শনিবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০২৩

<<<< সম্পাদকীয় >>>>

 


কালিমাটি অনলাইন / ১১১ 


প্রকাশিত হলো ‘কালিমাটি অনলাইন’ ব্লগজিনের দশম বর্ষের একাদশতম সংখ্যা। ক্রমিক সংখ্যার বিচারে একশ দশতম সংখ্যা। যেহেতু এই সংখ্যাটি প্রকাশিত হচ্ছে ইংরেজি নতুন বছরের প্রথম মাস জানুয়ারীতে, তাই সম্পাদকীয় লিখতে বসে বইমেলার ভাবনাটাই মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। বিশেষত বিগত বছরের নভেম্বর মাস থেকেই শুরু হয়ে গেছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং তার পার্শ্ববর্তী কয়েকটি রাজ্যে লিটল ম্যাগাজিন মেলা। বছরের শেষে মেলার আবহটা নিয়ে আসে লিটল ম্যাগাজিন মেলাই। রাজ্যের বিভিন্ন জেলা শহরে লিটল ম্যাগাজিন কর্মীদের উদ্যোগে পঠন-পাঠনের একটা পরিবেশ সৃষ্টি হয়। আর এভাবে লিটল ম্যাগাজিন মেলাগুলো চলতে চলতেই জানুয়ারী মাসের শেষ মঙ্গলবারে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সূচনা হয় আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলার, যা  বুধবার থেকে বারোদিনের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় সাধারণ মানুষদের জন্য।

যদিও আমরা সাধারণ কথাবার্তায় উচ্চারণ করে থাকি ‘আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা’, কিন্তু সরকারীভাবে স্বীকৃত নাম ‘আন্তর্জাতিক কলকাতা পুস্তকমেলা’ (পূর্বনাম ‘কলিকাতা পুস্তকমেলা’)। পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতাতে এই  বইমেলা শুরু হয়েছিল বিগত শতাব্দীর ১৯৭৬ সালে। বেশ কয়েকবছর মেলা  চলার পর ১৯৮৪ সালে আন্তর্জাতিক বইমেলার স্বীকৃতি অর্জন করে। তবে একথাও প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে, যদিও এই বইমেলা আন্তর্জাতিক বইমেলা রূপে বিশেষিত, কিন্তু মেলায় সিংহভাগ অংশগ্রহণ করে বাংলা প্রকাশনা। সঙ্গে অবশ্যই অংশগ্রহণ করে ইংরেজি, হিন্দি, ঊর্দু প্রকাশনাও। এছাড়াও বিদেশি দূতাবাসগুলিও স্টল বা প্যাভিলিয়ন সাজিয়ে নিজ নিজ দেশে প্রকাশিত বইপত্রের প্রদর্শনী করে থাকে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও ভারত সরকারের বাংলা প্রকাশনা বিভাগগুলিও এই মেলায় অংশ নিয়ে থাকে। সেইসঙ্গে  ফ্রাঙ্কফুট বইমেলার আদলে প্রতি বছর মেলায় অংশগ্রহণকারী একটি বিদেশি রাষ্ট্র ‘ফোকাল থিম’ ও অপর একটি রাষ্ট্র ‘সম্মানিত অতিথি রাষ্ট্র’ নির্বাচিত হয়। সেইসব দেশের প্রকাশনা সংস্থাগুলি অংশগ্রহণ ক’রে কলকাতা বইমেলার  আন্তর্জাতিক মানকে গৌরবান্বিত করে। প্রাসঙ্গিক আলোচনায় আরও উল্লেখ করা যেতে পারে, কলকাতা বইমেলা বিশ্বের বৃহত্তম অবাণিজ্যিক বইমেলা, ফ্রাঙ্কফুর্ট  বা লন্ডন বইমেলার মতো বাণিজ্যিক বইমেলা নয়। কলকাতা বইমেলায় ফ্রাঙ্কফুর্ট ও লন্ডন বইমেলার মতো গ্রন্থপ্রকাশনা, পরিবেশনা এবং অনুবাদ সংক্রান্ত কোনো চুক্তি বা বাণিজ্য হয় না। বরং বইয়ের প্রকাশকরা ও পরিবেশকরা সাধারণ মানুষের কাছে তাদের বইয়ের প্রদর্শনী, প্রচার ও বিক্রি করে থাকে। সাহিত্য, শিল্প ও সংস্কৃতির পীঠস্থান কলকাতায় তাই এই বইমেলা কলকাতার প্রাচীন ঐতিহ্য ও পরম্পরার অনুসারী।

আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলার পাশাপাশি সমান গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহ্যশালী বইমেলা বাংলাদেশের ঢাকায় আয়োজিত ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’। প্রতি বছর ১লা ফেব্রুয়ারী থেকে শুরু হয় এই বইমেলা এবং শেষ হয় ফেব্রুয়ারী মাসের শেষ দিনে। যতদূর জানা যায়, ১৯৭২ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারী চিত্তরঞ্জন সাহা বাংলা একাডেমীর সামনের বটতলায় কলকাতা থেকে ৩২টি বই এনে একটা চটের ওপর সাজিয়ে বইমেলা শুরু করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় চিত্তরঞ্জন সাহা প্রতিষ্ঠিত ‘স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ’ (এখন ‘মুক্তধারা প্রকাশনী’) থেকে প্রকাশিত ভারতে অবস্থানকারী বাংলাদেশী শরণার্থী লেখকেরা ছিলেন এই বইগুলির লেখক। পরবর্তীকালে এই মেলা ক্রমশই সম্প্রসারিত হয়। বাংলা একাডেমী এবং বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি মেলার উদ্যোক্তা হন। পূর্বে এই বইমেলার নাম ছিল ‘একুশে গ্রন্থমেলা’। ১৯৮৪ সালে মেলার নতুন নামকরণ করা হয় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’।

প্রতি বছরের মতোই, আশাকরি, ‘আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা’ এবং ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ স্মরণীয় হয়ে থাকবে দুই দেশের অগণিত সাহিত্যপ্রেমী পাঠক-পাঠিকা, লেখক-লেখিকা এবং প্রকাশনা তথা পরিবেশনা সংস্থাগুলির কাছে।

ইংরেজি নতুন বছরের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই সবাইকে।

 

আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :

kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com

দূরভাষ যোগাযোগ : 9835544675

অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ : Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India.

 

 

 

 


অভিজিৎ মিত্র

 

সিনেমার পৃথিবী – ২৭      



   

আজ আমাদের গন্তব্য খুব কাছাকাছি। ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলো। একদম মাথার ওপর থেকে যদি ক্লকওয়াইজ লিখতে শুরু করে পুরো একটা বৃত্ত ঘুরে আসি, তাহলে ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর নাম এভাবে আসবেঃ আফগানিস্তান, চিন, নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ, মায়ানমার, শ্রীলঙ্কা, মলদ্বীপ এবং পাকিস্তান। এরমধ্যে আমরা আজ নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের ছবি নিয়ে আলোচনা করব। চিনদেশের সিনেমা নিয়ে আগেই আলোচনা করেছি।

শুরুর আগে আবারো এক ছোট ফুটনোট। নেপালের সিনেমা মানে কিন্তু নেপালি সিনেমা নিয়ে আলোচনা নয়। ওদের ইন্ডাস্ট্রি যে রকম ছবি বানায়, তা আমার আলোচনায় আসবে না। ষাটের দশক থেকে শুরু করে নেপালি সিনেমা কোন না কোনভাবে মোটামুটি ভারতের সাহায্যেই চলেছে প্রায় কুড়ি বছর। তারপর ওখানকার উৎসাহীরা নিজেরা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি চালানো শুরু করার পর প্রচুর সিনেমা হয়ে চলেছে, যেমন বিখ্যাত গায়ক উদিত নারায়ণ ১৯৮৪ সালে নেপালি  সিনেমায় নায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন, ‘কুসুমে রুমাল’ নামক এক  ছবিতে। এইসব ছবি হয়ত ফাঁকা সময়ে লঘুমস্তিষ্কে দেখতে মন্দ লাগবে না, কিন্তু আমি এইসব ছবিতে উৎসাহী নই - সেটা আপনারা জানেন। আমি আজ নেপালের যেসব সিনেমা নিয়ে আলোচনা করব, তারমধ্যে হিমালয়, এভারেস্ট এবং ওখানকার আর্থ-সামাজিক অবস্থা ও আন্দোলন নিয়ে করা বিদেশী ছবির প্রাধান্য।

আমার হিসেবে নেপাল সম্পর্কিত যে যে ছবি যথেষ্ট সাড়া জাগিয়েছে - হিমালয়া (১৯৯৯), দ্য সারি সোলজার্স (২০০৮), কাটমান্ডু, এ মিরর ইন দ্য স্কাই (২০১১), হাইওয়ে টু ধাম্পাস (২০১৪), রেড মনসুন (২০১৪), এভারেস্ট (২০১৫), শেরপা (২০১৫), সেতো সূর্য (২০১৬) এবং এভেন হোয়েন আই ফল (২০১৭)। এর ভেতরে রেড মনসুন এবং সেতো সূর্য দুজন নেপালি পরিচালকের তৈরি, বাকি ছবিগুলো বিদেশী পরিচালকদের। কিন্তু এই ছবিগুলোর প্রতিটাই পুরোপুরি নেপালে তৈরি এবং নেপালের কোন না কোন দিক ফুটিয়ে তুলেছে। এরমধ্যে ফ্রেঞ্চ পরিচালক এরিক ভালির ‘হিমালয়া’ নেপালে তৈরি প্রথম ছবি যা  অস্কার নমিনেটেড হয়েছিল। ‘সারি সোলজার্স’ নেপালের গৃহযুদ্ধে মহিলা  সেনাদের অংশগ্রহন নিয়ে তৈরি, ‘কাটমান্ডু, এ মিরর ইন দ্য স্কাই’ এক বিদেশী মহিলার নেপালে এসে বাচ্চাদের টানে সেখানে থেকে যাওয়ার ছবি, ‘হাইওয়ে টু ধাম্পাস’ প্রায় একই থিমে কিন্তু এখানে সাধারন মানুষের দুর্দশার ওপর ফোকাস  বেশি, ‘রেড মনসুন’ সম্পর্কের জটিল আবহে দুর্দান্ত, ‘এভারেস্ট’ ও ‘শেরপা’  এতই বিখ্যাত ছবি যে প্রায় প্রত্যেকেই দেখেছেন, ‘সেতো সূর্য’ (সাদা সূর্য) নেপালের গৃহযুদ্ধ শেষ হয়ে যাবার পরেও ক্ষত বয়ে বেড়াবার ছবি, ‘এভেন হোয়েন আই ফল’ নেপালের গরীব নাবালিকা মেয়েদের জিম শেখানোর অছিলায়  বাড়ি থেকে নিয়ে গিয়ে ভারত ও অন্যান্য দেশের সার্কাসে কাজ করানোর জন্য কিভাবে পাচার করে দেওয়া হয়, সেই নিয়ে এক অসাধারণ ডকু। 

 

আলোচনার জন্য আজ আমরা বেছে নেব ‘হিমালয়া’। এরিক ভালির ১০৮  মিনিটের ছবি। ভালি নিজে একজন ক্যামেরাম্যান, সুতরাং এই ছবির সিনেমাটোগ্রাফি যে অনবদ্য হবে, তা বলাই বাহুল্য। নেপালের উত্তর-পশ্চিম অংশের হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় বেঁচে থাকার জন্য লড়াই আর মানুষের নিজেদের মধ্যে ক্ষমতা দখলের লড়াই, এই দুয়ের অদ্ভুত মিশ্রণ এই সিনেমা। মাটি থেকে  প্রায় ষোল হাজার ফুট ওপরে হিমালয়ের ডলপা অঞ্চলের বাসিন্দারা ইয়াকের গাড়ি নিয়ে পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়ায় রক সল্ট (সন্ধক নুন) খোঁজার জন্য। সেই রক সল্ট তারা নিয়ে যায় অনেক নিচের পাহাড়ি অঞ্চলে, যেখানে নুনের পরিবর্তে তারা খাদ্যশস্য নিয়ে ঘরে ফেরে। বেঁচে থাকার জন্য সারা বছর এভাবেই তাদের জীবন সংগ্রাম করতে হয়। এদিকে কে তাদের ক্যারাভ্যানকে পথ দেখাবে সেই নিয়ে এক আভ্যন্তরীণ সমস্যা শুরু হয়। বয়স্ক টিনলে নাকি  যুবক কার্মা, কে হবে নেতা? তুষারঝড়ের মাঝে ক্যারাভ্যান এগিয়ে চলে আর টানটান চিত্রনাট্য-ও। টানাপোড়েনের মাঝে অবশেষে বোঝা যায় জয় হয়েছে মানুষের, সর্বশক্তিমানের।

এই ছবিতে ভাল লেগেছে ভালির নেপালের সাধারণ মানুষের ওপর বিশ্বাস, যে কারণে এখানে প্রায় সব অভিনেতাই সাধার্ণ মানুষ - ডলপা অঞ্চলের বাসিন্দা। এবং যেটা আমার মনোযোগ কেড়েছে, সেটা এক নিয়ম। তিব্বতিদের ‘স্কাই বুরিয়াল’ বা আকাশের মাঝে মৃত মানুষকে কোন এক উঁচু পাথরের ওপর শুইয়ে  দেওয়া যাতে আকাশের পাখিরা তাকে ঠুকরে খেয়ে নিতে পারে, প্রকৃতির উপাদান আবার প্রকৃতিতেই ফিরে যায়। অরুণাচল প্রদেশেও আমি অনেকটা এই  রকম নিয়ম দেখেছি, যেখানে মৃত মানুষকে বহু টুকরো করে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয় যাতে নদীর মাছ ও অন্যান্য জন্তুরা তাকে খেয়ে শেষ করতে পারে। এই ছবিতে আরো এক ভাবার বিষয় এর পরতে পরতে লুকিয়ে থাকা দর্শন। অ্যাডভেঞ্চার ভাল, কিন্তু তার ভেতরেও জানা দরকার সঠিক তথ্য, নইলে জীবন বিপন্ন হতে পারে। এই জ্ঞান ‘হিমালয়া’কে এক মহাকাব্য করে তুলেছে।     

ভুটান এক ছোট্ট দেশ এবং এখানেও নেপালের মত অনেক বিদেশী ছবি তৈরি হয়েছে। কিন্তু নেপালের মত এখানে আমি বিদেশী ছবি না ঘেঁটে ভুটানের দুজন বৌদ্ধ লামার ছবি বেছে নেব। খেয়েন্তসে নোরবু এবং তার শিষ্য পাও চয়নিং দর্জি। নোরবু-র চারটে মাইলস্টোন ছবি- ‘দ্য কাপ’ (১৯৯৯), ‘ট্রাভেলার্স অ্যান্ড ম্যাজিশিয়ান’ (২০০৩), ‘ভারাঃ এ ব্লেসিং’ (২০১৩) ও ‘হেমা হেমা’ (২০১৬) এবং দর্জি-র এক অসাধারণ ছবি - ‘লুনানাঃ এ ইয়াক ইন দ্য ক্লাসরুম’  (২০১৯), ভুটানের সিনেমার খোলনলচে পুরো বদলে দিয়েছে। নব্বইয়ের দশক থেকে ছায়াছবি তৈরি শুরু করে যে দেশ সিনেমায় এত সুন্দরভাবে এগিয়ে যায়, তাদের প্রচেষ্টাকে কুর্নিশ জানাতেই হয়। এখানে আমরা দর্জির ‘লুনানাঃ এ ইয়াক ইন দ্য ক্লাসরুম’ নিয়ে আলোচনা করব।

এক তরুণ শিক্ষক উগয়েন গানবাজনা ভালবাসে, অস্ট্রেলিয়া চলে যেতে চায়। কিন্তু দেশের প্রতি তার আবশ্যিক কাজ এখনো বাকি। তাকে শিক্ষক হিসেবে পাঠিয়ে দেওয়া হয় লুনানা নামক এক প্রত্যন্ত গ্রামে। সেই গ্রামে পৌঁছতে গেলে গাড়ি রাস্তা শেষ হবার পর পায়ে হাঁটা পথে আটদিন ট্রেকিং করতে হয়। বহু কষ্টে গিয়ে উগয়েন দ্যাখে সেখানে না আছে ইলেকট্রিসিটি, না আছে কোন পড়ার বই, না আছে ব্ল্যাকবোর্ড। সে হতাশ হয়ে পড়ে, গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে চায়। কিন্তু সেই দেবশিশুর মত বাচ্চাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা ও সব কিছুর সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা দেখে সে রয়ে যায়। তাদের সঙ্গে নিজেও শিখতে শুরু করে কিভাবে এত কাঠিন্য সত্বেও জীবন উপভোগ করতে হয়। সেই গ্রামের এক অদ্ভুত নিয়ম, ক্লাসরুমের মধ্যে একটা ইয়াক-কে বেঁধে রাখা হয়। ভুটানের মানুষের সঙ্গে ইয়াকের যে আন্তরিক সম্পর্ক, ইয়াকের গোবর যে ঘরবাড়ি গরম রাখতে সাহায্য করে, এগুলো বোঝার জন্য ক্লাসরুমে সেই ইয়াক। প্রথমে অদ্ভুত লাগলেও পরে উগয়েন মানিয়ে নেয়। সেখানকার এক যুবতী উগয়েনকে এক ফোক গান শেখায় ‘ইয়াক লেবি লাদার’। বছর ঘোরার পর উগয়েন লুনানা গ্রাম ছেড়ে চলে  যায়। সব বাচ্চারা মুষড়ে পড়ে। থিম্পু ফিরে গিয়ে উগয়েন তার স্বপ্ন সাকার করতে অস্ট্রেলিয়া পাড়ি দেয়। সেখানে একবারে গায়ক হিসেব কাজ নেয়। কিন্তু কেউ তার গান মন দিয়ে শোনে না। উগয়েন একদিন রেগে গিয়ে ‘ইয়াক লেবি লাদার’ গাইতে শুরু করে।

১০৯ মিনিটের অপূর্ব সিনেমা। সহজ ছবি, যা ভালবাসা যায়। এবং এটাও জানলে অবাক হবেন যে এই সিনেমায় লুনানা গ্রামের যারা অভিনয় করেছে, তারা কেউ কোনদিন সিনেমা দ্যাখেনি, সিনেমা কি জিনিষ তারা জানে না, সিনেমা কিভাবে কোথায় দেখানো হয় সেই নিয়েও তাদের বিন্দুমাত্র জ্ঞান নেই। গ্রামের মোট জনসংখ্যা ৫০-৬০। কোন মেলোড্রামা নেই, উঁচু-নিচু অভিনয় নেই, মেক-আপ নেই, ক্যামেরার চাতুরি নেই। আছে শুধু লুনানার ওয়াইড অ্যাঙ্গল প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং সেখানকার দেবশিশুর মত কিছু ছোট ছোট বাচ্চা।   

 

বাংলাদেশের সিনেমার ইতিহাস বেশ দীর্ঘ। সেই তিরিশের দশকে প্রথম নির্বাক ছায়াছবি তৈরি থেকে শুরু করে ১৯৫৬ সালে প্রথম বাংলা ছায়াছবি ‘মুখ ও মুখোশ’ (বাংলাদেশ তখনো কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান) হয়ে শেখ মুজিবর রহমানের  ১৯৫৭ সালে ‘ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন বিল’ পাস করানো এবং বাংলাদেশের ছবির পালে হাওয়া লাগা, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর সত্তর ও আশির দশকে ছবির স্বর্ণযুগ, এরপর হঠাৎ কয়েক দশক সিনেমার নিম্নমুখী গ্রাফ, অবশেষে আবার ২০০০-এর পর থেকে ফিরে তাকানো। বিশাল বড় ইতিহাস। আমায় যদি বাংলাদেশের কিছু উল্লেখযোগ্য ছবি বেছে নিতে বলা হয়, তাহলে আমার পছন্দ - মুখ ও মুখোশ (১৯৫৬), জীবন থেকে নেয়া (১৯৭০), ওরা ১১ জন (১৯৭২), তিতাস একটি নদীর নাম (১৯৭৩), লাল সালু (২০০১), মাটির ময়না (২০০২), আয়নাবাজি (২০১৬) ও আলফা (২০১৯)। আরো অজস্র ভাল ছবি আছে যেগুলোর নাম ইচ্ছে করেই নিলাম না। বিশেষ করে, বলতেই হয় যে, ২০০০ সালের পর থেকে বাংলাদেশে অন্যরকম থিমের ওপর যথেষ্ট ভাল ছবি তৈরি হচ্ছে। এখানেও আমি একটা নতুন ছবিই বেছে নেব – ‘আয়নাবাজি’  (২০১৬)।

এই ছবির নামভূমিকায় চঞ্চল চৌধুরী (আপনারা হয়ত এই বিখ্যাত অভিনেতার নাম শুনেছেন)। আয়না। এক স্টেজ অভিনেতা যে টাকার অভাবে সফল অভিনেতা হয়ে উঠতে পারে নি। মায়ের মৃত্যুর পর আয়না তার অভিনয় দক্ষতা টিকিয়ে রাখার জন্য এক অদ্ভুত পেশা বেছে নেয়। ঢাকা শহরের হাই প্রোফাইল কারো জেল হলে সে তার পরিবর্তে জেলে গিয়ে সেই লোকটির মত অভিনয় করত। আবার ছাড়া পাবার পর বাইরে নিজের জীবনে ফিরে আসত, হাতে প্রচুর টাকা নিয়ে। এইভাবে কিছুদিন। তার পর আবার জেল, অন্য কারো হয়ে। একদিন সে তার মনের মানবীকে খুঁজে পায়। হৃদি। তার সঙ্গে ঘর বাঁধবে বলে এই অভিনয় জীবন ছেড়ে দেবে ঠিক করে। কিন্তু এবারো যে তাকে জেলে যেতেই হবে। কারণ যার হয়ে তার জেলে যাবার কথা, তাকে না বলার পর সে হৃদিকে  কিডন্যাপ করে নেয়। আয়না আবার জেলে যায়। গিয়ে বুঝতে পারে এবারে তাকে ফাঁসানো হয়েছে কারণ এবারে জেলের আসামী মৃত্যুদন্ড পেয়েছে। সে সুযোগ বুঝে একদিন জেল থেকে পালায়। হৃদির কাছে ফিরে আসে। সংসার শুরু করে। কিন্তু সম্পূর্ণ নতুন এক ছদ্মবেশে। এই ছবি ঢাকা শহরের এক অন্ধকার দিক।

অমিতাভ রেজা চৌধুরীর এই ছবি প্রায় আড়াই ঘন্টার। শুটিং পুরোটাই ঢাকা শহরে। পরতে পরতে ঢাকা-র ইতিহাস যেন এই ছবিতে। এবং রহস্যময় সিনেমাটোগ্রাফি। এবং আরো উপভোগ্য, এই ছবি থেকে ইতিমধ্যেই তেলুগু ছবির রিমেক হয়ে গেছে। শুধু একটাই সমস্যা – যেটা গড়পরতা বাংলা চবির থাকেই। সেটা হল, এই ছবি প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি দৈর্ঘ্যের। অন্তত আমার সেইরকম মনে হয়েছে।

শ্রীলঙ্কার (অতীতের সিংহল) ছবি বলতে মূলত সিংহলি ও তামিল ছবি। সেই চল্লিশের দশক থেকে যাত্রা শুরু করে পঞ্চাশের দশকে কান ফিল্ম ফেস্টিভালে সাড়া জাগানো, তারপর সরকার আর এলটিটিই-র মধ্যে ঝামেলার হাত ধরে সিনেমার সমূহ ক্ষতি এবং অবশেষে আবার ২০০০ সালের পর ছবির ঘুরে দাঁড়ানো, এই সব একটু ঘাঁটলেই মনোযোগী পাঠক ইতিহাসে পেয়ে যাবেন। যেটা পাবেন না, সেটা হল শ্রীলঙ্কার এই সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক ধ্বংস এবং তার ফল হিসেবে সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি প্রায় বন্ধের মুখে দাঁড়িয়ে।

যাইহোক, শ্রীলঙ্কার যে যে সিনেমা এখনো অব্ধি দাগ কেটে গেছে, সেগুলোর একটা ছোট লিস্ট দেওয়া যাক - লাইন অব ডেস্টিনি [রেকাভা] (১৯৫৬), চেঞ্জেস ইন দ্য ভিলেজ (১৯৬৩), সেভেন সিজ (১৯৬৭), এ সার্টেন লুক (১৯৭২), দ্য ট্রেজার (১৯৭২), হাউ টু বি অ্যান অ্যাডাল্ট (১৯৭৫), দ্য ওয়াস্পস আর হেয়ার (১৯৭৮), দ্য হান্ট (১৯৮৪), উম্ব ফর হায়ার (১৯৯০), দ্য ফরসেক্ন ল্যান্ড (২০০৫), ফ্রাঙ্গিপানি (২০১৪), নিউজপেপার (২০২০)। তবে শ্রীলঙ্কার ছবি বললে প্রথমে নাম আসবে পরিচালক লেস্টার জেমস্ পেরিসের। ক্লাসিক সিংহল ছবির সিংভাগ ওনার বানানো। শ্রীলঙ্কার ছবির প্রাণপুরুষ। ওনার একটা ছবি নিয়েই তাহলে আজ কাটাছঁড়া করা যাক- ‘দ্য ট্রেজার’।

এই ছবির গল্প আমি বরং এক লাইনেই বলি। জি বি সেনানায়কের ছোটগল্প ‘দ্য রিভেঞ্জ’ অনুসরণে ছবি ‘দ্য ট্রেজার’। গুপ্তধনের চাবিকাঠি হাতে পাবার জন্য এক  ভার্জিন মেয়েকে খুন করতে হবে। সেই নিয়ে টানটান সিনেমা। আমি গল্প নিয়ে তত চিন্তিত নই। আমার চিন্তা অন্য দুটো ব্যাপারে। ১০৮ মিনিটের এই ছবিকে বলা হয়েছে শ্রীলঙ্কার প্রথম ৫০ বছরের ছবির ইতিহাসের সেরা ছবি এবং ফ্রান্সের এক লাইব্রেরীতে এই ছবিকে বিশ শতকে পৃথিবীর সেরা ১০০ সিনেমার লিস্টে রাখা হয়েছে। আমি এখানে সেটাই বুঝতে চাই।

এই ছবির প্রথম প্লাস পয়েন্ট, স্ক্রিপ্ট। বেশ ভাল ডায়লগ। মানতেই হবে। দ্বিতীয়, অভিনয়। মুখ্য চরিত্রে যথাযথ অভিনয় চোখে পড়ে। ফলে সিনেমার বাঁধুনি আরো বেড়ে যায়। তৃতীয়, মিউজিক। কোথাও কোথাও চমকে দেবার মত ড্রাম। সবশেষে, ক্যামেরার কাজ। লেস্টার জেমসের ছবি মানে ক্যামেরার কিছু না কিছু নতুনত্ব থাকবেই। এই ছবিতে, শ্যাডো শুটিং। ফলে রহস্য রোমাঞ্চের আবহ একদম জমে গেছে। এই ছবিকে ক্লাসিক বলতেই হয়।  

পাকিস্তান নিয়ে যতই আমাদের ভুরু কুঁচকোনো থাকুক (বিভিন্ন বিষয়ে, যেগুলো এখানে আমি কলমের ডগায় আনতে চাই না), একটা ব্যাপার মাথায় রাখতেই হবে - পাকিস্তান কিন্তু ছবি তৈরির বিষয়ে বেশ সিরিয়াস। ওখানে প্রচুর ধর্মীয় বিধিনিষেধ থাকলেও ওখানকার তরুণ পরিচালকরা বেশ ভাল ভাল সিনেমা  তৈরি করছেন। এবং আপনাদের নিশ্চয় মনে আছে, এবার কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে পাকিস্তানের ‘জয়ল্যান্ড’ (২০২২) নন্দনে বেশ সাড়া ফেলেছিল। একটা  ব্যাপার আমি সবসময় মাথায় রাখি এবং আমার পাঠক-পাঠিকাদেরও মাথায় রাখতে বলি। কেউ যদি সাহিত্য শিল্প সংস্কৃতি বিজ্ঞান ইত্যাদি বিভিন্ন উৎকর্ষ মূলক ক্ষেত্রে ভাল কিছু করে দেখান, তিনি যে দেশেরই নাগরিক হোন না কেন, তার প্রশংসা করতেই হবে। সেখানে যেন রাজনীতি বা জাতের নামে বজ্জাতি না ঢোকে।

পাকিস্তানের অনেক ছবি আমার পছন্দের। এখানে কয়েকটার নাম বলি - নিন্দ (১৯৫৯), ইনসানিয়ৎ (১৯৬৭), উমরাও জান আদা (১৯৭২), জিন্না (১৯৯৮), খুদা কে লিয়ে (২০০৭), মান্টো (২০১৫), জয়ল্যান্ড (২০২২), স্যান্ডস্টর্ম (২০২২)। আজ ‘জয়ল্যান্ড’ নিয়ে আলোচনার ইচ্ছে ছিল, কারণ এই ছবিতে ট্রান্সজেন্ডার দেখানোর পাশাপাশি আরো কয়েকটা অদ্ভুত ব্যাপার আছে। কিন্তু সেই লোভ ছাড়তে হচ্ছে, নাহলে অন্য এক ছবির সঙ্গে অধর্ম করা হবে। ‘খুদা  কে লিয়ে’। এই সেই ছবি, যখন ধর্মীয় আর পারিবারিক শাসনে পাকিস্তানের  সিনেমা প্রায় ঘাড় ভেঙ্গে পড়ে গেছে, তখন আবার ইন্ডাস্ট্রিকে উঠে দাঁড়াবার অক্সিজেন জুগিয়েছিল।

দুই ভাই ও গায়ক, মনসুর আর সার্মাদ, ৯/১১ তারিখে আল-কায়দা আমেরিকা আক্রমণের পর তাদের জীবন কিভাবে বদলে গেছিল, সেই নিয়ে এই ছবি। এক  ভাই আমেরিকা গিয়ে হঠাৎ জেলে চলে যায়। আরেক ভাই এক ব্রিটিশ যুবতীকে জোর করে বিয়ে করে নেয়। পরে সেই ঝামেলা কোর্ট অব্ধি গড়ায়। সেখানে নাসিরুদ্দিন শাহকে এক ছোট্ট রোলে দেখা যায়। কিভাবে যুদ্ধ আর ঘৃণা ছড়ানোর জন্য এক শ্রেণীর মানুষ ইসলাম ধর্মকে অপব্যবহার করছে, তার এক প্রামাণ্য   দলিল এই ছবি।

শোয়েব মনসুরের প্রায় তিন ঘন্টার এই সিনেমা দীর্ঘ এবং একটু বোরিং হলেও সঠিক জায়গাটা কিছু লোকের সামনে তুলে ধরতে পেরেছে। ধর্মের নামে বিভেদ ও হিংসা ছড়ানো বন্ধ করা হোক। যারা এইসব বদমাইশি করতে চায়, তাদের বেছে বেছে আলাদা করে দেওয়া হোক। সিনেমাটোগ্রাফি আমার খুব একটা ভাল লাগেনি। বরং মিউজিক বেশ ভাল। সিরিয়াস ডায়লগের পাশাপাশি মজার কিছু ডায়লগ আছে। মনসুরকে যখন আমেরিকান পুলিশ জিজ্ঞেস করছে ‘what is between you and osama bin laden?’, তখন মনসুরের জবাব ‘maybe he is a gay and he liks me’। তবে এই ছবি দেখে সবাই একটা ব্যাপার মেনে নিতে বাধ্য হবেন, পৃথিবীর যে কোন দেশের শান্তিপ্রিয় নাগরিকরা শান্তিতে ও নিভৃতে থাকতেই ভালবাসেন। 

মায়ানমারের ছবি নিয়ে আলোচনা ইচ্ছে করেই এড়িয়ে গেলাম। অতীতের বার্মা, যেখান থেকে অনেক দুর্দান্ত ছবি তৈরি হয়েছিল, আজ যেরকম ভগ্নস্তূপ হয়ে পড়ে আছে - সেটা মেনে নেওয়া যায় না।

তাহলে এশিয়া শেষ। আমার আগামী পর্যালোচনা শুরু হবে আবার ইউরোপ থেকে। তবে এই অব্ধি তো অনেক দূরান্তের বিশ্ব সিনেমাও দেখা হল। এবার আমি আমার মনোযোগী পাঠকের কাছে আশা করতেই পারি যে আরো এগোনোর আগে সত্যজিৎ রায়ের ‘বিষয় চলচ্চিত্র’ বা সিডনি লুমেটের ‘Making Movies’ বইগুলো মাঝে মাঝে উল্টে পাল্টে দেখবেন। তাহলে আমাদের আলোচনার গভীরে ঢুকতে সুবিধে হবে।     

(ক্রমশ)

 

 


প্রদোষ ভট্টাচার্য


 কলকাতায় বাংলা ছবির ‘মুক্তি-শৃঙ্খল




 

(প্রথম পর্ব)

 

স্বীকারোক্তিঃ যাঁরা ‘কালিমাটি’-তে এর আগে উত্তম-সুচিত্রা এবং তরুণ মজুমদারকে নিয়ে আমার লেখা পড়েছেন, তাঁদের কাছে, উক্ত শিরোনামের নিচে যেসব ছবির আলোচনা করেছি, সেগুলি প্রেক্ষাগৃহের দৃষ্টিকোণ থেকে আবার এখানে যখন আসবে, তখন ‘এ তো পড়া’ মনে হবেই। এ ব্যাপারে আমি নিরুপায় এবং ক্ষমাপ্রার্থী।

যবে থেকে সজ্ঞানে সিনেমার বিজ্ঞাপন দেখতে শিখেছি, তবে থেকে লক্ষ্য করেছি যে বাংলা ছবি মুক্তি পেত মূলত চারটি ‘চেন’ বা শৃঙ্খলে, যার প্রতিটিতে থাকত তিনটি করে প্রেক্ষাগৃহ। এর বাইরেও বাংলা ছবি দেখাবার হল ছিল, তবে সেগুলিতে বাংলা ছাড়াও হিন্দী বা, একটি হলের ক্ষেত্রে ইংরেজী ছবি আসত। প্রথম পর্বে আসি যে শৃঙ্খলের প্রেক্ষাগৃহ-সমূহে সবচেয়ে বেশী বাংলা ছবি দেখেছি।

 

মিনার-বিজলী-ছবিঘর

 

বিজলী

 


১৯৬৫ সালে পরপর বাংলা ছবি দেখেছি। মা তাঁর স্মৃতিচারণের খাতায় ৩০শে এপ্রিল তারিখে তিনটি ছবির নাম লিখে রেখেছেনঃ একটি ইংরেজী, দুটি বাংলা। একই দিনে একাধিক ছবি দেখার চল আমাদের পরিবারে তেমন ছিল না, আর তিনটি ছবি একদিনে তো অকল্পনীয়! ৩০শে এপ্রিলের আগে রাতের শোতে  ভবানীপুরের বিজলীতে দেখেছি তরুণ মজুমদারের ‘একটুকু বাসা’ (ছবিটি মার্চ মাসের ২৬ তারিখে মুক্তি পায়)।

সেই প্রথম বিজলীতে প্রবেশ। ঐ বয়সে যে কোন সিনেমা হলে ঢুকেই আমার নজর যেত যে সাদা ‘স্ক্রীনে’র ওপর ছবি দেখানো হবে, সেটি ঢাকা থাকবে কি রঙের পর্দায় এবং সে পর্দা খুলবে কীভাবে। সিংহভাগ হলেই পর্দা বা curtain যে  রঙেরই হোক, খুলত দুভাগে ভাগ হয়ে দুপাশে সরে গিয়ে। আমার দেখা একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল বিলিতী ছবির বনেদী প্রেক্ষাগৃহ মেট্রো, যার সোনালী পর্দা ভাগ না হয়ে সম্পূর্ণভাবেই ওপরে উঠে যেত। বিজলীর স্ক্রীন ঢাকা ছিল ধূসর রঙের পর্দায়, যা যথাসময়ে দুভাগে দুদিকে সরে গেল, আর, পরিষ্কার মনে আছে, শুরু হলো ‘অনীক ঘি’-র বিজ্ঞাপন।

মূল ছবিতে পর্দায় প্রথম এলেন অনুপকুমার, তুলে দেখালেন তাঁর একপাটি জুতোঃ সোলে গর্ত! এরপর গল্প এগিয়ে চললো। বাবা পাহাড়ী সান্যাল। ছেলে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নববিবাহিতা স্ত্রী সন্ধ্যা রায়কে নিয়ে নিজস্ব একটি বাসস্থান খুঁজতে গিয়ে ওঠেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের হোটেলে। সেখানে আবাসিকরা স্বাভাবিকভাবেই সন্দেহ করে যে দু’জনের মধ্যে সম্পর্কটা ঠিক বৈধ নয়। এই নিয়েই যত মজা। শেষে সৌমিত্র হাফ-প্যান্ট আর চশমা পরে একদল ফুটবল খেলোয়াড়দের সঙ্গে বেরিয়ে যান। সঙ্গের বড়রা, মা, বাবা, দাদা, মাসীমা, সবাই বেশ উপভোগ করেছিলেন। আমি ওই ৮ বছর বয়সে খুব একটা কিছু বুঝিনি, ভালও লাগেনি। ছবিটি বোধহয় আর নেই। সুরকার হেমন্ত হলেও তাঁর কণ্ঠে কোন গান ছিল বলে মনে পড়ছে না।

ছবিটির শেষ দৃশ্য বেশ মনে আছেঃ পাহাড়ী সান্যাল চটি বাজিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন শুয়ে থাকা রবি ঘোষের দিকে, আর ভয়ার্ত রবি ঘোষ তৎক্ষণাৎ মাথা অবধি চাদরে মুড়ে ফেলছেন। মনে থাকার কারণ যে এর পরেই পর্দায় ‘শেষ’ লেখাটি ফুটে উঠল, হলের আলো জ্বলে উঠল, কিন্তু – সেই ধূসর curtain তো আবার জুড়ে গিয়ে স্ক্রীন ঢেকে দিল না! সেই পর্দা, তারপর এতবার বিজলীতে ছবি দেখেছি, কিন্তু আর দেখা দেয়নি! মা’কে প্রশ্ন করতে বলেছিলেন, “ও শুধু তোমাকে একবার দেখতে এসেছিল তো! দেখা হয়ে গেছে, তাই আর আসছে না।” পুরনো কলকাতা-বিশেষজ্ঞরা কিছু জানেন?

১৯৬৬ সালে বিজলীতে রম-রম করে চলা ‘মণিহার’-এর টিকিট বাবা কেনেন, আবার সেই রাত্রির শো-তে। মজার কথা হলো যে বাবা আমাকে নিয়ে  গিয়েছিলেন বিজলীর পাশে ভারতীতে ‘দোলগোবিন্দের কড়চা’-র টিকিট কাটতে। কেন যে তা হলো না জানি না। প্রসঙ্গত দুটি ছবিই একদিনে মুক্তি পায়ঃ ৪ঠা ফেব্রুয়ারী। আমি তো খুব খুশি কারণ ছবিতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আছেন বিশ্বজিৎ, যাঁর আমি ভক্ত হয়ে উঠেছিলাম সেই তিন বছর বয়সে ‘শেষ পর্যন্ত’ দেখে! বলা বাহুল্য, হাসির ছবি না হওয়ার দরুণ আমার পুরনোপন্থী মা-বাবার ছবিটি একেবারেই ভালো লাগেনি, মা তো ‘কে যেন গো ডেকেছে আমায়’ গানটিতে ‘মরমিয়া-দরদিয়া’ কথা দুটির ব্যবহারে এতই বিরক্ত হয়েছিলেন, যে ওই শব্দ দুটি প্রায়ই ভেংচি কেটে উচ্চারণ করতেন! ছবিটি অবশ্য প্ল্যাটিনাম জুবিলী করেছিল! এবং গানের জগতে প্রায় যুগান্তকারী ঘটনা ছিল ছবির শুরুতেইঃ পাহাড়ী সান্যালের মুখে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে তাঁর আদর্শ পুরুষ (এবং বেতারের সঙ্গীত শিক্ষার আসরের কল্যাণে আমার শৈশবের সঙ্গীতগুরু) পঙ্কজ মল্লিকের গান!

১৯৬৭-র এপ্রিলে বিজলীতে দেখি অরুন্ধতী দেবীর পরিচালনায় ‘ছুটি’, যে ছবির জন্যে নন্দিনী মালিয়া নাকি অসুস্থ, মৃত্যুমুখী নায়িকার চরিত্রে ‘টাইপকাস্ট’ হয়ে যানছবিটির অন্যতম সম্পদ সুচিন্তিতভাবে রবীন্দ্রসঙ্গীত এবং প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে দুটি হারিয়ে যাওয়া গানের ব্যবহারঃ ‘আমার জীবন নদীর ওপারে’ আর ‘আমার হাত ধরে তুমি নিয়ে চলো সখা’।

১৯৬৯ সালে মুক্তি পাওয়া একটি মাত্র ছবিই দেখেছিঃ সত্যজিৎ রায়ের ‘গুপী গাইন ও বাঘা বাইন’, বিজলীতে।

১৯৭০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত বাংলা ছবি ঐ বছরে একটিই দেখেছিঃ বিজলীতে ‘এই করেছ ভাল’, বিধায়ক ভট্টাচার্যের কাহিনী ও চিত্রনাট্য। মৃত্যুশয্যায় বাবা বা মামা তাঁর চোখে অপদার্থ দুই ছেলেকে– নাকি ভাগ্নে? - (অনুপকুমার ও সমরজিৎ) পথে আনার জন্যে উইল করে গেছেন যে সম্পত্তি পেতে হ’লে তাদের ‘ডিভোর্স’ হওয়া মেয়ে বিয়ে করতে হবে। অপরদিকে দুই কন্যার (জুঁই বন্দোপাধ্যায় ও শমিতা বিশ্বাস) বিত্তবান কিন্তু কৃপণ পিতা (কানু বন্দ্যোপাধ্যায়) এবং তাঁর ভৃত্য (রবি ঘোষ)। এই চাকরটি তার বিভিন্ন কীর্তির জন্যে তিরস্কৃত হ’লেই গম্ভীর গলায় বলে, “খুব খারাপ লাগে। যাই, একটু কেঁদে আসি!” কী করে  ছেলেমেয়েদের মিলন ঘটে তাই নিয়েই হাসির ছবি। অনুপকুমার মঞ্চের অভিনেতা, তাঁর গুরু জহর রায়। বিশেষ করে রবি ঘোষ অভিনীত চরিত্রটি নিয়ে প্রচুর পাবলিসিটি হয়েছিল, তিনি নাকি দারুণ করেছেন। আমার তুলনায় কানু বন্দ্যোপাধ্যায় অভিনীত বাবার চরিত্র বেশী উপভোগ্য লেগেছিল। বাবা ছবি দেখার পর চরম বিরক্তিভরে বলেছিলেন, “আমার জন্যে বাংলা ছবির টিকিট আর কেটো না!” উক্তিটি মনে রাখবেন! কেন, তা ১৯৮১ সালে এলে বুঝবেন! প্রসঙ্গত, বলে রাখি আমাদের পরিবারে প্রধানত ইংরেজী ছবিই দেখা হ’তো।

১৯৭২ আমার বাংলা ছবি দেখার ইতিহাসে একটা মাইল ফলক! আমার সবচেয়ে প্রিয় তিনটি বাংলা ছবির– মুক্তির সময়ের হিসেবে– প্রথমটি দেখি এই বছরে। সেপ্টেম্বরে মুক্তি পায় মিনার-বিজলী-ছবিঘর ‘চেন’-এ হীরেন নাগ পরিচালিত, শঙ্কু মহারাজের ভ্রমণ-কাহিনী অবলম্বনে ‘বিগলিত করুণা জাহ্নবী যমুনা’। বাড়িতে ছিল ১৯৫২ সালের ‘মহাপ্রস্থানের পথে’ ছবির স্তোত্রগানের রেকর্ড, পঙ্কজ মল্লিক এবং অন্যান্যদের উদাত্ত-গম্ভীর কণ্ঠে। ছবিটি তখনো দেখার সৌভাগ্য হয়নি। ‘বিগলিত করুণা’তেও চিত্রনাট্য শুনিয়ে অনিচ্ছুক পঙ্কজবাবুকে নাকি রাজী করিয়েছিলেন হীরেন নাগ! একের পর এক স্তোত্রগান, দুটিতে মুখ্যকণ্ঠ পঙ্কজবাবুর। এছাড়া একটি বাউল গান তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গলায়। দুটি রবীন্দ্রসঙ্গীতঃ নায়িকা মধুচ্ছন্দার মুখে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গলায় ‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে’, আর সবিতাব্রত দত্তের মুখে শ্যামল মিত্রের গলায় ‘মহাবিশ্বে, মহাকাশে, মহাকাল মাঝে’আমার অভিযোগ, ঐ একই অভিনেতার মুখে ‘চরৈবেতি’ মন্ত্রে তো কণ্ঠ ছিল পঙ্কজ মল্লিকের! এই রবীন্দ্রসঙ্গীতের জন্যেও প্রয়োজন ছিল সেই মেঘমন্দ্র কন্ঠস্বরের!

এছাড়া মুগ্ধ করেছে গোমুখ-যাত্রাপথে বিভিন্ন চরিত্রের মধ্যে ভাবের আদান-প্রদান। নায়ক বাঙালী শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় ও সুমন-নাম্নী মারাঠী ব্রাহ্মণ কন্যার ভূমিকায় মধুচ্ছন্দার কণ্টকিত প্রেম, অবাঙালী শিশুকন্যা মুন্নি আর দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে শারীরিক-মানসিকভাবে বিধ্বস্ত জার্মান কার্লের ভাষার বাধা পেরিয়ে মুগ্ধকর ভালোবাসার ছবি – প্রতিটি আমার মন কেড়েছিল। বিজলীতে ছবিটি দেখেছি মোট ৪ বার, সেপ্টেম্বরে মুক্তি পাওয়া থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে। মাঝে, বেশ কিছু বাংলা প্রেক্ষাগৃহে ধর্মঘট হবার জন্যে, একাধিক ছবির প্রদর্শন বন্ধ ছিল। এর পরে, কোন এক শুক্রবার খোলার পরই, মিনার-বিজলী-ছবিঘরের কর্তৃপক্ষ কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে জানান যে ‘বিগলিত করুণা জাহ্নবী যমুনা’ আর দু’ দিন হলে থাকবে, তার মধ্যে যাদের দেখার, তারা যেন দেখে নেন। একটা দোকান থেকে লজেন্স কিনে টাকা ভাঙালাম, দু টাকা পাঁচ পয়সা দিয়ে টিকিট কেনবার জন্যে! সেই চতুর্থ এবং শেষবার ছবিটি দেখা! এর অনেক পরে, বিদেশ থেকে ফিরে VHS ক্যাসেট কিনে বাড়িতে ছবিটি রেখেছিলাম। যাবতীয় VHS  ক্যাসেট দান করে দিয়েছি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের Film Studies বিভাগকে। জানি না এখন খুঁজলেও CD বা DVD পাব কিনা।

১৯৭৩-এর ডিসেম্বরে বিজলীতে দেখেছিলাম ‘ননীগোপালের বিয়ে’। মন্দ লাগেনি, বিশেষ করে শুরুতে কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ধুন্ধুমারের মধ্যে দিয়ে নায়ক-নায়িকার (চিন্ময় রায়, জুঁই বন্দ্যোপাধ্যায়) পরিচয়, প্রথমে নায়িকার বিরূপতা, শুধু যে তিনটি রবীন্দ্রসঙ্গীত সে গাইবে তাই নিয়ে দিশেহারা ননীগোপালের বদ-রসিকতার জন্যে নয়, তার পদবী ‘মল্লিক’ থেকে ‘বেল্লিক’ করে ফেলার জন্যে,  ইত্যাদি! তবে একটা ক্ষোভ নিজের প্রতিই রয়ে গেছে। একই সময়, বিজলীর উল্টোদিকে ইন্দিরায় চলছিল এক ব্যতিক্রমী ছবি ‘বিজ্ঞান ও বিধাতা’। সেটিই বা সেটিও কেন দেখিনি? আর তো চাইলেও দেখতে পাব না!

১৯৭৩/৭৪ সালেই বিজলীতে দেখেছি পুনর্মুক্তিপ্রাপ্ত ১৯৫৯ সালের ছবি ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’। মূল আকর্ষণ ছিল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে বাংলা গান ছাড়াও সংস্কৃত শ্লোকোচ্চারণ। ভ্রমণ-কাহিনি হিসেবে, আমার দেখা ছবিগুলির মধ্যে, সবচেয়ে ভাল লেগেছে ১৯৭২-এর ‘বিগলিত করুণা জাহ্নবী যমুনা’, যার সম্বন্ধে আগেই লিখেছি। ‘হিংলাজে’র ওপর প্রভাব ছিল ১৯৫২ সালের যুগান্তকারী নিউ থিয়েটার্সের ‘মহাপ্রস্থানের পথে’র, যে ছবি দেখব আরও কয়েক বছর পর রবিবার সকালের বিশেষ প্রদর্শনীতে, বসুশ্রী সিনেমায়। ‘হিংলাজে’র শুরুতেই শিহরিত হয়েছিলাম হেমন্তকণ্ঠে শ্লোক শুনে। দু’টি অনবদ্য বাংলা গান তো ছিলই (‘তোমার ভুবনে মা গো এত পাপ’ আর ‘পথের ক্লান্তি ভুলে’) আর ছিল দু’বার দীর্ঘ – স্তোত্রগান নয় – শ্লোকপাঠ। এর মধ্যে ‘হে চন্দ্রচূড়’ নামক শিবস্তোত্রটি ‘মহাপ্রস্থানের পথে’তে দারুণভাবে গেয়েছিলেন পঙ্কজ মল্লিক, অন্যান্যদের সঙ্গে। তাই হেমন্তর ‘পাঠ’ তুলনায় ম্লানই মনে হয়েছিল। আমার মতো হেমন্ত-পাগলেরা আরও একটা ব্যাপার লক্ষ্য করে থাকবেনঃ ছড়িদার-চরিত্রে অনিল চট্টোপাধ্যায়ের মুখেই ছবির দুটি বাংলা গান আর শ্লোক। তার ওপর, প্রথম আবির্ভাবে তার মুখে হেমন্তকণ্ঠে হিন্দি ‘নাগিন’ ছবির সেই বিখ্যাত গানের প্রথম কলি – ‘মন ডোলে মেরা, তন ডোলে মেরা’! আরেকটা কথাঃ বয়ঃসন্ধির সময় এই ছবিটি বাবা-মার সঙ্গে বসে দেখা বেশ অস্বস্তিজনক লেগেছিলনায়িকা কুন্তী (সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়) ধর্ষণের শিকার, তীর্থযাত্রীদের মধ্যে পাহাড়ী সান্যাল অভিনীত চরিত্রটি এবং আরেকজন অসংযত যৌনকর্মের গ্লানিতে আক্রান্ত! যথারীতি বাবা-মা চরম অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন, বাবা বিশেষ করে ছবির সঙ্গীতের উৎকর্ষ স্বীকার করেও আমার হেমন্তর গান শোনার প্রতি ‘লোভ’ কে সম্বরণ করার কথা বলেছিলেন। প্রসঙ্গত, এটি আমার বড় পর্দায় দেখা উত্তমকুমার অভিনীত পঞ্চম ছবি।

এখানে উত্তমকুমার গতানুগতিক ‘রোম্যান্টিক’ নায়ক কিন্তু নন। থিরুমল প্রেমে মুগ্ধ হয়ে কুন্তীকে নিজের সঙ্গে ঘরছাড়া ভবঘুরের জীবন যাপন করতে বাধ্য করেছে। ফলে  কুন্তীর কপালে জুটেছে নারীর পক্ষে যা চরম লাঞ্ছনা, তাই। হিংলাজের তীর্থযাত্রীদের দলে পড়ে পথের কষ্ট আর তারপর উদভ্রান্ত কুন্তীর প্রত্যাখ্যান তাকে করে তোলে উন্মাদ। সাময়িক ভাবে প্রকৃতস্থ হয়েও সে আবার পাগল হয়ে যায়, শেষে হিংলাজের ফুটন্ত কুণ্ডে করে আত্ম-বলিদান। এ এক বিচিত্র চরিত্র-চিত্রায়ন!

১৯৭৪-এ প্রথম দেখা বাংলা ছবি বিজলীতে তরুণ মজুমদারের ‘ফুলেশ্বরী’, দেখার কারণ অবশ্যই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। গানে হেমন্ত নিরাশ করেননি বটে, কিন্তু ছবিটি তেমন মনে ধরেনি। এর দুটি কারণঃ ফুলেশ্বরীরূপী সন্ধ্যা রায়ের দাদার ভূমিকায় অনুপকুমারের অতি-অভিনয়, আর কাহিনিতে প্রায় অলঙ্ঘ্য সমস্যা সৃষ্টি করে তারপর হঠাৎ ‘তারপর সব ঠিক হয়ে গেল!’ কৌশল অবলম্বন। তরুণবাবু আমার সবচেয়ে প্রিয় বাংলা ছবির পরিচালক, এবং এই খেলাটি কিন্তু তিনি একাধিকবার খেলেছেন। আর আমার তিনটি অতিপ্রিয় বাংলা ছবির তালিকায় প্রথম স্থানে ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’-এর সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে ১৯৮০ সালে তৈরি তাঁর যে ছবিটি, তাতেও কিন্তু শেষে এই একই কাণ্ড করেছেন পরিচালক, তবে ‘ফুলেশ্বরী’র মতো ঠিক অতটা দায়সারাভাবে নয়। সে প্রসঙ্গে যথাসময়ে আসব।

প্রসঙ্গত, এতদিনে আমি ইস্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে ভর্তি হয়েছি (১৯৭৪-এর দ্বিতীয়ার্ধে)। পাঠ্যের মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দেবী চৌধুরাণী’। অতএব গেলাম বিজলীতে ছবির চিত্রায়নে জীবনে সর্বপ্রথম মহানায়িকা সুচিত্রা সেনকে চাক্ষুষ করতে! না ছবি ভালো লাগলো, না তাঁর অভিনয় মন কাড়লো!

১৯৭৫-এ বেতারে সমালোচনা শুনে বিজলীতে দেখা হল ‘রাণুর প্রথম ভাগ’। বেশীর ভাগ বাংলায় লেখা সমালোচনা ছবিটির প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেও, আমার মতেThe Statesman দৈনিকের সমালোচক একদম সঠিক বলেছিলেনঃ An inane attempt! পরিচালক তপন সিংহ বা তরুণ মজুমদার হলে একটা মন-ছোঁয়া ছবি হতে পারত। যা হয়েছে তা অতি-সাঙ্কেতিকতা দোষে দুষ্ট, শেষ দৃশ্যে এক অর্থহীন ‘গিমিক’ সম্বলিত একটি বাজে ছবি। নাম-ভূমিকায় নীরা মালিয়া শ্রেষ্ঠ শিশুশিল্পী হিসেবে জাতীয় পুরষ্কার পেয়েছিলেন! এ ধরনের ছবিতে এই  জাতীয় পুরষ্কারের সগর্ব ফাঁকা আওয়াজ ছাড়া কিছু থাকে না। অনেক পরে দূরদর্শনে এর চেয়েও অসহ্য, এবং একাধিক জাতীয় পুরষ্কার-প্রাপ্ত, এক ছবি দেখার দুর্ভাগ্য হয়েছিলঃ ‘দিবারাত্রির কাব্য’ (১৯৭০)!

এর পর ঐ ৭৫-এ, আবার বিজলীতেই, দেখলাম ‘ছুটির ফাঁদে’। মোটামুটি মজার ছবি, যদিও অপর্ণা সেন অভিনীত জয়তী চরিত্রটিকে বেশ গায়ে-পড়া, অতি-ন্যাকা লেগেছিল। চমৎকার করেছিলেন ‘পিকভোট’-রূপী উৎপল দত্ত। ১৯৬৫ সালে বাবা ভারতীয় সৈন্যদল থেকে অবসর নিয়ে Voltas কোম্পানীতে যোগ দিয়েছিলেন। সেই সুবাদে ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৬-এর জুন মাস অবধি আমাদের ঠিকানা ছিল মধ্য কলকাতার রাসেল স্ট্রীটে, কোম্পানীর ফ্ল্যাট। Voltasথেকে বাবা অবসর নেন ঐ ৭৬-এর ফেব্রুয়ারীতেই, কিন্তু কোম্পানীর কর্তৃপক্ষ, অতি সৌজন্য-সহকারে আমাদের ১৫ই জুলাই অবধি ফ্ল্যাটে থাকার অনুমতি দেন, যাতে আমি B. A. Part 1 পরীক্ষা নির্বিঘ্নে শেষ করতে পারি। এর মধ্যে ধীরে-ধীরে আমাদের জিনিসপত্র সরতে থাকে বাবার তৈরি আমাদের নিজস্ব ‘সল্ট লেক’ (বিধান নগর)-এর বাড়িতে। এই টালমাটাল সময় একটি বাংলা ছবিই  দেখা সম্ভব হয়েছিলঃ বিজলীতে তপন সিংহের ‘হারমোনিয়াম’। আর এটিই সম্ভবত আমার প্রথম ‘প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য’ মার্কা বাংলা ছবি! ছবিটির কাহিনির উপস্থাপনায় বেশ অভিনবত্ব আছে। বাদ্যযন্ত্রটি যেখানে-যেখানে হাতবদল হয়ে গিয়ে পড়ছে, সেখানেই তাকে কেন্দ্র করে ঘটছে বিচিত্র সব ঘটনা। আমাদের মতো সাহিত্যের ছাত্রদের কাছে তখন এটি ইউরোপীয় সাহিত্যের picaresque novel-এর এক অদ্ভুত রূপ! উক্ত উপন্যাসগুলিতে বিভিন্ন ঘটনার কেন্দ্রে থাকে কোন মনুষ্যচরিত্র – যেমন টম জোনস বা রডেরিক র‍্যানডম! এখানে তাদের জায়গায় একটি আপাত-অজীব বস্তু, যে কিন্তু মানুষের হাতে হয়ে ওঠে বাঙ্ময়! প্রথম মালিক, সুররসিক জমিদারের (অসিতবরণ) কাছ থেকে সে যায় এক উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারে (কালী বন্দ্যোপাধ্যায়, সোনালী গুপ্ত), সেখান থেকে বেশ্যালয়ে (শমিত ভঞ্জ, আরতি ভট্টাচার্য, ছায়া দেবী, স্বরূপ দত্ত), তারপর আবার ফিরে আসে এক মধ্যবিত্ত গৃহে (বিপত্নীক অনিল চট্টোপাধ্যায়) যেখানে সেটি দেখতে পান সেই জমিদারের কন্যা (অরুন্ধতী দেবী)। গানে-গানে মুখর এই ছবিতে সবাই চমৎকৃত হয়েছিলেন ছায়া দেবীর স্বকণ্ঠে গাওয়া গান শুনে। কিন্তু আমার মনপ্রাণ-জুড়ে তো সেই একজনের গলাঃ ‘মন বলে, “আমি মনের কথা জানি না!”’, যে গান আমরা এবং জমিদার প্রথম শুনি একক কণ্ঠে (কার কণ্ঠ বলা নিস্প্রয়োজন), এবং যাতে ছবির শেষে স্মৃতির ধারায় ভেসে গলা মেলান জমিদার-কন্যাও!

তখন থেকে কলকাতার উত্তরপূর্ব প্রান্তে বাস করলেও হাতিবাগান-শ্যামবাজার তখনো চেতনার বাইরে! ১৯৭৭ সাল। গেছি লেক মার্কেটে মাসীমার বাড়ি ভাবলাম, এই সুযোগে ইন্দিরায় দেখব অগ্রগামী পরিচালিত ‘স্বাতী’কারণ, ছবির সঙ্গীত পরিচালক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মানে তাঁর গলায় গান থাকার সম্ভাবনা! পাকড়াও করলাম ম্যাডক্স স্কোয়ারের পাশে থাকা ইস্কুলের বন্ধুকে। সে তো ‘স্বাতী’ শুনেই “রে রে” করে উঠল। যে ছবির উৎস-কাহিনীর নাম ‘নেকী’ তা’ সে কিছুতেই দেখবে না। আমাকে বগলদাবা করে সে হাজির ইন্দিরার ঠিক উল্টোদিকে বিজলীতে, যেখানে তখন চলছে ‘আনন্দ আশ্রম’আমি গজগজ করছিঃ কোথায় হেমন্ত, আর কোথায় শ্যামল মিত্র-কিশোরকুমার! অবশ্য, ততদিনে ‘আমার স্বপ্ন তুমি’ গানটা শুনে মন্দ লাগেনি! প্রথমার্ধে  উত্তমকুমারের বেশ বয়েস হয়ে গেছে, আর শরীরে মেদের পরিমাণও চোখে লাগছিল! কিন্তু, বিরতির ঠিক আগে, যখন মৃতা স্ত্রীর পাশে হাঁটু গেড়ে বসে উত্তম কাঁদছেন, বন্ধুটি খোঁচা মেরে বলল, “কি অভিনয় দেখেছিস?” নিমরাজি হয়ে উত্তর দিলাম, “হুঁ!” কিন্তু বিরতির পর বয়স্ক অমরেশকে (উত্তম-অভিনীত চরিত্রের নাম) দেখে আমি বাক্যহারা!

আমাকে জোর করে ‘আনন্দ আশ্রম’ দেখানোর পেছনে কাহিনিটা পরে জেনেছিলাম। শুধু ‘নেকী’র প্রতি অনীহা নয়! আমার বন্ধুবর আগে একদিন ছবিটি দেখতে এসেছিলেন। কিন্তু বিরতিতে পেট মোচড় দেওয়ায় তাকে বাড়ি ছুটতে হয়! তাই আমাকে নিয়ে পুরো ছবি দেখা!

‘আনন্দ আশ্রম’, যতদূর জানি, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের ‘তিন পুরুষ’ কাহিনী অবলম্বনে তৈরি, যেটি নিয়ে ১৯৪০ সালে নিউ থিয়েটার্স করেছিল ‘ডাক্তার’ ছবি, ঠিক ‘আনন্দ আশ্রমে’র মত বাংলা এবং হিন্দিতে। অনেক পরে নন্দনে ‘ডাক্তার’ দেখে মনে হয়েছে যে এক উত্তমকুমার (এবং কিছুটা শর্মিলা ঠাকুর)কে বাদ দিলে ১৯৭৭-এ পুনর্নির্মিত ছবিটি অনেকটাই হতাশ করেছে। নায়কের - ১৯৪০-এ অমরনাথ, ১৯৭৭-এ অমরেশ -  কঠোর পিতার চরিত্রে নটসূর্য অহীন্দ্র চৌধুরী অশোককুমারের চেয়ে কয়েক যোজন এগিয়ে, বিশ্বস্ত কিন্তু সহানুভূতিশীল ভৃত্যের রূপে অসিত সেন ১৯৪০-এর অমর মল্লিকের ধারে-কাছে যেতে পারেননি, এবং তৃতীয় প্রজন্মের জ্যোতিপ্রকাশ ও ভারতী দেবীর পাশে রাকেশ রোশন একরকম, মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় অসহ্য। বাঙালীদের নমস্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব পঙ্কজকুমার মল্লিক অমরনাথের চরিত্রে ছবির সুরকার হিসেবে একাধিক অবিস্মরণীয় গান গেয়েছেন (একটি রবীন্দ্রসঙ্গীতও) কিন্তু নায়কের ভূমিকায় অভিনয়ে উত্তমকুমারের সমতুল্য তাঁর আগে কেউ ছিল না, তাঁর পরেও কেউ আসেনি। উৎপল দত্তও খুব উপভোগ্য অভিনয় করেছেন। কিন্তু, বিশেষ করে দ্বিতীয়ার্ধে, উত্তমকুমারকে বাদ দিলে ছবির আবহাওয়ায় কোনরকম বাঙালীত্বের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে! আর শক্তি সামন্ত খানিকটা ইচ্ছাপূরণের পথে হেঁটেছেন কঠোর পিতা ও মুক্তমনা পুত্রের মিলন দেখিয়ে। ‘ডাক্তার’ ছবির শেষে এই সুখ-সমাপনের অভাব এবং নিজের পূর্বপুরুষের তৈলচিত্রের সামনে দাঁড়িয়ে অহীন্দ্রবাবুর মর্মস্পর্শী পরাজয় স্বীকার অনেক বেশী স্মরণীয়।

আমার সেই ‘আনন্দ আশ্রম’ বন্ধুকে অনেক কষ্টে সল্ট লেক থেকে দক্ষিণ কলকাতায় ফোনে যোগাযোগ করে (বয়স্ক পাঠক মনে করে দেখুন সেই সত্তরের দশকে কাউকে ফোনে পেতে গেলে একটা নম্বর কতবার ডায়াল করতে হতো!) গেলাম বিজলীতে ছোটবেলার অতিপ্রিয় উপন্যাস ‘চারমূর্তি’র (১৯৭৮) চিত্রায়ন দেখতে। চিন্ময় রায়ের টেনিদা ধুতি নয়, চোস্ত প্যান্ট পরে, বাকি ৩ জনও তাই। চিন্ময় রায় যাহোক একটা কিছু করেছেন, প্যালারামের মধ্যে অল্প চারিত্রিক বৈশিষ্ট পেয়েছি, হাবুল আর ক্যাবলা একেবারেই ম্যাড়ম্যাড়ে! খলনায়কদের মধ্যে একমাত্র স্বামী ঘুটঘুটানন্দরূপী সত্য বন্দ্যোপাধ্যায় নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের সৃষ্টির কাছাকাছি যেতে পেরেছেন, শম্ভু ভট্টাচার্যের গজেশ্বর শুধুই হাস্যকর, চাপা হিংস্রতা একেবারেই নেই, রবি ঘোষের শেঠ ঢুণ্ডুরাম হাবুল-ক্যাবলার মতই ম্যাড়ম্যাড়েযে টেনিদার গান শুনে চাটুজ্জেদের পোষা কোকিল হার্টফেল করেছিল, সে এখানে একাধিক গান গায় মান্না দের গলায়! ছবিটি অবশ্য দারুণ জনপ্রিয় হয়েছিল!

বিজলীতে আজ অবধি দেখা শেষ বাংলা ছবি ২০১৪ সালের ‘পিকনিক’, পরিচালক রাজ মুখোপাধ্যায়, অভিনয়ে দেবরাজ রায়, সুদীপ মুখোপাধ্যায়, জয় বদলানী প্রমুখ। ইন্দর সেন পরিচালিত ১৯৭২ সালের একই নামের ছবির সঙ্গে গুলিয়ে ফেলবেন না। একটি বাজে ভূতের ছবি দেখে মজা পাব ভেবে গিয়েছিলাম! ভূতের ছবি নয়, রহস্য কাহিনি, অতিদীর্ঘ এবং ক্লান্তিকর। তার ওপর, বোকামি করে ব্যালকনির টিকিট কেটেছিলাম, আর কর্তৃপক্ষ হলে দর্শকের সংখ্যা দেখে যুগপৎ শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র এবং সমস্ত পাখা বন্ধ করে রেখেছিলেন। ফলে ছাদের গরম ভাপ পুরো ভোগ করতে হয়েছিল। বিরতিতেই বন্ধুপ্রতীম ছাত্র অভিরূপ প্রস্তাব দিল বেরিয়ে যাওয়ার। নেহাত হত্যাকারী কে জানবার জন্য বিরতির পরেও গরম সহ্য করে বসেছিলাম। জানা মাত্র দুজনে চম্পট দিই।

এত বাংলা ছবি ছাড়াও ১৯৮২ থেকে ১৯৮৪-র মধ্যে দুপুরের শো-তে দেখি বিজলীতে একমাত্র হিন্দি ছবি, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রযোজিত এবং বিশ্বজিৎ, ওয়াহিদা রহমান, ললিতা পাওয়ার অভিনীত Daphne du Maurier-এর Rebecca উপন্যাসের অন্যতম ভারতীয় চিত্ররূপ, ১৯৬৪ সালের ‘কোহরা’, যার গানগুলি মুগ্ধ করা, কিছু দৃশ্য বেশ ভয়ের, Alfred Hitchcock-এর Rebecca-র চিত্রায়ন, এবং দুটি দৃশ্যে উক্ত পরিচালকের Psycho ছবির প্রভাব স্পষ্ট।

 

মিনার



 

এতদিনে এই ‘চেন’-এর মিনারে (শ্যামবাজার) দেখেছি সেই ১৯৬৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সত্যজিৎ রায়ের ‘চারুলতা’।

১৯৮২তে দেখা দুটি নতুন ছবিই তরুণ মজুমদারের। বছরের গোড়ায় মিনারে ‘মেঘমুক্তি’, যেখানে দেবশ্রীকে দেখে (তিনি দ্বিতীয় নায়িকা, অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিপরীতে) 36 Chowringhee Lane-এর ঘা সেরেছিল! মূল নায়ক-নায়িকা বিশ্বজিৎ-সন্ধ্যা রায়, বিশ্বজিৎ-অভিনীত চরিত্রটির নাম ‘হেমন্তকুমার রায়’, তিনি পেশায় গায়ক! হেমন্ত রায়ের মুখে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের চারখানা একক গান আর একটি সমবেত গান তখন মনে তেমন দাগ না কাটলেও এখন শুনতে বেশ লাগে। তখন আমার ভালো লেগেছিল হেমন্ত রায়ের নিজের বিয়ের বাসরে গাওয়া ‘তোমার মনের তুলসীতলায় আমার মনের প্রদীপ’। স্ত্রী সন্ধ্যা রায় সন্তানসম্ভবা হবার পর স্বামী রেকর্ড করেন, ‘বলো খোকা নাকি খুকু, কে আসছে ও কোল জুড়ি?/ কল্পলতার শাখায় ফুটছে সে কোন কুঁড়ি?’ আমার মা’র পছন্দ হয়েছিল এই গানটি। কাহিনির আসল জটিলতা এবং মজা অবশ্য বিশ্বজিৎ-অয়নের দোর্দণ্ডপ্রতাপ বাবা,  ভোজনরসিক উৎপল দত্তকে নিয়ে।

১৯৯০-তে দেখা প্রথম বাংলা ছবি, আমার হবু-স্ত্রীর সঙ্গে শ্যামবাজারের মিনারে তরুণ মজুমদার পরিচালিত ‘আপন আমার আপন’। আমার কাছে ছবির মুখ্য আকর্ষণ ছিল, ১৯৮৯-তে মনপ্রাণ হাহাকারে ভরিয়ে দিয়ে প্রয়াত, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের একটি দৃশ্যে উপস্থিতি। ঐ দৃশ্যে তিনটি বাক্য তিনি উচ্চারণ করেছিলেনঃ “আমি ...-এর প্রস্তাব সর্বান্তকরণে সমর্থন করছি,” আর নায়ক (তাপস পাল) তার গান শেষ করার পর, “বেশ গেয়েছো, বাবা! দেখো, এ কণ্ঠ যেন হারিয়ে না যায়!” মনে হয়, ছবির যে প্রিন্টটি এখন পাওয়া যায়, তাতে এই তৃতীয় বাক্যটি নেই!

ছবিটির সপক্ষে বলব যে তরুণবাবুর অন্যান্য ছবিতে যেভাবে শহুরে বিত্তবানদের নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা হয়, এখানে দীপঙ্কর দে-সঙ্ঘমিত্রা বন্দ্যোপাধ্যায়-শতাব্দী রায়-ইন্দ্রাণী দত্ত-দের পরিবারের ক্ষেত্রে তা হয়নি। এমনকি আপাতদৃষ্টিতে বিত্তের দম্ভে এবং প্রেমে ব্যর্থ হবার তাড়নায় সাময়িকভাবে বিপথগামী প্রসেনজিতের চরিত্রটিও শেষ পর্যন্ত অত্যন্ত অনুমানযোগ্য পদ্ধতিতে আত্মত্যাগ করে নিজেকে উদ্ধার করেছে।

ছবির বড় খামতি তার মুখ্য গানটির সুর, যে গানের ওপর পুরো কাহিনিই নির্ভর করছেঃ ‘আঁধারে কখন এসে জ্বালবে প্রদীপ তুমি!/ পথের খোঁজে, পথের মাঝে হারিয়ে গেছি আমি!’ সুরকার রাহুল দেব বর্মণ এবং গায়ক অমিতকুমার, দুজনেই হতাশ করেছেন! একেই বলে, বিসমিল্লায় গলদ! যাঁর সুরের স্পর্শে চিরকাল প্রাণ পেয়ে এসেছে তরুণ মজুমদারের ছবি (এই ছবি অবধি দুটি ব্যতিক্রম বাদেঃ হিন্দি ‘বালিকা বধূ’ ও বাংলা ‘অমর গীতি’), তিনি এই ছবিতে শুধুই পার্শ্বচরিত্র! অন্য গানগুলি অবশ্য মন্দ নয়।

এ বছরে দেখা দ্বিতীয় নতুন বাংলা ছবি, সেই একই সঙ্গিনীর সঙ্গে (ছবিটি দেখার ইচ্ছে ছিল তাঁরই), অপর্ণা সেন পরিচালিত ‘সতী’। সতীদাহের মতো একটা জ্বলন্ত বিষয় নিয়ে দু-দু’জন ‘বুদ্ধিদীপ্ত ছবির পরিচালক’ (অপরজন গৌতম ঘোষ) যে কি নিপুণতার সঙ্গে দুটি অদর্শনযোগ্য ছবি বানালেন তা সত্যিই সশ্রদ্ধ বিস্ময় উদ্রেক করে!

১৯৯৩-এ সেই সঙ্গিনীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হবার পর এপ্রিল মাসে তাঁর সঙ্গে ডবল শো দেখব স্থির করে গেলাম হাতীবাগান-শ্যামবাজার এলাকায় রাধায় ‘রক্তের স্বাদ’ আর মিনারে পদ্মানদীর মাঝি দেখতে। ১৯৯১-এ আপন আমার আপন ছিল আমার নির্বাচন, সতী তাঁর! এবারেও রক্তের স্বাদ আমি দেখতে চেয়েছিলাম, পরের ছবিটির নির্বাচন আমার রুচিশীলা জীবনসঙ্গিনীর। দুটি ছবি দেখে ফেরার পথে বাসের মধ্যেই আমার কম্প দিয়ে জ্বর আসে। বাড়িতে তারপর  দিন-সাতেকের জন্যে শয্যাশায়ী! আমি আজও দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে আগে পদ্মায় ভ্রমণ করে তারপর রক্তের স্বাদ নিলে আমায় অসুস্থ হয়ে পড়তে হত না!

বিয়ের বছরে আর একটিই নতুন বাংলা ছবি দেখেছি। সেই পদ্মানদীর মিনারে বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত পরিচালিত, মিঠুন চক্রবর্তী ও দীপঙ্কর দে অভিনীত তাহাদের কথা! একটি ব্যাপারেই রক্ষা – ছবিটির চলমান সময় পদ্মানদীর মাঝির চেয়ে কম ছিল, যে কারণে মূল ছবির সঙ্গে চার্লি চ্যাপলিন অভিনীত একটি স্বল্পদৈর্ঘের ছবি যোগ করা হয়েছিল। এই দ্বিতীয় ছবিটি মূল ছবির পরে দেখালে সেই পদ্মানদীর পর রক্তের স্বাদ নেওয়া হতে পারত।

এরপর সিনেমা হলে বাংলা ছবি দেখা সেই ১৯৯৬-তে মিনারে ঋতুপর্ণ ঘোষের উনিশে এপ্রিল। দেবশ্রী রায়ের বোধহয় সর্বশ্রেষ্ঠ অভিনয়, অপর্ণা সেনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে! তবে ঘর্মাক্ত কলেবরে ছবি দেখতে-দেখতে মনে হচ্ছিল যে নিজের ভাষায় তৈরী ছবি দেখতে গিয়ে এমন কৃচ্ছসাধন করতে হবে কেন? দর্শকদের কি ন্যূনতম স্বাচ্ছ্যন্দটুকু টিকিটের দামের বিনিময়ে প্রাপ্য নয়?

১৯৯৮-এ সপরিবারে আবার মিনারেই দেখা হয় ঋতুপর্ণ ঘোষের দহন। ছবির বিষয়বস্তু এতটাই রূঢ় ও বেদনাদায়ক যে বেশ ভয়ে-ভয়ে মিনারে ঢুকেছিলাম। তবে অত্যন্ত রুচিশীল চিত্রায়নের মহিমায় অত্যধিক মানসিক আঘাত লাগেনি। বোধহয় এই কারণেই জনৈক সমালোচক লিখেছিলেন, ‘উত্তাপহীন এ কেমন দহন?’ দুই কেন্দ্রীয় নারীচরিত্র ছাড়াও নির্যাতিতা মেয়ের বাবা হিসেবে শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় এবং প্রতিপক্ষের ঝানু ও নির্মম উকিলের ভূমিকায় নির্মলকুমারের অভিনয় মনে থাকবে। ঠাকুমার চরিত্রে সুচিত্রা মিত্রের আবির্ভাব ছিল বাড়তি চমক।

১৯৯৯-তে আমার শ্যালিকার বিয়ের পর, তাঁকে এবং ভায়রা-ভাইকে নিয়ে সস্ত্রীক আমি এবং শালাবাবু মিনারে দেখি ঋতুপর্ণ ঘোষের অসুখ। ভায়রা-ভাই দেখার পর বলেছিলেন, “যা দেখালেন, দাদা, সত্যিই অসুখ করে গেল!” শ্যালক বলেছিলেন, “বোঝা গেল যে ঋতুপর্ণ দ্বিতীয় সত্যজিৎ হচ্ছেন না!” নন্দনে আশির দশকের শেষে বা নব্বই-এর গোড়ায় ‘চাওয়া-পাওয়া’-র পর এক দশকেরও বেশী বড় পর্দায় তরুণবাবুর সঙ্গে দেখা হয়নি। আবার দেখলাম এবং মুগ্ধ হলাম ২০০৩ সালে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোট গল্প ‘কিন্নরদল’ অবলম্বনে চিত্রিত ‘আলো’ দেখে (প্রেক্ষাগৃহ শ্যামবাজারের মিনার)। আটখানি রবীন্দ্রসঙ্গীতে সমৃদ্ধ এই ছবিটির অভিনেতা-অভিনেত্রীরা তরুণবাবুর চিত্রবিশ্বে নতুনঃ নাম-ভূমিকায় ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, তাঁর স্বামীর চরিত্রে কুণাল মিত্র, পার্শ্ব চরিত্রে ভাস্বর চট্টোপাধ্যায়, আলোর একাধিক বোনেদের একজনের ভূমিকায় সৌমিলি বিশ্বাস, এবং অভিষেক চট্টোপাধ্যায়, যাঁর অভিনীত চরিত্রটি অনুপকুমারকে মনে করাচ্ছিল। তরুণবাবু তাঁর বেশীর ভাগ ছবিতে যেভাবে ‘God made the country, and man made the town’-এর দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চলেন, এ ছবিতে তার খানিক ব্যতিক্রম ঘটেছে। গ্রামের অভাব, সংকীর্ণমনস্কতা, কিছু ব্যক্তির – বিশেষ করে ঋতা দত্ত-চক্রবর্তী অভিনীত নারীচরিত্রটির – ক্রুরতা, কিছুই আড়াল করা হয়নি। বরং শহর থেকে আসা আলোর স্বতঃস্ফূর্ত ভালোবাসা আর মানুষকে আপন করে নেওয়ার মানসিকতায় শেষ অবধি আপ্লুত হয়েছে সবাই। আর এই কাজে অবস্মরণীয় হয়ে উঠেছে আলোর মুখে ‘শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে’ গানটি (কণ্ঠে অরুন্ধতী হোম চৌধুরী), বিশেষত তার সঞ্চারী এবং আভোগ অংশ, আর ঠিক তার আগে গানের যন্ত্রানুসঙ্গঃ

‘যে শাখায় ফুল ফোটে না, ফল ধরে না একেবারে,

তোমার ওই বাদল-বায়ে দিক জাগায়ে সেই শাখা রে!

যা কিছু জীর্ণ আমার, দীর্ণ আমার, জীবনহারা,

তাহারই স্তরে-স্তরে পড়ুক ঝরে সুরের ধারা।

নিশিদিন এই জীবনের তৃষার ‘পরে, ভুখের ‘পরে –

শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে, পড়ুক ঝরে!’

কাহিনী যে বিয়োগান্ত দিকে মোড় নেবে, তার পূর্বাভাস এসেছে আলো তার কিন্নরদলকে নিয়ে গ্রামে নৃত্য-গীতানুষ্ঠান করার সময়ে নাচের সঙ্গে যে গানটি পরিবেশন করেঃ

 

‘আমার রাত পোহাল শারদপ্রাতে –

বাঁশি, তোমায় দিয়ে যাব কাহার হাতে?’

সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে আলোর মৃত্যুর সংবাদে সারা গ্রাম যখন মুহ্যমান, তখন হঠাৎ এক রাতে আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে তারই কণ্ঠেঃ

 

‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে,

আমি বাইব না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে।

….

তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি?

সকল খেলায় করবে খেলা এই আমি!

নতুন নামে ডাকবে মোরে, বাঁধবে নতুন বাহুর ডোরে,

আসব-যাব চিরদিনের সেই আমি!’

উদভ্রান্ত হয়ে গ্রামের মানুষ আলোর বাড়িতে ছুটে গিয়ে দেখে অন্ধকারে বসে এক  ছায়ামূর্তি! না, প্রেতাত্মা নয়, আলোর স্বামী। গ্রামোফোনে সে বাজাচ্ছে স্ত্রীর প্রয়াণের আগে রেকর্ড করা শেষ গান। আর তার প্রতিভূ সে রেখে গেছে তার কন্যাসন্তানের মাধ্যমে!

রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রয়োগে তরুণবাবুর জুড়ি মেলা যে ভার, সেই আশির দশকের গোড়ায় ‘দাদার কীর্তি’ দেখেই বুঝেছিলাম। এবারেও তিনি হতাশ করেননি।

 


‘আলো’-র তিন বছর পর (২০০৬) সেই মিনারেই স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে দেখি, আবার বিভূতিভূষণের ছোট গল্প অবলম্বনে, ‘ভালোবাসার অনেক নাম’। ছবির অন্যতম আকর্ষণ ছিল মুখ্য চরিত্রে উত্তমকুমারের নাতি গৌরব চট্টোপাধ্যায় আর  হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ছোট নাতনী মেঘা। এছাড়া ‘বালিকা বধূ’-র (১৯৬৭) পর এই প্রথম তরুণ মজুমদারের ছবিতে এলেন মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়! তবে, কাহিনীতে নিজের কনিষ্ঠা কন্যাকে বোনের ভূমিকায় অভিনয় করাবার সিদ্ধান্ত কার ছিল, কে জানে! অন্যান্য ভূমিকায় যথাযথ রূপদান করেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মনোজ মিত্র, তাপস পাল প্রমুখ। মনোজ মিত্র অভিনীত কন্যাদায়গ্রস্ত স্টেশনমাস্টারের মেয়ে বুলবুলির ভূমিকায় (সম্ভবত) মৌলি ভট্টাচার্য খুবই উপভোগ্য, কারণ বিমলকে (গৌরব) আকর্ষণ করতে – এই গ্রামের নবাগত ইস্কুলমাস্টারের গলাতেই বাবা মেয়েকে ঝোলাতে চান – বুলবুলি পুরনো দিনের বাংলা ও হিন্দী ছবির গানের সুরে তার প্রেম নিবেদন করে! বিমলের চরিত্র ‘ফুলেশ্বরী’-র কেদারকে (শমিত ভঞ্জ) মনে করায়। এছাড়া তার মুখে প্রাঞ্জলের কণ্ঠে ‘আমি অল্প নিয়েই থাকতে পারি, যদি পাই একটু ভালোবাসা’, পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখে শিবাজী চট্টোপাধ্যায়ের গলায় ‘ও নিঠুর দয়াল, এ কী তব খেলা’ (যা হেমন্তকণ্ঠে শোনা একাধিক গানের সুর মনে জাগিয়ে তোলে), আর একটি রবীন্দ্রসঙ্গীতের মন-ছোঁয়া প্রয়োগ (‘নয়, নয়, নয় এ মধুর খেলা) হৃদয়ে দোলা দেয়। তবে, ‘আলো’-র পর ‘ভালোবাসার অনেক নাম’ একটু নিস্তেজ লাগে।

 

ছবিঘর




আরেক বছর, উত্তমকুমারের জন্মদিন উপলক্ষে সারা শহর-জুড়ে ওঁর ছবি দেখানো হচ্ছিল। হবু-শ্যালিকার সঙ্গে (অতএব ১৯৯৩-তে বিয়ের আগে) শেয়ালদার ছবিঘরে দেখেছিলাম তপন সিংহের দুটি ছবিঃ

·         উপহার (১৯৫৫), যাতে উত্তমকুমার ও মঞ্জু দে পার্শ্বচরিত্র, কাহিনির কেন্দ্রে অদ্ভুত নিষ্ঠুর মানসিকতার পিতা কানু বন্দ্যোপাধ্যায় আর তাঁর কন্যার ভূমিকায় সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়।

·         ঝিন্দের বন্দী (১৯৬১), যাতে প্রথম দর্শনে বেশী নজর কেড়েছিলেন খলনায়ক ময়ূরবাহন-রূপী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। পরে ছোট পর্দায় ছবিটি আবার দেখে বুঝেছিলাম যে উত্তম-সৌমিত্রের বিরোধিতার দৃশ্যে আক্ষরিক অর্থে একে অপরকে টেক্কা দিয়েছেন দুই দাপুটে অভিনেতা।

এই পর্ব শেষ করার আগে একটি জনশ্রুতির উল্লেখ করি। হল তিনটির নামকরণ নাকি আদি মালিকের তিন কন্যার নামে! মীনা, বিজলী ও ছবি! একি সত্য?

পরের পর্বে আসব উত্তরা-পূরবী-ঊজ্জ্বলা নিয়ে।

 

(ক্রমশ)