সমকালীন ছোটগল্প |
হারানো হীরের টুকরো
(পাথর হয়ে যাওয়া দুটো হীরেরটুকরোর
গল্প)
শুনেছি টাটানগর রেল ব্রীজটা এখন অনেকখানি পাল্টে গেছে। তবে সেটা ম্যাসিভ রিনোভেশনের জন্য। তবে তার মুল চরিত্রগুলি এখনও একই রকম আছে। টাটানগর রেল স্টেশনের গা ঘেঁষে এই রোড ব্রীজটা একঝাঁক রেল লাইনের উপর দিয়ে গেছে। গেছে বার্মামাইন্স হয়ে গোলমুড়ি ছুঁয়ে সাকচির দিকে। আমাদের রেলওয়ে মিশ্রিত মাধ্যমিক স্কুলটা ছিলো এই ব্রীজের ঠিক ওপারে। সিনেমা হল স্টার টকিজের পাশে। আমাদের রেল কলোনি থেকে সেটা অনেকটাই দূরে। আমরা টাটানগর রেল কলোনির ছেলেমেয়েরা রোজ স্কুলে যেতাম হেঁটে হেঁটে এই লম্বা ব্রীজটা পার করে। পথচারিদের জন্য ব্রীজের একপাশে আলাদা হেঁটে যাওয়ার ব্যবস্থা ছিলো। হাঁটাপথ আর গাড়িঘোড়া যাওয়ার পথের মাঝে লোহার চওড়া দেওয়াল দেওয়া ছিলো। হাঁটা পথের অন্য পাশটাতেও টানা বেরিয়ার দেওয়া ছিলো। তবে সেটা লোহার পাইপ আর টিনের সিট দিয়ে তৈরি। সেখান থেকে নিচের রেললাইন, রেলগাড়ি বা একটু দূরের রেল স্টেশন সবই চমৎকার দেখা যেত। আমরা সে সব দেখতে দেখতে স্কুলে যাওয়া আসা করতাম। যখন ইলেকট্রিক ট্রেন চলা শুরু হলো তখন সেই বেরিয়ারের জায়গায় জায়গায় মজবুত তারের জাল দেওয়া উঁচু উঁচু ফ্রেম লাগিয়ে দেওয়া হলো। যাতে সেখান দিয়ে কেউ ঝুঁকতে না পারে। তাদের ঠিক নিচ দিয়েই ইলেকট্রিক ট্রেনের হাই পাওয়ারের তার গেছে। ঝুঁকলে বিপদ হতে পারে তাই সে ব্যবস্থা। আমরা বিশ্বাস করতাম ঐ তারের ইলেকট্রিকের পাওয়ার মানুষদের তার দিকে টেনে নিতে পারে।
আমাদের সবচেয়ে দারুন লাগতো যখন নিচ দিয়ে ট্রেন যেত। প্যাসেন্জার ট্রেন, মালগাড়ি আর ট্রলি। সবই যেত। এই ট্রলিগুলো খুব মজার। ছাদ খোলা চারটে চাকার উপরে চৌকো পাটাতন। প্রথমে ঠেলে ঠেলে চালু করতে হয়। তারপর একবার চালু হয়ে গেলে সেটা নিজে নিজেই ছুটতে পারে। এই ট্রলিদের কাজ লাইন মেইনটেনেন্সের লোকজনদের বয়ে নিয়ে যাওয়া। ক্ষতিগ্রস্ত লাইনের মেরামতের জন্য অকুস্থলে মেকানিকদের পৌঁছে দেওয়া। আমরা উপর থেকে দেখতাম। দুজন লোক লাইনের উপর ছুটতে ছুটতে ট্রলি ঠেলছে। কখনো দেখতাম ট্রলি চলা শুরু করলে তারা টুক টুক করে লাফিয়ে তাতে উঠে পড়ছে। ট্রলির মাঝখানে একটা রডের মাথায় পতপত করে লাল পতাকা উড়তো। এই লাইনগুলোতে সবচেয়ে বেশি চলাচল করতো মালগাড়ি। মালগাড়িতে চেপে টাটার কারখানাতে দিনরাত কাঁচামাল আর জ্বালানি আসছে যাচ্ছে। তৈরি হওয়া আয়রন ইনগট, আয়রন সিট, লোহার ছড় চালান যাচ্ছে নানা জায়গায়। সব এই রেলপথে। মালগাড়ি চেপেই তাদের যাওয়া আর আসা।
আমাদের
স্কুল যাওয়ার লম্বা রাস্তাটা এসবের জন্যই খুব আকর্ষণীয় ছিলো। অনেক ছেলেমেয়েই একসাথে
যেতাম। সাধারণত ছেলেদের দল মেয়েদের দল আলাদা আলাদা যেত। একটা দুটো ব্যতিক্রম যে থাকত
না, তা নয়। যেমন গীতা। সে আমার সাথে সাথেই যেত আসতো। আমি কতবার বলেছি-
-
ঐ তো মেয়েরা যাচ্ছে। যা না ওদের সাথে!
ও
যেত না। বলতো-
-
মা বলে দিয়েছে সবসময় তোর সাথে সাথে থাকতে।
এক ক্লাসেই পড়তাম দুজনে। থাকতামও রেল কলোনির প্রায় পাশাপাশি কোয়ার্টারে। প্রায় বলছি, কারণ সাত কোয়ার্টারের ব্লকে আমাদের কোয়ার্টারের নাম্বার সাত, গীতাদের চার। মাঝে আছে দুটো কোয়ার্টারের ব্যবধান।
স্কুল যাওয়ার সময় আগে ভাগে রেডি হয়ে গীতা আমাদের বাড়িতে চলে আসতো। মা ঘি মাখানো গরম রুটির ভেতরে চিনি দিয়ে পাকিয়ে দিত। আমার সাথে সাথে গীতাকেও দিত। নিজেদের বাড়ি থেকে খেয়ে আসলেও সেই পাকানো রুটি গীতা খুশি হয়ে খেয়ে নিত। তারপর স্কুলে যাওয়া। সে যাত্রার শুরুটা দুজনের। পরে পরে আরো ছেলেমেয়ে এসে জুটতে জুটতে অনেক বড়ো দল হয়ে যেত। ফেরার পথে ঠিক উল্টোটা হতো। বড়ো দল কমতে কমতে আমাদের কোয়ার্টারের সামনে এসে যখন পৌঁছাতাম, তখন কেবল আমরা দুজন। আমি আর গীতা।
একবার হঠাৎ রিপেয়ারিং-এর জন্য ঐ ব্রীজটা বন্ধ করে দেওয়া হলো। গাড়িঘোড়া বিষ্টুপুরের ঘুরপথ দিয়ে যাবে। কিন্তু পথচারিদের কী হবে? বিশেষ করে আমাদের মতো স্কুল ছাত্র-ছাত্রীদের? তাদের স্কুলে যাওয়ার কী হবে? শুরুতে দুদিন স্কুল ছুটি দেওয়া হলো। কিন্তু জানা গেলো ব্রীজের ড্যামেজটা ছোটোখাটো নয়, অনেকখানি। তাই রিপেয়ার করতে বেশ কিছু দিন সময় লাগবে। এতো দিন তো স্কুল বন্ধ রাখা যায় না! তাই একটা অতি বিপজ্জনক ব্যবস্থা করা হলো। রেল কলোনির ছাত্র-ছাত্রীরা রেললাইন পেরিয়ে স্কুলে যাওয়া আসা করবে। যতদিন ব্রীজ সারাই হয়ে পদযাত্রীদের জন্য খুলে দেওয়া না হয়, এই ব্যবস্থাই চলবে। ছেলেমেয়েদের নিরাপত্তার জন্য ঠিক করা হলো সেই সময় রেল লাইনে পাহাড়া দেওয়ার লোকজন থাকবে। তারা ছেলেমেয়েদের "কড়ি নিগরানি' দিয়ে রেললাইন পারাপার করিয়ে দেবে। ঘোষ কাকিমা অর্থাৎ গীতার মা এসে বলে গেলেন, যতই রেলের লোক থাকুক তোদের খুব সাবধানে রেললাইন পার করতে হবে। আর গীতাকে বললেন, তুই ওর হাত ধরে থাকবি। কখনো ওর হাত ছাড়বি না।
ট্রেন
আসছে কিনা ভালো করে দেখে নিয়ে তবে লাইন পেরোবি।
আমার
মা সাহসী মহিলা। তিনি বললেন-
-
আরে তুমি অতো ভাবছো কেন? ওরা এখন ক্লাস সেভেনে পড়ে। বড়ো হয়ে গেছে। নিজেরাই সাবধানে
যেতে আসতে পারবে। তাছাড়া বলছে তো গার্ড দেবার জন্য লোক থাকবে।
শুরু
হয়ে গেলো আমাদের অন্যরকম স্কুলযাত্রা। এবার আর ওপর থেকে রেলগাড়ি আর রেললাইন দেখতে
দেখতে নয়। বরং রেলগাড়ি আর রেল লাইনের মধ্য দিয়ে। লাইন টপকে টপকে আর ট্রেন এড়িয়ে
এড়িয়ে। লাল ঝান্ডা হাতে কয়েকজন রেলের সুরক্ষা কর্মী থাকতো আমাদের সুরক্ষা আর সাহায্য
প্রদান করার জন্য। মুখে হুইসেল নিয়ে। তারা খুব ছোটোদের আর মেয়েদের প্রতি বিশেষ নজর
দিত। একদিন তেমন একজন গীতাকে হাত ধরে লাইন পার করিয়ে দিতে চাইলো। গীতা ঝটকা মেরে তার
হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলেছিলো-
-
লাগবে না। ওর হাত ধরেছি তো! ওই আমাকে ঠিক পার করে দেবে।
মাসখানেক
আমাদের এই লাইন টপকে স্কুল যাওয়া আসা চলেছিলো।
ঐ লাইন পথে অনেক মালগাড়ি যেমন আসা যাওয়া করতো তেমন কিছু মালগাড়ি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতো। সেরকম কিছু মালগাড়ি পথ আটকে দাঁড়িয়ে থাকলে আমাদের অনেকটা ঘুরে গিয়ে লাইন পেরোতে হতো। সুরক্ষাকর্মীরা কড়া নজর রাখতো যাতে কোনো ছেলেমেয়ে মালগাড়ির তলা দিয়ে গলে লাইন না পেরোয়। তবু কয়েকজন দুরন্ত ছেলে সেই অপকম্মটা করে ফেলতো। কখনো কখনো লাইনে কয়লা চোরদের দেখা যেত। তারা কয়লার মালগাড়ি থেকে কয়লা চুরি করত। আরপিএফের তাড়াও খেত। তাড়া খেয়ে পালাতো আবার ফিরেও আসতো।
একদিনের কথা বলি। সেদিন শনিবার ছিলো। হাফ ছুটির পর দুপুরবেলা স্কুল থেকে ফিরছি। লাইনের উপর এসে দেখি দূরে একটা কয়লার মালগাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। তবে আজ সেখানে কোনো কয়লাচোর নেই। দেখলাম অনেকটা কয়লা নিচে রেল লাইনের পাশে স্তুপাকার হয়ে পড়ে আছে। আর তার উপরে রোদ পড়ে কী যেন ঝলমল করছে। আমদের একটা আদখ্যাঁচড়া জ্ঞান ছিলো। কয়লাখনিতেই হীরে পাওয়া যায়। আমার আর গীতার দুজনেরই মনে হলো ওখানে কয়লা গাদার ওপর ঐ যে ঝলমল করছে, ওটা হীরে। সুতরাং দুজনেই সেদিকে দৌড়ালাম। কাছে গিয়ে দেখি সত্যি সত্যি কয়লার স্তুপের মধ্যে একটা চকচকে সাদাটে পাথরের টুকরো। ঝটপট তুলে নিলাম। কয়লার স্তুপটা নাড়া দিতেই আরো একটা একই রকম সাদা চকচকে পাথর পেয়ে গেলাম। দুজনের জন্য দুটো হীরে হয়ে গেলো। এবার ফেরা উচিত। তাছাড়া প্রহরীদের নজরে পড়ে গেলে বকা খেতে হবে। কিন্তু হীরের লোভ প্রবল লোভ। সহজে তার থেকে মুক্তি পাওয়া যায় না। আমাদের মনে হলো আর একটু দেখা যাক। মালগাড়িটার দরজাটা খোলা ছিলো। সেখান থেকেই কয়লাগুলো নিচে গড়িয়ে পড়েছে। আমরা সেই পথে উঁকি দিয়েই শিউরে উঠলাম। একটা মেয়ে চিত হয়ে শুয়ে আছে। একেবারে উলঙ্গ। চোখ দুটো বোজা। প্রথমেই মনে হলো বেঁচে আছে কি? তার পর হুড়মুড় করে রাশি রাশি প্রশ্ন মন ভরিয়ে দিলো। মেয়েটা ওখানে কয়লার ওপরে ওরকম ন্যাংটো হয়ে শুয়ে আছে কেন? কী হয়েছে ওর? এটা কি খুন?
আমরা
খুব ভয় পেলাম আর উল্টো পায়ে দৌড় লাগালাম। আমাদের ছুটে আসতে দেখে কাজে ঢিলে দেওয়া
প্রহরী আমাদের দেখতে পেলো। আমাদের কাছে এসে খুব ধমকাতে লাগলো-
-
কিঁউ গিয়া থা উধর? তারপর গীতার দিকে তাকিয়ে বলল-
-
তু তো লড়কি হ্যায়। কোই পকড়কে তুঝসে ভি গলত কাম কর দেতা তো? মু কালা কর দেতা তো?
কৌন বচাতা?
ভীত
সন্ত্রস্ত গীতা অনায়াসে আঙ্গুল তুলে আমাকে দেখিয়ে দিয়েছিলো। যেন সবরকম পরিস্থিতি
থেকে ওকে বাঁচাবার সব দায় আমার!
এতো
আতঙ্কের মধ্যে আমার প্রতি গীতার এই ভরসাটা আমাকে অবাক করে দিয়েছিলো। ভালোও লেগেছিলো
খুব।
বাড়ি
ফিরে এসে আমরা হীরে দুটো লুকিয়ে ফেলেছিলাম। গীতা তার হীরেটাও আমাকে দিয়ে দিয়েছিলো।
একেবারের জন্য নয়, রাখার জন্য।
পরদিন স্কুলে যাবার সময় দেখেছিলাম, কয়লাগাড়িটা ওখানে আর নেই। মেয়েটার লাশটা নিশ্চয় আরপিএফ এসে ট্রলিতে করে চাপিয়ে নিয়ে গেছে।
গীতা
আমাকে জিজ্ঞেস করল-
-
তুই কাকিমাকে বলেছিস কিছু?
মাথা
নেড়ে জানালাম-
-
না। বলিনি।
-
আমিও মাকে কিছু বলিনি।
এ
ঘটনা ভুলতে আমাদের অনেক সময় লেগেছিলো। দুঃস্বপ্নের মধ্যে দৃশ্যটা ঘুরে ঘুরে ফিরে ফিরে
আসতো। ঠিক যেমনটা দেখেছিলাম। কালো কয়লার স্তুপের উপর নিরাবরণ দেহ। আর দেখতাম সেই নেংটো
দেহটাই ট্রলিতে চাপিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। লাইন ধরে ছুটে যাচ্ছে ট্রলি। লাল পতাকা
উড়িয়ে। ধড়মড় করে ঘুম ভেঙ্গে যেত।
আমরা
পরে লুকিয়ে লুকিয়ে আমাদের সেই হীরের টুকরো দুটোকে সাবান দিয়ে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার
করে নিয়েছিলাম। ফলে সে দুটো আরো বেশি চকচকে হয়ে গেছিলো। অনেকদিন পর্যন্ত ঐ পাথর দুটো
আমাদের কাছে সযত্নে হীরে হয়েই ছিলো।
তারপর
তো একসময় বড়ো হয়ে গেলাম। অনেক বড়ো। তখন একসময় হীরে দুটো হীরে থেকে মামুলি পাথর
হয়ে গেলো। অগত্যা তাদের ফেলে দেওয়া হলো।
ততদিনে
আমরা আরো জেনে গেছি, সেদিন আমরা ঐ কয়লার গাড়িতে একজন রেপ ভিক্টিমকে দেখেছিলাম। যাকে
ভোগ করে মেরে ফেলা হয়েছিলো। তখনকার ভাষায়। মু কালা করকে মার দিয়া গয়া।
আজ স্মৃতিপথে সেই সময়ে ফিরে যেতেই মনের মধ্যে আবার সেই পাথরের মামুলি টুকরোগুলো নুতন করে হীরে হয়ে উঠলো। আর আবার সেই পুরনো রেপ ভিক্টিমের জন্য মনে নুতন করে ক্লেশ জন্মালো।
আর
তখনই যেন মনে মনে গীতা এসে আমার হাত ধরলো। আর তাতেই মন সান্তনা পেলো। শান্ত হলো।
কথা
ছিলো, আমি কখনো গীতার হাত ছাড়বো না। গীতাও আমার হাত ছাড়বে না। সেটা তার মায়ের আদেশ।
আমাদের
হাত তবে কে ছাড়িয়ে দিলো?
অবশ্যই
সময়।
সত্যিই
সময় বড়ই নিষ্ঠুর!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন