সমকালীন ছোটগল্প |
শাশুতোষ আশুতোষের গল্প
এটাকে
খাঁটি স্মৃতিকথা বলা যাবে না। এ গল্পটা আমার শোনা গল্প। তবে যার কাছে শোনা মিথ্যেবাদী
বলে তার এলাকায় খ্যাতি ছিলো। তাই এ কাহিনীর সত্য মিথ্যা নিয়েও আমার তরফ থেকে কোনো
গ্যারান্টি দেওয়া সম্ভব নয়। শুধু এটুকুই বলছি। গল্পটা শুনিয়ে নারায়ণদা আমায় বলেছিলেন-
God promise. It is 100% true.
এটা যার গল্প, তার নাম আশুতোষ। নারায়ণদার মতে তার নাম গিনিস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ড-এ ওঠা দরকার। কারণ একজন মানুষের এতোগুলো শাশুড়ি ভূ-ভারতে আর কারোরই কখনো ছিলো না। এখনো নেই। সেই লোকটার নাম নারায়ণদা যদিও বলেছিলেন - আশুতোষ। কিন্তু তার নাম শাশুতোষ হলেই উপযুক্ত হতো। হিন্দীতে শাশুড়িকে শাসুমা বলা হয়।
আশুতোষের
তিন বিয়ে। সুতরাং হিসেব অনুযায়ী তার তিন শাশুড়ি হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিলো। কিন্তু
তার তিন শ্বশুরই একাধিক বিয়ে করেছিলেন। তাদের
সংখ্যা তিন, তিন, দুই। এবং যেহেতু তাঁরা সকলেই তখন জীবিত ছিলেন, তাই আশুতোষের মোট শাশুড়ির
সংখ্যা ছিলো আট। আট শাশুড়ি নিয়েই সংসার ছিলো আশুতোষের। তা বলে আশুতোষ বা তার শ্বশুরেরা কেউই কিন্তু কুলীন ব্রাহ্মণ ছিলেন
না। আশুতোষরা ছিলেন কায়েত সরকার। শ্বশুর তিনজনও কায়েত। দুজন দত্ত একজন ঘোষ।
আসলে
বহু বিবাহ করতে কুলীন হওয়াটা খুব একটা জরুরি নয়। অর্থ এবং ইচ্ছে থাকলে একাধিক বিয়ে
করাটা যে কারো পক্ষেই সম্ভব। বিশেষ করে আমাদের মেয়েপ্রধান দেশে ব্যাপারটা খুবই সহজসাধ্য।
এখানে অনেকে আপত্তি করে বলতে পারেন, মেয়েপ্রধান কেন বলছেন? আমাদের সমাজ তো পুরুষপ্রধান।
বইতেও সেরকমই লেখা আছে।
কিন্তু
প্রাধান্যের মাপকাঠি কি একটা নাকি? পুরুষেরা যেমন ক্ষমতায় প্রধান। মেয়েরা তেমন সংখ্যায়।
বিয়ের বাজারে একটা পাত্র এসে দাঁড়ালেই ব্যাপারটা
টের পাওয়া যায়। একজন পাত্রের জন্যেই নিমেষে রাশি রাশি বিবাহযোগ্যা কন্যা এসে হাজির
হয়ে যায়। যেখানে ‘ঝুলিয়ে দাও’ এটাই বিবাহের প্রারম্ভিক মন্ত্র, সেখানে পাত্রের গুণাগুণ
বিচারটা অতিশয় গৌণ ব্যাপার। এমনকি সে ইতিমধ্যেই বিবাহিত কিনা সেটাও তেমন বিবেচ্য নয়।
সতীন নিয়ে ঘর তো স্বর্গের দেবীরাও করেছেন।
ধর্মগ্রন্থ, মহাকাব্য পড়ে দেখুন। সেখানে দু একজন ছাড়া সব দেবীরই এক বা একাধিক সতীনের
কথা লেখা আছে।
আবারও
বলি উপরে বলা এই ব্যাখ্যাগুলো কিন্তু একটাও আমার নয়। সব নারায়ণদার। নারায়ণদা বিড়ি
খেতেন অবিরাম। সবসময় তাঁর পকেটে প্লাস্টিকে মোড়া অনেক বিড়ি থাকতো। বিড়িগুলো সবকটাই
আধখাওয়া। আনকোরা নতুন বিড়ি ক্বচিৎ কখনো দেখা যেতো। এই আধপোড়া আধখাওয়া বিড়ির পেছনে
ছিলো ‘চরিত্রদোষ’। নারায়ণদার চরিত্রদোষ নয়, বিড়ির চরিত্রদোষ। বিড়ি হচ্ছে এমন একটা
নেশার বস্তু যাকে না থেমে লাগাতার চুমু খেয়ে যেতে হয়। চুমু দিতে একটু দেরি করলেই
তার ডগার আগুন নিভে যায়। যেহেতু বিড়ি এবং বিড়ি ধরানোর দেশলাই কোনোটাই নারায়ণদার
নিজের নয়, অন্যের থেকে চেয়ে পাওয়া। তাই বিড়ি নিভে গেলে তাঁকে আবার সেটা জ্বালতে
হলে দেশলাইধারি কাউকে প্রয়োজন হয়। সবসময় তেমন কাউকে হাতের কাছে পাওয়া যায় না।
তখন নিভে যাওয়া বিড়িকে সযত্নে প্লাস্টিকে
মুড়ে রেখে দেওয়া ছাড়া গত্যান্তর নেই। নারায়ণদা আবার অপচয় একদম পছন্দ করেন না।
এটা তাঁর চরিত্রের গুণ।
গল্প
শোনানোর এলেমের জন্য ঘনাদা টেনিদার দেশে নারায়ণদারও খ্যাতনামা হওয়া উচিত ছিলো। কিন্তু
দিনকাল অনেকদিন থেকেই খারাপ হয়ে চলেছে। সেই খারাপ দিনকালে নারায়ণদাই ডেকে ডেকে সবাইকে
গল্প শোনাতে চাইতেন। সেই সঙ্গে বিড়িও চাইতেন। ফলে সবাই তাকে এড়িয়েই চলতো।
কিন্তু
তাঁর মুখে আশুতোষের আট শাশুড়ির মুখবন্ধটি শুনে আমি একদিন থেমে গেছিলাম। পায়ে পায়ে
নারায়ণদার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলেছিলাম-
-
আট শাশুড়ি? বলছো কি গো?
-
তবুও তো মাস-শাশুড়ি, পিস-শাশুড়িদের জুড়িনি। সে সব জুড়লে সংখ্যাটা যে কোথায় গিয়ে
দাঁড়াবে! হুঁ!
দে
বিড়ি দে! দেশলাই দে!
আমার
বিড়ির নেশা নেই। তাই দোকান থেকে কিনে এনে বিড়ি দেশলাই দিতে হলো। নারায়ণদা নতুন বিড়ির
প্যাকেট পকেটে ভরেন। আধখাওয়া বিড়ির প্যাকেট বের করে তারই একটা নিয়ে ধরিয়ে ছিলেন।
তারপর দেশলাইটা আমায় ফেরত দিয়ে বলেছিলেন-
-
যতো সব্বোনাশের কারণ এই দেশলাই। বুঝলি! ওটা সাথে রাখলেই চেইন স্মোকার হয়ে যেতে হয়।
এই
ডায়লগ শুনে তো আমি অবাক।
-
ওমা নারায়ণদা, আপনি বুঝি এখন চেইন স্মোকার নন?
-
না তো!
নারায়ণদাও
ডবল অবাক।
-
তুই আসার আগে বিড়ি খাচ্ছিলাম আমি? তবে? চেইন স্মোকার কী করে হলাম?
তারপর
বিড়িতে সুখ টান দিয়ে বলেছিলেন-
-
চেইন স্মোকার নই, তবে বেচেইন স্মোকার বলতে পারিস। মাঝে মাঝে ভেতরে গরম ধোঁয়া না ঢুকলে
বড়ই বেচেইন লাগে।
আমি
মনে করিয়ে দিলাম-
-
নারায়ণদা, আশুতোষের আট শাশুড়ির কথা হচ্ছিল যে!
-
হ্যাঁ। হচ্ছিলো। হবে।
এক
এক করে - না না - তিন তিন দুই করে আশুতোষের যখন আট শাশুড়ি হয়ে গেলো তখন আশুতোষ একদিন
সব শাশুড়িদের কাছে একটি প্রস্তাব রাখলো। আলাদা আলাদা করে না করে জামাই ষষ্ঠীর অনুষ্ঠানটা
সন্মিলিত ভাবে করা হোক। একই দিনে তিন বউ নিয়ে
সেই অনুষ্ঠানে হাজির হবে আশুতোষ আর তিন শ্বশুর আর আট শাশুড়ির কাছ থেকে আশির্বাদ নেবে
একসাথে। এতে খরচ, ধকল, ছুটোছুটি সব অনেক কমে যাবে। আট শাশুড়িই তাতে রাজী হয়েছিলো।
তিন শ্বশুরও রাজি হয়ছিলো এক কথায়।
নারায়ণদা
বলেছিলেন-
সত্যিই
খুব বিবেচক ছিলো আশুতোষ। একবার তো আমিও এ্যাটেডেন্ট করেছিলাম আশুতোষের সেই সন্মিলিত
জামাই ষষ্ঠী। আমার নিজের বিয়ে ঠিক হবার আগে আগে। সত্যিই দারুন অভিজ্ঞতা ছিলো সেটা।
দৃশ্যটাও খুব সুন্দর।
আশুতোষ
কোনো এক শাশুড়ির বানানো ফুলছাপ আসনে বসে আছে। একে একে তিন শ্বশুর আর আট শাশুড়ি এসে
তার মাথায় ধান দূর্বা দিয়ে আশির্বাদ করে
যাচ্ছে। আশুতোষের তিন বউ হেব্বি সেজে গুজে চেয়ারে বসে চেয়ে চেয়ে দেখছে। আশির্বাদ
সেরে তিন শ্বশুর একমনে বিড়ি ফুঁকছেন। শালা শালিরা ঘোরাঘুরি করছে। ঠিক যেন চাঁদের হাট
বসেছে। এসব দেখে আমিও মুগ্ধ হয়ে গেছিলাম।
সেই
মুহূর্তে সেই মুগ্ধতা অতীত থেকে বর্তমানে এসে নারায়ণদাকে জড়িয়ে ধরেছিলো। আমি নারায়নদার
কথার মাঝেই প্রশ্ন রেখেছিলাম-
-
আচ্ছা। আশুতোষের তিন শ্বশুর আর আট শাশুড়ি ছিলো বললেন। শালা শালী কজন ছিলো?
আমার
এই প্রশ্ন শুনে নারায়ণদা একটু চমকে, একটু থমকে, হাতের বিড়িতে টান দেওয়া থামিয়ে,
আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে মাথা চুলকাতে লেগেছিলেন। তারপর অস্ফুটে বলেছিলেন-
-
গুনিন তো! তবে এখন ভাবছি। গোনাটা উচিত ছিলো। সেই পরিসংখ্যানটাও তো গিনিস বুক অফ ওয়ার্ল্ড
রেকর্ড এ প্রকাশযোগ্য।
এদিকে অমনোযোগী হওয়ায় নারায়ণদার হাতের অভিমানী চুম্বন চ্যুত বিড়ি নিবে গেছিলো। সেই নিভে যাওয়া আধখাওয়া বিড়িটা নারায়ণদা তার পকেটের সংগ্রহে যোগ না করে আমার থেকে দেশলাইটা আবার চেয়ে নিয়েছিলেন। নতুন করে বিড়ি ধরানোর পর এবার আর দেশলাইটা আমায় ফেরত দেননি।
আমি
বলেছিলাম-
-
একি, সাথে দেশলাই রাখলে চেইন স্মোকার হয়ে যাবেন যে!
-
হলে হবো। নো পরোয়া। বুঝলি, বিড়ি কিন্তু সিগারেটের মতো অতো ক্ষতিকারক নয়। সবাই সিগারেট
স্মোকিং ইজ ইনজুরিয়াস টু হেল্থ বলে। বিড়ি স্মোকিং ইজ ইনজুরিয়াস টু হেল্থ কি কেউ
বলে কখনো? শুনেছিস তুই? দেখেছিস সেরকম লেখা কোনো বিজ্ঞাপন বা হোর্ডিং?
আমি
মাথা নেড়েছিলাম। তারপর বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে নারায়ণদা আমাকে বলেছিলেন-
-
এবার বাড়ি যাই। বউকে ইম্পর্ট্যান্ট প্রশ্নটা করতে হবে।
-
কোন প্রশ্ন?
-
কেন, আশুতোষের মোট কজন শালা শালী ছিলো? সেটা জানতে হবে তো। গিন্নীর থেকে জেনে গিনিস
বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে পাঠাবো।
-
সেটা বৌদি বলবে কি করে?
-
আরে আমার বৌ মানে তোর বৌদি তো আশুতোষেরই এক শালী। ওরই তো জানার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।
বলে
নারায়ণদা উঠে চলে গেছিলেন।
আশুতোষের
জামাই ষষ্ঠী অনুষ্ঠানেই তো সব ঠিকঠাক হয়েছিলো।
এর পরে নারায়ণদার সঙ্গে অনেকবার দেখা হয়েছে। তবে সেই আশুতোষের মোট শালা শালীর পরিসংখ্যানটা নারায়ণদা কখনো আমাকে জানাননি। তাই আমি সেটা জানতে পারিনি। তাই এখন আপনাদেরও জানাতে পারলাম না। এছাড়া আমি এটাও জানতে পারিনি, শাশুতোষ আশুতোষের আট শাশুড়ির এই গল্পটা সত্যি সত্যি, সত্যি কি না!
ঐ
যে বললাম ওনার মিথ্যেবাদী বলে রেপুটেশন ছিলো!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন