ধারাবাহিক উপন্যাস
দিগন্তসেনা
(১২)
কিছুদিনের
মধ্যেই সরকারি ভবনটি নির্মিত হলে তার উদ্বোধন উপলক্ষে সাংবাদিক সম্মেলনে শ্যামাঙ্গী
জানাল রাষ্ট্র স্থাপনের জন্য সারা পৃথিবী থেকে সে যাদের সঙ্গে করে এনেছিল, সরকারের
নানা দফতরগুলোতে তারাই বেশির ভাগ থাকছেন আর
সেই দফতর বন্টন করা হয়েছে তাদের দক্ষতার ভিত্তিতেই। উদাহরণ দিয়ে শ্যামাঙ্গী বোঝাতে
চেষ্টা করল, নগর উন্নয়ন দফতরে যাদের নিয়োগ করা হয়েছে, যেমন তুপাক ইউপানকি, সে বংশ সূত্রেই
প্রাচীন ইনকাদের বর্তমান বংশধরই শুধু নয় একসময় তার পূর্বপুরুষরা ছিল ইনকা সাম্রাজ্যের
রাজা এবং পড়াশোনা সূত্রে ইনকা, আজতেক ও মায়া সভ্যতার নগরায়ন তার নখদর্পনে। এছাড়াও আছে মানকো আপারু যে বংশসূত্রে ইনকা সম্রাটদের রক্ত
বহনই যে শুধু করছে তাইই নয়, সে ইনকা সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ থেকেও অনেক জ্ঞান অর্জন করেছে,
পাশাপাশি মায়া সভ্যতার সম্পর্কেও তার জ্ঞান অপরিসীম। রেঁনোয়া আগামেনন গ্রীক ও রোমান
এই দুই সভ্যতারই রক্ত বহন করছে। আমাদের নতুন নির্মিত সরকারি ভবনটা ভালোভাবে দেখলেই
আপনারা বুঝতে পারবেন কি আসাধারণ নৈপুণ্যের সঙ্গে এগুলো করা হয়েছে। প্রতিরক্ষা দফতরে আমি ছাড়াও রয়েছে চৈতি চট্টোপাধ্যায় যে যুদ্ধবিদ্যায়
রীতিমত বিশারদ। রয়েছে উপত্যকা সেন যে আসলে কিনা একজন বিজ্ঞানী এবং একের পর এক যুদ্ধযান
বানিয়ে ইতিমধ্যেই সাড়া ফেলে দিয়েছে। আমাদের নবনির্মিত সরকারি ভবনটি আজ খুলে দেওয়া হয়েছে যাতে সবাই দেখে উপলব্ধি করতে পারে যে আমরা
কিভাবে যোগ্য ব্যাক্তিকে সমাদর করেই এক একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিযুক্ত করেছি’,
শ্যামাঙ্গী বলল। ‘মূল ভুখন্ডের এমন অনেক ব্যক্তিই আছেন’
শ্যামাঙ্গী
বলতে থাকল,’যারা এখানে বসবাস করেন না, তাদেরও বিভিন্ন দফতরের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
এর পেছনে প্রধানত যে দুটি কারণ কাজ করেছে, তার প্রথমটি হল তারা কেউ এই রাষ্ট্র তৈরীতে
শুরু থেকে সহযোগিতা করে গেছেন বা বর্তমানে
আমাদের মূল ভূখন্ডে যে দলটি আছে মানে নবদিগন্ত উন্মোচন হিসেবে যোগ দিয়ে বিভিন্ন
কাজে অংশগ্রহণও করেছেন, আর দ্বিতীয় কারণ হল, তারা কোন একটা বিশেষ বিষয়ে প্রভূত জ্ঞানের অধিকারী। তাদের এখানে থাকারও একটা
ব্যবস্থা আশা করছি আমরা অবিলম্বেই করতে পারব।
একই বিষয়ে কমপক্ষে দুজন করে রাখা হয়েছে এই কারণে যে এক জনের অবর্তমানে অন্যজন যাতে
সেই কাজটা চালিয়ে যেতে পারেন, তাই। একেবারে কম বয়সী কাউকে কাউকে রাখা হয়েছে তাদের প্রতিভা
ও জ্ঞানের কথা মাথায় রেখে’। ধন্যবাদ আর অভিনন্দনের
মধ্যে দিয়ে শ্যামাঙ্গী তার বক্তব্য শেষ করল। সরকারি ভবনটি দেখতে দেশ বিদেশ থেকে আসা
প্রচুর লোক ও সাংবাদিকরা সেটা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল। দূরদর্শনের ক্যামেরা ধারাভাষ্য
সহযোগে ভবনটির দেওয়ালের নানা কারুকাজ সবাইকে দেখাতে লাগল যাতে পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে
যে কেউ ঘরে বসেই এই ভবনের কারুকাজ দেখতে পারে। সেদিনের বিশেষ অনুষ্ঠানে কয়েকজন রাষ্ট্রপ্রধানকেও
আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, তাদের যথাযথ দেখভাল করল শ্যামাঙ্গী নিজে অন্যান্য মন্ত্রীদের
সঙ্গে নিয়ে। কোন কোন সাংবাদিকের কৌতুহলের উত্তরে
শ্যামাঙ্গী জানাল, ‘একটা বিশেষ পরিস্থিতিতে এই রাষ্ট্র নির্মাণ করা হয়েছে এবং সেই পরিস্থিতিটা তৈরী হয়েছিল বা এখনও মাঝে মাঝে
সেরকম ঘটনা ঘটেই চলেছে। তাই মূল ভূখন্ডের জনগণের দাবীতেই নবদিগন্ত উন্মোচন হিসেব দলটি
তৈরী করা হয়েছে যা এখনও রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেনি। তবে প্রয়োজন হলে অবশ্যই করবে। ওখানকার
বেশির ভাগ মানুষই দিগন্তসেনায় চলে আসতে চাইছে,
কিন্তু এর পরিধি এত ছোট যে সকলের স্থান সঙ্কুলান হবে না। তাই মূল্ভূখন্ডেও আমাদের অস্তিত্ব
যেমন আছে, থাকবে। প্রয়োজনে মানুষের চাহিদা অনুযায়ী বাড়বে’।
যৌনতা তৃপ্তির একটা কারণ হিসেবে নাকি স্রেফ একটু
অন্য রকমের দেখতে অথচ আসলে একই, প্রায় অর্ধেক
সংখ্যক মানুষকে পদানত করে নিজেদের অধিকারে রেখে রাজত্ব ভোগ করার ও অহম চরিতার্থতার
একমাত্র একটা উপায় হিসেবেই এই একটা একটা করে ধর্ষণের ঘটনা পৃথিবীতে কিম্বা সভ্যতায়
ঘটে যেতে থাকে এই চিন্তা ও দ্বিধায় বিপর্যস্ত মগজটাকে নিয়ে শ্যামাঙ্গী যখন ডান দিকে
তাকায় তখনই দেখতে পায় দিগন্তসেনার আবাসিক বিদ্যালয়টিতে তার ছেলেগুলো আরও অন্যান্য অনেকের
সঙ্গেই বাথরুমে গেছে আর বাথরুম শেষ হয়ে যাওয়ার পর একে অপরের ছোট ছোট গোপনাঙ্গগুলো নিয়ে খেলা করছে। ঠিক সেই মুহূর্তে কি করবে বুঝতে না পেরে একই জায়গায় স্নানুবৎ দাঁড়িয়ে
থাকে চোখটা ওদের থেকে সরিয়ে নিয়ে সোজা দূরে
কোন একটা কিছু খুব গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখার তীব্র ইচ্ছেয় ডুবে একেবারে মগ্ন হয়ে গেল।
তার সহকারি পেদ্রো গুয়েররেসএর গলার আওয়াজে চমকে উঠে যখন তার ভাবনা আর সেই সংক্রান্ত
হিসেবের জগৎটা একেবারে ভেঙে চুরমার হয়ে যায়,
তখন খুব ঠান্ডা গলায় শ্যামাঙ্গী পেদ্রোকে বলে, ‘বাচ্চাদের দেখাশোনার জন্য আমাদের বোধহয়
আরও বেশ কিছু লোক বিদ্যালয়টায় নিয়োগ করা উচিত, কেননা ওরা সবসময় খুব অদ্ভুত অদ্ভুত খেলাধুলো
আবিস্কার করে আর সেগুলোতেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এটা ঠিক নয়। পেদ্রো খানিকটা হতভম্ব হয়ে
গিয়ে বলে যে ওরা, যারা কিনা একেবারেই শিশু, বড়রা যদি তাদের খেলাধুলোর জগৎটাকেও নিয়ন্ত্রণ
করতে চায়, তাহলে সেটা খুব নির্মম হয়ে দাঁড়াবে। সে কথা শুনে শ্যামাঙ্গী স্তম্ভিত হয়ে
গেলেও সেটা যাতে কোন ভাবেই প্রকাশ হয়ে না পড়ে সেই চেষ্টা করতে লাগল প্রাণপণ। একবার
ভাবল পেদ্রো কি সবটা দেখতে পেয়েছে যেটা ও দেখেছে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল সেটা অসম্ভব।
কেননা ও বেশ কিছুটা দূর থেকেই আসা পেদ্রোর গলার স্বর শুনেছিল, এখনও স্পষ্ট মনে আছে
ওর। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ওর খুব ছোটবেলার একটা কথা মনে পড়ে গেল। খুব ছোটবেলা ওর কোন
এক তুতো ভাই ওর পাছায় সুড়সুড়ি দিচ্ছিল বলে ওর খুব একটা আরামের অনুভূতি হচ্ছিল। আর ঠিক
সেই মুহূর্তেই ওর চোখের সামনে ভেসে উঠল আরও
একটা ঘটনার অন্য একটা দৃশ্য। দুপুরে খাইয়ে দাইয়ে একদিন অলিন্দর একমাত্র মেয়ে পিপাসা আর ভূমিকার ছোট ছেলে
রণিতকে শুতে দেওয়া হয়েছিল পাশাপাশি, তখন একজনের চার আর অন্যজনের পাঁচ ছয় বয়েস হবে,
ঠিক সেই সময় ও নিজে চোখে দেখেছিল, ওরা বর-বউ খেলছিল একজনের অপর আর একজনের ওপর সোজা
শুয়ে পড়ে ওদের মা বাবাদের দেখাদেখিই সম্ভবত আর এখন ওরা তারই ফলস্বরূপ
এখন দুজনেই দিগন্তসেনার বাসিন্দা হয়ে উঠেছে। শ্যামাঙ্গী পেদ্রোর দিকে তাকিয়ে বলল,
‘যাওয়া যাক তাহলে’ বলেই দুজনে ঘোড়ার পিঠে উঠে চলতে শুরু করল। দিগন্তসেনায় নতুন এক আগন্তুক
উপত্যকা সেন। ইতালিতে গতবছর যে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত ছিল, সেই সময়ই ওর সঙ্গে শ্যামাঙ্গীর আলাপ
হয়েছিল। কথাবার্তা বলার পর ওকে এত ভালো লেগেছিল যে সেই সময়ই ওকে এখানে আসতে আমন্ত্রণ
জানিয়ে ছিল। শুধু আমন্ত্রণ রক্ষা করতে এসে সব দেখে শুনে উপত্যকা নিজেই এখানে থেকে যাওয়ার
সিদ্ধান্ত নেয়। ওর আসল বাড়ি বাংলাদেশে। শ্যামাঙ্গী তো এটাই চেয়েছিল। জানতে পেরে নিজে
খুশি হয়ে ওর থাকার ব্যাবস্থা পাকা করে দিয়েছে
এখানে। মূল ভূখন্ডে যাওয়ার পয় ফাগুনের সঙ্গে ওর বন্ধুত্ব হয়েছিল। তবে সেটা টেকেনি।
শেষমেষ চৈতির সঙ্গেই একটা পাকাপাকি ব্যাবস্থা
হয়ে যায় যেটা আসলে ছিল নিছকই বন্ধুত্ব নয়, গভীর প্রেম আর সেই প্রেমের টানেই একদিন চৈতি
সাতপাঁচ ভাবা বন্ধ করে এখানে এসে ওঠে সেই তখন , যখন ও সবে মাত্র ওর প্রথম সন্তানের
জন্ম দিয়েছে। এমন কি সেই নবাগতার নামটাও উপত্যকাই দিয়েছিল- যাজ্ঞসেনী। কয়েক মাসের শিশুকে
কোলে নিয়ে শ্যামাঙ্গীর কাছে আসার নাম করে যখন দিগন্তসেনায় পা দেয়, তখনও শ্যামাঙ্গী
কিছুই আঁচ করতে পারেনি। ঘন্টার পর ঘন্টা উপত্যকা
আর চৈতির সময় কাটানোটা যে শুধুই সময় কাটানো নয় সেটা দুজনকে চূড়ান্তু অন্তরঙ্গ
অবস্থায় দেখার আগে অব্দি কিছুই বুঝতে পারেনি শ্যামাঙ্গীও। চৈতি প্রেম করে বিয়ে করলে
কি হবে, বেচারা চৈতির স্বাধীন রক্ত শ্বশুর বাড়ির পরাধীনতার শৃঙ্খল একেবারেই মেনে নিতে
পায়নি। তাই ভালো হওয়া স্বত্বেও সমস্ত ক্ষোভটা রজতাভর ওপরে গিয়ে পরে। কাজের নাম করে চৈতি এখানে থেকে যেতে শুরু করে উপত্যকার
সঙ্গেই। মাঝে মাঝে রজতাভর কাছে গিয়ে ওঠা বসা
বা জোড়াজুড়িতে শোওয়া ছাড়া আসলে ও মানসিক আশ্রয়টা
খুঁজে পেয়ে যায় উপত্যকার কাছে। ফলে গবেষণার কাজটাও ও আরও বেশি করে মনযোগ দিয়ে করতে
পারে। শকুন্তলাও ওর তৃতীয় সন্তান ইলোরাকে নিয়ে স্বামীর সঙ্গে এখানেই থাকা শুরু করেছে। সঙ্ঘমিত্রা আর অভিযান আপাতত এখানকার আবাসিক বিদ্যালয়ে।
ফলে আস্তে আস্তে এখানে শ্যামাঙ্গীর ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারীরা যেন সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে উঠছে ভবিষ্যতের হাল ধরার জন্য
এরকম একটা পরিস্থিতি তৈরী হয়। ইতিমধ্যেই শকুন্তলা আবার গর্ভধারণ করেছে সবাইকে একেবারে
অবাক করে দিয়ে। সবাই ওকে যতই বোঝাবার চেষ্টা করে যে এতে ওর শরীরের চুড়ান্ত ক্ষতি হতে পারে,ও সবার ওপর দিয়ে
গিয়ে এটাই প্রমাণ করে ছাড়ে যে সেটা তো নয়ই,
বরং একমাত্র এই একটি কারণেই ওর শরীর আর মনের ক্ষমতা চক্রবৃদ্ধি হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
জীবন তো একটাই। তাই প্রাণ ভরে সুখ নিতে আর
বিলিয়ে দিতে চায় ও সবার মধ্যে। ফলে সকলেরই ধারণা হয় ওর কোনদিনই কান্ডজ্ঞান হবে না।
কথাটা ওর স্বামীরও মনে হয় আর বেচারা এটাও ততদিনে বুঝে ফেলেছে শকুন্তলাকে ছাড়া ও থাকতেও
পারবে না। তাই একদিন কোন এক মনোরম সকালে ঘুম থেকে উঠে সে সোজা গিয়ে নিজেই একটা অপারেশন
করিয়ে আসে কাউকে কিচ্ছু না জানিয়ে। কিন্তু শ্যামাঙ্গী অনায়াসেই জেনে যায় ডাক্তারের
তুমুল বদান্যতায়। অতএব এবার ও ভাবে শকুন্তলার গর্ভধারণ পর্বের পাট চুকল। এবার ও মন দিয়ে ওর কাজকর্ম করবে। তবে কথাটা ও কাউকেই
জানায় না। আসলে শকুন্তলার গর্ভধারণ পর্বটা যে আরও বিস্তৃত ও আকর্ষনীয় হয়ে উঠল সেটা
বোঝা যাবে আরও ক’বছর পর। সেই সঙ্গে সে একটা ঐতিহ্যের
বেড়াকে খুব অবলীলায় টপকে যাবে আর সূচনা করবে নতুন পারিবারিক ও বংশানুক্রমিক প্রথা যা
আর কেউ আগে করেনি।
লগ্নলতার দ্বিতীয় সন্তান জন্মের পর তার খুব মন খারাপ
হল। কেননা সে বেচারা অনেক আশা করে বসে ছিল অন্তত এবার ওর একটা মেয়ে হবেই। সুলক্ষী ওর
ছেলের নাম রাখল উপমান। লগ্নলতা ঠিক সেই সময়েই, যখন মিহির এসেছে ছেলেকে দেখতে, খুব জোর
গলায় ঘোষণা করল, ‘আমার একটা মেয়ে চাইই আর সেটা এক বছরের মধ্যেই’। উপমানকে মাত্রিদুগ্ধপান
করাতে করাতেই ও পরবর্তী গর্ভধারনের ব্যাবস্থাটা পাকা করে ফেলল। মানময়ী খবরটা পেয়ে বলে
উঠ, ‘দিনকাল কি পড়েছে! মেয়েগুলো যেন মা হবার প্রতিযোগীতায় নেমেছে’। সোফিয়া কিন্তু ওসবের
ধার কাছ দিয়েও গেল না। ও লিভ-ইনে থাকাকালীনই একটি সন্তানের জন্ম দিল আর শিশুটি মেয়ে।
শ্রাবণ ওর নাম রাখল সাসা। মানময়ী, অনঙ্গ, অলঙ্কৃতা বারবার করে শ্রাবণ, সোফিয়াকে বিয়ে
করতে বলে হন্যে হয়ে গেল, কিন্তু তবু ওরা যে বিয়েটা করল না, সেটা সোফিয়ার কারণেই। ও
কিছুতেই বিয়ে করতে চায় না। ফাগুন শেষ পর্যন্ত অভিনন্দা বলে একটি মেয়ের প্রেমে পরেছে।
দুজনের বাড়ি থেকেই চেল্লাতে লাগল ওদের বিয়ে করার জন্য আর দুজনেই তাদের পাল্টা উত্তর
দিল,’বাবা! কি এমন হয়েছে! একটু প্রেমই তো করেছি।
নাকি আর কিছু! যেন একেবারে গোটা মহাভারতটাই অশুদ্ধ হয়ে গেছে। এমন কর না তোমরা! যত্ত
সব সেকেলে ব্যাপার স্যাপার!’ বাড়ির লোকেরা তাদের ছেলেমেয়ের দেওয়া উত্তর শুনে হা হয়ে
গেল।ছেলে মেয়ে দুজনেই বলল, ‘মুখটা বন্ধ কর। না হলে মুখে মাছি ঢুকে যাবে’। বুঁচি বলল,
কি দিনকালই না পড়েছে বাবা!’ সম্রাটের মুখে কোন কথা জোগায় না। উল্কাও সুতনুকা বলে একটি মেয়ের প্রেমে পড়ে। পরিস্থিতি সুবিধের নাও হতে পারে
ভেবে দুজনেই ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বে বলে বাড়িতে জানিয়ে দেয় আর খুব মন দিয়ে পড়াশোনা করতে
থাকে। তারপর দুজনেই এত ভালো রেজাল্ট করে যা দেখে বাবামায়েরাও এত খুশী হয় যে পারলে আকাশ
থেকে চাঁদটাকেই পেড়ে এনে ওদের হাতে ধরিয়ে দেয়। ঠিক এই রকম একটা মোক্ষম সময়ে দুজনেই ইঞ্জিনিয়ারিং
পড়তে বিদেশে পাড়ি দেয়। সঙ্গে লিভ-ইন আর পড়াশুনো দুটোই চালিয়ে যায় এমন সমান তালে আর
লয়ে যে দুজনেই সাংঘাতিক সাংঘাতিক সব নম্বর নিয়ে একটার পর একটা করে বছর পার করতে থাকে।
শেষ পর্যন্ত দুজনেই বড়সড় অঙ্কের টাকাওয়ালা একএকটা করে চাকরি পেয়ে সেটা করতে শুরু করে
দেয়। বাবামায়েদেরও গর্ব আর ধরে না। লোকজন,পাড়াপ্রতিবেশী, আত্মীয়, কুটুমদের ডেকে ডেকে
মিষ্টি খাওয়াতে শুরু করে দেয় এবং বড়সড় একটা মিষ্টির তুফান বইয়ে দেওয়া ব্যাবদ বড়সড় একটা
বিলও তারা পেমেন্ট করে দেয় মিষ্টির কোম্পানি গুলোকে। ছেলে এবং মেয়ে দুজনেই সেটা জেনে
তার চাইতেও আরও অনেক অনেক বেশি অঙ্কের টাকা তারা বাবামাকে পাঠিয়ে দেয়।
নীলনদও বেশ খানিকটা বড় হয়েছে। বয়ঃসন্ধি কালটায় পৌঁছেই
সেও একটা মেয়ের প্রেমে পড়ে যায়। আর তার জন্য একেবারে পাগল হয়ে ওঠে। বন্ধুবান্ধব্দের
চেষ্টায় তার সঙ্গে যোগাযোগ আর প্রেম নিবেদন ও সম্মতি আদায় পর্বটা চুকলেই সে বেশ একটু
বেপরোয়া আর বেহিসেবী হয়ে ওঠে। খবরটা শ্যামাঙ্গীর কানে আসতেই ও একদিন ওকে ছুটিতে বাড়িতে
নিয়ে আসে। তারপর ওকে ডেকে ওর ওই সব আচরণের ব্যাখ্যা চায়। খুব আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করে
সেদিনের সেই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা ছেলেটা কেমন
মাথা নীচু করে চুপচাপ বসে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা। শ্যামাঙ্গী ওকে জিজ্ঞেস করে ও বাড়ি
যাবে কিনা। কথাটা শোনা মাত্রই যখন ও এসে ওর হাতে পায়ে পড়ে, শ্যামাঙ্গী উঠে দাঁড়ায় আর জিজ্ঞেস করে, ‘কী হয়েছে?’
ও কিছুই বলে না। শুধুই কাঁদতে থাকে আর এই বলে ওকে শাসায় যে বাড়িতে পাঠালে ও আত্মহত্যা
করবে। শ্যামাঙ্গীর চোখ কপালে উঠে যায় একেবারে। তারপর খুব করে ওকে আদর করে কোলে নিতে
যায়। ও কাঁদতে কাঁদতে ঘোষণা করে যে ও বড় হয়ে গেছে
আর ও ওর জায়গা থেকে পিছিয়ে যায় যাতে
শ্যামাঙ্গী ওকে কোলে নিতে না পারে। শ্যামাঙ্গী ওকে ডেকে পাশে বসায়। আলতো করে জড়িয়ে
ধরে আদর করে। ও তখন ঝাঁঝিয়ে উঠে বলে,’না। তুমি আমাকে ছোঁবে না। তুমি মেয়ে।‘শ্যামাঙ্গী
ওর কানে ফিসফিসিয়ে বলে,’প্রেমে পড়েছিস, তাই তো? আমি জানি। তা মেয়েটা কে?’ অনেক কায়দা
কসরৎ করে ও ওকে বোঝায় যে ও চাইলে ওকে কিন্তু সাহায্যও করতে পারে। তখন সব কথা ও বলে
দেয়। তারপরেই দুজনে মিলে প্ল্যান করে ওরা এর পর কী কী করবে আর কী কী ভাবে এগোবে। তার
পরেই দেখা গেল ওর মধ্যে একটা সাংঘাতিক পরিবর্তন এসেছে। পড়াশুণোয় খুব মনোযোগী হয়ে ওঠে
শুধু নয়, যে ছেলেটা ক্লাসে লাস্ট বেঞ্চে বসা শুরু করেছিল, এবার সে হয়ে যায় ক্লাসের
ফার্স্ট বয়ই শুধু নয়, বেশির ভাগ বিষয়েই সবার চেয়ে বেশি নম্বর পেতে শুরু করে। মেয়েটাও ওর
কাছে নানা কথা বলে। ওরা একসঙ্গে মেলামেশা ও ঘোরাফেরা করে। দশম শ্রেণী পেরোলে নীলনদ
শ্যামাঙ্গীর সঙ্গে পরামর্শ করে এবার কী করবে। কেননা ওরা তো এক ক্লাসে পড়ে না। মেয়েটা
ছোট। শ্যামাঙ্গী আরও দুটো বছর মন দিয়ে পড়াশুনোর করার কথা বলে আর নীলনদও তাইই করে। তারপর
শুধু ওই মেয়েটার কারণেই ও খুব ভালো রেজাল্ট করে ও বাবামার কথা অমান্য করেই কলেজে এমনিই
পড়াশুনো করে যায়। এর মধ্যে শ্যামাঙ্গীর বাড়িতে ওরা গল্প আড্ডা আর দেদার মজা করে। বিজ্ঞানের
বিশেষ শাখায় উচ্চতর পড়াশুণোর জন্য নীলনদকে বাইরে যেতে হবে। মেয়েটিও উচ্চতর শিক্ষার
জন্য বাইরে চলে যায় একসঙ্গে। ওরা একসঙ্গেই থাকে যেটা শুধুই শ্যামাঙ্গী জানে। লিভ-ইন করতে করতেই ওরা পড়াশুনো শেষ করে। নীলনদ গবেষণা
শুরু করে। মেয়েটা চাকরি করতে শুরু করে। মেয়েটার নাম দিগঙ্গনা।
(ক্রমশ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন