শুক্রবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২২

অঞ্জন সেনগুপ্ত

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

 

রূটম্যান



 

(১১)

 

সাবিনার নরম হাতটাকে নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে খলিল বলে- না, কোন দুঃখ পাই নাই। আসলে ঘটনাখান সকলে জানে না যে। আর তাই কহে। যেমন তুমি এইমাত্র কহিলা। হামিও তো বেবাক লোকের মতনই ভালই ছিলাম। পাথারে কত্ত খেইলেছি। হামার সাথে কেউ দৌড়ে পারত না। কিন্তু একদিন বাপের জন্য পান্তাপেঁয়াজের নাস্তা লিয়ে মাঠে গেছি। দেখলাম কি বলদগুলান ঘাস খাইছে। কিন্তু উয়াদের কাঁধে মই জুতাই আছে। হামি বাপকে কহিলাম কি যে একবার মইয়ে চহিড়া মাঠে দু’পাক দেই। বাপ না করল বটে কিন্তু হামি তা না শুনে  বলদগুলানরে যেই না টাইনতে গেলাম আর অমনি শালা হামাকে মারল এক লাথ। ব্যস! হামি তো অজ্ঞান। বাপের টাকা ছিল না বলেই টাউনে না গিয়া দক্ষিণ টোলার হামেদ হেকিমের ঠিনে লিয়ে গেল। সে জরিবুটি দিয়া চিকিৎসা করে হামাকে ছাড়ে দিল। তখন হামি ভাল করে হাঁটতেও পারি না। মা তো রাত-দিন কাঁইন্দে ভাসায়। ধীরে ধীরে হেকিমের ওষুধ আর মালিশ করতে করতে আজ হামি তাও হাঁইটতে পারছি। তাই কেউ হামার পায়ের কথা তুলে হামাকে গাল পারলে হামার মনে বড় আঘাত লাগে। তবে হামি তোমার কথায় মনে কোন দুঃখ পাই নাই সাবিনা। খলিল একটা ফৎ করে নিঃশ্বাস ফেলে বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে ভাবে, আজ আর পুরনো কথা এসব ভেবে কী হবে। আজ তো তার না আছে মা আর না আছে সাবিনা। ঘরে এখন আর ঢুকতে ইচ্ছে করে না। মনে হয় দোজখ বুঝি এর থেকেও ভালো। অথচ সে এখন এই গ্রামের মধ্যে অনেকের মতোই স্বচ্ছল। শুধু ওর কোন ফুটানি নেই বলেই কেউ সেভাবে বুঝতে পারে না। খালি পাশের বাড়ির চাচি রোজই একবার করে বলে- ‘তা হাঁরে খলিল বেটা, এবার তো একখান সাদি কর। মাইয়া মাইনষের মতন রোজ রোজ পাক করা কি পুরুষের কাম নাকি! তুই একবার রাজি হলেই হামার ফুপুর বেটির সাথে বিহা লাগায় দিব। লিলির মতন মাইয়ারে জামাই কেন যে তালাক দিল তার কারণখান আজো কিলিয়ার হয় নাই। তবে শুইনেছি জামাইয়ের মনে নাকি অন্য একজনরে ধইরেছে। সবই আল্লার বিধান। তবে লিলি কিন্তু খুব গেরস্থালি মাইয়া। এ কথাখান হামি তোরে কহে দিলাম’।

এসব কথা চাচি প্রায়শই বলে থাকে। কারণ খলিলের সাথে তার কোন রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও এই চাচি সব সময় খলিলের মাকে নিজের বড় দিদি বলেই মানতো। তাই খলিলের উপর তার একটা প্রচ্ছন্ন জোর রয়েছে। এটা খলিল মুখে যাই বলুক মনে মনে অস্বীকার করতে পারে না। আবার চাচি তার জন্য যতই ভাবুক না কেন সে তো সাবিনাকে পুরো মনটা সেই কবেই দিয়ে দিয়েছে। আজ না হয় সাবিনা অন্যের ঘর করে। অন্যের সন্তানের মা। তবু মনে মনে আজো খলিল তাকেই ভালোবাসে। অবশ্য এ কথাটা গ্রামের কারোর জানারও নয়, কাউকে বলারও নয়।

পাঁচ ওয়াক্তের শেষ নমাজ আদায় শুরু হয়ে গেছে। গ্রামের মসজিদে তিন তিনখানা বড় চোঙ লাগান আছে। কেউ সময় ভুল করলেও মুয়াজ্জিন ভুল করেন না। আর তাই ঠিক ঘড়ি ধরে তিনি সবাইকে জানিয়ে দেন যে আল্লার দরবারে এবার সকলের মোনাজাত জানাবার সময় হয়ে গেছে। আল্লা সবার কথা অবশ্যই শুনবেন। খলিল তার আঁখায় কালো ভাতের হাঁড়িটা চাপিয়ে দিয়ে আগুনটাকে আরো উসকে দেয়। আর মুয়াজ্জিন ফয়জল চাচার কথা মনে পড়ায় মনে মনে হাসে। এতদিনে খলিল বুঝে গেছে যে তাদের আল্লা আর হিন্দুদের ভগবান এরা সবাই অন্ধ,বোবা। মানুষদের কষ্ট না দেখতে পায়, না বুঝতে পারে! তাহলে কি আর ফয়জল চাচার পর পর দুটো বেটা নদীতে হেলতে গিয়ে ডুবে যায়! আর চাচিই বা কেন অন্যের সাথে ভেগে যাবে। আল্লা কি এসব দেখে না! মুয়াজ্জিন চাচার সাথে তো আল্লার রোজ কথা হয়। সে নিশ্চয়ই আল্লার কাছে মোনাজাত করে। আর নিজের কথা তো খলিল ছেড়েই দিল। কারণ সে না নমাজ আদায় করে, না মোনাজাত করে। চারদিকে এত কিছু দেখে দেখে তার আর আল্লার উপর ভরসা নেই। তাহলে কি আর সাবিনা অন্যের হয়ে যায়। এসব ভাবতেই খলিলের বুকটা ব্যথায় টনটন করে ওঠে। বাঁশের চোঙা দিয়ে আঁখায় ফুঁ দিতে গিয়ে তার দু’চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল ঝরতে থাকে।

আজ আর কোন সবজি পাকাতে ইচ্ছে করল না খলিলের। ভাতের মার, আলু-পেঁয়াজ দিয়েই সে দুপুরের খাওয়াটা সেরে ফেলল। আকাশটা সকাল থেকেই গুম গুম আওয়াজ করছিল। আর এখন তো চারদিক একেবারে অন্ধকার করে অপেক্ষা করছে। আজ আর বিকালে সে বটতলায় যাবে না বলে ঠিক করে। বিকালের দিকে সাধারণত তেমন কোন কাজ হয় না। বড় জোর কোন জওয়ান হয়তো তার বুটের সোল লাগাতে এল বা সেলাই করাতে এল। এর বেশি কিছু নয়। তাই বিকালে কাজের থেকে তাদের সাথে আড্ডাটাই বেশি হয়। এতে তার অবশ্য লাভটাই বেশি। অবলা পাচারের অনেক গল্প ওদের কাছ থেকে শোনা যায়। জওয়ানরা খলিলকে বিশ্বাস করে তাদের প্ল্যানের গল্প শোনায়। আর খলিলও পরে তা উগড়ে দেয় সোলেমানদের ডেরায়। আর তার আমদানিও বেড়ে যায়।

বৃষ্টি তখন ঝরতে শুরু করেছে। খলিল একটা বিড়ি ধরিয়ে তার তক্তপোশে উঠে বসে। বৃষ্টির রেশ বাড়ার সাথে সাথে মুহুর্মূহু বাজ পড়ে চলেছে। এ সময়টা বিশেষ ভালো নয়। বিশেষ করে যারা মাঠের কাজে ব্যস্ত রয়েছে তাদের পক্ষে। বাতাস ক্রমশই বাড়তে থাকায় দরজা দিয়ে জলের হ্যাঁচলা আসছিল। খলিল উঠে গিয়ে হাতের বিড়িটা বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দরজা ভেজিয়ে দেয়। আবার তক্তপোশে বসে এক সময় শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দেয়। আর তখনই একটা বীভৎস্ জোরে  বাজ পড়ে। খলিল চকিতে ভয় পেয়ে চোখ বন্ধ করে নেয়। যে নাস্তিকের মুখে কখনই আল্লার নাম শোনা যায়নি সে হঠাৎ বলে ওঠে-‘হায় আল্লা! তুমি কি আইজ ক্ষেইপে গেলে নাকি!’

বেশ কিছুদিন ধরেই একটা গুমট আবহাওয়া ছিল। বৃষ্টি হওয়ারই কথা। কিন্তু সাথে যে এমনভাবে বেয়াক্কেলের মতো বাজ পড়েই চলেছে তা মোটেই সুবিধার নয়। খলিল আর তাকিয়ে থাকতে পারে না। অন্য দিন খাওয়ার পরে বিছানায় গড়িয়ে নেওয়াটা খলিলের অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে। তবে বিকালের দিকে সে চলে যায় বটতলায়। কিন্তু আজ এই দুর্যোগের মধ্যে বটতলায় গেলে লোকে শুধু ল্যাংড়া খলিল বলেই ডাকবে না, সাথে পাগল শব্দটিও যোগ করে নেবে। কাজেই আজ আর যাওয়ার কোন কথাই নেই। খলিলের চোখ আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে সে।

নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, মালদহ, দক্ষিণ দিনাজপুর, শিলিগুড়ি, কোচবিহার এইসব জেলার সীমান্তবর্তী গ্রামগুলো সব সময় কর্মচঞ্চল হয়ে থাকে। রাত-দিনের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই! তবে কাজের রকমফের ঘটে যায় এক এক সময়। অবশ্য সব সীমান্তের গ্রামগুলোয় কর্ম চঞ্চলতা থাকলেও প্রায়শই তা ভিন্নধর্মী। ঘুর পথে অবলা ও মানুষ পাচার কম বেশি সব সীমান্ত দিয়ে হয়ে থাকলেও কোন কোন সীমান্তবর্তী গ্রামবাসীরা খুব ছোট খাট জিনিস পাচার করাই বেশি পছন্দ করে। যেমন সর্দি কাশির সিরাপ, সোনা বা পিতলের চাকতি অথবা মেয়েরা তলপেটে দামি কাপড় বেঁধেও পাচার করতে অভ্যস্ত। মালদহের সীমান্তবর্তী গ্রামের লোকেরা বিএসএফদের চোখে ধুলো দিয়ে বস্তা বস্তা লবণ, পেঁয়াজ ইত্যাদি পাচার করে বেশি মুনাফা পেয়ে থাকে। আর এসব পাচারের পেছনে রয়েছে রুটম্যানদের নজরদারি। ওপারে এই রুটম্যানদের পোশাকি নাম পালটে গিয়ে হয়ে যায় লাইনম্যান। কাজের মধ্যে খুব একটা তারতম্য নেই। শুধু জামা পালটে যাওয়ার মতো।

তবে অবলা পাচারে যেমন অনেক বেশি টাকা মুনাফা করা যায় তেমনি রিস্কও অনেক বেশি। আর আছে কাজের বিভিন্ন বিন্যাস। বিভিন্ন প্রদেশের গোহাটা থেকে কিনে আনা অবলাদের একটি নির্দিষ্ট স্থান পর্যন্তই আনা হয়। আর সারা রাস্তা জুড়েই চলে হরিলুটের মতো টাকা ছড়ানোর খেলা। এ যেন হাতে বাটি নিয়ে ভিখারিদের দাঁড়িয়ে থাকার মতো পুলিশ হাত পেতেই রয়েছে। অবলাদের আনার পর বাকিদের কাজ শুরু হয়ে যায়। রুটম্যানেরা অবশ্য সমস্ত রুটের খবরা খবর আগেই দিয়ে রাখে। আর তার ভিত্তিতেই গাড়ি এগিয়ে চলে। অবলাদের গাড়ি থেকে নামানোর পরে তারা চলে যায় রাখাল বা বাগালদের দায়িত্বে। তারা সাধারণত সীমান্ত পর্যন্তই অবলাদের পৌছে দেয়। বাকিটা অনেক লোকের কাজ। কিন্তু একক দায়িত্বেও অনেক সময় অবলা পার হয়ে যায় দেশের সীমান্ত। এসব ক্ষেত্রে একবারেই দশ হাজার টাকা যে কোন লাইনম্যানকে রাতারাতি পাগল করে দিতে পারে। জমাতে পারলে বা সে সব টাকায় জমি জিরেত কিনতে পারলে ভাল। কিন্তু তা যদি নেশায় উড়ে যায় তা হলেই সর্বনাশ তাদের একেবারে ভিটেতে ঘুঘু চড়িয়ে দেয়। আসলে টাকা রাখতে জানতে হয়।

খলিলের সামান্য বিড়ির নেশা ছাড়া আর তেমন কোন নেশা নেই। তাই তার টাকা জমে। আর জমির পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। দু’বছর অন্তর ঘরের চালে খড়  পাল্টানোর বিড়ম্বনা থেকে বাঁচার জন্য গেল বছর সে ঘরের মাথায় সুন্দর লাল টুকটুকে টালি চড়িয়েছে। আর এসব দেখে অনেকেই মুচকি হাসলেও চাচি সরাসরি বলে-সবই তো ভালাই করছিসরে খলিল। শুধু একখান মাইয়া মাইনষেরে আইনতে পারছিস না! ঘরত মাগ না থাইকলে দু’দিন পরে গেরামের  লোকেই তোকে আর পুরুষ ভাইববে না। ছেমড়ি কইরা গাল পারবে। সেটা শুইনতে ভালো লাইগবে? এতদিনে কোন মনের মানুষও পালিনারে হারামজাদা! হামার নাতনির দু’দিন পরেই বিহা লাইগবে। তখন তোর সরম লাইগবেনি!  কোন গামছায় মুখ খান ঢাকবি কহ?

শেষ কথাগুলো খলিলের কানে ঢোকেনি। চাচির এত কথার প্রথমেই যখন সে কোন মেয়েকে মনে ধরার কথা বলছিল তখনই খলিলের মনটা আবার হারিয়ে গিয়েছিল পাশের গ্রামে মতিনের বাড়িতে। উঁকি দিচ্ছিল সেই বাড়ির দাওয়ায়, পেছনের বাগানে! কিন্তু বড় নিঃশব্দ ছিল সেই বাড়ি! এমনকি পাশের বাড়িটাকেও একটা ভূতুরে বাড়ির মতই লাগছিল। পাড়াটাও কেমন যেন ঝিমিয়ে পড়েছে। কিছুক্ষণ আগের প্রবল ঝড়-বৃষ্টি আর বাজের হুঙ্কারে কি পাড়ার সবাই ঘরে সিঁধিয়ে গিয়েছে নাকি! খলিলের কেমন যেন একটা সন্দেহ হয়। সে এক সময় মতিনের ঘরের দরজায় সামান্য ঠেলা দেয়। দরজায় কোন শিকল তোলা নেই। আর তাই সে দেখতে পায় যে ঘরটা শুধু ফাঁকাই নেই, চারদিকে সব কিছুই এমন ভাবে ছড়ানো ছিটানো রয়েছে যে মনে হচ্ছে এইমাত্র বুঝি আজকের ঝড়টা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল! একেবারে লন্ডভন্ড অবস্থা। অগোছালো শতছিন্ন বিছানাটার কাছে এগিয়ে যেতেই খলিলের নাকে আসে সেই কবেকার নারী হয়ে ওঠা সাবিনার গায়ের মিষ্টি মাতাল করা গন্ধ। সে বিছানার কাঁথায় হাত দিতে গিয়েও থমকে যায়! আবার সে ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে। একচিলতে দাওয়ায় আসতেই দেখে সীমানার বাইরে গাব গাছটার ডালে রাজ্যের কাক এসে হাঁক ডাক শুরু করেছে। খলিল বাড়ির চৌহদ্দি ছাড়িয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ায়।

গ্রামটা খলিলের কাছে মোটেও অচেনা নয়। তবে যেদিন সাবিনা এই গ্রামে মতিনের ঘরে চলে এল সেদিন থেকে খলিল এ গ্রামের পথ মাড়ায়নি। হঠাৎ  করেই যেন সারা গ্রামটাই তার শত্রু হয়ে গেছে। কোন লোকের বাড়ি হাকিমপুরে শুনলেই সে তার দিকে বড় কড়া চোখে তাকায়।  যেন সেই হাকিমপুরের লোকটি ভীষণ এক অপরাধ করে ফেলেছে। অথচ খলিল আজো মতিনকে দেখেনি বা দেখলেও নামে চেনে না। কিন্তু সারা গ্রাম ভেঙে আজ সবাই গেল কোথায়!

খলিল বিস্মিত চোখে সারা গ্রাম ঘুরতে ঘুরতে বাড়ির পথে রওনা দেয়। কিন্তু দু’পা  এগিয়েই তার পা আটকে যায় হাকিমপুরের কর্দমাক্ত রাস্তায়। মতিনের বাড়ির সামনের গাব গাছে তখনও কাকগুলো একই বিচ্ছিরি ভাবে ডেকে চলেছে। হঠাৎ খলিল শুনতে পায় অনেক লোকের দলা পাকানো কান্না ও কথার উচ্চকিত শব্দ ক্রমশই গ্রামের দিকে এগিয়ে আসছে। খলিল রাস্তার এক পাশে দাঁড়িয়ে পড়ে।

ঘটনাটা ঘটেছিল সেই ঝড়-বৃষ্টি শুরুর প্রথম বাজ পড়ার সময়। তখন সারা পাথারে একমাত্র মতিন কাঁধে মালিকের হাল নিয়ে আসছিল। ওর সামনে ছিল মালিকের এক জোড়া বলদ। অনেক্ষণ ধরেই ভাবছিল যে এবার শেষ লাঙলটুকু দিয়েই ঘরে ফিরে যাব। আর তাই হয়তো সামান্য দেরি হয়েছে। গরুগুলোও একেবারে ভিজে একসা হয়ে গেছে। যদিও এই গুমোটে ওরাও রীতিমত হাঁসফাঁস করছিল। আর তাই ওদের মাথা থেকে চুঁইয়ে পড়া জলগুলো মাঝে মাঝে লম্বা জিভ বের করে তা দিয়ে টেনে নিয়ে সামান্য গলা ভেজাচ্ছিল। আর ঠিক তখনই চারদিকের কালো অন্ধকারকে খানখান করে দিয়ে শব্দের গতির অনেক আগেই এক ফালি আলো এসে আছড়ে পড়ল ঐ বলদ দুটো আর মতিনের মাথায়। মতিন আল্লা ডাকারও সময় পেল না। ঐ জল কাদায় লুটিয়ে পড়ল তিনটি প্রাণী!

তাই সারা গ্রাম ভেঙে পড়েছিল পূব পাথারে! আর এখন সবাই মতিনকে নিয়ে গ্রামে ফিরছে। কিন্তু খলিল মতিনকে দেখেও ঠিক চিনতে পারল না। অবশ্য খলিলের না চেনারই কথা। শোনা যায় কোন মানুষের বজ্রাঘাতে মৃত্যু হলে নাকি তাকে চেনা যায় না। চেহারা নাকি পুড়ে একেবারে কালো হয়ে যায়। সবটাই খলিল ছোটবেলায় শুনেছে। তবে তাদের গ্রামে দেখেছে একটা মৃত তাল গাছকে। তার মৃত্যুর কারণও ছিল বজ্রাঘাত! একেবারে ডালপালাহীন শুকনো একটা গাছ যার অর্ধেকটা পুড়ে খাঁক হয়ে গেছে। যে কোনদিন বাকিটুকুও সামান্য পলকা ঝড়েই পড়ে যাবে। খলিল মাত্র একবারই মতিনকে দেখল। শরীরে কোন বস্ত্র নেই।  শুধু পুরুষাঙ্গটা এক টুকরো গামছা দিয়ে ঢাকা। অনেকেই কাঁদছে। কিন্তু তাদের মধ্যে খলিল সাবিনাকে খুঁজে পেল না। তাহলে সে গেল কোথায়! স্বামীর মৃত্যুতে স্ত্রী যাবে না তা আবার হয় নাকি! হয়তো ঐ এক দঙ্গল মহিলার মধ্যেই সাবিনা রয়েছে। সবাই যেন কাদা-জলে মাখামাখি হয়ে অচেনা হয়ে গেছে! কাউকেই আলাদা করে চেনা যায় না। সবাই কাঁদছে। সবার কান্নার একই সুর। একই কথা! এছাড়া বাকি গ্রামবাসীরা সকলেই মাথা নীচু করে অতি মন্থর ভাবে এগিয়ে চলেছে। খলিল কাউকে জিজ্ঞাসা করতে পারল না। সে শুধু একবারের জন্য জোরে সাবিনা বলে চিৎকার করে উঠল।

ঠিক তখনই ওর ঘরের ভেজানো দরজাটা হাট করে খুলে গেল। অন্ধকার ঘরে ঢুকে চাচি বলল-কিরে খলিল, শরীলখান খারাপ হল নাকি! কারে চিল্লায় ডাকছু? তাই তো হামি ছুইটা আলম।

খলিল কিছুক্ষণ চাচির মুখের দিকে ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকল। কিন্তু আঁধার ঘরে চাচি তা দেখতে পেল না। খলিল বলল-চাচি ঝরি ছুটেছে?

-সে তো মেলাই আগেই ছুইটেছে। চাচি বলে।

-চাচি তুমি একনা ঘরত লম্ফ জ্বালায় দাও। হামি এক ছুটে হাকিমপুর যামু আর আসমু।

-হাকিমপুরে তোর ফের কে আছেরে খলিল? ঐ গেরামে তো তোর কুন কুটুম নাই শুইনেছি। চাচি অবাক হয়ে জানতে চায়।

-সাবিনার বড় বিপদ চাচি। হামি ছাড়া ওর তো আর কেহ নাই গো চাচি। তাই ওরে হামার ঘরে নিয়াই আসি। খলিল প্রায় ছোট ছেলের মতোই ছুটতে থাকে। কে বলবে ওর একটা পা খোড়া।

 

(ক্রমশ)


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন