ধারাবাহিক উপন্যাস
দিগন্তসেনা
(১১)
অভিমন্যুর
ঔরসে ওদের আর কোন সন্তান জন্মাবে কিনা একথা ভাবতে ভাবতে শ্যামাঙ্গী সুদূর অতীতে ফিরে
গেল। শ্যামাঙ্গীকে যুদ্ধের পরে হসপিটালে দেখতে
যায় মানময়ী ওর বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে আর সে ততক্ষণে তার একটা নামও ঠিক করে ফেলেছে
– শুভেচ্ছা। বাচ্চাসহ মাকে দেখে শ্যামাঙ্গী বলে ওঠে, ‘আহ! ওকে আবার এখানে এনেছ কেন?
নিয়ে যাও’। তারপরও বাচ্চাটা হুমড়ি খেয়ে পড়ে শ্যামাঙ্গীর কোলের মধ্যে। তখন ক্ষতগুলো
কোনরকমে বাঁচিয়ে ও ওর বাচ্চাটাকে কোলে নেয় আর আদর করে। মার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘নামটা
তুমি খুব ভালো বেছেছ। আমার খুব পছন্দ
হয়েছে’। কিন্তু তারপরও তাকে সতেরটা যুদ্ধ লড়তে
হয় মূল ভূখন্ডের বিদ্রোহী কিম্বা ধর্ষকদের জন্য। আর এই সবকটার পেছনেই থেকে যায় কারণ
হিসেবে রক্ষণশীল সমাজদলের ঢ্যামনামী ও প্রলাপ। আর এই সতেরটা যুদ্ধ থেকেই ও সংগ্রহ করে
সতেরো জন বিভিন্ন বয়সের অনাথ শিশু আর ও তাদের নিয়ে এসে দিগন্তসেনায় আইনগত ভাবে নিজেকে
দিয়েই ওদের মাতৃত্বের অধিকার সুনিশ্চিত করে। ইতিমধ্যে দিবাঙ্গের সেজছেলে অলিন্দের একমাত্র
কন্যা পিপাসা আর ভূমিকার এক ছেলে রনিত দুজনে
দিগন্তসেনায় এসে দাঁড়ায় সব কথা জানিয়ে। শ্যামাঙ্গী ওদের থাকার ব্যবস্থা করে ও বলে,
‘তোরা যেমনি আছিস, তেমনি থাক। আমি এতে কোন অসুবিধে দেখছি না। আর সন্তান জন্মের ব্যাপারে
এখানে অনেক বিজ্ঞানী, ডাক্তার, বিষেশজ্ঞ আছে, তাদের পরামর্শ নে। তেমন হলে না হয় সন্তান
ধারণের দিকে যাবি না। আর একান্তই যদি সন্তান
চাস, তাহলে দত্তক কিম্বা স্পার্ম ডোনেশন ব্যাঙ্কের সাহায্য নিবি। এ তো সহজ ব্যাপার।
এ নিয়ে এত চিন্তার কী আছে?’ ওদিকে শ্যামাঙ্গীর দত্তক নেওয়া সতেরটি শিশুর নাম দেওয়া
হয় আর সেই দায়িত্বটা পালন করে অনঙ্গ আর মানময়ী।
ওদের মধ্যে তিনজন মেয়ে আর চোদ্দজন ছেলে। তিন মেয়ের নাম রাখা হয় দ্বিধা, পিপীলিকা আর
মহিমা। চোদ্দজন ছেলের নাম রাখা হয় পতঙ্গ, লালন, দোহার কবীর, শহর, অরণ্য, সেবক, দ্যুতি,
ধৃতি,অঙ্কন, উজান, উপল, চারণ এবং প্রাচীন। নামকরণ উপলক্ষে ধুমধাম করে রীতিমত নানারকমের
বাজি ফাটিয়ে লোকজন নেমতন্ন করে একটা তিনদিনের নানারকম খাওয়াদাওয়ার অনুষ্ঠান পালন করা
হল দিগন্তসেনায়। তারপর কিছুদিন গেলে তাদের আবাসিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হল। কেননা ততক্ষণে
তাদের সকলের বয়ে কম বেশি চার, পাঁচ বা তার
বেশি হয়ে গেছে। শুভেচ্ছা মানময়ীর কোলেই ঘুরে
বেরাতে লাগল। কেননা তখনও পর্যন্ত তার বয়েস হয়নি চার, এই অজুহাতে। তবে ঠিক হল আগামী
এক কিম্বা দু বছরের মধ্যেই তাকেও অন্যদের মত স্কুলে যেতে হবে এবং থাকতে হবে।
উপমার
ছেলে নীলনদ যত বড় হয়ে উঠতে লাগল ততই শ্যামাঙ্গীর কাজকর্মের ওপর ওর খুব আগ্রহ দেখা গেল।
সে ঘরের মধ্যেই প্রথমে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলতে লাগল বন্ধুদের নিয়ে এসে। অল্প দিনের মধ্যেই
তার আর তার সঙ্গীসাথীদের দাপটে গোটা বাড়িটাই
রণাঙ্গনে পরিণত হল। এক তলার পড়ার টেবিলটা ছাদে উল্টে থাকে এমন ভাবে যাতে চারটে পায়া
সোজাসুজি আকাশের দিকে মুখ করে ছাদে আটকে থাকে আর টেবিলক্লথটা গিয়ে দোতলার সিলিংএর গায়ে
লেপ্টে ঝুলে থাকে কোন কিছু ছাড়াই। ওপরের ব্যালকনির দরজা খুলে এসে নীচে মুখ থুবড়ে পড়ে আর গোটা দুটো দেবদারু গাছ ওপর তলায় হাতপা মেলে
দিব্যি শুয়ে থাকে এমন যাতে কেউ নিজের ঘরে শুতে না পারে। তুলসীমন্ডপ বসার ঘরের সোফায়
দিব্যি আরাম করে শুয়ে থাকে আর চেয়ারগুলো বাগানে
গড়াগড়ি খায়। শোবার খাটটা পেছনের দেবদারু গাছের মাথায় ছাতা হয়ে এমনি ঝুলতে থাকে যে তার
তোষকখানা একটা কুকুরের জিভের মত আধখানা সেখান থেকে ঝোলে। বাথরুমের চৌবাচ্চা থেকে থালা
গেলাস বাটিগুলো উদ্ধার করতে হয় রীতিমত জাল ফেলে চারাপোনা ধরবার মত করেই। কেননা তার
মধ্যে গোটাকয়েক আস্ত সাবান ফেলে দেওয়া হয়েছে বিপক্ষ দলের যুদ্ধের সৈনিকরা যাতে ওখানে
পা হড়কে পড়ে গিয়ে খানিকটা আছাড় খেয়ে তাদের দমের অর্ধেকটা উবে চলে যায় আকাশে। অন্য আর
একটা খাটের পায়াগুলো খুলে নিয়ে দড়ি দিয়ে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে ছাদ থেকে যাতে নিজের দলের
সেনারা প্রয়োজনে ওগুলো ধরে ছাদে উঠে আসতে পারে নিশ্চিন্তে। আলমারির সব জামাকাপড় বের
করে সেগুলো পাঠানো হয়েছে ছাদে। সেখানে বিপক্ষ দলের হাত থেকে চরম গুরুত্বপূর্ণ পরিস্থিতিতে
নিজেরাই লুকোতে পারে যাতে তার পাকাপাকি বন্দোবস্ত করা হয়েছে তাকগুলোকে বেমালুম খুলে
নিয়ে। মানময়ী একদিন বলে ওঠে, ‘ওহ! এই ছেলেটাকে নিয়ে আর পারি না’। তারপর সোজা শ্যামাঙ্গীর
কাছে পাঠিয়ে দেবার বন্দোবস্ত করা হয় তাকে উৎসব উপলক্ষে পুজোর ছুটিতে এই বলে, ‘যা যুদ্ধটা
ভালো করে শিখে আয়’। সে তো নাছোড়বান্দা। কেননা তার বক্তব্য হচ্ছে যে একা গেলে নাকি যুদ্ধটা
ভালো শেখা যাবে না। তাই বন্ধুদেরও নিয়ে যেতে হবে। তারপর বন্ধুরা বন্ধুদের বাবা মা সহ সোজা গিয়ে পৌঁছায় শামাঙ্গীর
দরজায়। কাজের লোক দরজাটা খুলতেই সকলে কর্নেল সি শ্যামাঙ্গীর উদ্দেশে ডান হাত দিয়ে সাল্যুট
করতে করতে ঘরে ঢুকে মার্চপাস্ট করতে শুরু করে
দেয়। শ্যামাঙ্গী তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসে বলে, ‘স্টান্ড স্টীল’। তখন যে যে জায়গায় ছিল যে
অবস্থায় সে সেখানেই একটুও না নড়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।
পঞ্চান্নটা বাচ্ছা সহ গোটা বাড়িতে রীতিমত একটা হট্টগোল শুরু হয়ে যায়। শ্যামাঙ্গীর বাড়িটাও
প্রায় মানময়ীর বাড়ির মতই যখন ওইরকম একটা রণক্ষেত্রের কাছাকাছি পৌঁছে যায়, তখন ও তাড়াতাড়ি
ওদের সামনে একটা থালায় অসংখ্য মিষ্টি আর কেক রেখে সকলকে খেয়ে নিতে বলে জানায়, ‘যুদ্ধ
শুরু হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি খেয়ে নে এগুলো। এবার সোজা রণক্ষেত্রে যেতে হবে’। তারপর ও সবাইকে
নিয়ে সোজা আবাসিক বিদ্যালয়ের দিকে যায় এবং ওদেরকে ওখানেই পড়া নামক যুদ্ধ শেখাবার জন্য
ভর্তি করে দেয়। বাবা মা’রা তাদের সইসাবুদ ও অন্যান্য কর্তব্য সেরে বাড়ি ফিরে যাবার সময় বলে, ‘বাব্বা! বাঁচা গেল।
এবার স্কুলটাকেই না ভেঙে ফেলে একেবারে লাটে তুলে দেয়’।
রেঁনোয়া
বত্তিচেল্লীর সঙ্গে বেশ ক’বছর থাকতে থাকতে এবং নিজে দুটো ছেলেমেয়ের মা হবার পর আনুষ্ঠানিক ভাবে বিয়ে করে শকুন্তলা
বলল, বিয়েটা আর কিছুই নয়, স্রেফ কয়েকটা সই আর আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে দেদার
আড্ডা, খাওয়া দাওয়া আর শেষে একটু পানভোজন। মেয়ে সংঘমিত্রা তিন বছরে পা দিয়েছে আর ছেলে
অভিযান এক বছর চার মাসে পড়ল। সেই সঙ্গে বিয়ে উপলক্ষেই আরও একজনের আগমন বার্তা ও নিজেই
টের পেয়েছে শুধু নয়, সবাইকে জানিয়েও দিয়েছে। সংঘমিত্রা আর অভিযানকে অলংক্রিতার জিম্মায়
রেখে ওরা যখন মধুচন্দ্রিমায় গিয়েছিল সেই সময়ের ফল এটা। কিন্তু গবেষণা, সংসার, সন্তান,
রেঁনোয়ার সঙ্গে লিভ-ইনে থাকতে থাকতে একঘেয়ে লাগছিল বলেই বিয়ে করা। বেচারা শকুন্তলা
দেখল বিয়েটা দুদিনেই ফুরিয়ে গেল। ব্যাপারটা যেন এমন - এল আর গেল। ডাক্তারের পরামর্শ
নিয়ে ও এবার শ্যামাঙ্গীর বাহিনীতে যোগ দিল। আর ঠিক সেই সময়েই সম্রাটের মেয়ে চৈতীও বিয়েটা
সেরে ফেলল ছোটবেলা্র বন্ধু রজতাভর সঙ্গে। সে বিয়েতেও ধূমধাম চলল তিন চারদিন ধরে। তারপরেই
মধুচন্দ্রিমা থেকে ফিরে এলে ডাক্তার জানাল সে সন্তান সম্ভবা। বুঁচি আর সম্রাট খুব খুশি
যদিও ওরা এখন কর্মসূত্রে আলাদাই থাকে। নবদিগন্তুন্মোচনহিসেব শকুন্তলাকে পেয়ে খুব খুশি
আর শকুন্তলাও দলের সব সদস্যদের পেয়ে খুব খুশি। বিভিন্ন সভা সমিতিতে যেতে লাগল তার সঙ্গে
ছেলে মেয়ে দুটোকেও ওখানে নিয়ে যেতে লাগল মাঝে মাঝে এই ভেবে যে এতে ওদের মানসিক বিকাশটাও
ভালো হবে। পুপুর একটা ছোট্ট ফুটফুটে সুন্দর মেয়ে মেয়ে হয়েছে। ওর নাম রেখেছে ওরা আগমনী
জয়েস। এদিকে লগ্নলতার একটা ছেলে হয়েছে আর এখন ও আরও একবার মা হতে যাচ্ছে। প্রথম ছেলের
নাম প্রবাহ। পুপু আর উপমা দুজনেই ঘোষণা করে দিয়েছে, এই একটাই ভালো। আর নৈব নৈব চ। এতদিনে
শ্রাবণ এক ধাপ এগোলো। সোফিয়া বলে একজনের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে ওর আর ওরা লিভ-ইন রিলেশনে
আছে এখন। সোফিয়াও সমাজতত্ববিদ আর ওদের দেখা একটা
আন্তর্জাতিক সম্মেলনে। গোটা বাড়িটা না হলেও গোটা সংসারটা ভরে উঠেছে মানময়ীর। মানময়ী নিজের ভেতরে
ভেতরে খুব তৃপ্ত বোধ করে। অনঙ্গরও কিছু কম গর্ব হয় না। সেও ছেলেমেয়ে, নাতিনাতনির কথা,
গল্প সবাইকে বলে। মানময়ী সঙ্ঘমিত্রাকে নিয়ে বসে অক্ষর চেনাতে। অনঙ্গ ওকে অঙ্ক আর সংখ্যা
চেনাবার চেষ্টা করে। বাচ্চাদের আর বাড়ির অন্যান্য
সদস্যদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যার কারণেই মানময়ী তার বাড়ির আশেপাশের আরও দুটো বাড়ি
কিনে ফেলে সেগুলোকে কোন কোন ঘর বা বারান্দা দিয়ে মূল বাড়ির সঙ্গে যোগ করে নেয় অনঙ্গর
বুদ্ধি আর পরামর্শ মত। তাই সে বছর গ্রীষ্মের ছুটিতে যখন বাচ্চারা বাড়িতে আসে আর সঙ্গে
তাদের বাবা-মারাও এসে থাকে, তাতে কোন অসুবিধেই কারুর হয় না। বরং মজা আর হৈ হুল্লোড় করে দিনগুলো যেন উড়ে যেতে থাকে আর সবারই
মনে হয় দিনগুলো আরও একটু রয়ে সয়ে গেলেই বেশি ভাল হত। সেবারের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট হল
বিয়ের পর প্রথম পুপু এ বাড়িতে আসে। ওর সঙ্গে আসে স্বামী রবার্ট জয়েস ও এক বছরের মেয়ে
আগমনী জয়েস। এসে পর্যন্ত আগমনী এর ওর কোলে চেপে ঘুরে বেড়াতে থাকে আর মাঝে মাঝে
কোল বদল করতে থাকে। এমনকি সে নীলনদের কোলে
চেপেও ঘুরে বেড়াতে থাকে গান গাইতে গাইতে। শকুন্তলা আর তার ছানাপোনাগুলোকে দেখে ও তাদের
গল্প শুনে পুপু এতই আনন্দে বিহ্বল হয়ে যায় যে শকুন্তলার স্বামী অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মানময়ী তাদের তাড়াতাড়ি স্মরণ করিয়ে
দেন তারা যেন এতদূর থেকে আসা বাড়ির জামাই-এর দিকে আতিথেয়তার কোন ত্রুটি না করে। তখন
শকুন্তলা আবার পুপুর স্বামীর দিকে ফিরে তার
সঙ্গে জবরদস্ত আড্ডা শুরু করে আর তাতে অন্যরাও এসে এমন অংশীদার হয়ে ওঠে যে সারাদিনে
তাদের আড্ডা ভাঙবার কোন লক্ষণই দেখা যায় না। শ্যামাঙ্গীর সতেরজন ছেলেমেয়ে মিলে বাড়িটাকে
নিয়ে যেন লোফালুফি খেলে এমনই যে তাদের সামলানোই
মুশকিল হয়ে পড়ে। অভিমানও ওদের সঙ্গে থাকতে থাকতে অনেক নতুন নতুন খেলা আর দুষ্টুমি শিখে
ফেলে যা পরবর্তী সময়ে শকুন্তলাকে সামলাতে গিয়ে রীতিমত হিমসিম খেতে হবে ভাবে আর শুধু
মাত্র সেই কারণেই সেও তার ছেলেকে পাঠিয়ে দেয় দিগন্তসেনার আবাসিক বিদ্যালয়ে। অবশ্য সংঘমিত্রাকেও
ও সেখানেই পাঠিয়ে দেয় একই সঙ্গে। তার আসন্ন বাচ্চাটির ভবিষ্যৎও ও এভাবেই ঠিক করে ফেলে।
সবাই এটা নিয়ে এমন ঠাট্টা জুড়ে দেয় যে বেচারা রেঁনোয়া বত্তিচেল্লী লজ্জার হাত থেকে
বাঁচতে সে ঘর থেকে অন্য ঘরে চলে যেতে বাধ্য হয়। শকুন্তলা তখন সদর্পে ঘোষণা করে, ‘বিয়ে
না করে প্রেম করে যাওয়াটা যে কত গর্বের আর তৃপ্তির, এমন কি ছেলেমেয়ে জন্ম দেওয়াটাও, সেটা যারা
না করেছে তারা বুঝবে না। আমার তো এখন আরও একটা বাচ্চাকে গর্ভে ধারণ করতে ইচ্ছে করছে।
কিন্তু কি করব বল, এই বাচ্চাটা না বেরালে অন্য আর একটাকে গর্ভে ধারণ করারও জায়গা নেই।
আমি তো চাই এইরকম ভাবে বাচ্চার জন্ম দিতে দিতে আমার বাচ্চাদের একটা লম্বা লাইন পড়ে
যাক’। আর ঠিক তখনই সবাই ওকে বলে যে ও কি সাংঘাতিক
রকম বেহায়া হয়ে গেছে। সেটা শুনে ও ভ্রুক্ষেপ না করেই পাল্টা বলে দেয়, ‘তোমরা বুঝলে
না গো আমার মত জীবনে বেহায়া হওয়া কি চরম সুখের’।
আর তার পরে পরেই শ্যামাঙ্গীর খোঁজ করে ও যখন সকলের জানতে চায় যে শ্যামাঙ্গী সারা জীবন এমন সন্নাসিনীই
থেকে যাবে কিনা বিয়ে বা লিভ-ইনের চুড়ান্ত মজাটা না নিয়েই, তখন সে দায়িত্ব সবাই ওর ঘাড়েই
চাপিয়ে দেয় যাতে ও নিজে গিয়ে কথাটা শ্যামাঙ্গীকে জিজ্ঞেস করে। অলঙ্কৃতা এসে যখন বলল সকলকে যে এই বেহায়াটা গিয়ে শ্যামাঙ্গীর
দলে যোগ দিয়েছে, তখন সকলের মুখ দেখে মনে হল গোটা আকাশটাই যেন ওদের মাথায় ভেঙে পড়েছে।
শকুন্তলা সবাইকে বোঝাতে লাগল যে নারী পুরুষ নির্বিশেষে কত অসংখ্য মানুষ শ্যামাঙ্গীর
প্রেমে পাগল আর তারা শ্যামাঙ্গীকে পেলে যেন একেবারে বর্তে যাবে এমনই তাদের হাবভাব।
আর সেটা হাতে নাতে প্রমাণ করবার জন্যই যেন কিছুক্ষণ পরেই শ্যামাঙ্গী ওখানে সশরীরে উপস্থিত
হল। সবাই দেখল শ্যামাঙ্গীকে কত সুন্দর অল্পবয়সী দেখাচ্ছে। মনে মনে সবাই ভাবল যে যত
বয়স বাড়ছে ততই যেন ওকে আরও বেশি বেশি করে সুন্দরী আর অল্প বয়সী দেখাচ্ছে। রোজকার মত
আজও শ্যামাঙ্গী প্যান্ট আর শার্টই পরেছে। সে আসলে এখানে এসেছিল তার চোদ্দটা ছেলে আর
চার মেয়েকে খুঁজতে। সেটা জেনে অন্যরা জানতে চাইল কেন ও ওদের খুঁজছে। শ্যামাঙ্গী জানাল
ওদের চান খাওয়ার জন্য। তখন সেটা শুনে সবাই বলল যে ওটা ওরাই করে দেবে। তার বদলে ও যেন এখন ওদের সঙ্গে একটু থাকে। শ্যামাঙ্গী বসল। তারপর
পুপু, শকুন্তলা, উপমা আর লগ্নলতা সবাই মিলে ওর কাঁধ থেকে আঙ্গুলের পাতা অব্দি হাত বোলাতে
বোলাতে আর মাঝে মাঝে এক এক জায়গা নিরীক্ষণ করতে করতে বলতে লাগল যে ওর হাতটা কি সুন্দর।
তারপর পিঠে হাত বোলাতে বোলাত বলল ওর পিঠটাও কি সুন্দর। আর তারপর ওকে বলল যে ওকে কি সুন্দর
দেখতে। ও খুব অবাক হয়ে যেতে লাগল আর
বোঝবার চেষ্টা করল ওরা কী চায়। তারপর ওরা ওকে বলল যে ও যদি বিয়ে করে তাহলে খুব ভালো
হয়। কেননা তাহলে ওরা খুব মজা আর আনন্দ করতে পারবে। কেননা ওরা সবাই এক হতে পারবে ওর
বিয়ে উপলক্ষে। শ্যামাঙ্গী বলল, ‘সে ঠিক আছে। তোদের দরকারটা কী সেটা বল’। ওরা বলল,
‘এটাই। কেননা একজন ওর প্রেমে পড়ে ওদের শরণাপন্ন
হয়েছে আর ও বিয়ে না করলে সে বেচারা মরে যাবে।
শ্যামাঙ্গী গোটা শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে
উঠে দাঁড়াল আর মুখে একটা ধমকের শব্দ করল,
‘হাপ’। তারপর বলল, ‘সব জাহান্নামে যাক আর সেই সঙ্গে তোরাও যা’। বলে উঠে সোজা ঘর থেকে
বেরিয়ে গেল। রান্নাঘরে মানময়ীর কাছে গিয়ে বলল, ‘যত সব পাগলের দল’। মানময়ী মেয়ের চোখমুখের
ভাব দেখে আর কিছু জিজ্ঞাসা করতে ভরসা পেল না।
তারপর প্রবাহ এসে ওর আঙুলগুলো ধরে নাড়াতে লাগল। ও বলল; ‘কী? প্রবাহ বলল, কোলে উঠব। ও ওকে কোলে তুলে নিল। প্রবাহ
বলল, ছাদে চল। ও ওকে কোলে নিয়ে ছাদে চলে গেল।
বিকেলে
গোটা বাড়ির মোট তেইশটা বাচ্চা নিয়ে শ্যামাঙ্গী ছাদে কুমিরডাঙ্গা খেলতে লাগল। বাচ্চারা
খুব খুশি। খেলা হয়ে গেলে ও ওদের সবাইকে জিজ্ঞেস করল, ‘তোরা আইসক্রিম খাবি না চকলেট
খাবি’? সবাই একসঙ্গে বলল, ‘দুটোই’। তখন ও আস্তাবল
থেকে ওর ঘোড়াটা বের করে নিয়ে খানিকটা এদিক ওদিক টহল দিয়েদ দেখে শুনে আসবার পথে আইসক্রিম আর
চকলেট নিয়ে এসে বাচ্চাদের হাতে ধরিয়ে দিল। তারপরে বাড়িতে ওর যেটা নিজের ঘর সেখানে বসে
বইপত্র ঘাঁটতে শুরু করল। শেষে একটা আন্তর্জাতিক আইন বিষয়ে বই নিয়ে পড়তে শুরু করল। সমস্ত
হৈ হট্টগোলের মধ্যে বিরাট পেল্লাই মাপের একটা খাবার টেবিলে পঞ্চাশটা চেয়ারে বসে সকলে
যখন যে যার নিজের রাতের আহার সারতে সারতে গল্পে আর হাসিতে ব্যস্ত তখন অলঙ্কৃতা এসে
একটা ছোট বাটিতে ওর রাতের এক ও একমাত্র খাবার কাজু ও কিসমিস দেওয়া ওট দিয়ে গেল। ও বলল,
‘শোন, সুদাম কোথায় রে? জানিস কিছু?’ উত্তরে অলঙ্কৃতা বলল, ‘ও সবার সঙ্গে খেতে বসেছে। আসলে বাড়িতে জামাইরা সব
খেতে বসেছে তো, তাদের দেখা শোনার জন্যই মা
ওকেও বসে পড়তে বলল’। ও বলল, ‘আচ্ছা। তুইও তো ওদের সঙ্গে বসে গেলে পারতি’। তাতে অলঙ্কৃতা
জানাল যে পরিবেশনের পুরো দায়িত্বে সেক্ষেত্রে
মানময়ী একা থাকত। ফলে খুব অসুবিধে হত। সবার হয়ে গেলে ও মানময়ীকে নিয়ে বসবে খেতে। তখন
শ্যামাঙ্গী বলল, ‘পতিই পরম গুরু আর শ্বশুরবাড়ি মন্দির সম। এবং নিজে না খেয়ে অন্যকে
খাওয়ানো এটাই মেয়েদের পবিত্র ধর্ম’। শুনে অলঙ্কৃতার এতটা হাসি পেল যে ও একেবারে খিলখিল করে হেসে উঠল। তখন শ্যামাঙ্গী বলল,
‘উঁহু! মেয়ে মানুষের হাসতে মানা! হেসো না বৎস’। অলঙ্কৃতা আরও হাসতে হাসতে ঘর থেকে বেরিয়ে
গেল।
হঠাৎ করেই খবর আসে দিগন্তসেনায় হসপিটালে কিছু সমস্যার কারণে জরুরী পরিষেবা দেওয়া বন্ধ রাখা হয়েছে। শ্যামাঙ্গী অনেকদিন ধরেই ভাবছিল যে এবার পুরো ব্যাবস্থাকেই যে শুধু ঢেলে সাজাবে তাই নয়, সেটাকে শক্ত পায়ে স্বাধীনভাবে কাজ করার উপযোগীও করে তুলবে। এইজন্যে যে সবসময় ওর ওপর নির্ভর করে থাকলে ওরও সমস্যা হয় আর অন্যদেরও সমস্যা হয়। একবার ভাবল কাল চলে যাবে ভোরবেলা। পরক্ষণেই মনে হল, এক্ষুনি যাওয়া দরকার। বাড়িতে সবাইকে জানিয়ে ও বেরিয়ে পড়ল। পৌঁছেই খোঁজ নিল পরিস্থিতিটা কী। ওকে যখন জানান হল পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবার জন্য খানিকটা সময় অবশ্যই দিতে হবে, তখন ও আর কিছু বলল না। বরং ও ওর সহকারী পেদ্রো গুয়েররেসকে ডেকে নিয়ে বসার ঘরে ছোট মিটিং করে আগামী কাল ওর দলের সদস্যদের নিয়ে একটা মিটিংএর আয়োজন করল। যদিও আবাসিক তবুও রবিবার বলে ছাত্রছাত্রীদের ক্লাস নেই। তাই কোন অসুবিধে হবে না। রবিবার সকাল দশটায় স্কুলের হল ঘরে শ’দেড়েক লোক জড়ো হল। তারপরে মিটিং শুরু হল। মিটিংএ ও ওর ভাবনার কথা জানাল। অন্যদেরটাও জানল। তারপরে সর্বসম্মতিতে ঠিক হল, একটা নতুন সরকারি ভবন নির্মাণ করা হবে যেখানে প্রত্যেকটি বিষয়ের জন্য আলাদা আলাদা দফতর থাকবে এবং সেই দফতরের জন্য আলাদা আলাদা ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রীও থাকবে। সবার ওপরে থাকবে রাষ্ট্রপতি ও মুখ্যমন্ত্রী, তার অধীনে উপমুখ্যমন্ত্রী। আর তাদের অধীনে থাকবে মন্ত্রীদের এই দল। প্রত্যেকটি বিভাগ হল এইরকম – শিক্ষা দফতর, চিকিৎসা দফতর, কৃষি দফতর, শিল্প, স্বরাষ্ট্র, মানব সম্পদ উন্নয়ন, পূর্ত, অর্থ, ক্রীড়া, পরিবহন, আবহাওয়া, সেচ, বিদ্যুৎ ও নগর উন্নয়ন দফতর। শিক্ষা দফতরে আন্তনীয় ফিয়েররো ও উজ্জয়নী রোদদ্রিগেজ, চিকিৎসা দফতরের দায়িত্বে থাকবে ভ্যালেন্তিনা কারেনিনা, কারলোস ফিয়েররো, কৃষি দফতরে থাকল রামিরেজ পালমা ও অরনো বোসার, শিল্পে থাকল ফ্রান্সিস্কো চাইওয়াক আর জুলি ভ্যাঁসি, স্বরাষ্ট্র দফতরে থাকবে শ্যামাঙ্গী চট্টোপাধ্যায়, গ্রেগরি লতানো আর প্রমোদ সারিন, অর্থ দফতরে থাকবে জোয়ে আবদেরজাক, পিয়ের নোরোয়া। পরিবহণ দফতরে রাখা হল জি লাব্রুস ও আদ্রিয়ানা আলারকা, ক্রীড়া দফতরে থাকবে লুদিভিন দ্যুভাল ও রামন পিসাররো আর জন ব্রাউন। মানব সম্পদ দফতরে থাকবে ইয়াসমিনা নাথান, পানচো আলবেরতো ইরিগোয়েন, আলানসো ফেরনান্দেজ। নগর ঊন্নয়ন দফতরে থাকল তুপাক ইউপানকি, মানকো আপারু, বার্নিয়ের লিজাক, রেঁনোয়া বত্তিচেল্লী, রেঁনোয়া আগামেনন। পূর্ত দফতরে থাকবে ইভান খিমেনেজ ও হেলেন থালেস, সেচে থাকছে মামা ওকল্যিও ও ডেভিড ক্রিস্তবাল। বিদ্যুৎ দফতরে থাকছে অ্যালান বার্নেট ও গেইল ব্রাহে। তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরে শ্রাবণ চট্টপাধ্যায়, জঁ লুক র্যঁলা, অ্যালেক্স মর্গান, রেঁনোয়া বত্তিচেল্লী এবং প্রতিরক্ষা দফতরে শ্যামাঙ্গী চট্টোপাধ্যায়, চৈতি চট্টোপাধ্যায়, উপত্যকা সেন থাকল। শ্রমদফতরে রাখা হল শকুন্তলা চট্টোপাধ্যায় ও মিশেল আব্রাহাম। সকলের সম্মিলিত সিদ্ধান্তে ঠিক হল রাষ্ট্রপতি হবে শ্যামাঙ্গী চট্টোপাধ্যায়, মুখ্যমন্ত্রী সুদাম চট্টোপাধ্যায় আর উপমুখ্যমন্ত্রী ভ্যালেনতিনা ইয়েব্রা। শ্যামাঙ্গীর সহকারী হিসেবে পেদ্রো গুয়েররেস যেমন ছিল তেমনই থাকবে। সমস্ত সংবাদ বেতার ও দূরদর্শন মারফত সম্প্রচার করা হল।
(ক্রমশ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন