কালিমাটির ঝুরোগল্প ১১৯ |
ভার্যা
শক্ত
কাঠের মতো গড়ন ছিল আগাগোড়া। চওড়া কাঁধ, চৌকো মুখ। শান্ত শ্যামলা গায়ের রঙ।
মধ্যগগন
পার করেও একদা কত্থক নৃত্যশিল্পী লতার দেহ এখনও টানটান।
'ভদ্রলোকের মতো পায়জামাটা পরে বাইরের বারান্দায় বের হতে পারো না?' লতা খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা সুনন্দকে বলে। সুনন্দ তার চল্লিশ বছরের বিবাহিত স্বামী। টকটকে গৌরবর্ণ, এখন তামাটে। সুনন্দর ক্রণিক কোনও অসুখ নেই, তাই দিব্য হেঁটে চলে বেড়ায় এই আটাত্তরেও।
'না, পারি না?'
'অনেকেই
দেখছে, আশেপাশের বাড়ি থেকে।'
'দেখুক,
আমার বাড়িতে যা খুশি যেমন ভাবে খুশি পরে থাকব। আমার ইচ্ছে'।
লতা নীরবে নাভির নীচে অন্তর্বাস পরা সুনন্দকে দ্যাখে, আর নিজের বাবার কথা মনে পড়ে। কী সৌম্য, রুচিশীল, ঋদ্ধ মানুষ ছিলেন তিনি। সুনন্দ এমন বিকৃত রুচির মানুষ হয়ে যাবে ধীরে ধীরে, কখনও যে স্বপ্নেও ভাবেনি লতা!
লুকিয়ে পর্ণোগ্রাফি দেখতে দেখেছে সুনন্দকে। মন বিবমিষায় ভরে উঠেছে। একা ছাদের কার্নিশ ধরে দাঁড়িয়ে তারায় ভরা আকাশ দেখতে দেখতে ভেবেছে কতদিন, হয়ত তারই ত্রুটি। কোথাও সুনন্দর অতৃপ্তি রয়ে গেছে তাদের যৌথ যাপনে। অজান্তেই চোখ ভিজেছে। আবার নিজেই সুনন্দকে নিয়ে থিয়েটার দেখতে গেছে। থিয়েটার দেখতে কী অসম্ভব ভালোবাসে সুনন্দ! একজন মানুষের মধ্যে এমন দ্বৈত সত্তা থাকে কী করে, তাও ভেবে ভেবে কুল কিনারা পায় না লতা।
কলিং বেল বেজে ওঠে। দরজায় বর্ণালী। পাশের লাগোয়া বাড়ির। খুব ভালো সম্পর্ক লতার সঙ্গে।
'কাকীমা, একটা কথা জানাতে এলাম।'
'ভিতরে
এসো'।
'না,
না ঠিক আছে। কাকীমা, রিনি গতকাল সন্ধ্যায় এসেছিল আপনার কাছে। ওর স্কুলের রবীন্দ্রজয়ন্তীর
অনুষ্ঠানে একটা নাচ করবে, সে ব্যাপারে কথা বলতে'।
'ওহো, আমি তো কাল ছিলাম না গো, একটু বেরিয়ে ছিলাম'।
'কাকু সেটা না জানিয়ে রিনিকে ভিতরে ডেকে খাটে বসিয়ে… কী করে যে সে কথা মুখে বলি কাকীমা! দশ বছরের মেয়ে আমার। ভাগ্যিস, চীৎকার করে উঠেছিল। কাকু তাতেই ভয় পেয়ে গিয়ে রিনিকে ছেড়ে দেন। দরজা কিন্তু খোলাই ছিল। রিনি পড়িমড়ি করে বাড়ি ফিরে আমাকে বলে। আমরা হতভম্ব। এতো বছর পাশাপাশি আছি আমরা! বিশ্বাস করতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে মেয়ে। আজ একটু আগে জ্বর এসেছে'।
পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে লতার। চোখের সামনে অন্ধকার। সামলে নিয়ে বলে, 'বর্ণালী, রিনি যা বলছে, সত্যি বলছে'।
'আপনি
কাকুর এমন স্বভাবের কথা জানেন কাকীমা!'
'কিছুটা
তো জানি'।
'কিছু
বলেন না! কেন?'
'জানি
না ঠিক। রিনিকে আর কখনও পাঠিও না আমাদের বাড়ি। তোমরা সুনন্দকে শাস্তি দিতে চাইলে দিতে
পারো'।
মধ্যরাতে বন্ধ ঘরে প্রৌঢ়া লতা দুপায়ে ঘুঙুর পরে মুখে বোল তুলে নাচতে থাকে, নাচতেই থাকে, নাচতেই থাকে।
পায়ের
পাতা একসময় ফেটে রক্তধারা বয়ে যায় ধবধবে সাদা মার্বেলের মেঝেতে। সাদা রঙে আল্পনা
আঁকতে থাকে লতার রক্ত রাঙা দুটি পা।
বাবা
বলতেন, 'বিপ্লবের রঙ লাল'!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন