সোমবার, ১৯ জুন, ২০২৩

শ্রাবণী দাশগুপ্ত

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

 

 লাল-নীল-পেন্সিল

 


(৩৮)    

গত রাতে শোভনকে বাড়ির কাছে নার্সিংহোমে ভর্তি করে এসেছে লিপিকা। বিকেল থেকে বারদুই বমি ইত্যাদি করে অদ্ভুত নিস্তেজ হয়ে পড়ছিল। চোখ খুলতে পারছিল না। নিজের বিবেচনামতো ও-আর-এস খাইয়ে সে চেষ্টা করছিল, কিন্তু ভরসা হল না। যতীন বলে ছেলেটি রাত ন-টা অবধি নিজের ছোট্ট গুমটিতে থাকে, ডেকে নিয়েছিল তাকে। নিজেই ড্রাইভ করে পৌঁছেছে নার্সিংহোমে। অ্যাডমিট করার পর জেনারেল চেক-আপ হয়েছে। প্রেশার লো এবং ওঠাপড়া বেশী, পালস-রেট আর অক্সিজেন স্যাচুরেশনও কম। রাতটা অবজার্ভেশনে রাখলেন সিনিয়র ডাক্তার। পরিচয় ছিল না, আলাপ হল। লিপিকাদের ফ্ল্যাটের পাশের রাস্তাতে ওঁর ফ্ল্যাট, এক কিলোমিটার মতো দূরত্ব। লিপিকা স্নায়ু শক্ত রেখে, মাথা ঠাণ্ডা করে চলছিল। ডাক্তারের সহৃদয় আশ্বাসে গলায় সান্দ্র আবেগ উঠে এল। কিছুই প্রায় না বলে কোনওরকমে ‘গুড নাইট ডক্টর’ বলে বাড়ি ফিরেছিল।

সমস্ত বন্দোবস্ত সেরে ফিরতে ফিরতে প্রায় এগারোটা। গাড়ি গ্যারাজ করে ওপরে উঠে এসে দরজার লক্‌ খুলে ঢুকে আবার লক্‌ করল নিজেকে। সোফার ওপরে ব্যাগ আর গাড়ির চাবি নামিয়ে রেখে অনুভব করল রাতটা সে সম্পূর্ণ একা। অস্বস্তিটা ঝেড়ে ফেলতে চাইল মাথা থেকে। বাথরুমে ঢুকে ধুয়ে ফেলল হাত-পা-শরীর, জামাকাপড় বালতির জলে ডুবিয়ে রাখল। একা থাকা নতুন নয়, তবে অভ্যেসও নেই। চাকরিতে থাকাকালীন শোভনকে স্বল্পমেয়াদী ট্যুরে যেতে হয়েছে, যদিও বছরে হয়ত দু-তিনবার। তাছাড়া কাছে বাবুল ছিল, নিজের চাকরির ব্যস্ততাও থাকত।

চিন্তা করতে চাইছিল না বলে হালকা ঘুমের ওষুধ খেল। ঘুম গাঢ় হয়নি, তন্দ্রাচ্ছন্ন কেটেছে। সারারাত কিলিবিলি অ্যাবস্ট্রাক্ট স্বপ্ন, মাথার মধ্যে ঝিঁঝিঁপোকার ডাক। ভোর চারটে না বাজতে বিছানা ছেড়েছে। প্রতিদিন দিনের প্রথম চা খায় ছ-টা নাগাদ, পরে শোভন উঠলে দ্বিতীয়বার। আলো জ্বেলে কিচেনে নিজের বড়কাপটা নামিয়ে চা করে শোওয়ার ঘরে বিছানায় মশারি গুটিয়ে বসল। ঘর অন্ধকার, বাইরেও অন্ধকার। আলো ফুটতে দেরি আছে। রাস্তার আলো জ্বলছে। বেডসাইড টেবিলের ওপরে ছোট্ট রাতবাতি, পাশে শোভনের ড্রইংখাতা ও পেন্সিল ইত্যাদি। খাতা খুলে ওলটাতে শুরু করল, বুকের ভেতর কাঁপতে লাগল। শোভন আগ্রহ নিয়ে দেখাতে চাইলেও সে মন দিয়ে দেখে না, ব্যস্ততার চাকায় বাঁধা তার সারাদিন। খাতাটা আড়েপ্রকারে বড়, ছবির সংখ্যা কম। পৃষ্ঠা উলটে শোভনের আঁকা দেখতে থাকে। মনে হয় বেশ তো এঁকেছেসুন্দর রঙের বিন্যাস, গাঢ় রঙ বেশী। লিপিকা ছবি-টবি বোঝে না, শোভনকে আগে কোনওদিন আঁকতে দেখেনি। বাবুলকে আঁকার ক্লাসে ভর্তি করেছিল ছোটোবেলাতে, সে নিজেই ছেড়ে দেয়।

ছবিগুলোতে নাম ও ক্যাপশন দেওয়া নেই। সহজ ছবি হলেও ক্যাপশন থাকলে দেখতে আরাম লাগে। শেষেরটা মেলার, ছবিটার অসমাপ্ত স্কেচ এখন রেখায় রঙে স্পষ্ট। খুঁটিয়ে দেখে লিপিকা, কত কী ছবিতে আঁটিয়েছে! ঠিক মধ্যেটায় কাঠের নাগরদোলা, তাকে ঘিরে অন্য দোকানপাট। ছোটো-ছোটো করে আঁকা দোকানগুলোতে জিলিপি, মাটির পুতুল, বাসনকোশন। অস্পষ্ট একটা তাঁবুর মাথায় হোর্ডিং ‘ম্যাজিক শো’। কোণার দিকে চূড়ামন্দির, উঁচু  রথ বা সার্কাসের তাঁবু, যা খুশী ভেবে নেওয়া যায়। একটা স্টলের সামনে মাটিতে উবু হয়ে সবুজ শাড়ির মহিলা কী কিনছে। নাগরদোলার সামনে উলটোমুখে দাঁড়ানো চারজন, চার উচ্চতায়। শাশুড়ির সবুজ রঙপ্রীতি ছিল সে জানে, শোভন তার মাকে সবুজ শাড়িতে এঁকেছে। চারজন যে শোভনেরা তিনভাই আর বাবা অনুমান করতে অসুবিধা হয়না। ছবিটার মধ্যে কখন ঢুকে পড়ে লিপিকা। পাঁচজন মানুষের নড়াচড়া দেখে, খুবই দ্রুত যেমন ফাস্ট ফরোয়ার্ডে হয়! কথাবার্তা বোধ্য নয়, শুধু শব্দটুকু ওড়ে। কী কিনছেন শোভনের মা? হয়ত অভ্যেসবশতঃ দরদাম করছেন। মাথা থেকে আলগা ঘোমটা নেমে এসেছে পিঠে। নাগরদোলার সামনে শোভনের হাত ধরে টানাটানি করছে দাদা ও ভাই, শোভন মাথা নাড়ছে। বাবার পিঠের কাছে গিয়ে আশ্রয় খুঁজছেউঠবে না সে, ভয় করে। প্রত্যেককে একেবারে চোখের সামনে দেখতে পায় লিপিকা, ছোট্ট আয়তনের পুতুলের মতো! এবারে চটকা ভেঙে গা-ছমছমে ভয়ের অনুভূতিতে কেঁপে ওঠে। কী যে সব ঘটছে! 

খাতাটা বন্ধ করে ফেলতে যায় তাড়াতাড়ি, নজরে আসে পৃষ্ঠার একেবারে নীচের দিকের কোণে নাম, ‘শোভন বসু’ নয়, ‘শোভু’ ডাকনাম। শব্দটা আঙুল দিয়ে স্পর্শ করে লিপিকা। ওই নামে শোভনকে ডাকার মতো এখন কে আছে? তাই কি গলিপথে ঘুরে বেড়ায়? চাপা ক্ষোভ ও বিরক্তি আন্দোলিত হয় মনের মধ্যে। ভালো! ভালোই আছে মানুষটা। এতবছর ঘনিষ্ঠভাবে একসঙ্গে থাকার পরেও বউ-ছেলের অস্তিত্ব নেই তার ভাবজগতে। শুধু অতীতের রাস্তা খুঁড়ে যাওয়া! একটু আগে নিজের কয়েক সেকেণ্ড দর্শনের ব্যাখ্যা খোঁজে মনের মধ্যে। শোভন চিরকালের নিরীহ দলছুট ধরণের, তার দাদা-ভাইয়ের চেয়ে আলাদা। তাকে উঁচু জায়গায় উঠতে দেখেনি লিপিকা, ভার্টিগো আছে। বাবুলকে নিয়ে বেড়াতে বেরিয়ে নাগরদোলা, রোপ-ওয়েতে উঠত না শোভন। লিপিকা উঠত বাবুলের সঙ্গে। কল্পনায় কত কী ঘোরে লিপিকার মাথায়বড়ো বিজন ছিল বাবার প্রিয়, ছোটো রঞ্জন মা-র। তাহলে শোভন? শোভনের পরে একটি মেয়ের বাসনা ছিল শ্বশুরমশায়ের, হয়নি। সে জায়গায় এল রঞ্জন। শোভনেরও ছিল ইচ্ছে, লিপিকা আর চায়নি বলে মেনে নিয়েছে।  

জানালা দিয়ে হালকা ঠাণ্ডা বাতাস আসছে, হয়ত অদূরে কোথাও বৃষ্টি হয়েছে। আকাশের রঙ ফরসা হয়নি, মেঘ করে আছে। ছোট্ট টেবিলক্লক টিকটিক করে চলেছে। সময় দেখে না লিপিকা, শরীর আলগা করে নেশাড়ুর মতো পড়ে থাকে। নার্সিংহোমে সেভাবে ভিজিটিং আওয়ার নেই, তবু সাতটার আগে গিয়ে কী হবে? সাড়ে-সাতটা নাগাদ কাজের মহিলা মালতী আসবে। মহিলা শান্ত, ভালো। ধীরেসুস্থে কাজ করে, কাজও পরিষ্কার। কানে কম শোনে, বাঁহাত সামান্য কমজোরী। শিউলি কাজ ছেড়ে দিয়েছে অনেক দিন।

চা শেষ করে চোখ বুজে পড়ে থাকে লিপিকা। এতক্ষণে ঘুম আসছে। 

ক-দিন আগে নার্সিংহোম থেকে ফিরে মোটামুটি ঠিক আছে শোভন। বরং লিপিকার ভেতরটা নাড়া খেয়েছে। চিন্তাগুলো জমা ছিলই, সচেতনে তেমন করে নাড়ে-চাড়ে নি। শোভনের দু-দিনের সাময়িক অনুপস্থিতিতে একটা ভাবনা গ্রস্ত করে রেখেছিল। দু-জনের কেউ একলা হবে একদিন। তার দিনরাত ওঠা-বসা জমা থাকবে এই ছোটো ফ্ল্যাটের চার দেওয়ালের ভেতরে। তারপর সে-ও নেই হয়ে যাবে। আস্তে আস্তে একথাটা, বাস্তবটা ভেতরে চারিয়ে নিতে চাইছিল সে। শোভনের নার্সিংহোমে থাকার সুবাদে ডাক্তারের সঙ্গে বিভিন্ন কথাবার্তা হয়েছে, ফোননম্বর নিয়েছে। হঠাৎ দরকার হলে যোগাযোগ করার অনুমতি চেয়ে রেখেছে। ডাক্তারের বয়স লিপিকার কাছাকাছি, দু-এক বছর বেশী হতে পারে। লিপিকা জিজ্ঞেস করেছিল শোভনের সায়কায়্যাট্রিক চিকিৎসার প্রয়োজন আছে কিনা। ডাক্তার বলেছিলেন, “আমার মনে হয় না। উনি ওঁর নিজস্ব জগৎ বানিয়েছেন, সেখানে ঢুকে পড়তে ভালোবাসেন। ছবির মধ্যে ধরে রাখতে চান চাইল্ডহুড ঘটনা। তা করুন না! আর খানিকটা ভুলোমন, এই তো? আর তো কোনও সমস্যা দেখছি না। রেস্ট অল কোয়াইট নর্ম্যাল। আপনি অকারণ টেনশন করছেন। বরং যত পারেন ওঁকে সঙ্গে করে বেরিয়ে পড়ুন, আত্মীয়-বন্ধুদের বাড়ি যান। ওঁর ভালো লাগবে। আর ফিজিক্যালি যাতে ফিট থাকেন সেটা তো দেখছেনই...”

নীরবে ডাক্তারের কথায় সায় দিচ্ছিল লিপিকা। আসলে কাঁটার মতো একরাশ বিরক্তি ভীড় করেছিল। ডাক্তার স্পষ্টই বোঝাল যেন শোভনকে সে বেশী করে সময় দেয়! বিরক্তি চাপতে গিয়ে আরও বিরক্ত লাগে, নিজেকে ব্যস্ত করে ফেলে আরও বেশী। ঘরের খুঁটিনাটি কাজগুলো আরও মন দিয়ে করতে থাকে। খাওয়ার পরে সারাদুপুর বিশ্রাম না করে অ্যাকোয়ারিয়াম নিয়ে পড়ে। শোভন তখন অঘোরে ঘুমোয়। কাজ শেষ করে বেদম ক্লান্ত শরীরে দেখে টলটল করছে স্বপ্নের মতো নীলরঙা জল। সলমন খুশীতে ভাসছে, লেজের আঘাতে ঢেউ তুলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাছের সংখ্যা বেশ কম এখন। ছোটো কয়েকটা মাছ মরে যাওয়ার পর সে নতুন মাছ আর আনেনি। কাজ ফুরোলে ঘড়ি দেখে, কখন যেন বিকেল ঢলে গেছে। তারপর বুঝি চোখ লেগে এসেছিল, ফোনের শব্দে ঘুম ভাঙে।

“কেমন আছস রে মেজদি? যোগাযোগ রাখবি না ঠিক করছস?”

কয়েক সেকেণ্ড সময় লাগে ধাতস্থ হতে, দেবীর ফোন কতদিন পর! গলায় ঝাঁঝ নেই, ব্যঙ্গ নেই, খুশীর সুর। লিপিকা গলা ঝেড়ে বলে,

“ফোন করতে পারিনি অনেকদিন। আসলে তোর শোভনদাকে নিয়েসে হাসপাতালে থেকে এল ক-দিন।

“হাসপাতালে? কেন? আমাদের জানাস নাই। চিরকাল দূরে রাইখা দিছস! দাদাও বলছিল, লিপিটা কেমন জানি  হয়ে গেছে।

লিপিকা কয়েক মুহূর্ত নীরব থাকে, কোনও অভিযোগের জবাব দেয় না। দেবীর মুখে দাদার নাম শুনে অবাক হয়! প্যাচ-আপ করেছে? স্বার্থ ছাড়া দেবিকা এক পা এগোয় না, কে জানে কী ব্যাপার। দেবিকা বলে,

“কি-রে মেজদি, ভুইল্যাই গেছিস মনে হচ্ছে?”

লিপিকা লজ্জা পায় খুব, তার আপন ভাই-বোন! সামলে নিয়ে বলে,

“কী যে বলিস! এত চাপে আছি ক-দিন, বোঝাতে পারব না।

“বুঝছি। তুই তো আবার কাউরে ডাকবি না, তালে উপায় কী!”

“তোরা ভালো আছিস? কৌশিক? দাদার কী খবর রে?”

দেবিকা ফোনের ওদিক থেকে খুক-খুক করে হাসে, হেঁয়ালি করে,

“খবর আছে, অনেক বড় খবর। তর কথাই মিলল! কইছিলি না তারা দুইজনে মিলে যা ঠিক করবে তাই?”

লিপিকা অন্যমনস্কতার জন্য চটপট ধরতে পারেনা, তবু অনুমান করে জিজ্ঞেস করে,

“আমি বলেছিলাম? মামপির ব্যাপারে?”

“হ্যাঁ রে। মেয়ে রাজী হয়েছে, কলকাতা আসছে পরের হপ্তায়!”

দেবিকা গড়গড় করে দেবার্ঘ্যর কাছে শোনা সংবাদটি রঙ চড়িয়ে পরিবেশন করতে থাকে। লিপিকা প্রথমে বেশ খুশী হয়, হঠাৎ প্রশ্নটা মাথায় চড়ে বসে, মামপি কি শেষ পর্যন্ত কষ্টে পাওয়া চাকরিটা ছেড়ে দিচ্ছে?  

 

(ক্রমশঃ)

 

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন