সমকালীন ছোটগল্প |
ক্রিসালিস
(১)
--জনক আর শুকদেবের গল্পটা জানিস?
--জনক মানে ওই জনক চাচার কথা বলছিস কি? জনক চৌবে? ওই যে ভুজিয়ার দোকান?
--ধুস শালা গান্ডু! আমি পুরাণের জনক আর শুকদেবের কথা বলছি।
--পুরাণ? হুঁ: পুরাণ এখন পোঁদ দিয়ে বেরোচ্ছে! ছেলের ভবিষ্যতের চিন্তায় আমরা হাজব্যান্ড ওয়াইফ টিভি অব্দি দেখছি না! তো পুরাণ! মাইরি! তুই না! দিনদার টিউটোরিয়ালে তোর ছেলেও পড়ছে আগে থেকে। সেইজন্যেই পরামর্শ চাইলাম, এখন পুরাণ মারাচ্ছিস?
--শোন! খিস্তি করিস না।সে কথাই তো বলছি, একটু রসিয়ে বলছি।
--বিনি খরচে এডভাইস?", চোখ সরু করে অচিন বলে।
--মানে?
--সিগারেট ফিগারেট অন্তত ছাড়!
–-ওঃ! শালা তুই না! নে - বল!
ধোঁয়া ছেড়ে অচিন বলে, "তো, শুকদেব জনকের হস্টেলে ভর্তি হতে গেছে। তখন তো ছাত্রদের ডে স্কুল ছিল না, শিক্ষাগুরুদের হস্টেলেই থাকতো হতো। তবে বয়েজ ওনলি! গার্লস হোস্টেলের কনসেপ্টটা তখনো চালু হয়নি-
--ওঃ শালা তুই না! কি বলতে চাস খোলাখুলি বলতো! ধান ভানতে শিবের গীত গাইছিস কেন? দিনদা কেমিস্ট্রি পড়ায়, নাম করা প্রাইভেট টিউটর, তোর কাছেই তো ঠিকানা, ফোন নম্বর নিলাম! একমাসের টিউশন ফি বাবদ দু হাজার টাকা এডভান্স জমা করতে হোল। ওটা জমাই থাকবে, সিকিউরিটি ডিপোজিট হিসাবে। মাস পয়লা আবার দুহাজার করে জমা করতে হবে। এ কি! তোর ছেলেকে ওখানে পাঠাচ্চিস আমার দুমাস আগের থেকে, তোকেও কি ওই সিকিউরিটি ডিপোজিট রাখতে হয়েছে? এই সিম্পল কোশ্চেনটির উত্তরে বোকাচোদা পুরাণ মারাতে বসলি!
--ব্যাটা শোন না! গল্পটা শোন! আমি পুরানের আলোকে বর্তমান শিক্ষণ পদ্ধতির একটা ছবি আঁকতে চাইছি!
দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনিল মনে মনে বলে,'জ্ঞান দেবার সুযোগ পেলেই কোনো শালা ছাড়ে না! বলে যা আজকে! 'বায়োলজির সেরা টিচার আমার শ্বশুরের বন্ধুর ছেলে। তখন এসো, আজকের শোধটা সেদিন তুলবো।' মুখে বলে,"বল কি বলছিলি তোর পুরাণ কথা!
--শুকদেব জনকের কাছে ব্রহ্মজ্ঞান লাভের জন্যে গেসল। জনক বলল, "বেশ! দেব। আগে গুরুদক্ষিণা দাও!"
শুকদেব বলল, "আগে ব্রহ্মজ্ঞানটি দিন! জ্ঞান না পেলে কেমন করে গুরুদক্ষিণা হয়!" জনক তখন হাসতে হাসতে বলেছিল, "ব্রহ্মজ্ঞান হয়ে যাবার পর কি আর কে গুরু কে শিষ্য সে বোধ থাকে!
তাই আগে গুরুদক্ষিণার কথা বললাম। "-এই হলো গল্প। জনকের রেফারেন্স তোর মতন মাথামোটাকে দিচ্ছি এটা বোঝানোর জন্যে যে দিনদা নতুন কিছু নিয়ম চালু করে নি। ওর বদনাম করতে চাইলে করতে পারিস। একমাস পরে দিনদার কোনো ছাত্র বা ছাত্রী যদি পড়তে না যায়, দিনদা কি টাকা আদায় করতে তার বাড়িতে ছুটবে
তোম্বা মুখে অনিল বলে, "আরে এটা না বোঝার কি আছে? তোর এই দিনদা জনক তো আর একমাসের মধ্যে রসায়ন জ্ঞানদান শেষ করতে পারবে না। এতে করে কি হচ্ছে যে শিক্ষাশুরুর আগেই গুরুর বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গিটি প্রকট হয়ে পড়ছে, এই আর কি!
-- শোন! তুই আমি খুঁত ধরলে কিস্যু যায় আসে কি! দিনদা তোর হাতের নাগালে তাই চেঁচাচ্ছিস তো! তিনমাস আগে কি হল! তিন মাসের টিউশন ফি আর আরো কি সব হাবিজাবি ফিজ বাবদ একুশ হাজার টাকা জমা দিয়ে তোর ছেলেকে এগারো ক্লাসে ভর্তি করিসনি কি? তখন কি এ কথাগুলি বলেছিলি?
--এটা তো স্কুল! সব স্কুলেই এ নিয়ম চালু আছে। সবাই মানে, মানতে বাধ্য বলে। চ! সামনের চা দোকানটার একটা বেঞ্চ খালি হল। একটু গলা ভেজাই।
রাস্তার ওপর গাছের তলায় কাচের বড় শোকেসের সামনে পেতে রাখা দু তিনটি বেঞ্চ। বেঞ্চ খালি পাওয়াই মুশকিল! বসে পড়ে দুজনে। দুজনের একই অফিস, একসঙ্গে তৈরি করা পাশাপাশি বাড়ি।দুজনেরই একটি মাত্র সন্তান, একই স্কুলের এগারো ক্লাসে ভর্তি হয়েছে। দুজনের ঘরণীই পরস্পরের প্রিয় সখী। আত্মীয়তা না থাকলে কি হবে দুটি পরিবার পরস্পরকে ছাড়া ভাবতেই পারে না! অচিন বয়সে বছর দুয়েকের বড়ই হবে, তাই হয়তো কর্তৃত্ব করে খানিকটা। বিশেষ করে পড়াশোনার ব্যাপারে। অচিনের পরামর্শ অনুসারে পুত্রের কোচিংয়ের প্রথম কিস্তি জমা করার সময়েই অনিল জেনে নিয়েছিল ছেলের রোল নম্বর কত হল। এটা জানা দরকার, দিনদার রোল কলের সময় সাড়া দিতে হবে তো! ছাত্র ছাত্রীদের নাম ধরে ডাকার সময় পান না দিনদা। এক একটা ব্যাচে উনি মাত্র আশিজনকে পড়ান! শহরের চারটে কোণায় উনি চারখানা রুম ভাড়া নিয়েছেন, সপ্তাহে একদিন করে সে রুমগুলিতে পড়ানো হয়। সুতরাং তুমি যদি যথাসময়ে টাকা জমা দিয়ে সিট বুক না করে রেখেছো তাহলে ছুটতে হবে দশ পনেরো কিমি দূরের অন্য পাঠকক্ষে! এক একটি রুমে তো মাত্র আশিজনই সুযোগ পাবে! বেশ! এবার যেখানেই হোক, তুমি সুযোগ পেলে। এবার তোমার যদি আগ্রহ জাগে পাঠকক্ষটি দেখার, উঁকি মেরে দেখে নাও! ষোল বাই বারো বা আঠারো আয়তনের একটি ঘর। পুরো ঘরটি জুড়ে শতরঞ্চি পাতা। বসার পরে সামনে বইখাতা রেখে লিখতে হয়। ফলে ছাত্র ছাত্রীদের গা ঘেঁষাঘেঁষি করেই বসতে হয়! একদিকের দেওয়ালে একটি সাদা ব্ল্যাকবোর্ড। প্রায় সকলেই তাদের ছেলে মেয়েকে পৌঁছতে, নিতে আসেন। গোটা চল্লিশেক চার চাকা, দু চাকাতে গোটা পাড়াটা ভর্তি! একদিন কৌতূহলী হয়ে ক্লাসের ভেতরটা
--হ্যাঁ!
--তা ওরা বাইরে কেন?
--ভেতরে কষ্টে সৃষ্টে বাহাত্তরজন বসতে পারে, এরা ক্লাস শুরুর আধ ঘন্টা আগে আসতে পারেনি, তাই ভেতরে ঢোকার চান্স পায়নি।
-- ওঃ! দিনদার হিসাব থেকে জানালার পাশের জায়গাটাও ছাড় পায়নি, ধন্য ব্যবসাবুদ্ধি! আচ্ছা, ভেতরে দিনদা চেঁচাচ্ছে, ব্ল্যাকবোর্ড এ লিখছে, সেসব এরা দেখতে শুনতে পাচ্ছে? মাইরি! এরা আর ভেতরে মেয়েদের গা ঘেঁষে বসা ছেলেগুলো কিচ্ছু শিখছে না এটা জোর দিয়ে বলতে পারি! বেকার আসা এদের।
--শোন! বিদ্যাসাগর গ্যাসবাতির আলোয় পড়াশোনা করতেন!
--এখনকার ছেলেমেয়েরা বিদ্যাসাগরের চাইতে অনেক বেশি কষ্ট করে।
--কিরকম?
--রাত চারটে সাড়ে চারটায় ঘুম থেকে উঠে সকাল সাড়ে ছটার মধ্যে হাগাহাগি, চান, টিফিন করে স্কুলে দৌড়োনো, আড়াইটায় বাড়ি ফিরে নাকে মুখে দুটি গুঁজে তিনটের বাস ধরে চারটেয় টিউশন, সেটা শেষ করে রাত আটটার টিউশন, রাত এগারোটায় বাড়ি ফিরে নাকে মুখে দুটি গুঁজে ঘুম, কিংবা খেতে খেতেই ঘুমে ঢুলে পড়া- এতক্ষণ পাঠক্রিয়ার মধ্যে বিদ্যাসাগর থাকতেন? হুঁ! তাহলে আর বর্ণপরিচয় লিখতে হতো না! এরা অনেক বেশি কষ্ট করে।
--অভ্যেস করানো হচ্ছে। মিলিটারির ট্রেনিংয়ের মতন। পড়া শেষে তো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীর চাকরিতে ঢুকবে সব। বারো ঘন্টার ডিউটি!
-- হুঁ:! কি দিন এসে গেল মাইরি!
--হ্যাঁ! বাইক রেডি কর! ছুটি হচ্ছে। দিনদা রোল কল করছে! তাড়াতাড়ি বেরোতে না পারলে মেইন রাস্তায় ওঠার আগে জ্যামে পড়ে যাবি ।
বাড়ি পৌঁছে ছেলে প্রথমেই একগুচ্ছ জেরক্স করা কাগজ বের করল। গোছাটা অচিনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, "বাবা দেখ!" ইংরেজি প্রিন্ট আউট আর তার মাঝে ডায়াগ্রাম এক ঝলক দেখে নিয়ে অচিন বলল, "কি এগুলো? কেমিস্ট্রির কিছু সলভড প্রবলেম মনে হচ্ছে! কোনো রেফারেন্স বই থেকে জেরক্স করলি মনে হচ্ছে?"
জিত মুচকি হাসে, বলে, "নেট থেকে ডাউনলোড করা, করে সেট দিনদা স্যার আমাদের প্রত্যেককেই দিয়েছেন। এই সেটটা আই আই টি আর হুঁ! এই সেটটা জেইই'র প্রিপারেশনের জন্যে।" এই দুটি নাম শুনে অচিন এবার একটু উৎসুক হয়, বলে, "বুঝলাম না! নেট থেকে ডাউনলোড করতে হবে কেন? টেক্সট বইয়ে থাকবে না?"
-- ওঃ বাবা! তুমি না! ইটস নট সো সিম্পল! ধরো, কার্বন। হ্যাঁ? এই কার্বনের কতগুলো কম্পাউন্ড আছে জানো তো? আউট অব দোজ মিলিয়নস- আট দশটা কম্পাউন্ন্ডের স্ট্রাকচার নিয়ে ভেরিয়াস এঙ্গেল থেকে পিকিউলিয়ার প্রবলেম সলভ করতে দেয় এইসব এন্ট্রান্স এগজামগুলোয়। সব টেক্সট বইতে কি আর ইন ডিটেইলস থাকে! নেট এন্ড এইসব স্যারেরা ছাড়া এইসব এন্ট্রান্স এগজাম! উফ! হরিবল! ভাবাই যায় না!
সুচেতা এতক্ষন ছেলের কথা শুনছিল মুগ্ধ চোখে। গদগদ স্বরে তিরস্কারের ভঙ্গি করে বলল ,"নে, আর পাকামি করতে হবে না। জামাপ্যান্ট ছেড়ে বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে বোস!" তারপর অকারণে অচিনকে খোঁটা দিল, "তুমি কী বোঝ বল তো এখনকার পড়াশুনার?গাঁয়ের স্কুলের ফার্স্ট বয় ছিলে। তোমাদের সময়ে কম্পিটিশন কি জিনিস ছিল না, তাই চাকরিটা পেয়ে গেসলে।
অচিন হাসে। জিতের ওঠার লক্ষণ নেই দেখে সুচেতা তাগাদা দেয়, "কি রে! ওঠ এবার! হোমওয়ার্ক গুলো তো শেষ করতে হবে। রাত এগারোটার মধ্যে না শুলে ভোর চারটেয় উঠবি কি করে!" ছেলে বলে, "দাঁড়াও না। বাবার আই কিউটা একটু টেস্ট করি!বাবা! বলতো দেখি, 'ক্রিসালিস' কি?" অচিন ভিরমি খায়! বলে, "বাব্বা! প্রথম শুনলাম! কেমিস্ট্রির কিছু প্রবলেম নাকি?" ছেলে মিটিমিটি হাসে! বলে, "নাঃ! পিওরলি জেনারেল নলেজের কোশ্চেন। হ্যাঁ! জুলজিরও বলতে পারো। নাও বলো! যাকগে! মা! তুমি তো বায়ো সায়েন্স। উত্তরটা দিয়ে বাবাকে হারিয়ে দাও তো!" সুচেতা হাল ছেড়ে দেয়, বলে, "এইসব জটিল ব্যাপার নিয়ে সময় নষ্ট করার চাইতে তুইই তাড়াতাড়ি বলে দে!
খাবার গরম করতে হবে।" বাবা-মা দুজনকেই জব্দ করা গেছে দেখে ছেলে খুশি হয়। অচিনও। পত্নীর কাছে তর্কে হেরে যে স্বামী কাজে জিতে যান তিনি বুদ্ধিমান। সন্তানের কাছে জ্ঞানগম্মি তে পিছিয়ে থাকলে সব পিতা খুশিই হন। জিত বলে, "কিভাবে প্রজাপতি জন্ম নেয় জানো তো? "
--হ্যাঁ! শুয়োপোকা থেকে।
--প্রজাপতিতে কোনভার্টেড হবার আগে শুয়োপোকা যে গুটিটা তৈরি করে তাকে 'ক্রিসালিস' বলে। বুঝলে?
--ও! তাই নাকি! জানতাম না তো!
অচিন ভাবে সত্যিই সে ভাগ্যবান। কিই বা সিলেবাস ছিল তাদের! এখনকার ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোতে কি না শেখাচ্ছে! এইসব টিউটর বা স্কুলগুলো যেমন নেয় তেমনি উসুল ও দিয়ে দেয়।
তার ভাবনায় ছেদ পড়ে পাশের ঘরে ফোন বেজে ওঠায়। ফোন তুলে সুচেতা একটা দুটো কথা বলতে থাকে। অচিন বুঝে যায় ফোনটা তার নিকটাত্মীয়দের কারুর নয়, তাই টিভি চালু করে। লো ভলিউমে। সে শুনতে পায়, সুচেতা বলছে,"না। যে ব্যাপারে আমি কিছু জানি না মামা।ধরুন! ওকে
মানুষে মানুষে প্রতিটি সম্পর্কই অর্থনৈতিক। তাই খুব জ্বাল দিয়ে ঘন করে তৈরি করা সম্পর্কের মধ্যেও অর্থ বা স্বার্থর পাক কড়া হয়ে গেলেই সম্পর্কের লাড্ডু আর দানা বাঁধে না ঝুরো ঝুরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে!
মাতুলালয়ের সঙ্গে অচিনের সম্পর্কের নাড়ু কোনদিনই দানা বাঁধেনি। প্রতীক্ষারত রিসিভারটি কানে তুলে নেবার আগে এমনই ভাবছিল সে। সুচেতার সতর্কীকরণের প্রয়োজন ছিল না।
-- হ্যাঁ মামা বল! শুভ ফার্স্ট ডিভিশন পেল! বাঃ!
-- হ্যাঁরে! যাক বল তোরা কেমন আছিস?
--ভালো না গো! তোমাকে জানাইনি খামোখা চিন্তা করবে বলে। একটা মেয়েলি রোগে ভুগে ভুগে সুচেতার মেজাজ খিটখিটে। আমার আবার হার্টে গন্ডগোল ধরা পড়েছে। এসব কারণে দুজনেরই মন মেজাজ ঠিক থাকে না। প্রায়ই খিটিমিটি লেগে যাচ্ছে দুজনের। এতে করে জিতেরও পড়ার ক্ষতি হচ্ছে বেশ! যাকগে ছাড়ো, তোমাদের কথা বলো। শুভ, পিন্টু, বৌমা সব খুশি তো? কত পেয়েছে যেন?
– সাতশো চব্বিশ। ধর, গাঁয়ের ইস্কুল, কোচিং টোচিং বলে ত কিছু পায় নাই। সেই লেগেই ইখেনের হেডমাস্টার থেকে আরম্ভ করে সব্বাই বলচে কি, 'কোলকাতা বা দুগ্গাপুরে কুনু ভালো ইস্কুলে উয়াকে ভত্তি করে দাও!' তোদের উখেনে ত বাঘা বাঘা মাস্টার রইছে! লয়? উয়াদের কাছে টিউশুনি পড়লে জয়েন্ট কি আই আই টি কি আরো কি কি সব বড় বড় পরীক্ষা আছে তাথে পাশ করার ভালো টেনিং পাওয়া যায়।" সতর্ক শজারুর মতন অচিনের কান আর গায়ের লোমগুলো খাড়া হয়ে ওঠে! সে বলে, "তাই যদি হতো মামা তাহলে তো দুর্গাপুরের হাজার হাজার ছেলেমেয়ে এইসব পরীক্ষাগুলোয় চান্স পেতো। তা নয়! কলকাতা বাদ দিলে অন্য কোনো শহর থেকে এতো ছেলেমেয়ে
মামা দমবার পাত্র নয়, বলে ওঠে, "তবু ধর, ফেমিলির হেড বলেই ইয়ারা এখনো মানে আমাকে, তাই ঠাকুদদা হিসাবে আমারও দায় আছে একটা, ইটাই আমি মানি। লয়? আমি মনে মনে যা ভাবছিলাম ঠিক সেটাই কাল রেতের বেলাতেই বউমা বললেক আমাকে। তুয়ার সঙ্গে পরামশশো করতে বললেক। তাই বলি, গার্জেন হিসাবে আমাদের কাজ উয়াকে একটা ভালো ইস্কুলে ভত্তি করা আর টিউশুনির পয়সা জুগিয়ে যাওয়া। লয়? এখন শিব গড়তে যেয়ে
-- হ্যাঁ! সেটা তুমি বলতে পারো। মামা! কিছু মনে কোরো না, প্রতি মাসে শুভর পেছনে কত টাকা খরচ করতে পারবে তোমরা?
-- তোর সঙ্গে ত বছরে একবার কথা হয়, তাও আমি ফোন করলে তবেই! ফোনই ত ঘরে ঢুকল বছর দুয়েক। তাই বলা হয় নাই আর ইসব কথা কি ফোনে বলা যায়, 'হ্যাঁরে! আমি পঞ্চাশ লাখ জমাইছি?' জিগালি যখন তখন বলি শুন! আমার রিটারমেন্টের পুরা টাকাটাই ফিক্সড করা আছে। চাষ আর পুখুর থেকে যা ইনকাম তাতেই হেসে খেলে সংসার চলে যায়। গাঁয়ে ঘরে ত আর ফুটানি কিছু নাই! রোগ বালাইয়ের খরচও কিছু নাই! ধর ক্যানে মাসে বিশ পুঁচিশ যা লাগে খরচা করবো।যা লাগব্যাক আমি দুব। টাকা রেখে কি করবো? লাতিনও নাই যে বিয়া দিতে হব্যাক। লয়? এখন তুই হেল্প করলেই শুভটাও মানুষ হয়ে উঠলেক। ইটাই কামনা এখন!
--আমি? আমি কি হেল্প করবো?
-- তোর কাছে শুভ থাকলেক। মানে তুইই গাইড করলি উয়াকে।তোর ত তিনটে শুবার ঘর। বসার ঘরও বিরাট
বলে, "মামা! মাথা ঠান্ডা করে শোন! শহরের পড়াশোনাটা পুরোপুরি কেনাবেচার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে! আমি বা আমার মতো লোকেরা সমস্ত শখ আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে শুধু ছেলে বা মেয়ের পেছনে ঢালছি! লোকে ঘোড়ার রেসে টাকা লাগায় শুনেছ তো? আমাদের সন্তান হচ্ছে সেই রেসের ঘোড়া! তুমি মাসে বিশ হাজার টাকা খরচ করতে পারবে বলছ! বেশ! বিষ্ণুপুরে শুভর বাবা মা একটা বাড়ি ভাড়া নিযে থাকুক। ওখানের হাইস্কুল আর টিউশনির সুনাম দীর্ঘদিনের। তবে শুভ একা থাকলে হবে না, বাবা মায়ের সঙ্গেই থাকুক।তুমি জানো না, এই বয়সের একটা ছেলেকে কোথাও একা রাখা মানে বখে যাওয়ার চান্স বেশি। বাবা-মায়ের সতর্ক নজর দরকার!" মামা হাসে। বলে, "রেজাল্ট ভালো হতে পারে ইটা আন্দাজ করেই সব জায়গায় খোঁজ লিয়া হয়ে গেছে রে! বিস্টুপুরে কুথাও আর ঘর ফাঁকা পড়ে নাই যে ভাড়া পাওয়া যাবেক। কুনু মেসও খালি নাই। সব ভর্তি! ভেবেছিলম যেদি ভালো রেজাল্ট করতে পারে
-- হুঁ! তাহলে এক কাজ করো। ওকে একটা মপেড কিনে দাও! স্কুল সেরে একটা দুটো টিউশনি পড়ে রাতের দিকে দিব্যি বাড়ি ফিরতে পারবে। রাস্তা তো মাত্র
মামা তো আর যাই হোক অচিনের মতন শহুরে হয়ে যায় নি। তাই ফোনে আর যুক্তি সাজাতে পারে না। তাছাড়া গ্রামীণ মানুষ হলেও তো বোঝে অচিন ভাইপোকে রাখতে রাজি নয়। মামার ম্লান হাসি শোনা যায়। বলে," তুই অনেক বছর হল গাঁয়ে আসিস নাই। তবে খবরের কাগজ ত পড়িস। পদ্ম আর ঘাসফুলে গোটা গাঁ এখন দু ভাগ! একদল বলে, গাঁয়ের মানুষের উবগার আমাদের চাইতে ভালো আর কেউ করতে লারব্যাক, ত অন্যদল বলে," আমরা কি কিছু কম বঠি না কি? তুমরা হঠ দেখি! আমরা দেখছি!' দিনের বেলায় লাঠালাঠি আর রাতের আঁধারে দল বেঁধে হামলা আর বোমা ছুঁড়াছুঁড়ি! সন্ধের পরে মদ, জুয়া আর সাট্টার ঢালাও জারবার! তারপর রাত দশটার পর থেকে ভিডিও হলে ছেলে ছোকরার ভিড়! খারাপ সিনামা! বহু ছেলে মাধ্যমিকে ইরকম শুভর মতোই রেজাল্ট করে তারপর হায়ার সেকেন্ডারিতে পি ডিভিশন! হায়ার সেকেন্ডারী ইস্কুলও ত সেই বহু দূরে! তা বাদে একটা টিউশুনি মাস্টার নাই যে পড়াব্যাক! ইখেনে কুনু ভবিষ্যত নাই! রেজাল্ট ভালো করায় ভাবলম যে তোর কাছে রেখে যদি পড়ানো যেত! তাহলে হয়তো--"
-মামা! তোমাকে আগেই বললাম ওর ভালো যদি চাও ওকে কোনো হস্টেলে বা কোনো আত্মীয় বাড়িতে রেখো না। বাবা মায়ের ডাইরেক্ট কন্ট্রোলে রাখো।তোমাদের যুগ তো বটেই আমাদের যুগও পাল্টে গেছে! বখে যাওয়ার জন্যে অজস্র হাতছানি।
সহসা অচিন ডুকরে কেঁদে ওঠে!ভাগ্যিস! কেঁদে ওঠার মুহূর্তে
-- চেয়ারটা ঠিক আছে তো?
--হ্যাঁ গো! রাখো!
গলা বুজে এসেছিল অচিনের। দান হাতের তর্জনী দিয়ে দু চোখের কোণের থেকে ক'ফোঁটা জল মেঝেতে ফেলল। সুচেতা ততক্ষণে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। হাত বাড়িয়ে অচিনের কাঁধ স্পর্শ করল সে। বলল, "কেঁদে নাও! হালকা হবে। আমার মাকে যেদিন দু বছরের জন্যে আসতে বারণ করেছিলাম, আমিও কেঁদেছিলাম! সেদিন তুমি আমার পাশে এসে দাঁড়াওনি! আজ আমি তোমার পাশে!" সুচেতার আবেগ অচিনকে স্পর্শ করে না, সে বিড়বিড় করে বলে,"নিখিল নক্ষত্র থেকে মানুষের/ এইভাবে সরে সরে থাকা/ নীলিমার প্রতিচ্ছবিহীন ঘোলা জলে/ এইভাবে মানুষের স্নান...!/
সুচেতা ওর অস্ফুট শব্দগুলোকে আঁকড়ে ধরতে চায়, বলে, "কি বলছ বিড়বিড় করে?"
-- কবিতা! তুমি হয়তো জানো না, একান্ত ব্যক্তিগত মুহূর্তে আমি কবিতার কোলে মাথা গুঁজি! মনকে প্রবোধ দিই। দেখছ না? কিভাবে একটা চরম স্বার্থপর কীটের মতন নিজের চারপাশে একটা গন্ডী তৈরি করে দিন কাটাচ্ছি?
সুচেতা তার কন্ঠস্বরে একঝুড়ি মায়া মিশিয়ে উত্তর দেয়,"হ্যাঁ! তাই তো! মাকে আসতে বারণ করে দিয়েছি! বন্ধু বা প্রতিবেশীরা বাড়িতে আড্ডা দিতে এলে চিন্তা শুরু হয়, কতক্ষণে যাবে সব! কোনো দরকার নেই, তবু রান্নাঘরে গিয়ে এটা ওটা নাড়তে শুরু করি! তারা একটু বসে থেকে উঠে পড়ে! নিজেরা পারতপক্ষে কারুর সঙ্গে মেলামেশা করি না, আমরা না থাকলে ছেলে যদি ফাঁকি মারে! আমরা কেমন পোকার মতন গুটি তৈরি করে দিন কাটাচ্ছি! কেন বলো তো?
-- কেন?
-- একটা প্রজাপতি জন্ম নেবে বলে! একজন বড়ো ডাক্তার কি একজন বড় প্রযুক্তিবিদ বা আর একজন অমর্ত্য সেন এই দেশকে উপহার দেব বলে! আমাদের ছেলে, জিত! ভবিষ্যতের প্রজাপতি! আমরা একটু গুটির অন্ধকারে থাকবো না?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন