সিনেমার পৃথিবী – ২৭
আজ
আমাদের গন্তব্য খুব কাছাকাছি। ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলো। একদম মাথার ওপর থেকে যদি ক্লকওয়াইজ
লিখতে শুরু করে পুরো একটা বৃত্ত ঘুরে আসি, তাহলে ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর নাম এভাবে
আসবেঃ আফগানিস্তান, চিন, নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ, মায়ানমার, শ্রীলঙ্কা, মলদ্বীপ এবং
পাকিস্তান। এরমধ্যে আমরা আজ নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের ছবি নিয়ে
আলোচনা করব। চিনদেশের সিনেমা নিয়ে আগেই আলোচনা করেছি।
শুরুর
আগে আবারো এক ছোট ফুটনোট। নেপালের সিনেমা মানে কিন্তু নেপালি সিনেমা নিয়ে আলোচনা নয়।
ওদের ইন্ডাস্ট্রি যে রকম ছবি বানায়, তা আমার আলোচনায় আসবে না। ষাটের দশক থেকে শুরু
করে নেপালি সিনেমা কোন না কোনভাবে মোটামুটি ভারতের সাহায্যেই চলেছে প্রায় কুড়ি বছর।
তারপর ওখানকার উৎসাহীরা নিজেরা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি চালানো শুরু করার পর প্রচুর সিনেমা
হয়ে চলেছে, যেমন বিখ্যাত গায়ক উদিত নারায়ণ ১৯৮৪ সালে নেপালি সিনেমায় নায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন, ‘কুসুমে
রুমাল’ নামক এক ছবিতে। এইসব ছবি হয়ত ফাঁকা
সময়ে লঘুমস্তিষ্কে দেখতে মন্দ লাগবে না, কিন্তু আমি এইসব ছবিতে উৎসাহী নই - সেটা আপনারা
জানেন। আমি আজ নেপালের যেসব সিনেমা নিয়ে আলোচনা করব, তারমধ্যে হিমালয়, এভারেস্ট এবং
ওখানকার আর্থ-সামাজিক অবস্থা ও আন্দোলন নিয়ে করা বিদেশী ছবির প্রাধান্য।
আমার
হিসেবে নেপাল সম্পর্কিত যে যে ছবি যথেষ্ট সাড়া জাগিয়েছে - হিমালয়া (১৯৯৯), দ্য সারি
সোলজার্স (২০০৮), কাটমান্ডু, এ মিরর ইন দ্য স্কাই (২০১১), হাইওয়ে টু ধাম্পাস (২০১৪),
রেড মনসুন (২০১৪), এভারেস্ট (২০১৫), শেরপা (২০১৫), সেতো সূর্য (২০১৬) এবং এভেন হোয়েন
আই ফল (২০১৭)। এর ভেতরে রেড মনসুন এবং সেতো সূর্য দুজন নেপালি পরিচালকের তৈরি, বাকি
ছবিগুলো বিদেশী পরিচালকদের। কিন্তু এই ছবিগুলোর প্রতিটাই পুরোপুরি নেপালে তৈরি এবং
নেপালের কোন না কোন দিক ফুটিয়ে তুলেছে। এরমধ্যে ফ্রেঞ্চ পরিচালক এরিক ভালির ‘হিমালয়া’
নেপালে তৈরি প্রথম ছবি যা অস্কার নমিনেটেড
হয়েছিল। ‘সারি সোলজার্স’ নেপালের গৃহযুদ্ধে মহিলা
সেনাদের অংশগ্রহন নিয়ে তৈরি, ‘কাটমান্ডু, এ মিরর ইন দ্য স্কাই’ এক বিদেশী মহিলার
নেপালে এসে বাচ্চাদের টানে সেখানে থেকে যাওয়ার ছবি, ‘হাইওয়ে টু ধাম্পাস’ প্রায় একই
থিমে কিন্তু এখানে সাধারন মানুষের দুর্দশার ওপর ফোকাস বেশি, ‘রেড মনসুন’ সম্পর্কের জটিল আবহে দুর্দান্ত,
‘এভারেস্ট’ ও ‘শেরপা’ এতই বিখ্যাত ছবি যে প্রায়
প্রত্যেকেই দেখেছেন, ‘সেতো সূর্য’ (সাদা সূর্য) নেপালের গৃহযুদ্ধ শেষ হয়ে যাবার পরেও
ক্ষত বয়ে বেড়াবার ছবি, ‘এভেন হোয়েন আই ফল’ নেপালের গরীব নাবালিকা মেয়েদের জিম শেখানোর
অছিলায় বাড়ি থেকে নিয়ে গিয়ে ভারত ও অন্যান্য
দেশের সার্কাসে কাজ করানোর জন্য কিভাবে পাচার করে দেওয়া হয়, সেই নিয়ে এক অসাধারণ ডকু।
আলোচনার
জন্য আজ আমরা বেছে নেব ‘হিমালয়া’। এরিক ভালির ১০৮
মিনিটের ছবি। ভালি নিজে একজন ক্যামেরাম্যান, সুতরাং এই ছবির সিনেমাটোগ্রাফি
যে অনবদ্য হবে, তা বলাই বাহুল্য। নেপালের উত্তর-পশ্চিম অংশের হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় বেঁচে
থাকার জন্য লড়াই আর মানুষের নিজেদের মধ্যে ক্ষমতা দখলের লড়াই, এই দুয়ের অদ্ভুত মিশ্রণ
এই সিনেমা। মাটি থেকে প্রায় ষোল হাজার ফুট
ওপরে হিমালয়ের ডলপা অঞ্চলের বাসিন্দারা ইয়াকের গাড়ি নিয়ে পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়ায়
রক সল্ট (সন্ধক নুন) খোঁজার জন্য। সেই রক সল্ট তারা নিয়ে যায় অনেক নিচের পাহাড়ি অঞ্চলে,
যেখানে নুনের পরিবর্তে তারা খাদ্যশস্য নিয়ে ঘরে ফেরে। বেঁচে থাকার জন্য সারা বছর এভাবেই
তাদের জীবন সংগ্রাম করতে হয়। এদিকে কে তাদের ক্যারাভ্যানকে পথ দেখাবে সেই নিয়ে এক আভ্যন্তরীণ
সমস্যা শুরু হয়। বয়স্ক টিনলে নাকি যুবক কার্মা,
কে হবে নেতা? তুষারঝড়ের মাঝে ক্যারাভ্যান এগিয়ে চলে আর টানটান চিত্রনাট্য-ও। টানাপোড়েনের
মাঝে অবশেষে বোঝা যায় জয় হয়েছে মানুষের, সর্বশক্তিমানের।
এই
ছবিতে ভাল লেগেছে ভালির নেপালের সাধারণ মানুষের ওপর বিশ্বাস, যে কারণে এখানে প্রায়
সব অভিনেতাই সাধার্ণ মানুষ - ডলপা অঞ্চলের বাসিন্দা। এবং যেটা আমার মনোযোগ কেড়েছে,
সেটা এক নিয়ম। তিব্বতিদের ‘স্কাই বুরিয়াল’ বা আকাশের মাঝে মৃত মানুষকে কোন এক উঁচু
পাথরের ওপর শুইয়ে দেওয়া যাতে আকাশের পাখিরা
তাকে ঠুকরে খেয়ে নিতে পারে, প্রকৃতির উপাদান আবার প্রকৃতিতেই ফিরে যায়। অরুণাচল প্রদেশেও
আমি অনেকটা এই রকম নিয়ম দেখেছি, যেখানে মৃত
মানুষকে বহু টুকরো করে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয় যাতে নদীর মাছ ও অন্যান্য জন্তুরা তাকে
খেয়ে শেষ করতে পারে। এই ছবিতে আরো এক ভাবার বিষয় এর পরতে পরতে লুকিয়ে থাকা দর্শন। অ্যাডভেঞ্চার
ভাল, কিন্তু তার ভেতরেও জানা দরকার সঠিক তথ্য, নইলে জীবন বিপন্ন হতে পারে। এই জ্ঞান
‘হিমালয়া’কে এক মহাকাব্য করে তুলেছে।
ভুটান এক ছোট্ট দেশ এবং এখানেও নেপালের মত অনেক বিদেশী ছবি তৈরি হয়েছে। কিন্তু নেপালের মত এখানে আমি বিদেশী ছবি না ঘেঁটে ভুটানের দুজন বৌদ্ধ লামার ছবি বেছে নেব। খেয়েন্তসে নোরবু এবং তার শিষ্য পাও চয়নিং দর্জি। নোরবু-র চারটে মাইলস্টোন ছবি- ‘দ্য কাপ’ (১৯৯৯), ‘ট্রাভেলার্স অ্যান্ড ম্যাজিশিয়ান’ (২০০৩), ‘ভারাঃ এ ব্লেসিং’ (২০১৩) ও ‘হেমা হেমা’ (২০১৬) এবং দর্জি-র এক অসাধারণ ছবি - ‘লুনানাঃ এ ইয়াক ইন দ্য ক্লাসরুম’ (২০১৯), ভুটানের সিনেমার খোলনলচে পুরো বদলে দিয়েছে। নব্বইয়ের দশক থেকে ছায়াছবি তৈরি শুরু করে যে দেশ সিনেমায় এত সুন্দরভাবে এগিয়ে যায়, তাদের প্রচেষ্টাকে কুর্নিশ জানাতেই হয়। এখানে আমরা দর্জির ‘লুনানাঃ এ ইয়াক ইন দ্য ক্লাসরুম’ নিয়ে আলোচনা করব।
এক
তরুণ শিক্ষক উগয়েন গানবাজনা ভালবাসে, অস্ট্রেলিয়া চলে যেতে চায়। কিন্তু দেশের প্রতি
তার আবশ্যিক কাজ এখনো বাকি। তাকে শিক্ষক হিসেবে পাঠিয়ে দেওয়া হয় লুনানা নামক এক প্রত্যন্ত
গ্রামে। সেই গ্রামে পৌঁছতে গেলে গাড়ি রাস্তা শেষ হবার পর পায়ে হাঁটা পথে আটদিন ট্রেকিং
করতে হয়। বহু কষ্টে গিয়ে উগয়েন দ্যাখে সেখানে না আছে ইলেকট্রিসিটি, না আছে কোন পড়ার
বই, না আছে ব্ল্যাকবোর্ড। সে হতাশ হয়ে পড়ে, গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে চায়। কিন্তু সেই দেবশিশুর
মত বাচ্চাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা ও সব কিছুর সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা দেখে সে রয়ে যায়।
তাদের সঙ্গে নিজেও শিখতে শুরু করে কিভাবে এত কাঠিন্য সত্বেও জীবন উপভোগ করতে হয়। সেই
গ্রামের এক অদ্ভুত নিয়ম, ক্লাসরুমের মধ্যে একটা ইয়াক-কে বেঁধে রাখা হয়। ভুটানের মানুষের
সঙ্গে ইয়াকের যে আন্তরিক সম্পর্ক, ইয়াকের গোবর যে ঘরবাড়ি গরম রাখতে সাহায্য করে, এগুলো
বোঝার জন্য ক্লাসরুমে সেই ইয়াক। প্রথমে অদ্ভুত লাগলেও পরে উগয়েন মানিয়ে নেয়। সেখানকার
এক যুবতী উগয়েনকে এক ফোক গান শেখায় ‘ইয়াক লেবি লাদার’। বছর ঘোরার পর উগয়েন লুনানা গ্রাম
ছেড়ে চলে যায়। সব বাচ্চারা মুষড়ে পড়ে। থিম্পু
ফিরে গিয়ে উগয়েন তার স্বপ্ন সাকার করতে অস্ট্রেলিয়া পাড়ি দেয়। সেখানে একবারে গায়ক হিসেব
কাজ নেয়। কিন্তু কেউ তার গান মন দিয়ে শোনে না। উগয়েন একদিন রেগে গিয়ে ‘ইয়াক লেবি লাদার’
গাইতে শুরু করে।
১০৯
মিনিটের অপূর্ব সিনেমা। সহজ ছবি, যা ভালবাসা যায়। এবং এটাও জানলে অবাক হবেন যে এই সিনেমায়
লুনানা গ্রামের যারা অভিনয় করেছে, তারা কেউ কোনদিন সিনেমা দ্যাখেনি, সিনেমা কি জিনিষ
তারা জানে না, সিনেমা কিভাবে কোথায় দেখানো হয় সেই নিয়েও তাদের বিন্দুমাত্র জ্ঞান নেই।
গ্রামের মোট জনসংখ্যা ৫০-৬০। কোন মেলোড্রামা নেই, উঁচু-নিচু অভিনয় নেই, মেক-আপ নেই,
ক্যামেরার চাতুরি নেই। আছে শুধু লুনানার ওয়াইড অ্যাঙ্গল প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং সেখানকার
দেবশিশুর মত কিছু ছোট ছোট বাচ্চা।
বাংলাদেশের
সিনেমার ইতিহাস বেশ দীর্ঘ। সেই তিরিশের দশকে প্রথম নির্বাক ছায়াছবি তৈরি থেকে শুরু
করে ১৯৫৬ সালে প্রথম বাংলা ছায়াছবি ‘মুখ ও মুখোশ’ (বাংলাদেশ তখনো কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান)
হয়ে শেখ মুজিবর রহমানের ১৯৫৭ সালে ‘ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট
কর্পোরেশন বিল’ পাস করানো এবং বাংলাদেশের ছবির পালে হাওয়া লাগা, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার
পর সত্তর ও আশির দশকে ছবির স্বর্ণযুগ, এরপর হঠাৎ কয়েক দশক সিনেমার নিম্নমুখী গ্রাফ,
অবশেষে আবার ২০০০-এর পর থেকে ফিরে তাকানো। বিশাল বড় ইতিহাস। আমায় যদি বাংলাদেশের কিছু
উল্লেখযোগ্য ছবি বেছে নিতে বলা হয়, তাহলে আমার পছন্দ - মুখ ও মুখোশ (১৯৫৬), জীবন থেকে
নেয়া (১৯৭০), ওরা ১১ জন (১৯৭২), তিতাস একটি নদীর নাম (১৯৭৩), লাল সালু (২০০১), মাটির
ময়না (২০০২), আয়নাবাজি (২০১৬) ও আলফা (২০১৯)। আরো অজস্র ভাল ছবি আছে যেগুলোর নাম ইচ্ছে
করেই নিলাম না। বিশেষ করে, বলতেই হয় যে, ২০০০ সালের পর থেকে বাংলাদেশে অন্যরকম থিমের
ওপর যথেষ্ট ভাল ছবি তৈরি হচ্ছে। এখানেও আমি একটা নতুন ছবিই বেছে নেব – ‘আয়নাবাজি’ (২০১৬)।
এই
ছবির নামভূমিকায় চঞ্চল চৌধুরী (আপনারা হয়ত এই বিখ্যাত অভিনেতার নাম শুনেছেন)। আয়না।
এক স্টেজ অভিনেতা যে টাকার অভাবে সফল অভিনেতা হয়ে উঠতে পারে নি। মায়ের মৃত্যুর পর আয়না
তার অভিনয় দক্ষতা টিকিয়ে রাখার জন্য এক অদ্ভুত পেশা বেছে নেয়। ঢাকা শহরের হাই প্রোফাইল
কারো জেল হলে সে তার পরিবর্তে জেলে গিয়ে সেই লোকটির মত অভিনয় করত। আবার ছাড়া পাবার
পর বাইরে নিজের জীবনে ফিরে আসত, হাতে প্রচুর টাকা নিয়ে। এইভাবে কিছুদিন। তার পর আবার
জেল, অন্য কারো হয়ে। একদিন সে তার মনের মানবীকে খুঁজে পায়। হৃদি। তার সঙ্গে ঘর বাঁধবে
বলে এই অভিনয় জীবন ছেড়ে দেবে ঠিক করে। কিন্তু এবারো যে তাকে জেলে যেতেই হবে। কারণ যার
হয়ে তার জেলে যাবার কথা, তাকে না বলার পর সে হৃদিকে কিডন্যাপ করে নেয়। আয়না আবার জেলে যায়। গিয়ে বুঝতে
পারে এবারে তাকে ফাঁসানো হয়েছে কারণ এবারে জেলের আসামী মৃত্যুদন্ড পেয়েছে। সে সুযোগ
বুঝে একদিন জেল থেকে পালায়। হৃদির কাছে ফিরে আসে। সংসার শুরু করে। কিন্তু সম্পূর্ণ
নতুন এক ছদ্মবেশে। এই ছবি ঢাকা শহরের এক অন্ধকার দিক।
অমিতাভ রেজা চৌধুরীর এই ছবি প্রায় আড়াই ঘন্টার। শুটিং পুরোটাই ঢাকা শহরে। পরতে পরতে ঢাকা-র ইতিহাস যেন এই ছবিতে। এবং রহস্যময় সিনেমাটোগ্রাফি। এবং আরো উপভোগ্য, এই ছবি থেকে ইতিমধ্যেই তেলুগু ছবির রিমেক হয়ে গেছে। শুধু একটাই সমস্যা – যেটা গড়পরতা বাংলা চবির থাকেই। সেটা হল, এই ছবি প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি দৈর্ঘ্যের। অন্তত আমার সেইরকম মনে হয়েছে।
শ্রীলঙ্কার (অতীতের সিংহল) ছবি বলতে মূলত সিংহলি ও তামিল ছবি। সেই চল্লিশের দশক থেকে যাত্রা শুরু করে পঞ্চাশের দশকে কান ফিল্ম ফেস্টিভালে সাড়া জাগানো, তারপর সরকার আর এলটিটিই-র মধ্যে ঝামেলার হাত ধরে সিনেমার সমূহ ক্ষতি এবং অবশেষে আবার ২০০০ সালের পর ছবির ঘুরে দাঁড়ানো, এই সব একটু ঘাঁটলেই মনোযোগী পাঠক ইতিহাসে পেয়ে যাবেন। যেটা পাবেন না, সেটা হল শ্রীলঙ্কার এই সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক ধ্বংস এবং তার ফল হিসেবে সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি প্রায় বন্ধের মুখে দাঁড়িয়ে।
যাইহোক, শ্রীলঙ্কার যে যে সিনেমা এখনো অব্ধি দাগ কেটে গেছে, সেগুলোর একটা ছোট লিস্ট দেওয়া যাক - লাইন অব ডেস্টিনি [রেকাভা] (১৯৫৬), চেঞ্জেস ইন দ্য ভিলেজ (১৯৬৩), সেভেন সিজ (১৯৬৭), এ সার্টেন লুক (১৯৭২), দ্য ট্রেজার (১৯৭২), হাউ টু বি অ্যান অ্যাডাল্ট (১৯৭৫), দ্য ওয়াস্পস আর হেয়ার (১৯৭৮), দ্য হান্ট (১৯৮৪), উম্ব ফর হায়ার (১৯৯০), দ্য ফরসেক্ন ল্যান্ড (২০০৫), ফ্রাঙ্গিপানি (২০১৪), নিউজপেপার (২০২০)। তবে শ্রীলঙ্কার ছবি বললে প্রথমে নাম আসবে পরিচালক লেস্টার জেমস্ পেরিসের। ক্লাসিক সিংহল ছবির সিংভাগ ওনার বানানো। শ্রীলঙ্কার ছবির প্রাণপুরুষ। ওনার একটা ছবি নিয়েই তাহলে আজ কাটাছঁড়া করা যাক- ‘দ্য ট্রেজার’।
এই ছবির গল্প আমি বরং এক লাইনেই বলি। জি বি সেনানায়কের ছোটগল্প ‘দ্য রিভেঞ্জ’ অনুসরণে ছবি ‘দ্য ট্রেজার’। গুপ্তধনের চাবিকাঠি হাতে পাবার জন্য এক ভার্জিন মেয়েকে খুন করতে হবে। সেই নিয়ে টানটান সিনেমা। আমি গল্প নিয়ে তত চিন্তিত নই। আমার চিন্তা অন্য দুটো ব্যাপারে। ১০৮ মিনিটের এই ছবিকে বলা হয়েছে শ্রীলঙ্কার প্রথম ৫০ বছরের ছবির ইতিহাসের সেরা ছবি এবং ফ্রান্সের এক লাইব্রেরীতে এই ছবিকে বিশ শতকে পৃথিবীর সেরা ১০০ সিনেমার লিস্টে রাখা হয়েছে। আমি এখানে সেটাই বুঝতে চাই।
এই ছবির প্রথম প্লাস পয়েন্ট, স্ক্রিপ্ট। বেশ ভাল ডায়লগ। মানতেই হবে। দ্বিতীয়, অভিনয়। মুখ্য চরিত্রে যথাযথ অভিনয় চোখে পড়ে। ফলে সিনেমার বাঁধুনি আরো বেড়ে যায়। তৃতীয়, মিউজিক। কোথাও কোথাও চমকে দেবার মত ড্রাম। সবশেষে, ক্যামেরার কাজ। লেস্টার জেমসের ছবি মানে ক্যামেরার কিছু না কিছু নতুনত্ব থাকবেই। এই ছবিতে, শ্যাডো শুটিং। ফলে রহস্য রোমাঞ্চের আবহ একদম জমে গেছে। এই ছবিকে ক্লাসিক বলতেই হয়।
পাকিস্তান নিয়ে যতই আমাদের ভুরু কুঁচকোনো থাকুক (বিভিন্ন বিষয়ে, যেগুলো এখানে আমি কলমের ডগায় আনতে চাই না), একটা ব্যাপার মাথায় রাখতেই হবে - পাকিস্তান কিন্তু ছবি তৈরির বিষয়ে বেশ সিরিয়াস। ওখানে প্রচুর ধর্মীয় বিধিনিষেধ থাকলেও ওখানকার তরুণ পরিচালকরা বেশ ভাল ভাল সিনেমা তৈরি করছেন। এবং আপনাদের নিশ্চয় মনে আছে, এবার কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে পাকিস্তানের ‘জয়ল্যান্ড’ (২০২২) নন্দনে বেশ সাড়া ফেলেছিল। একটা ব্যাপার আমি সবসময় মাথায় রাখি এবং আমার পাঠক-পাঠিকাদেরও মাথায় রাখতে বলি। কেউ যদি সাহিত্য শিল্প সংস্কৃতি বিজ্ঞান ইত্যাদি বিভিন্ন উৎকর্ষ মূলক ক্ষেত্রে ভাল কিছু করে দেখান, তিনি যে দেশেরই নাগরিক হোন না কেন, তার প্রশংসা করতেই হবে। সেখানে যেন রাজনীতি বা জাতের নামে বজ্জাতি না ঢোকে।
পাকিস্তানের অনেক ছবি আমার পছন্দের। এখানে কয়েকটার নাম বলি - নিন্দ (১৯৫৯), ইনসানিয়ৎ (১৯৬৭), উমরাও জান আদা (১৯৭২), জিন্না (১৯৯৮), খুদা কে লিয়ে (২০০৭), মান্টো (২০১৫), জয়ল্যান্ড (২০২২), স্যান্ডস্টর্ম (২০২২)। আজ ‘জয়ল্যান্ড’ নিয়ে আলোচনার ইচ্ছে ছিল, কারণ এই ছবিতে ট্রান্সজেন্ডার দেখানোর পাশাপাশি আরো কয়েকটা অদ্ভুত ব্যাপার আছে। কিন্তু সেই লোভ ছাড়তে হচ্ছে, নাহলে অন্য এক ছবির সঙ্গে অধর্ম করা হবে। ‘খুদা কে লিয়ে’। এই সেই ছবি, যখন ধর্মীয় আর পারিবারিক শাসনে পাকিস্তানের সিনেমা প্রায় ঘাড় ভেঙ্গে পড়ে গেছে, তখন আবার ইন্ডাস্ট্রিকে উঠে দাঁড়াবার অক্সিজেন জুগিয়েছিল।
দুই ভাই ও গায়ক, মনসুর আর সার্মাদ, ৯/১১ তারিখে আল-কায়দা আমেরিকা আক্রমণের পর তাদের জীবন কিভাবে বদলে গেছিল, সেই নিয়ে এই ছবি। এক ভাই আমেরিকা গিয়ে হঠাৎ জেলে চলে যায়। আরেক ভাই এক ব্রিটিশ যুবতীকে জোর করে বিয়ে করে নেয়। পরে সেই ঝামেলা কোর্ট অব্ধি গড়ায়। সেখানে নাসিরুদ্দিন শাহকে এক ছোট্ট রোলে দেখা যায়। কিভাবে যুদ্ধ আর ঘৃণা ছড়ানোর জন্য এক শ্রেণীর মানুষ ইসলাম ধর্মকে অপব্যবহার করছে, তার এক প্রামাণ্য দলিল এই ছবি।
শোয়েব মনসুরের প্রায় তিন ঘন্টার এই সিনেমা দীর্ঘ এবং একটু বোরিং হলেও সঠিক জায়গাটা কিছু লোকের সামনে তুলে ধরতে পেরেছে। ধর্মের নামে বিভেদ ও হিংসা ছড়ানো বন্ধ করা হোক। যারা এইসব বদমাইশি করতে চায়, তাদের বেছে বেছে আলাদা করে দেওয়া হোক। সিনেমাটোগ্রাফি আমার খুব একটা ভাল লাগেনি। বরং মিউজিক বেশ ভাল। সিরিয়াস ডায়লগের পাশাপাশি মজার কিছু ডায়লগ আছে। মনসুরকে যখন আমেরিকান পুলিশ জিজ্ঞেস করছে ‘what is between you and osama bin laden?’, তখন মনসুরের জবাব ‘maybe he is a gay and he liks me’। তবে এই ছবি দেখে সবাই একটা ব্যাপার মেনে নিতে বাধ্য হবেন, পৃথিবীর যে কোন দেশের শান্তিপ্রিয় নাগরিকরা শান্তিতে ও নিভৃতে থাকতেই ভালবাসেন।
মায়ানমারের ছবি নিয়ে আলোচনা ইচ্ছে করেই এড়িয়ে গেলাম। অতীতের বার্মা, যেখান থেকে অনেক দুর্দান্ত ছবি তৈরি হয়েছিল, আজ যেরকম ভগ্নস্তূপ হয়ে পড়ে আছে - সেটা মেনে নেওয়া যায় না।
তাহলে এশিয়া শেষ। আমার আগামী পর্যালোচনা শুরু হবে আবার ইউরোপ থেকে। তবে এই অব্ধি তো অনেক দূরান্তের বিশ্ব সিনেমাও দেখা হল। এবার আমি আমার মনোযোগী পাঠকের কাছে আশা করতেই পারি যে আরো এগোনোর আগে সত্যজিৎ রায়ের ‘বিষয় চলচ্চিত্র’ বা সিডনি লুমেটের ‘Making Movies’ বইগুলো মাঝে মাঝে উল্টে পাল্টে দেখবেন। তাহলে আমাদের আলোচনার গভীরে ঢুকতে সুবিধে হবে।
(ক্রমশ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন