বুধবার, ১৭ মে, ২০২৩

মৌসুমী মুখোপাধ্যায়

 

যুদ্ধ ধর্ষণ আন্তর্জাতিক আইন ও পিতৃতান্ত্রিক প্যাঁচপয়জার




(২)

১৯৯১ থেকে ২০০২ সালের মধ্যে সংঘটিত সিয়েরা লিয়নের গৃহযুদ্ধের সময় ধর্ষণ, যৌনদাসত্ব এবং জোরপুর্বক বিবাহ ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। বিদ্রোহী আর ইউ এফ সদস্যরা বহুসংখ্যক নারীকে অপহরণ করে যৌনদাসী কিম্বা যোদ্ধা হিসেবে ব্যবহার করে। এরা বেসামরিক নারীদেরও ধর্ষণ করত। এই দলের নারী সদস্যরা এখানকার পুরুষ সদস্যদের যৌনসেবা দিতে বাধ্য থাকত। গণধর্ষণ ও একক ধর্ষণ ছিল দৈনন্দিন ঘটনা। পি এইচ আর এর প্রতিবেদন অনুসারে এই যুদ্ধের সময় ধর্ষণের  ৯৩%  আর ইউ এফ সদস্যদের দ্বারা সংঘটিত হয়েছিল। এক হিসেব অনুযায়ী সিয়েরা লিয়নের গৃহযুদ্ধের সময় ২১৫০০০ থেকে ২৫৭০০০ নারী ধর্ষিত হয়েছিল। যদিও রাষ্ট্রসঙ্ঘের  রিপোর্ট বলছে ৬০০০০ এর বেশি নারী সিয়েরা লিয়ন যুদ্ধে ধর্ষিত হয়েছিল এবং ৪০০০০ এর বেশি নারী লিবেরিয়া (১৯৮৯ – ২০০৩), ৬০০০০ নারী সাবেক যুগোস্লাভিয়া (১৯৯২-১৯৯৫) এবং ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত ডেমোক্রাটিক রিপাব্লিক কঙ্গোতে কম পক্ষে ২০০০০০ নারী ধর্ষিত হয়েছিল। এমন কি রাষ্ট্রসঙ্ঘের রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, যুদ্ধ শেষ হবার পরেও যৌনসহিংস্রতার প্রভাব চলছিল, অবাঞ্ছিত গর্ভধারণ, যৌনতাবাহিত সংক্রমণ  এবং কলঙ্ক ইত্যাদি সব কিছু নিয়ে। রাষ্ট্রসংঘের রিপোর্ট থেকে আরও জানা যায়, যুদ্ধের পরেও জীবিতদের চাহিদা পূরণ—স্বাস্থ্যসেবা, এইচ আই ভি চিকিৎসা, মনস্তাত্ত্বিক সাহায্য, অর্থনৈতিক সাহায্য এবং আইনী প্রতিকার – এই সবের জন্য প্রচুর সম্পদের দরকার যেটা বেশির ভাগ সংঘর্ষ-উত্তর দেশগুলোর থাকে না।

ধর্ষণকে যুদ্ধের সময় একটা অনিবার্য কৌশল হিসেবে ধরা হয় যে কোন দেশের পক্ষেই। ১৯৯৮ সালের রাষ্ট্রসংঘের যৌন সহিংসতা এবং সশস্ত্র সংঘর্ষ বিষয়ক রিপোর্ট বলছে যে ঐতিহাসিকভাবে সেনারা ধর্ষণকে যুদ্ধের একটা বৈধ লুঠের সম্পদ হিসেবে দেখে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুদ্ধের সব পক্ষই গণধর্ষণ ও একক ধর্ষণের জন্যও অভিযুক্ত হয়েছিল। তা সত্বেও সন্দেহভাজন যুদ্ধপরাধের বিচারের জন্য বিজয়ী মিত্র দেশগুলোর দ্বারা গঠিত দুটি আদালতের কোনটিই স্বীকার করেনি যৌন সহিংসতা অপরাধ। সাবেক যুগোস্লাভিয়ায় বিপুল পরিমানে নারীরা ধর্ষণের শিকার হলেও তা ১৯৯২ সালের আগে রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের নজরে আসেনি। ১৯৯২ সালের ১৮ই ডিসেম্বর তারা ঘোষণা করে যে ‘ব্যাপক, সংগঠিত এবং পদ্ধতিগত ভাবে নারীদের আটক ও ধর্ষণ, বসনিয়া ও হরজগোভিনার বিশেষ করে মুসলিম নারীদের ধর্ষণ করাটা  একটা আন্তর্জাতিক অপরাধ হিসেবে স্বীকৃত হওয়া অত্যন্ত আবশ্যক। পরবর্তীকালে সাবেক যুগোস্লাভিয়ার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইন (আই সি টি ওয়াই ১৯৯৩) ধর্ষণকে মানবতার বিরুদ্ধে একটা অপরাধ হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করে অন্যান্য অপরাধ যেমন নির্যাতন নির্মূলনের পাশাপাশি বিশেষত যখন সেটা সশস্ত্র সংঘর্ষে বা বেসামরিক জনগণের ওপর ঘটে। ২০০১ সালে আই সি টি ওয়াই  আন্তর্জাতিক বিচারালয় হিসেবে একজনকে খুঁজে বের করে, যাকে তারা ধর্ষণের জন্য মানবতার বিরুদ্ধে দোষী সাব্যস্ত করতে সক্ষম হয়। তাছাড়াও উপরোক্ত  বিচারালয় দাসত্বের সংজ্ঞাকেও সম্প্রসারিত করে মানবতার বিরুদ্ধে চরম অপরাধ বলে যৌন দাসত্বকে অন্তর্ভুক্ত করার মধ্য দিয়ে। রুয়ান্ডার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালও ( আই সি টি আর ১৯৯৪) ধর্ষণকে একটা যুদ্ধ অপরাধ এবং মানবতার বিরুদ্ধে চরম অপরাধ বলে ঘোষণা করে।  ১৯৯৮ সালেই প্রথম আন্তর্জাতিক বিচারালয় গণহত্যার অপরাধ হিসেবে ধর্ষণের দায়ে একজন অভিযুক্ত ব্যক্তিকে পায়। তার নাম ছিল জঁ পল আকায়েসু, একজন প্রাক্তন মেয়রবিচারে তার বিরুদ্ধে বলা হয় যে সে এতগুলো যৌন হয়রানি ও ধর্ষণ করেছে যা কিনা গণহত্যার সামিল। শুধু তাই নয়, অপরাধগুলো সংঘটিত করা হয়েছিল তুতসি জাতি গোষ্ঠীকে আংশিক বা সম্পুর্ণ রূপে ধংস করে ফেলার উদ্দেশে। আন্তর্জাতিক বিচারালয়ের রোমান আইন ২০০২ সালের জুলাই থেকে বলবত হয়। এখানে বলা হয় ধর্ষণ, যৌন দাসত্ব, জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তি, জোরপূর্বক গর্ভধারণ, বলপুর্বক নির্বীজকরণ অথবা যে কোন ধরনের যৌন সহিংসতা ঘটানো বিস্তৃতভাবে ও পদ্ধতিগত ভাবে মানবতার বিরুদ্ধে এক চরম অপরাধ। বারবার ধর্ষণের বিরুদ্ধে আরেস্ট ওয়ারেন্টও জারি করা বা বের করা হয়েছে উপরোক্ত বিচারালয় দ্বারা।

বস্তুত, ব্রাউন মিলারের মতে, যুদ্ধের সময় শুধু নারীর কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহের উদ্দ্যেশ্যেই নয়, সেসময় পুরুষদের অনুপস্থিতিতে যে কোন যুদ্ধের সময় সংসার ও সমাজের হাল ধরে নারী তাই সেই সময় নাগরিক সমাজের কর্ণধার হয়ে ওঠে নারী ধর্ষণ বা ধর্ষণের ভয় দেখিয়ে যুদ্ধের সময় সিভিল সমাজের প্রতিনিধিদের গৃহছাড়া করতে বাধ্য করে শত্রুপক্ষের লোকেরা এমনকি নারীর গর্ভে সন্তান দিয়ে, নারীকে অপবিত্র করে সমাজচ্যুত করে আসলে সমাজের কাঠামো ভেঙে ফেলার রাজনৈতিক লক্ষেই এই  ধর্ষণ ক্ষমতার ব্যবহার আসলে পিতৃতান্ত্রিক ক্ষমতার একটা ঊল্টো প্রয়োগ নারীবাদীদের মতে কেবল ধর্ষণই একটি  গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন ও অপরাধ হিসেবে চিন্থিত হওয়ার যোগ্য(রোন্ডা কোপলান ১৯৯৮) বেশির ভাগ নারীবাদীরাই মনে করে, ধর্ষণ যখন গণহত্যার হাতিয়ার বলে চিন্থিত হয়, একমাত্র তখনই  যুদ্ধপরাধ আইন অনুসারে ধর্ষণ যুদ্ধের সময়কার অপরাধ হিসেবে গুরুত্ব পায় এক্ষেত্রে শুধু ধর্ষণ গুরুত্ব পায় না, আদালতে বিচার চাইতে হলে প্রমাণ করতে হবে যে এই ধর্ষণের ঘটনাটি  আরও বড় আকারের কোনও নির্যাতনের সঙ্গে যুক্ত, যে নির্যাতনের ভিত্তি জাতীয়তা, ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী কিম্বা কোনও বিশেষ ধরণের রাজনীতি নারীবাদীরা এখানে খুব সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন তোলেন যে জাতি, ধর্ম ও বর্ণ ভিত্তিক নির্যাতনের স্বীকৃতি না  থাকলেই তবে কেন সামাজিক লিঙ্গ বা নারীত্বের জন্য সংঘটিত নির্যাতনের ধরণকে নির্যাতন হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া যাবে না?

কেউ কেউ মনে করেন ধর্ষণের ঘটানোর মাধ্যমে যুদ্ধক্ষেত্রের লড়াই জায়গা করে নেয় নারীর শরীরে তাদের শরীরই যেন হয়ে ওঠে বিজয়ী ও পরাজিত গোষ্ঠীর পুরুষদের লড়াইয়ের জায়গা আমার মতে এই ভাবনার মধ্যেও কোথাও একটা পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিতে গোটা বিষয়টাকে দেখার একটা প্রবণতা লুকিয়ে আছে, আছে অতিরঞ্জনের ত্রুটিও তবে যেহেতু পিতৃতন্ত্রে পুরুষরাই নারীদের রক্ষা করার একটা সার্বিক ইজারা নিয়ে থাকে, তাই সেই কাজে ব্যর্থ হয়ে, পরাজিত হয়ে হার স্বীকার করে পরাজিত দলের পুরুষরা আর পরাজিত পুরুষদের মহিলাদের শরীরের ওপর কর্তৃত্ব কায়েম করে সেখানে বিজয় ঘোষণা করে বিজয়ী দলের পুরুষরা এটা যেন পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধেই, আমার মতে, পিতৃতন্ত্রের নিজস্ব দ্বৈরথ যুদ্ধে কামানদাগা ব্রাউন মিলারের মতে তাই এই যৌন হিংসার প্রত্যক্ষ লক্ষ্য ধর্ষিত মহিলারা হলেও পরোক্ষ লক্ষ্যে থাকে তাদের সমাজের পুরুষরা মহিলাদের লড়াইয়ে হেরে যাওয়া পুরুষদের কাছে ধর্ষিত এই মহিলারা হয়ে ওঠেন নিজেদের পৌরুষের হারের প্রতীক জাতির সম্মান ফিরিয়ে আনার জন্য এবং পুরুষদের পৌরুষ ফের প্রতিষ্ঠার জন্য এইসব নারীদের প্রত্যাখ্যান  করা সেই সময় জরুরী হয়ে পড়ে এর ফলে ধর্ষিত মহিলাদের সারা জীবন ধরে যে বিদ্রুপ ও লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়, তা ভয়াবহ লিসা শারলাখের মতে এ যেন শত্রুর হাতে একবার ধর্ষিত হবার পর নিজের সমাজের হাতে দ্বিতীয়বার ধর্ষিত হওয়ার বেদনার সামিল

যুদ্ধের সময়, যতই যা কিছু বলা হোক না কেন, মহিলাদের ধর্ষণ আসলে যুদ্ধেরই একটা হাতিয়ার কিন্তু তার আসল ভিত্তি পিতৃতন্ত্র  যা সব সময়ই নারীর শরীর আর মনকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায় সমাজের পুরুষ আধিপত্য কায়েম রাখার জন্যও তাই পিতৃতন্ত্রকে পুরোপুরি নির্মূল করতে না পারলে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করে নারীদের ধর্ষণ আটকানো কোন রকমেই সম্ভব নয় সর্বোপরি ওইসব আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গুলো নিজেরাই এক একটা পিতৃতন্ত্রের শেকড়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত সেখানে যুদ্ধকালে নারীর ধর্ষণ বা পরবর্তীকালে  তার মীমাংসা সবটাই পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের নিছক এক প্রতিফলন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের চৌহদ্দিটা মনে করা হয় পুরুষদের একান্ত নিজেদের ক্ষেত্র, যেখানে ক্ষমতা আর আধিপত্যবাদ বার বার করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠে অনর্থক যুদ্ধকে ডেকে আনে নারী ক্ষমতায়ণ যথার্থ ভাবে প্রতিষ্ঠিত হলে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের রসায়ন নতুন পথে চালিত হয়ে নতুন দিশা দেবে যেটা কিনা এই পৃথিবীতে অনবরত কোন না কোন যুদ্ধ লেগে থাকার অপ্রয়োজনীয়তাকে সর্বাংশে প্রতিষ্ঠিত করে মানবসভ্যতাকে বিশ্বআত্মীয়তার এক নতুন দিশায় দীক্ষিত করবে বলে আমার মনে হয়

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন