সমকালীন ছোটগল্প |
কুয়াশা
-বুল!
এই বুলু! কী বিড়বিড় করছিস রে?
মায়ের
ডাকে আচমকা ঘুমটা ভেঙে গেল। সকালবেলাতেও আধো-অন্ধকার। বৃষ্টি হয়েছে বোধহয়। ঘরের হলুদ,
ক্ষয়ে যাওয়া দেওয়াল জুড়ে ছোট ছোট হাতের ছাপ দেখতে পাচ্ছি। একটা হাঁফ ধরে আসছে আমার।
আবার
মা ডাকছে।
-"বুলু!
আয় তাড়াতাড়ি। কাল তুই বাজার করে দিলি বলে আজ একটু মাছ রেঁধেছি। খাবি আয়।"
কথাগুলো
বলতে বলতে মা ঘরে ঢুকে পড়েছে। মায়ের হাতটা টেনে ধরলাম।
-"মা,
আমি কী বিড়বিড় করছিলাম গো?
-"কী
যেন একটা ছড়া।"
-"কী
ছড়া?"
আমার
ভেতরের অস্বস্তিটা বাড়ছে।
-"খেলার
পুতুল, মাঠের গান হারিয়ে গেল ওদের স্থান। এমনই কিছু বলছিলি বোধহয়।"
মায়ের
কথায় চমকে উঠলাম। কাল রাতের স্মৃতিগুলো স্পষ্ট হচ্ছে এবার। মদ না খেলে আমি কাজটা করতে
পারি না। কাল তিনপেগ পেটে ঢেলে বাচ্চাটাকে তুলেছিলাম।
গতকালের
বাচ্চাটা আবার প্রতিবন্ধী ছিল নাকি! তাই তো অমন আবোল-তাবোল ছড়া বলছিল। কাল তিনপেগের
ডোজটা সামলাতে আজও কষ্ট হচ্ছে। তাই ছড়াটা
ঘুমের মধ্যে বিড়বিড় করেছি।
কিন্তু
দেওয়ালের গায়ে ছোট ছোট হাতের দাগগুলো! কী আশ্চর্য! এখন তো আর নেই!
-"মা,
দেওয়ালে বাচ্চাদের হাতের ছাপ ছিল?"
-''কী
পাগলের মত কথা বলিস?
মা
যেন হঠাৎ করে রেগে গেল।
-"এই
বাড়িতে বাচ্চা আসবে কোত্থেকে? তুই কাজে বেরোলে আমিও তো বেরিয়ে যাই। সারাদিন বাড়ি
বন্ধ। দুজনই রাতে ফিরি। কে আসবে এই বাড়িতে?
বেশ
ঝাঁঝের সঙ্গেই কথাগুলো বলল মা।
আমার
মাথাটা গুমোট মেঘের মতো ধরে আছে। ছড়াটা আবার মনে পড়ছে। গতকালের বাচ্চাদের মুখটা কেমন
অস্বাভাবিক। এই ছড়াটাই বারবার আওড়াচ্ছিল মেয়েটা। আমাদের দলের লোকগুলো বলছিল মেয়েটা
নাকি পাগল। তাই এমন বকছে। আমার রাগ হচ্ছিল। এমন পাগলি মেয়েকে তোদের দরকার হচ্ছে কেন?
সে কথা যদিও বলা হয়নি।
কয়েক
মাস হল এই শিশু পাচার র্যাকেটটার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছি আমি। স্বেচ্ছায় নয়, টাকার
জন্য। আমার দিদির মনের অসুখ। কতদিন ধরে হাসপাতালে পড়ে রয়েছে। বাবাটা ক্যানসারে মরল।
টাকাও গেল, মানুষটাও মরল।
মাকেও
হাজারটা রোগে ধরেছে। তাই নিয়েও কাজ করে। অনেক টাকার দরকার আমার।
গত
দু'সপ্তাহে প্রায় চারটে বাচ্চা আমাদের র্যাকেটের মাধ্যমে পাচার হয়েছে। এবার আমি একটু ছুটি নেব। গতকাল আমাদের নতুন এক প্রোজেক্ট
ম্যানেজারের ফোন নম্বর পেয়েছি। আমাদের লাইনে
অনেক বছর আগে থেকেই নাকি ছিল। তবে আমাদের দলের সঙ্গে এই প্রথম। তার সঙ্গে দেখা বা কথা
কোনটাই হয়নি। শুধু ফোন নম্বরটা নিয়েছি।
আজ
এখনি একবার ফোন করে জানাবো যে আমি কয়েকদিন ছুটি নেব। এক-একটা প্রোজেক্টের পর একটা
কালো রঙের লোমশ পোকা যেন আমায় কামড়ে ধরে।
মা
সমানে ডাকছে। ভাত বেড়েছে।
ফোনটা
ডায়াল করে বিদ্যুতের চমক লাগলো আমার। আমার ডায়াল করার সঙ্গে সঙ্গেই বাড়ি থেকে একটা
ফোন বেজে উঠলো। কিন্তু এই বাড়িতে তো আমার ছাড়া আর কারো ফোন নেই! মাকে দিতে চাইলেও
দেয়নি।
হঠাৎ
দেখি মা রান্নাঘর থেকে দৌড়ে আসছে। "তোকে বলাই হয়নি বুলু, কাল একটা ফোন কিনেছি,
তুই এত রাত করে ফিরিস যে কথা বলাই হয় না।"
মা
ফোনটা ব্যাগ থেকে বার করে।
আমি
হুমড়ি খেয়ে মায়ের ফোনের দিকে তাকাই। আমার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে
যায়। মায়ের ফোনে আমার নম্বর ভেসে উঠেছে।
সকালের
বৃষ্টির চাদরের কুয়াশাটা যেন জড়িয়ে ধরছে আমায়। আর সেই কুয়াশার মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে
অজস্র ছোট ছোট হাত।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন