে হৈহুল্লোড় করছিল, আর তাতেই চাপা পড়ে গেছিল অতলান্তের গাম্ভীর্য। হৃদয় কিন্তু কিছুতেই ভুলতে পারছিল না সেই মুখ। সে কী সত্যিই দেখেছে? মাঝে মাঝে সে অতলান্তকে দেখছিল। স্বাভাবিকভাবেই হাসিঠাট্টা করছে। কোথায় হারিয়ে গেছে মুহূর্তের ঝলকে দেখা সেই হিংস্র মুখটি! তার আর কোনও চিহ্নই নেই! অতলান্ত মুছে দিয়েছে তাকে।

সবাই চলে যাওয়ার সময় হঠাৎ অতলান্ত দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর হৃদয়ের দিক তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলল, খাসা একটা জীবন পেয়েছিস তুই।

হৃদয় যতই অন্যমনস্ক থাক, খুশিতে ডুবে থাক, খোঁচাটা সে ঠিকই টের পেয়েছিল।

সাঁঝ পরে শ্রমণকে বলেছিল, জীবন যত হৃদয়কে সুবিধে করে দিচ্ছিল, বন্ধুদের ঈর্ষা তত বেড়ে যাচ্ছিল। হৃদয়ের কথাগুলো ওদের আর প্রেরণা যোগাতে পারছিল না। ওরা শুধু ভাবছিল, হৃদয় কত সুখে আছে। তাই ওর পক্ষে ওসব কথা বলা সহজ। হৃদয়ের তুলনায় কত নিকৃষ্ট জীবন ওদের। সেখানে কত অভাব আর লড়াই। হৃদয়ের জীবনের তুলনায় ওদের জীবন কত আলাদা ওরা সেটা টের পেতে শুরু করেছিল। সেখান থেকেই মনের দিক দিয়ে ওরা হৃদয়ের দিকে দূরে সরে যেতে থাকে। ওখানে আমিও উপস্থিত ছিলাম সেদিন। অতলান্ত আর আগ্নেয় নানা কথায় আগাগোড়া হৃদয়কে খোঁচা দিয়ে যাচ্ছিল। হৃদয় বুঝতে পারছিল না। ও কখনওই বাস্তবের দুনিয়ায় থাকে না। নিজের খুশীতে মশগুল হয়ে ভাবছিল, ওর সুখে বন্ধুরা সবাই খুব সুখী হয়েছে। এ-সিটা ওর ঘরে বসছিল। আর ও ভাবছিল বন্ধুদের সুখের কথা। যেন ওর ঘরে এ-সিটা বসলে সেটা ওর বন্ধুদের পক্ষেও কত সৌভাগ্যের। কারণ ওর সৌভাগ্যের অংশীদার ওর বন্ধুরাও। আর ওর বন্ধুরা তখন ভাবছিল নিজেদের দুর্ভাগ্যের কথা যার বিন্দুমাত্র আঁচ হৃদয় পাচ্ছিল না। হৃদয় সত্যিই চাইছিল অতলান্ত সঙ্গে যাক। এ এক বিরল সুযোগ। সেই সুযোগ থেকে অতলান্তকে বঞ্চিত করতে চাইছিল না সে। এই সৌভাগ্যের জন্য বারবার কৃতজনগতা জানাতে চাইছিল হৃদয়ের কাছে। আর প্রাইভেট সেক্রেটারির মতো একজন মানুষ যে দেশের জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সেকথাও বারবার সে কথারও বারবার উল্লেখ করছিল।     

(ক্রমশঃ)


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন