বুধবার, ১৭ মে, ২০২৩

দেবাশিস সরকার

 

সমকালীন ছোটগল্প


সকলি কৃত্রিম নহে

 

(১)

গৃহিণীরই মনে করিয়ে দেবার কথা, প্রত্যেকবারই সেই পুরনো কৌশলে মনে করিয়ে দেন। কৌশলটা এরকম, "সামনের মাসের ২৬ তারিখ সন্ধ্যেবেলাতেও কি তুমি এরকম আড্ডা দিতে বেরিয়ে যাবে?" বহুকাল আগে বোকার মতন প্রশ্ন করে ফেলেছিলাম, "কেন বলো তো? ওইদিন বাড়িতে কোনো কাজ আছে নাকি?" ঝাঁঝালো জবাব এসেছিল, "ওই তারিখটাতেই আমার বাবা আমার হাত-পা বেঁধে আমাকে জলে ফেলে দিয়েছিল! হুঁ! রসকষহীন মানুষ একটা!" হাতপা বেঁধে জলে ফেলে দেওয়া প্রবচনটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করতে গিয়ে মনে পড়ে গেছিল ছাব্বিশ তারিখটির বিশেষত্বটি কি! তবে এবারে আর গৃহিণীকে মনে পড়াতে হয়নি আমাদের পুত্রটির কারণে। অনলাইনে পড়াশোনা চালু হওয়ায় হাতে একখানি মোবাইল পেয়ে যাওয়ার পর থেকে তার যাবতীয় উৎসাহ অনলাইনে প্রাপ্তব্য যাবতীয় খাদ্যবস্তু সম্পর্কে। সে বলল, "বাবা! ২৬ তারিখ তো তোমাদের এনিভারসারি। ওই দিনের ডিনারে এবারের মেনু কি?" আমি উদারতার প্রতিমূর্তি, "দ্যাখ তোর মায়ের সঙ্গে আলোচনা করে। আমাদের কারোর করোনা হয়নি। তোর মামাবাড়িতেও না। তারচেয়ে বড় কথা, তোর পিসি, পিসেমশাই দুজনেরই করোনা হলেও কোনো বিপদ ঘটেনি! সেলিব্রেশনের ব্যাপার তো বটেই! ওদের দুজনকে ডাকলেই জম্পেশ হত! কিন্তু ওই! গিফট নিয়ে এসে হাজির হবে। আমাদের তিনজনের জন্যেই কিছু কর তাহলে।"

--তুমি বললে সেলিব্রেশনের মুড এবার। বাজেট নিয়ে কিপ্টেমি করলে চলবে না কিন্তু!" বাংলা সংবাদ চ্যানেলের অল্পশিক্ষিত নিউজ রিপোর্টারদের মতন অপ্রয়োজনে এবং কথায় কথায় 'কিন্তু' এই সংকোচক অব্যয়টির যথেচ্ছ ব্যবহার করার সংস্কৃতি গরিমা হারানো বাংলা ভাষাকে কাঙাল করে দিচ্ছে। ব্যবহারে বরাবরই তীব্র আপত্তি জানিয়েছি, এরা দুজনে তা জানে এবং মানেও। এখন মুখ ফস্কে বেরিয়ে যেতে লজ্জায় পড়ল। কড়া চোখে পুত্রের দিকে তাকালাম। সে সেলিব্রেশনের মুডে এখন। সে বলল, "ছাড়ো এখন ওসব! সব সময় ইয়ে! মা বলে দাও তো এবারের মেনু কি কি?" নাঃ! তেনার পক্ষে সম্ভব না ওসব দাঁতভাঙ্গা খাদ্যবস্তুর নাম মুখে আনা। অগত্যা পুত্রই আমার হাতে ধরিয়ে দেয় একটি লিস্ট। সেটি খুলে সেই পুরনো রেস্টুরেন্টেই ফোন। "হ্যালো! এটা কি চাওলা 'স কিচেন?"

--না স্যার! এটা কে এফ সি।

--এঁ? রং নাম্বারে ফোন করেছি?

--না স্যার! নাম্বারটা ঠিকই আছে। কে এফ সি দোকানটা কিনে নিয়েছে।

--ও! এটা কি খাবারের দোকানই আছে? চাওলা নামটা ওরকমই রেখেছিল বটে, তবে সব রকমের ডিশই তো বানাতো! মানে, আমি বলছি, আমি কি এখানে ডিনারের অর্ডার দিতে পারি?

--কেন নয় স্যার? ডিনার, লাঞ্চ যা বলবেন! আর যেহেতু এটা একটা মাল্টি ন্যাশনাল ব্র্যান্ড, আমি আপনাকে এশিওর করতে পারি কি আগের চাইতে মাচ মোর বেটার টেস্ট এন্ড মাচ মোর বেটার কোয়ালিটির ফুড আইটেম আপনি পাবেন এখানে। কন্টিনেন্টাল ডিশেস ও আপনি পাবেন এখানে।জাস্ট অর্ডার করুন স্যার!

--না -ইয়ে - কন্টিনেন্টাল না। নামটা যদিও ওরকমই রেখেছিল চাওলা -- বলছি -- ইয়ে --ক্রিমি ইটালিয়ান চিকেন ললিপপ দু প্লেট আর ওভেন বেকড ফ্রেঞ্চ পিৎজা ছ’পিস পাওয়া যাবে?

--স্যার! এজ আই টোল্ড, বেটার কোয়ালিটির ফুড আইটেম আপনি পাবেন এখানে। তবে আমি সাজেস্ট করবো বিকজ আপনার কোলেস্টেরল লেভেল লাস্ট সিক্স মান্থসে একটু বেড়ে গেছে তাই ক্রিমি চিকেন ললিপপটা ছেড়ে   আমাদের ওভেন বেকড চিকেন ললিপপটা ট্রাই করুন!আপনার অর্ডারড ক্রিমি ইতালিয়ান ললিপপ  দু প্লেটে আমাদের গেইন ইজ মাচ মোর, তবু উই আর ওয়ারিড এবাউট ইয়োর কোলেস্টেরল লেভেল স্যার!

আমি তো রীতিমতো হতভম্ব হয়ে গেলাম! আমার কোলেস্টেরল লেভেল যে একটু বেশির দিকে তা তো এদের জানার কথা নয়! আমার এই দুশ্চিন্তার মাঝে ফোন এল, "এন্ড,--আইদার ওভেন বকড ফ্রেঞ্চ পিৎজা অর স্লাইসড ভেজিটেবল পিৎজাও নিতে পারেন স্যার!

ওর পরামর্শ কানে না তুলে আমি সেই মুহূর্তের জিজ্ঞাস্য উচ্চারণ করি, "অবাক কান্ড! আপনি তো গনৎকারের মতন কথা বলছেন! আমার কোলেস্টেরল হাই না লো সেটা আপনি জানবেন কি করে?"

--আমাদের কাছে আপনার গত চার বছরের লিপিড প্রোফাইলের রিপোর্ট আছে। চার বছর আগে আপনার ফার্স্ট স্ট্রোকটি যখন হয় সেই মুহূর্তে আপনার এল ডি এল ছিল ওয়ান এইটটির ওপরে --আপনি আমি কেউই জানি না এখন আপনার এল ডি এল--

আমার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে ওঠে! আমি কি এপলো হাসপাতালের ডক্টর স্বামীনাথনের সঙ্গে কিথা বলছি নাকি! এ কে! উপেক্ষা করার ভঙ্গিতে বলি, "লিভ ইট! আই নো হাউ টু ম্যানেজ এল ডি এল লেভেলস। আমি ভেজিটেবল পিৎজা পছন্দ করি না। আয়াম আন্ডার মেডিকেশন। কোলেস্টেরল কমানোর ওষুধ খাই আমি। আমি যেটা চাই সেটাই দিন!

--ওষুধ কি রেগুলারলি আপনি খাচ্ছেন স্যার? বিয়াল্লিশদিন আগে ভার্মা ফার্মাসিউটিক্যাল থেকে মাত্র তিনটে স্ট্রিপ কিনেছিলেন আপনি। দ্যাট মিনস, লাস্ট টুয়েল্ভ ডেজ - স্যরি টু সে স্যার - ইউ আর আন্ডার থ্রেট অব এন এনাদার এটাক।

আমার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা হিমস্রোত নেমে গেল! ভাগ্যিস ফোনটা স্পিকারে নেই! আমি ফোন করতে শুরু করতেই ছেলে পড়ার ঘরে চলে গেছে! এদিকে এই কে এফ সি' র ছেলেটা কি অতিপ্রাকৃত কিছু নাকি! একটা পরীক্ষা করার জেদ মাথায় চাপল!দেখি তো কতদূর অব্দি জানে এই ছেলেটা! বললাম, "কি আশ্চর্য! এই ভার্মা ছাড়া আমাদের শহরে আর কোনো ওষুধের দোকান নেই নাকি?

-- কিন্তু আপনার ডেবিট কার্ডের ট্রানজাকশন স্টেটমেন্টে তো নেই কিছু?

ওঃ! এ তো পাগল করে দেবে দেখছি! আমার আলমারির লকারে কত টাকা আছে সেটাও এবার বলে দেবে নাকি!

ওকে উপেক্ষা করার ভঙ্গিতে বলি, "আমি ক্যাশ দিয়ে কিনেছি ওষুধগুলো। "উত্তরটা দিয়েই মনে হোল, কি আশ্চর্য! কোথাকার কে এই ছেলেটা অথচ আমি এমন ভঙ্গিতে ওর সঙ্গে কথা বলছি যেন ও কোনো সিবিআই অফিসার আর আমি যেন কোনো ইকনমিক অফেন্ডার। এ কি বোকার মতন আচরণ আমার!

ওপাশ থেকে ব্যঙ্গ মিশ্রিত হাসির সঙ্গে ভেসে আসে, "স্যরি স্যার! বিয়িং আ সেলসম্যান অফিসিয়ালি আমার এরিয়া জাস্ট আমাদের প্রোডাক্টগুলি আপনাদের কাছে এট্রাক্টিভ করে তোলা। বাট আমাদের কোম্পানির মোটো হল কি, জাস্ট নট টু সেল বাট টু কেয়ার আওয়ার কাস্টমার অলসো। তাই আপনার কেয়ারলেসনেসের কথা মনে করিয়ে দিলাম। আমাদের রেকর্ড বলছে,'চাওলাস কিচেনের সঙ্গে আপনার নাইন ইয়ারসের রিলেশনশিপ। ওক্কে স্যার! কামিং টু দা পয়েন্ট। দেন, এজ ইউ উইশ - চিকেন ললিপপ আর --"

ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে আমার! ওর প্রশ্নের খোঁচায় বিপর্যস্ত হচ্ছিলাম এতক্ষণ। জরুরি কথা মনে পড়ে যাওয়ার ভঙ্গিতে বলি, "কটা নাগাদ ডেলিভারি হবে? "

--হুইদিন এন আওয়ার স্যার! কার্ডে পে করবেন নাকি ক্যাশ অন ডেলিভারি?

--ক্যাশ। চাওলার রেটেই তো পাবো খাবারগুলো?

--বা স্যার! কস্ট একটু বেশি পড়বে, এই পোস্ট প্যান্ডেমিক পিরিয়ডে সব কিছুই তো কস্টলি এখন। মোর ওভার আমাদের কোম্পানিটাও --

বুঝতেই পারছি ভালোই খসবে তবে এতক্ষণ ভ্যাজর ভ্যাজর করে তো ফিরে আসা যায় না। চেঁচিয়ে সুখবরটি বৌ ছেলেকে জানালাম।

সে না হয় হোল, খাদ্য বা তার উৎকর্ষ তো জিভেই মালুম হবে তবে আমি যে ক'পাতা ওষুধ কিনেছি, আমার ব্যাংক একাউন্ট স্টেটমেন্ট এমনকি লিপিড প্রোফাইল রিপোর্ট, সব এদের কাছে গেল কি করে? আমার প্যান, আধার নম্বর, মোবাইল ব্যাঙ্কিং পাসওয়ার্ড আর লকারের নম্বরও ওদের জানা নাকি? রাতারাতি পথের ভিখিরি হয়ে যাবো যে! সরাসরি প্রশ্ন করলাম, "আচ্ছা ভাই! আপনি আমার সম্পর্কে যেসব তথ্য দিলেন, সেসব আমার গোপন সম্পদ বা আপদ যাই বলি না কেন, প্রাইভেট তথ্য সব। আপনি জানলেন কি করে? প্যাগাসাস বা অন্য কোনো সফটওয়ার থেকে না কি? বলবেন একটু? "

যুবকটি শব্দ করে হাসল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, "না স্যার! স্যরি টু সে, আপনি এমন কিছু ভি আই পি নন, অন দি আদার হ্যান্ড, কেএফসি জাস্ট এজটা রেস্টুরেন্ট মাত্র। পেগাসাস টেগাসাস শুনে হাসি পাচ্ছে স্যার! উইথ দা হেল্প অব এন অর্ডিনারি সফটওয়ার আমাদের প্রত্যেক কাস্টমারের ডেটাবেস তৈরী করে রাখা আছে। যারা বেটার কাস্টমার সার্ভিস দিতে চায় সেইসব বিজনেস হাউসগুলোর প্রত্যেকেরই এইরকম ডেটা বেস আছে। এই ডেটাবেস থেকেই কাস্টমারদের লাইকিংস, ডিসলাইকিংস জানতে পারি আমরা। এন্ড - রিলেশনশিপ বিল্ড আপ করার জন্যে এটা খুব ইউজফুল হয়। যাক গে স্যার! আয়াম গেটিং লেট্ টু প্লেস ইয়োর অর্ডার টু দা কিচেন, দেন ক'টার সময় প্যাকেটটা পাঠাবো স্যার?

--ন 'টার সময় দিলেই হবে। আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দেবেন? জানি আপনারা বড় কোম্পানি, ছ্যাচড়া কাজ করেন না, তাই জিজ্ঞেস করতে সাহস পাচ্ছি।

--বলুন!

-- আমার প্যান নম্বর, আধার নম্বর আছে আপনাদের ডেটা বেসে? এ টি এম কার্ড নম্বর আর পিনটাও কি?

--স্যরি স্যার, একটা ফোন এতক্ষণ এনগেজড রাখা যায় না। পিক আওয়ার্স তো! কন্টিনিয়াস কল আসছে। পরে কথা হবে। দেন বিফোর নাইন পি এম আপনার প্যাকেট ডেলিভারি হবে। বাই -ঈ!

 

আর খাওয়া! খাওয়া মাথায় উঠল! আমার একাউন্ট ফাঁকা হয়ে গেলে এ খাবার গলা দিয়ে নামবে! এ টি এম কার্ডের পিন নম্বর জানারও দরকার হয় না। কার্ডের পেছনে যে তিন সংখ্যার সিভিভি কোড টি আছে সেটি দিয়েই তো লক্ষ লক্ষ টাকার ট্রানজাকশান সেরে ফেলা যায়!  কত রকমের ফাঁদ যে তৈরী আছে বাবা!  যাই একবার তুফানের বাড়ি। আমার অনেক আগে থেকেই নেট দুনিয়াতে ওর ঘোরাফেরা । এই বিপদ থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায় ও জানে কিনা দেখি!

দজা বন্ধ করতে এসে লিপি বলল, "ধন্য তুমি! আজকেও তোমাকে আড্ডা দিতে যেতে হবে! ওখানে প্রচুর রস, না? যাও! রাতে খাওয়ার একটু আগেই আসবে নিশ্চয়। হুঁ! ধন্য! "

বলো যা খুশি! কোন জ্বালায় যে জ্বলছি তা যদি তুমি জানতে তাহলে আজ যদি ফুলশয্যার রাতও হয়, তুমিই উৎসাহ দিতে যাওয়ার জন্যে।

(২)

বসার ঘরে সোফায় বসে সমস্ত শুনল তুফান। বললাম, "কি করা যায়  বল তো? আমার নিজস্ব গোপনীয়তা কি কিছুই থাকবে না?"

তুফান চিন্তিত মুখে বলল, "হুঁ! দ্যাখ, ফেসবুক বা হোয়াটস আপ আমিও খুলে দেখি। ক 'দিন আগেই এই জাতপাত ওসকানো রাজনীতির বিরোধিতা করে একটা ফেসবুক পোস্ট দিয়েছিলাম।

--দেখেছি। লাইকও করেছিলাম। আরে! আমি তোর কাছে কি জন্যে এলাম আর তুই ফেসবুক, হোয়াটস আপ খুলে বসলি?

--ধীরে বন্ধু ধীরে! বলছি, তুইও তো এসব ফেসবুক, হোয়াটস আপে আছিস?

--হ্যাঁ! সে তো সেই কবে থেকে!

--বেশ! মাত্র ক 'দিন আগে জানলাম, আমার ওই পোস্টটি অজস্র ওত পেতে থাকা শিকারীদের কাছে একটি ডেটা পয়েন্ট হিসাবে জমা পড়ল!

--মানে?

--সমস্ত পলিটিকাল পার্টিগুলির কাছে তো বটেই এমনকি সমস্ত কনজুউমার গুডস মেকিং কোম্পানির কাছে, যতসব ইনসুরেন্স কোম্পানি, ব্যাংক সকলের কাছেই তোর বা আমার ওই আপাত নিরীহ পোস্টটি একটি ডেটা পয়েন্ট হিসাবে জমা পড়ল।

--হল না হয় ঘোড়ার ডিমের তোর ওই ডেটা পয়েন্ট, তাতে কী ই বা হবে? আমি বা তুই যে সাম্প্রদায়িক বা অসাম্প্রদায়িক সেটি প্রমাণিত হোল। ভবিষ্যতে কাতে পেলে এই দলটা আমার পোঁদে বাঁশ দেবে, এটা বুঝলাম। চার বছর আগে আমার কোলেস্টেরল লেভেল যে কত ছিল তা আমার বা আমার বৌয়েরই মনে নেই সেটি একটি কোম্পানি কিভাবে জেনে বসে আছে? এ তো শালা আমি দরজা বন্ধ করে কার সঙ্গে শুচ্ছি সেটাও তো অন্য কেউ জানে মনে হচ্ছে! তাহলে তোর বাড়িতে এখন যে এলাম সেটাও ওই ওত পেতে থাকা শিকারিরা জেনে ফেলছে?

--ধেড়ে লোকেদের নিয়ে সমস্যাটা কী জানিস? তারা নতুন কিছু শিখতে চায় না, হ্যাঁ! জেনে ফেলেছে। ফুট না কেটে কী বলছি শোন আগে। গুগল আপের হেল্প নিয়ে কোনো ঠিকানা ফিকানা খুঁজেছিস কখনও?

--কতবার! এই তো গতবছর ভাইজাগ গেলাম। গুগল থেকেই তো হোটেল বুক করলাম তারপর ভাইজাগ স্টেশন থেকে কতদূরে সেই হোটেল না জানলে স্টেশনের অটোওলা কান মুলে ভাড়া নিয়ে নেবে না? তাছাড়া ভাইজাগ থেকে অন্য অন্য স্পটগুলোর ডিসট্যান্স গুগল দেখে দেখেই তো নোট করা! এ তো সবাই করে! তারপর গত বছর যখন শিলং গেলাম --

-- মিটে গেল! গুগলের স্ক্যানারে তোর মুভমেন্ট রেকর্ডেড! হতেই পারে গুগল এখন তোর প্রোফাইল সার্চ করে আমার লোকেশন পেয়ে গেছে! অভ্যশ্য তুই একা নোস, আমিও ওদের সার্ভেল্যানসে আছি।

আমি আর্তনাদ করেছি উঠি, "আঁ সেকি!"

তুফান আশ্বস্ত করে, "ঘাবড়াস না। তুই আমি সব্বাই ওই স্ক্যানারের সার্ভেল্যান্স মানে নজরদারিতে আছি। অনেক হসপিটালের দেওয়ালে নোটিশ চেটানো থাকে দেখিসনি? ‘তুমি এখন সি সি টিভি সার্ভেল্যাসের ভেতরে রয়েছো।' গলা কাটা বিল হোক কী ডাক্তার, নার্সের অবহেলায় রুগী মারা যাক, কোনো ঝামেলা করোনা, তোমার মুভমেন্ট রেকর্ড করা হচ্ছে!

হতাশায় ওকে কথা শেষ করতে না দিয়ে আমি বলে উঠি,"সেটা না হয় দেখা যায় মুভমেন্ট রেকর্ড করা হচ্ছে, ভাইজাগ গেছি... সেখান থেকে তোর বাড়িতে এলাম কিভাবে এসব কে রেকর্ড করছে, কেন করছে, বুঝিয়ে বলতে পারবি কি কিছু?

আরে আমি কি টেকনোলোজি নিয়ে পড়েছি? যতটুকু বুঝি বলছি -- সমুদ্রে ভেজা বালির ওপর পায়ের ছাপ পড়ে দেখেছিস? ক সেকেন্ড পরেই অবশ্য সমুদ্রের ঢেউ এসে সে ছাপ মুছে দেয়। ফেসবুক হোয়াটস আপে একটা পোস্ট বা একটা লাইক করা মানেই হচ্ছে তোমার পদচিহ্ন রয়ে গেল ফর এভার! সখানে কোনো সমুদ্রের ঢেউ নেই।

ধুর! যত্তসব গোল গোল কথা!সুযোগ পেয়ে তুফান শালা সিগারেটে টান দিতে দিতে  আমাকে জ্ঞান দিচ্ছে! পরিষ্কার  বুঝতে পারছি ও -ও আমার  মতনই  ফেঁসে আছে, যেদিন আমার ফোনটির মতন একটি ফোন পাবে সেদিন ওর টনক  নড়বে। এরকম কেয়ারলেস থাকার লোক তো ও নয় ! মনের এই বিরক্তির মাঝে তুফানের ফোন বেজে উঠল। হাতে নিয়ে তুফান বলল," এই দ্যাখ! তোর লিপিরাণীর ফোন! টুই কি ফোন নিয়ে বেরোস নি? নে, কথা বল!"

কানে নিয়ে টুবলুর শগলা শুনি,"তুমি কোথায় আছো?  খাবার দিয়ে গেল এইমাত্র। মা টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছে"

"যাচ্ছি এক্ষুনি! মিনিট দশেক।", তুফানকে চেপে ধরি," পায়ের ছাপ রয়ে গেল তো কি হল?"

-- ছোটবেলায় স্বপকুমারের ডিটেক্টিভ গল্পে পড়ো নি, পায়ের ছাপ ধরে ধরে গোয়েন্দা খুনির বাড়ি অব্দি পৌঁছে যাচ্ছে? এটা না হয় হাস্যকর তবে পুলিশের কুকুর তো আসে খানিকদূর অব্দি! কবে কোন পোস্টে লাইক মেরেছো, কোন কোন দোকানে কার্ড সোয়াইপ করে কি কি কিনেছো চাঁদু, কোন কোন আপে উঁকি মেরেছো - এ সমস্ত কিছু মিলিয়ে তোমার একটা সাইকোলজিক্যাল  প্রোফাইল তৈরী হোল। এবার যে ক্রেতা এটা কিনতে চাইবে তাকে বিক্রি করা হবে।

--ধূস! আমার মতন হরিদাস পালের প্রোফাইল কে কিনবে?

--মমতা, মোদী থেকে শুরু করে আম্বানি আদানি বা মার্ক জুকেরবার্গ থেকে জেফ বেজোস সব্বাই।

--ধুর শালা! এলাম একটা টেনশন থেকে, মজা মারছিস! উঠি!

--শোনো বন্ধু! খানিক আগে তোমাকে ডেটা পয়েন্ট বলে একটা কথা বলেছি?

--হ্যাঁ! তো কি?

--আরেকবার মনে করিয়ে দিই, একটা পোস্ট বা একটা পোস্টে লাইক করা মানে একটা ডেটা পয়েন্ট --

--তাতে ঘোড়ার ডিম! আমার কি হাত-পা গজালো শুনি? এতে কি হবে?

--আমেরিকায় আগের ইলেকশনে 'কেমব্রিজ এনালিটিকা ' দাবি করেছিল, ওখানকার প্রত্যেক ভোটারের পাঁচশো করে  ডেটা পয়েন্ট তাঁদের কাছে আছে। সেইমতো অন্যান্য পলটিকাল পার্টিগুলোর  সঙ্গে তাদের দর কষাকষি হয়েছিল। বিগ ডেটার ওপর কন্ট্রোলের  সাহায্যে প্রায় সমস্ত মানুষের ওপর দখলদারি করা যায়। মানে, তার জীবনযাপনের ওপর প্রভাব বিস্তার করে  তাকে নিজের নিয়ন্ত্রণে চালানো যায়। বলা যেতে পারে এটা সেই চাবিকাঠি!

--বুঝলাম না।

--তুই একজন ভোটার। জুকেরবার্গের টিম জেনে বসে আছে তুই বামপন্থী না ঘামপন্থী। তোদের বিধানসভা ক্ষেত্রে কত পার্সেন্ট মানুষ বামপন্থী বা কত পার্সেন্ট মানুষ ঘামপন্থী এ তথ্য যে পার্টি আগাম জেনে যাবে সে পার্টি সেরকম ভোট প্রচার বা প্রতিশ্রুতি বা স্ট্রাটেজি ঠিক করে নেবে। আগে তো পাড়ার ক্যাডারদের অনুমানের ওপর ভরসা করেই স্ট্রাটেজি ঠিক করতে হোত। জুকেরবার্গের  ডেটা পলিটিক্যাল পার্টিগুলোর কাছে  মোর অথেনটিক!

--হুঁ! তোর কথার যুক্তি আছে বলে মনে হচ্ছে আমার। চোখের আড়ালে দুনিয়াটা একটু একটু করে পাল্টে যাচ্ছে কিন্তু তবু তোর কথা ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না।

--বেশ! তোকে আর একটা ইনফরমেশন দিই। আমি তোর কলিগ, তুই আমাকে হাড়ে হাড়ে চিনিস, আমিও তোকে লোমে লোমে চিনি।

--শালা! ফাজলামির স্বভাব তোর যাবে না নাকি! হচ্ছে একটা সিরিয়াস কথা --

--শোন না! তুই বা আমি দুজনে দুজনাকে যতটা চিনি বা না চিনি আশিখানা লাইক পেলে কোনো ইউজার তোকে আমার চাইতে আরো ভালোভাবে চিনে নেবে। হোল? তোকে আমাকে আমাদের মা -বাবার চাইতে বেশি কেউ চেনে না, তাই তো?

--হ্যাঁ! তা তো বটেই!

--উঁহু! দেড়শোখানা লাইক পেলেই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, যাকে এখন 'এ আই ' শর্ট ফর্মেই চেনে সবাই সেই 'এ আই ' যে কোনো মানুষকে তার মা -বাবার চাইতে আরো ভালোভাবে জানতে পারে। হ্যাঁ! মাত্র দেড়শো খানা লাইক পেলেই!

--কি ডেঞ্জারাস!

--আরও আছে! মা-বাবার চাইতেও কোনো মানুষকে বেশি চেনে তার স্বামী বা স্ত্রী। তাই তো?সেই মানুষটা কি করতে পারে বা না পারে সেটা তিনশোটা লাইক পেলেই  এ আই স্বামী বা স্ত্রীর চাইতে  আরো ভালোভাবে বলে দিতে পারবে!

--ঠিক আছে! এটা নিয়ে পরে ভাববো। আমি এখন কিছু করতে বা না করতে চাইছি না। আমার বিচি মাথায় উঠে গেছে এই ভেবে যে আমার যা কিছু সঞ্চয় সেগুলি গোপন থাকবে নাকি প্যাগাসাস বা হাগাশাসের মতন কোনো স্পাইওয়ার ঢুকিয়ে এ টি এমের পিন বা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের পাসওয়ার্ড --

এবার গলার তেজ কমিয়ে তুফান বলে, "জানি না রে! তোকে ঘাবড়ে দিতে চাইছি না। তবে অনলাইন ট্রানজাকশনের সময় ফাইনাল স্টেজে সিভিভি নিম্বরটা লিখতে হয় তো?

--হ্যাঁ! তাই তো!

-- কোনো একবার ওই সিভিভি নম্বর টা ভুল লিখে দেখবি। সঙ্গে সঙ্গে ওই ট্রাঞ্জেকশনটি ডিক্লাইন মানে নাকচ কিরে দিচ্ছে মেশিন। তার মানেটা কি? তোর এ টি এম কার্ড নাম্বার তো বটেই সিভিভি কত সেটাও ডেটা বেসে আছে। তোর -আমার পিন নম্বর কি নেই?

আমার কণ্ঠস্বরে হাহাকার ফুটে ওঠে," রাতারাতি পথের ভিখিরি হয়ে যাবো না কি রে!"

--তাই বলি মাত্র একটা একাউন্টে যাবতীয় টাকা রেখে দিস না। ভাগ ভাগ করে পাঁচটা ব্যাংকে-- --তাতেও কি নিশ্চিন্তি আছে নাকি রে! ক 'দিন আগেই সরকার মনে করিয়ে দিয়েছে ব্যাংকে যত কোটি টাকাই থাকুক তোমার, মাত্র পাঁচ লক্ষ টাকার গ্যারান্টি সেই ব্যাংকটি নেবে। তারপর তুমি জপমালা ঘোরাও! আমাদের কি হয়েছে জানিস?  সারা গায়ে দাদ, মলমটা লাগাবো কোনখানে?শালা!

তুফান বললো, "হুঁ! গ্লোবাল ইকোনমির নাম করে আমাদের এল আই সি, ব্যাঙ্কগুলোর পোঁদের কাপড় খুলে বারান্দায় উপুড় করে শোয়ানো হয়েছে, এখন যে কেউ এসে --", রাগের ঝোকে হয়তো কি বলে ফেলতো তুফান, আমি ওর পেটে খোঁচা মারতে ও টের পেল, অফিসের ক্যান্টিনে বা পাড়ার আড্ডায় নয়, নিজের বসার ঘরেই বসে আছে ও। চুপ করে গেল।

আমার বৌয়ের হাতের মালা বোধহয় শুকিয়ে এল! কপালে চারখানা ভাঁজ নিয়ে আমি চললাম আমার কুড়িতম বিবাহবার্ষিকী উদযাপনে!

(৩)

রাতে খেতে বসে লিপি বলল, " তোমার বাবা ফোন করেছিল।" শ্বশুর, শাশুড়ি সম্পর্কে বলতে গিয়ে আমরা উভয়েই 'তোমার ' সর্বনাম টি ব্যবহার  করি।রুটি ছিঁড়তে ছিঁড়তে  পরবর্তী  বাক্যটি শোনার জন্যে আমি লিপির দিকে তাকাই। "ফোন না নিয়ে বেরিয়ে যাও কেন?” কি দুশ্চিন্তার মধ্যে যে গেছি  এবং রয়েছিওটা যদি বলি, ও এখন কাঁদতে বসবে। ন্যাংটো হয়ে যে বেরোইনি, এই ঢের!

--কি বলল? ওরা সুস্থ আছে তো?

--সে আছে এখনও। তোমার বাবার ওই রক্ত তরল করার ট্যাবলেটটা -- ওই কি স্ট্যাট যেন --

-- নোভাস্ট্যাট।

--হ্যাঁ! সেটাই। আর চারদিনের মতন আছে। এই খবরটি দেবার জন্যেই ফোন।

--কেন? দেবুর দোকান থেকেই তো মাসকাবারি ওষুধ কেনা হয়। মাস শেষ হতে এখনও ষোল দিন বাকি। ষোল - সতেরোটা ট্যাবলেট থাকার কথা।

--একটা পাতা মানে, স্ট্রিপ হারিয়েছে।

--অ! কি আর করা যাবে! দেবুর দোকানে গিয়ে কিনে নিলেই তো পারে। বলেছ?

--বলেছি। দেবুর দোকান সাতদিন ধরে বন্ধ। ওর করোনা হয়েছে।

--এই রে! আমাদের গাঁয়েও করোনা ঢুকে পড়ল?

--তোমাদের গাঁয়ের লোকেরা দেবুর বাবাকে শাসিয়ে এসেছে - এখন ওরা কেউই যেন একমাস বাড়ির বাইরে না বেরোয়!

--অ! কি আর করা যাবে! গাঁয়ের লোকেরা কেউ না কেউ তো বাঁকুড়া শহরে যাওয়ার আসা করেই। তাদেরই কাউকেনা কাউকে ধরে দুমাসের ওষুধ কিনে আনলেই Only। আজ রাত হয়ে গেছে। কাল সকালে ফোন করে বলে দিচ্ছি।

--আমি বলেছি সে কথা। প্রেসক্রিপশন আর ট্যাবলেটের স্ট্রিপটি উনি কোথায় রেখেছেন ভুলে গেছেন। ঠ্যালা সামলাও! এই জন্যেই বলেছিলাম, লোকাল ডাক্তার দেখাও। তা -না! স্পেশালিস্ট দেখাতে হবে! আদিখ্যেতা করে এতটা রাস্তা উজিয়ে নিয়ে এলে বড় ডাক্তার দেখাতে! হুঁ!

লিপি আমার বাবা - মাকে দুচোখে দেখতে পারে না। বিয়ের পর প্রথম প্রথম না হয় ওর শাঁখা সিঁদুর না পরা বা শাড়ি না পরে চুড়িদার, নাইটি পরে থাকা বা হারমোনিয়াম নিয়ে বসাতে আপত্তি করেছিল, তা বলে আজ কুড়ি বছর পরেও! আমার আর সহ্য হয় না, বলি, "তাতে তোমার কি অসুবিধে হয়েছে? দু রাতের বেশি তো বাবাকে রাখিনি এখানে।"

--ঠেস মেরে কথা বলার চেষ্টা করো না। তোমার বাবা -মার এখানে থাকা না থাকা নিয়ে আমার যেমন কোনো ইন্টারেস্ট নেই তেমনি কোনো অবজেকশনও নেই। খালি আমার প্রাইভেট স্পেসে আমি কাউকে বাকি গলাতে দিই না। ওখানের আশেপাশের ডাক্তার দেখালে কি হোত, প্রেসক্রিপশন হারিয়ে ফেললেও সেই লোকাল ডাক্তার  তোমার বাবাকে দেখলেই মনে করে বলতে পারতেন, কি কি ওষুধ তিনি প্রেসাক্রাইব করেছিলেন। যাক! তোমাকে সাজেশন দিতে যাওয়াই আমার ভুল হয়েছিল। মাপ করো!

পুত্র গম্ভীর মুখেই খাচ্ছিল, বলল, "বাবা! সেই ছোটবেলায় তোমাদের বাড়ি গেসলাম। মনে নেই কিছু, তোমাদের নিয়ারেস্ট টাউন তো বাঁকুড়া, না?"

--হ্যাঁ!

--বাঁকুড়া থেকে তোমাদের গ্রামে যেতে কতক্ষণ সময় লাগে?

--বাস জার্নি তো কমবেশি এক ঘন্টার মতো। তবে স্ট্যান্ডে বাস আসবে, ছাড়বে, প্রতি পাঁচ মিনিট চলার পর প্রত্যেক স্টপেজে পাঁচ মিনিট করে দাঁড়াবে -হরিবল!'দু আড়াই ঘন্টা লেগে যায়!

হুঁ! রাফলি পঞ্চাশ কিমি রাস্তা, বুঝলে?

-- হ্যাঁ! ঐরকমই। গুগল ম্যাপে দেখে নে না!

বলেই আমার মনে হল, এই রে! ওকেও ডেটা শিকারীদের খপ্পরে পড়বার পরামর্শ দিয়ে ফেললাম! অবশ্য ও তো ফেসবুক, হোয়াটস আপ খোলেই! আটকানো যায় কি!

আমার এই ভাবনার মাঝে ও কিছু হিসাব করছিল মনে হল, বলল, "হ্যাঁ! উইদিন টু ডেজ ম্যাক্সিমাম থ্রি ডেজের  ভেতরে তোমাদের বাড়িতে মেডিসিন পৌঁছে যাবে। থ্রি ডেজ আর এনাফ ফর ডেলিভারি। নট অনলি দ্যাট, মাচ লেসার প্রাইসে মেডিসিন ডেলিভারি দিয়ে দেবে।

--কে দেবে?

--এমাজনের একটা এপ আছে, এমাজন ফার্মেসি সার্ভিস লিখে সার্চ কর। খেয়ে উঠে অনলাইনে অর্ডারটা দিয়ে দাও। বাড়িতে ডেলিভারি দেবে। আমি দেখেছি।

লিপির গলায় নিশ্চিন্তির সুর," তাহলে তো সমস্যা মিটেই গেল! তোমাদের গ্রামেও যখন করোনা ঢুকে পড়েছে ওখানে যাওয়াটা তো ভীষণ রিস্কি! গাঁয়ের লোকেরা তো সোশ্যাল ডিস্টেন্স কি জিনিস বোঝেই না! তবে ভাগ্যিস এমাজন আছে! প্রবলেম তো সলভড! "আমি বাঁ হাত দিয়ে মোবাইল খুলি। লিপি বলে, "খেয়েই নাও না! চিকেন ললিপপ টা ডিলিশাস! আয়েশ করে খাও তো আগে!"

রাতে আর জাগাইনি। সকালে উঠেই বাবাকে ফোন, "ব্লাডথিনার ট্যাবলেট টা হারিয়েছো তো?"

--আঁ?

--আরে ঐ রক্ত তরল করার ওষুধটা!

--কোথায় যে গেল! এদিকে প্রেসাক্রিপশনটাও! মনে হচ্ছে আবার না তোর ওখানে ডাক্তার দেখাতে ছুটতে হয়! শরীরটাও তেমন জুতের নয়, এদিকে তোর মাও আর দুর্গাপুর যেতে চাইছে না!

এইরে! বাবা বোধহয় আবার আমার কাছে আসবার একটা প্ল্যান ফেঁদেছে! ট্যাবলেট বা প্রেসক্রিপশন কি সত্যি সত্যি হারায়নি? আমি সাত তাড়াতাড়ি বলি, "ঠিক আছে! ঘাবড়িও না। প্রেসক্রিপশনের ফটো আমি মোবাইলে তুলে রেখেছিলাম। কাল প্রিন্ট করিয়ে ক্যুরিয়ারে পাঠিয়ে দিচ্ছি।

--ওষুধগুলো....

--চিন্তা করতে হবে না। তিন দিনের মধ্যে ওষুধ বাড়িতে পৌঁছে যাবে। অনলাইনে দু মাসের ওষুধ কিনে দিচ্ছি।

--দেবুর দোকান তো বন্ধ! কাকে বাঁকুড়া যেতে বলবো! বাসটাস তো বন্ধ!

--বললাম তো! ওষুধ বাড়িতে পৌঁছে হবে পরশু।

--কাউকে দোকানে পাঠালাম না, তবু ঠিকঠাক ওষুধগুলো পেয়ে যাবো?

হুঁ হুঁ! বাবা! কোনো কিছুই আর হাতের নাগালের বাইরে নেই গো! জামাকাপড় বলো জামাকাপড়, মুদিখানা এমনকি সবজিও তোমার রান্নাঘরে পৌঁছে যাবে! কি চাই বলো না? কাঁচা মাছ বলো কাঁচা মাছ, নয়তো মাছ মাংসের ঝোল। কি চাই বলো, বাড়িতে বসেই সব পাবে! কোনো কিছুই আর হাতের নাগালের বাইরে নেই বাবা!

--হুঁ! কথাটা আজ কদিন এখানে সেখানে শুনছি বটে! তোকে জিজ্ঞেস করবো করবো করে করে করা হয় নি- -রেললাইন, টেলিফোনের লাইন জানি, এই অনলাইনটা কি জিনিস রে?

আমি ফাঁপরে পড়ে গেলাম। বিষয়টা কিভাবে বোঝাই! বাধ্য হয়েই বলি, “অতসব তোমাকে বুঝতে হয় না,- ইয়ে -ধরো  একটা দামি মোবাইলে  কানেকশন অন করে রাখা -ওরকমই।

--অ! তাহলেই পিওন এসে আমি যা চাই দিয়ে যাবে?

--তাই ই তো! কি চাও আগে মোবাইলকে অর্ডার দিতে হবে। যাকগে, আমি যখন গাঁয়ে যাবো তোমাকে বুঝিয়ে দেবো। আপাতত শোন!দিন দুয়েক  বাদে একজন লোক তোমার হাতে ওষুধ গুলো দিতে যাবে। দু মাসের ওষুধ আছে, গুছিয়ে রাখবে।

--অ! পিওন আসবে! তবু ভালো। তাহলে একটা কাজ করবি?

-- কি?

--তুই তো নিজে থেকে রুমাল কাচতে দিতিস না, তোর মায়ের চেঁচামেচিতে কখনও প্যান্টের পকেট থেকে তো কখনও বইয়ের ব্যাগ থেকে সেই আকাচা রুমাল বেরোতো।

হুঁ! মনে পড়ল, তবে হঠাৎ করে এ প্রসঙ্গ কেন এল বুঝতে পারলাম না!ক্ষণবিরতির  পর বাবা বলল, "এখনও কি সে অভ্যাস আছে? আছে বোধহয়। ডেলি কাচতে দেওয়ার অভ্যাস তোর হয়েছে?"

নাঃ! বাবার ভীমরতি ধরেছে মনে হচ্ছে! সামান্য বিরক্তির সঙ্গেই বলি, "ডেলি কাচতে দেওয়ার কি দরকার? আমি ঘামি কই?  এ সি গাড়িতে অফিস যাই, আসি। অফিসেও সেন্ট্রাল এ সি, লাঞ্চের পরে ন্যাপকিনে মুখ মুছি, ওই সারাদিনে একবার হয়তো মুখে বুলাই রুমালটা। হঠাৎ? রুমালের কথা তুললে?

--একটা প্লাস্টিক প্যাকেটে ভরে তোর ওই আকাচা রুমালটা ওষুধের সঙ্গে পাঠিয়ে দিবি?

--মানে? কি সব বলছো?

--ওই পুরনো রুমালটাতে তোর গায়ের গন্ধটা তো পেতাম! কতদিন শুঁকিনি!

--আঁ? কি বললে? হ্যালো? হ্যালো?

লাইনের গন্ডগোলই হবে, ওপাশ থেকে বাবা কি বলল শোনা গেল না!

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন