সোমবার, ১৯ জুন, ২০২৩

দীপক সেনগুপ্ত

 

সমকালীন ছোটগল্প


ঘন্টেশ্বর পশুপতি মন্দির

গাঁয়ের লোক ওকে ‘পশু’ বলে ডাকে। ওর আসল নাম কিন্তু পশুপতি। বাবা বাঙলি হলেও পশুর মা ছিলো নেপালের  মেয়ে। কাঠমান্ডুর কাছেই কোনো পাহাড়ি গ্রামে তার বাড়ি ছিলো। কাঠমান্ডুর পশুপতি মন্দির জগত বিখ্যাত। সেই পশুপতির স্মৃতিতেই ছেলের এই নামকরণ। ওর মা নিশ্চয় স্বপ্নেও ভাবেনি, লোকজন তার দেওয়া অতো ভক্তি শ্রদ্ধার  নামটার শেষমেষ এই দশা করবে। পশুর মা পশুর বাল্যকালেই মারা গেছিলো। মনে হয় ছেলের নামের এই বিকৃতি তাকে শুনতে হয়নি। বর্তমানে পশু এই গ্রামের ‘ছাই ফেলতে ভাঙ্গা কুলো’। বাড়ি বাড়ি টুকটাক ফাই ফরমাশ খেটে কোনোমতে তার দুবেলার ভাতের জোগাড় হয়। তার উপরে ছিঁচকে চোর বলে ওর একটা বদনাম আছে। সুযোগ পেলে লোকের বাড়ির থালা বাসন হাত সাফাই করে। গ্রামের নিমাই কাঁসারির কাছে সেসব গোপনে বিক্রি করে সামান্য কিছু পয়সা জোটে। তবে সেটা খুব একটা বেশি কিছু নয়। চোরাই মালের কে আর বেশি দাম দেয়? মাঝে মধ্যে পশু আফশোষ করে বলে-

-নিমাইকা মাত্তর দশটাকা দিলে?

-আর কতো দেবো? এনেছিস তো হালকা একটা মাল। ভারি ভারি কিছু আনলে তখন ভালো দাম দেবো।

ভারি বাসন কোসোন পশু পাবে কোথায়? এ গাঁয়ের লোকের কাছে তেমন ভারি ভারি বাসন কোসন নেই। টুক করে কাপড়ের মধ্যে লুকিয়ে হাতসাফাই করতে হয়। একসাথে একটার বেশি সরানোও যায় না। পশুর ভাগ্যে তাই কখনো দশ টাকার বেশি প্রাপ্তি হয় না। অথচ কাজটাতে রিস্ক আছে ষোলোআনা। যদিও হাতেনাতে আজ পর্যন্ত ধরা পড়েনি সে। কিন্তু জানে, ধরা পড়লে উত্তম মধ্যম মারধোর হবে। তার চেয়ে বড়ো কথা গ্রামছাড়া হতে হবে। এই গ্রামটার  প্রতি ভীষণ রকম টান পশুর। ছেড়ে যাবার কথা ভাবতেই পারে না। অথচ সেই কেলেঙ্কারিটার পর মালতী ওকে বলেছিলো-

-চল পালাই।

পশু রাজি হয়নি। তাতে মালতীর কি রাগ! মালতী হলোগে মধু মন্ডলের বিধবা মেয়ে। এখন তার আর একটা পরিচয় আছে, সে গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের সাফাই কর্মচারী। বিধবা হয়ে বাপের বাড়ি ফিরে এলে যখন দাদারা আশ্রয় দিতে অস্বীকার করলো, তখন গাঁয়ের লোকেরাই ওকে এই চাকরিটা জুটিয়ে দিয়েছে। একা একটা পেট চলে যায় তাতে।  গাঁয়ের লোকেরা ওর দাদাদের চাপ দিয়ে বাপের ভিটের একধারে মাথা গোঁজার মতো ভাঙ্গা কুঁড়েও একটা আদায় করে দিয়েছে। ঐ স্কুলেই একদা পিওয়নের কাজ করতো পশু। ওর কাজ ছিলো সময় মতো ঘন্টা বাজানো। প্রথমে প্রার্থনার ঘন্টা, তারপর একের পর এক পিরিয়ডের। শেষে ছুটির ঘন্টা। পিরিয়ড শেষে ডাস্টার ঘষে ব্লাকবোর্ড পরিষ্কার করা। এসবই ছিলো পশুর কাজ।

ভালই ছিলো। কিন্তু প্রকৃতির দুষ্টু মিষ্টি শয়তানিতে মালতীর সাথে পশুর আশনাই হয়ে গেলো। আর একদিন খুব আপত্তিজনক অবস্থায় কল্যাণ স্যারের কাছে হাতেনাতে ধরা পড়ে গেলো ওরা দুজন। কেলেঙ্কারি কান্ড। কুকর্ম তাও আবার বিদ্যার মন্দিরে। একেবারে ক্লাস রুমের ভেতর। পশুর চাকরিটা  চলে গেলো। মালতীরটা গেলো না। কিভাবে কি জানি সবার মনে হলো সমস্ত দোষটাই পশুর। তবে মালতীর উপর হুকুম হলো, স্কুলের নিষ্পাপ শিশুদের সে আর মুখ দেখাতে পারবে না। একদম সকাল সকাল এসে ঝাঁট ফাট দিয়ে যেতে হবে। তখনই মালতী পশুকে বলেছিলো-

-চল। এ গেরাম ছেড়ে পালাই।

পশু রাজি হয়নি। আসল কথা হলো ওর সাহসে কুলায়নি। তবে আস্তে আস্তে ব্যাপারটা ধামাচাপা পড়ে গেছে। পশু থেকে গেছে গ্রামেই। টুকটাক কাজ করে আর হাতসাফাই করে বেঁচে আছে কোনোমতে।

গ্রামটার গা ঘেঁষে একটা নদী আছে। নদীটার অবস্থাও পশুর মতো। কোনোকালে তার ভালো নাম একটা নিশ্চয় ছিলো। অব্যবহারে সবাই সেটা ভুলে গেছে। লোকমুখে এখন ওর নাম ‘মাজাভাঙ্গা’। সেটা হয়তো নদীটার হঠাৎ করে অনেকখানি বাঁক নেওয়ার জন্যেও হতে পারে। শ্মশানটা সেখানেই। যেটা ব্যবহার করে আশপাশের চারটে গ্রাম। ওখানেই আছে শ্মশান কালীর মন্দির। জাগ্রত বলে খ্যাতি আছে তার। মন্দিরটা ছোটোই। তবে মন্দিরের চাতালটা বেশ বড়ো। প্রায়ই লোকে সেখানে নামধাম লেখা পাথরখন্ড বসায়। আর তাতেই ওটার বৃদ্ধি হতে থাকে। অনেকে আবার পেতলের ঘন্টাও দেয়। এভাবে মন্দিরটাতে বেশ কটা ঘন্টাও হয়ে গেছে।

সে রাতে সত্যিই চুরির কোনো উদ্দেশ্য ছিলো না ওর। রাতে ঘুম আসছিলো না। এলোমেলো ঘুরতে ঘুরতে একসময় পশু দেখলো, সে ঐ মন্দিরের সামনে এসে হাজির হয়েছে। ওর মনে হলো এই অন্ধকার নিস্তব্ধ রাতে মন্দিরের ঠান্ডা চাতালটায় গিয়ে শোয়। তাতে যদি ঘুম আসে। চাতালে শুয়ে ও দেখলো ঘন্টাগুলো সব ছাদ থেকে ঝুলছে। তারমধ্যে একটা ঘন্টা বেশ বড়োসড়ো। পেতলের তৈরি ঘন্টাটা নিশ্চয় বেশ ভারি হবে। ও উঠে দাঁড়ালো। ঘন্টার ওজন আন্দাজ করার উদ্দেশ্যে ওটাকে ধরতেই ওটা ঝড়াক করে শেকল সহ ছাত থেকে খুলে ওর হাতে চলে এলো। সত্যিই বেশ ভারি ঘন্টাটা। এক মুহূর্ত ভাবনায় পড়লো পশু। তারপর মনস্থির করে নিয়ে শেকল সমেত ঘন্টাটাকে নিয়ে রওনা  দিলো নিমাই কাঁসারির বাড়ি। দরজায় টোকা দিয়ে বলল-

-নিমাইকা আমি পশু। মাল এনেছি।

নিমাই জানে মাল নিয়ে এরকম অসময়েই আসে পশু। দোর খুলে নিমাই পশুকে ভেতরে ডেকে নিলো। কিন্তু মাল দেখেই আঁতকে উঠলো সে।

-সব্বোনাশ! এ কি এনেছিস? এতো শ্মশান কালীর ঘন্টা! সত্যিই তুই একটা পশু। বিন্দুমাত্র ভয় ডর নেই তোর? পাপ  পূণ্যি বোধ নেই? এক্ষুনি ফেরত নে যা। এক্ষুনি। দুর দুর করে পশুকে তাড়িয়ে দিয়েছিলো নিমাই।

এইবার পশু পড়লো মহা আতান্তরে। এখন এই বিশাল বোঝা নিয়ে কি করবে ও? আবার ফিরে যাবে মন্দিরে? এদিকে রাত কাবার হয়ে ভোর হয়ে আসছে। কারো চোখে পড়ে গেল কেলেঙ্কারি হবে। তবু সাহস করে সেদিক পানেই এগোতে লাগলো ও। কাছাকাছি যেতেই নজরে পড়লো,  মড়া নিয়ে লোকজন এসেছে শ্মশানে। অনেক লোকজনের ভিড় ওখানটায়। এখন ওখানে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। আবার উল্টো পথে ধরলো ও। তেঁতুলতলা বেশি দূর নয়। বিশাল আকাশ ছোঁয়া গাছটা। ঘন ঝোপালো পাতায় ভরা। পশু ঘন্টা কাঁধে নিয়ে গাছ বেয়ে উঠতে লাগলো। বেশ অনেকটা ওঠার পর ওর মনে হলো, এখানে যদি ঘন্টাটা বেঁধে রাখা যায়, কারো নজরে পড়বে না। যা ভাবা তাই  কাজ। তেঁতুল গাছের ডালে শক্ত করে শেকল পেঁচিয়ে ঘন্টাটাকে বেঁধে দিলো ও। এতোসব করে যখন ও নীচে নামলো, চরাচরে ভালই আলো হয়ে গেছে। বেশ করে উঁকি দিয়ে দেখে নিলো - নীচ থেকে ঘন্টাটাকে একদম দেখা যাচ্ছে না। একরকম নিশ্চিন্ত হয়ে ও বাড়ি ফিরে গেলো।

পরদিন সকালেই গ্রামজুড়ে মহা শোরগোলটা শুরু হয়েছিল। সব্বোনেশে কান্ডো ঘটে গেছে। শশ্মান কালীর মন্দির থেকে বড়ো ঘন্টাটাই বেপাত্তা। দেখতে দেখতে দুঃসংবাদটা পাশাপাশি চারটা গ্রামেই ছড়িয়ে গেলো। খুব ভয়ে ভয়ে দিনটা কাটালো পশু। ভয় নিমাইকাকে। যদি নিমাইকা পশুর নামটা বলে দেয়! দিনটা পার হলে পরে খানিক নিশ্চিন্ত হলো ও। বুঝতে পারলো নিমাইকা খবরটা চেপেই গেছে। নিশ্চয় ভেবেছে ওতে ওর নিজেও জড়িয়ে পড়ার ভয় আছে। একটা দুটো করে দিন কাটতে লাগলো। আর হৈচৈ স্থিমিত হতে থাকলো।

একদিন, বোধহয় সে দিনটা সোমবার। কালবৈশাখী ঝড়টা উঠলো সন্ধ্যাবেলায়। প্রবল বাতাস। ঝড়ের দাপটে সব গাছপালাগুলো জোরে জোরে মাথা ঝাঁকাতে থাকলো। আর এর মধ্যেই ঝড়ের আওয়াজ ছাপিয়ে শোনা যেতে লাগলো ঢঙ ঢঙ ঢঙ ঘন্টাধ্বনি। লাফিয়ে উঠলো পশু। এবার আর ওর রক্ষে নেই। মালতী যা পারেনি, ঘন্টাধ্বনি তা সম্ভব করে দিলো। গ্রাম ছেড়ে পালিয়েই গেলো পশু।

ফিরলো প্রায় বছর পাঁচ পরে। তখন অবশ্যি ওকে চিনতে পারা খুব মুস্কিল। তখন ওর লম্বা লম্বা চুল দাড়ি। পরনে গেরুয়া কাপড়। রীতিমত সন্ন্যাসীর চেহারা। গ্রামে ঢুকে পশু দেখলো কমবেশি অনেক কিছুই পাল্টে গেছে। সবচেয়ে  উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন, তেঁতুলতলায় নতুন একটা মন্দির হয়েছে। শিবের মন্দির। ঘন্টাটাও আছে। তবে নতুন মন্দিরে নয়। ঘন্টাটা এখনো বাঁধা আছে সেই গাছের মাথাতেই। যেখানে পশু ওটা বেঁধে দিয়েছিলো। লোকেদের বক্তব্য, স্বয়ং মহাদেব ওটা ওখানে উড়িয়ে এনেছেন। কার সাধ্যি সেটা সেখান থেকে সরায়? ঘন্টাটা বাজানো হয় লম্বা একটা দাড়ি  দিয়ে - নীচে থেকে। এই মন্দিরের সাফ সাফাইয়ের দায়িত্বও বর্তেছে মালতীর উপর। পশু এগিয়ে গিয়ে মন্দির চাতালে গ্যাঁট হয়ে বসলো। দেখতে দেখতে ওকে ঘিরে ভিড় জমে গেলো। অনেকেই হঠাৎ করে এরকম একজন সন্ন্যাসীর আবির্ভাব দেখে বিস্মিত - ভক্তিতে আপ্লুত। পশু তাদের ভক্তি আরো উস্কে দিয়ে জানালো, ও এসেছে শিবের আদেশ পেয়ে হিমালয় থেকে। আর সেইসঙ্গে মন্দিরটার নামকরণ রে দিলো ‘ঘন্টেশ্বর পশুপতি মন্দির’। সব্বাই সেটা একবাক্যে মেনে নিলো।

যেমন আবির্ভাব সেরকমই অন্তর্ধান হলো সন্ন্যাসীর। পরদিন সকালে সবাই দেখলো সন্ন্যাসী আর নেই। আরো অনেক পরে টের পাওয়া গেলো মালতীও নেই।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন