শনিবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০২৩

শ্রাবণী দাশগুপ্ত

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

 

লাল-নীল-পেন্সিল




 

(৩৪)

 

পি-জিতে এসে প্রথম যোষিতা নামে বিহারী মেয়ে শ্রুতির রুমমেট ছিল, প্রায় সমবয়সী। অচেনা কারো সঙ্গে একসাথে থাকা জীবনে প্রথমবার। ছোট্ট ঘরে দু-খানা চৌকি। তার ওপর সে বাড়াবাড়ি রকমের অগোছালো, উদ্ধত, আন্তরিকতাশূন্য রুক্ষ। শ্রুতির আজন্ম চেনাদের চেয়ে অনেক আলাদা। কম্প্যুটার ইঞ্জিনিয়ার, নামী কম্পানিতে সিস্টেম অ্যানালিস্ট। ফিরতে খুব রাত হত, পি-জি-র মালকিন বিনীথা-ম্যাডাম বয়স্ক মহিলা, অসন্তুষ্ট হলেও মুখে বলতেন না। অসহ্য লাগত শ্রুতিরও।

ঘরে ঢুকেই আলো জ্বেলে যোষিতা জামাকাপড় বদলাত, ল্যাপটপ খুলে বসে থাকত আরো কিছুক্ষণ, শেষরাতে মরার মতো ঘুমোত। শ্রুতির ঘুমের ব্যাঘাত হত। সে উঠত সকালে, নিজস্ব কাজকর্ম, অফিস যাওয়ার প্রস্তুতি – তখন সামান্য আওয়াজে যোষিতা বিরক্তি দেখাত। শ্রুতি অভিযোগ করেছিল পি-জি ম্যাডামকে, যে কোনও কারণে তাকে উনি পছন্দ করতেন।

হুম স্টে কুল। ইউ মে শিফট টু মাই নিউ পি-জি অ্যারেঞ্জমেন্ট অর অ্যাডজাস্ট ফর ফিউ উইকস্‌ -- শী উড বী লিভিং ফর ইউ-এস সুন।

অদম্য জিদ ও লড়াইয়ের গল্প আছে যোষিতার সফলতার পেছনে। বিহারের কাঠগোঁড়া ভুঁইহার পরিবারের মেয়ে হায়দরাবাদে চাকরি নিয়ে এসেছিল। একজন বয়ফ্রেন্ড ছিল, লিভ-ইন করত। ব্রেক-আপ হয়ে যাওয়ার পরে পি-জিতে এসে ওঠে। সম্ভবত আরো দু-একজনের সঙ্গে ডেটিং করছে, সেজন্য ফিরতে রাত হয়। যতটা জানেন পি-জি ম্যাডাম বললেন, শুনতে শুনতে অবাক হচ্ছিল শ্রুতি। 

তবে যোষিতা যাওয়ায় সে বাঁচল, একা নিজের মতো করে পেল ঘরখানাকে। অবশ্য সে আর ক-দিন? হপ্তাখানেকের মধ্যে একটি মেয়েকে এন্ট্রি দিলেন বিনীথা ম্যাডাম। দু-কিলোমিটার নতুন একটা পি-জি শুরু করেছেন, তার খরচ তুলতে হচ্ছিল। অদিতি দিল্লীর মেয়ে, পুনেতে চাকরি করছিল। কম্পানি নতুন ব্র্যাঞ্চ অফিস খুলে এখানে পোস্টিং দিয়েছে। ভারী সুন্দর দেখতে, সোনালি-সোনালি গায়ের রঙ অথচ যেন অনুজ্জ্বল, নির্জীব, বিমর্ষ। কথা বলত খুব কম, অতি ধীরে যাতে কারো অসুবিধা না হয়। শ্রুতির ভালো লেগেছিল, বন্ধুত্বের চেষ্টা করেছিল। ভীষণ ভদ্র আর ফর্মাল সে, আলাপ জমে নি। মাস দেড়েক কাটিয়ে হঠাৎই চলে গেল অদিতি। একজন বয়স্ক পঞ্জাবী ভদ্রলোককে পি-জি ম্যাডামের সঙ্গে কথা বলতে দেখেছিল শ্রুতি। যাওয়ার আগের দিন তাদের ট্রিট দিল অদিতি, হালকা করে জড়িয়ে ‘গুডবাই হাগও। পরে বিনীথাম্যাডাম বলেছিলেন,

হার ফাদার হ্যাজ্‌ অ্যারেঞ্জড্‌ হার ম্যারেজ অ্যাণ্ড ফোর্সড্‌ হার টু গো উইদ হিম। ভেরি আনফেয়ার!”

বিদ্যুতের মতো খেলে গিয়েছিল মাথায়, তবে এ-ই কি সে? বাবুল বলতে চায়নি?

অদিতি বিদায় নেওয়ার পরে শ্রুতি অনুরোধ করে পুরো ঘর নিজের জন্য চেয়েছিল। বিনীথাম্যাডাম বেশ গাঁইগুঁই করেও পরে রাজি হয়েছেন। এটা তাঁর বিজনেস, পরের বোর্ডারের চার্জ বাড়ত। শ্রুতি ভেবে রেখেছে এবারে স্যালারি হাইক হলে ছোটো ফ্ল্যাট রেন্টে নেবে।

এই ক-মাসে বাবা বারকয়েক ফোন করেছে মামপিকে, আগ্রহ করে জানতে চেয়েছে। তার মা দু-তিনটে কথা বলে আলগাভাবে,

খাওয়াদাওয়া সময়মত করিস ত? অফিস থেকে কখন ফিরস?”

এর চেয়ে বিশেষ কিছু বলে না, হয়ত রাগ আর ক্ষোভ পুষে রেখেছেমামপি ভাবে। ভৌগোলিক কারণে দীর্ঘ অদর্শন মা-মেয়ের মানসিক দূরত্ব আরও বাড়িয়েছে। দেবিকাও যে ভেতরে-ভেতরে ভেঙে আছে সে হদিশ মেয়েকে টের পেতে দেয় না।

শুরুর দিকে সম্পূর্ণ নির্বান্ধব শহরে মামপির অসহায় লাগত, মনখারাপ করত, কথা বলে হালকা হওয়া যায় তেমন কারও কথা মনে পড়ত না। কিন্তু কলকাতায় ফেরার কথা ভাবতে চাইত না।

দেবিকা ইতোমধ্যে খোঁজ নেওয়ার উদ্দেশ্যে দু-তিনবার দেবার্ঘ্যর মা-কে ফোন করেছিল। মহিলা নিরুত্তাপ ভদ্রতা করেছেন, দেবিকা দুঃখী গলায় বলেছে,

আমি আর কী করতে পারি বলেন দিদি? আজকাল ছেলেপুলেরা কি আমাগ মতে চলে?”

কৌশিক চিন্তিত থাকে মেয়ের জন্য, প্রকাশ করে না। সামান্যতম ইঙ্গিতে দেবিকা যে অগ্নুদ্‌গার করবে তাকে বড় ভয় পায় সে,

অহন ক্যান কও? আগেই ত বলছিলাম। তোমার আল্লাইদ্যা মেয়ে, বোঝ ক্যামন লাগে!”

কৌশিকের চোখের সামনে বড় হতে হতে করে ত্রিশ পেরিয়ে গেল ছোট্ট মেয়ে, কৌশিকের তেমন করে “বাবা হয়ে ওঠা হল না। অল্পবয়সের ভুল, মূর্খতায় অনভিপ্রেত দুর্ঘটনার ফল মামপি – কৌশিক সন্তানের কাছে গোপন অপরাধবোধে কুণ্ঠিত হয়ে রইল মেয়ের জন্ম ইস্তক। কোনও বিশেষত্ব নেই তার, কোনও গুণও না। সে অলস, বয়সের সঙ্গে আলস্য আরও বাড়ছে, উৎসাহ লাগে না কোনও কাজে। মেয়ে কিছুকাল ধরে অনেক দূরের, মেয়ের জন্য নীরব সমর্থন আছে, অহঙ্কারবোধও। দেখানোর অবকাশ নেই।

তার ব্যক্তিত্বহীনতা দেবিকার উগ্রতা বাড়িয়েছে। মামপিও বাবা-মা কাউকে সহ্য করতে পারে না। দেবিকার পরিবারের আর একজন মানুষও এমন নয়, কৌশিক বরাবর তাদের সমীহ করে এসেছে। চড়া কটকটে রঙের পেছনে ঠাণ্ডা মিয়ানো ছায়ার মতো তার অস্তিত্ব। পিতৃসূত্রে পাওয়া দোকান বাড়িয়ে মোটামুটি স্ত্রী-কন্যার গ্রাসাচ্ছদন করতে পেরেছে। মাথার ওপর ছাদেরও চিন্তা নেই, শ্বশুরবাড়িতে আশ্রিত। মা-র মৃত্যুর পর পুরোপুরি বাড়ির ভোগদখল করে তুষ্ট আছে দেবিকা।

বয়সের কারণে নিজের দুর্বলতা নিয়ে বড় ভাবে, তাকে পীড়া দেয়, মেরুদণ্ডহীন সরীসৃপ মনে হয় নিজেকে। জীবন সঠিকভাবে সাজিয়ে নিতে পারল না। মুখের মধ্যে, গলার ভেতরে নিমপাতার রসের মতো অনুভূত হয়। রাতে ঘুম আসতে চায় না।

পার্লারে গিয়েছিল শ্রুতি। আইব্রো, ফেশিয়াল ক্লিন-আপ, মাসাজ – ইদানিং কর্পোরেট লুক্ রাখতে এসব খাতে আজকাল খরচাপত্র করতে হয়, ভালোও লাগে। চুল ছোটো করে স্টাইলিং করেছে, মুখের নিরস-বিরস ভাব সরে গিয়ে অনেক আকর্ষণীয় দেখায়। সন্ধে পেরিয়েছে। পার্লার থেকে বেরিয়ে পথের ধারে টী-কর্নারে চা-এর অর্ডার দিয়ে বসে শ্রুতি, বেশ ওয়েদার এখন। এখানকার ক্রমশঃ সব কিছু নিয়ে নিজেকে ভালোবেসে ফেলছে, ফেলে-আসা ঝুলকালির দৈনন্দিন অন্ধকার আর পীড়া দেয় না। অর্ডারমতো চায়ের কাপ আর কুকিজ রেখে গেল ওয়েটার। পাশে-রাখা ফোনে আলো জ্বলে উঠল। হোয়াটস্যাপ-এ বাংলা মেসেজ,

অনুমতি পেলে প্লেনের টিকিট বুক্‌ করবো।

ওই নম্বর সে এখানে এসেই ডিলিট করেছিল, কারও ইচ্ছাধীন হওয়া তার পক্ষে আর সম্ভব নয়। বিগত মাসগুলোতে সে কোনওরকম যোগাযোগ করেনি, ওদিক থেকেও তাই। বুকের মধ্যে গজিয়ে-ওঠা ঈষৎ নরম অনুভূতিটুকু মরে গেছে তখনই।

শ্রুতি একদৃষ্টিতে ফোনের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে।

  

(ক্রমশঃ)

 

 


1 টি মন্তব্য: