সমকালীন ছোটগল্প |
তীরন্দাজ
-উঃ! এখন ছেলেটা কী করবে যে!
-কে ছেলে! কার কথা বলছো তুমি
কেয়া?
-প্রতীকের কথা বলছি। ছেলেটার
মাথায় এভাবে আকাশ ভেঙে পড়লো, ছাদ সরে গেলো ওর মাথা থেকে! কেউ থাকলো না পাশে…
-কোনও কিছুই হঠাৎ করে হয় না জানো
কেয়া। ধোঁয়া দেখলে তার পেছনে নিশ্চিৎ জেনো একটা ছারখার করা আগুন আছে। এই ‘আকাশ ভেঙে
পড়া’ কনসেপ্টটা কিছু মানুষের বানানো। বুঝলে!
ক্রিয়েটেড সামথিং। অকস্মাৎ বলে
কিছু হয় না। সবকিছুই আপাত রিলেটেড। সব ঘটে-যাওয়া ভয়ঙ্কর ব্যপারগুলোরই এক-একটা বাস্তব
গ্রাউন্ড আছে।
-আমি জানি, তুমি এরকম কথাই বলবে।
তোমার উত্তরটা এরকমই হবে। এই যে হঠাৎ করে প্রতীকের মা মারা গেলো, এটা প্রতীকের মাথায়
আকাশ ভেঙে পড়া নয় তবে? আকাশ ভেঙে পড়া একটা প্রোভার্ব আমি জানি। এতটা মুর্খ নই আমি!
এমন এক-একটা পরিস্থিতি মানুষের ওপর দিয়ে যায় যা সত্যিই তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মত
ভয়ঙ্কর দুর্ভাগ্য। বাবার আকাশের তলা থেকে সরিয়ে আনা কিশোর ছেলেটা…
-বাহ! বেশ বোঝো তো! শুধু আমার
যুক্তিগুলোই বোঝো না! না কি ইচ্ছে করে বুঝতে চাও না! প্রতীকের মা হঠাৎ করে তো মারা
যায়নি। একেবারেই হঠাৎ করে মারা যায়নি। এর পেছনে দীর্ঘ ছারখারের আগুন আছে যা তৈরি করেছে
ওর স্বামী মিঃ সংরাগ মুখার্জী। মারা যায়নি, খুন করা হয়েছে রাধিকা, মানে মিসেস মুখার্জীকে।
-তাই নাকি?
-মিসেস মুখার্জীর মনের তীব্র
ডিপ্রেসনের কথা তুমি জানতে কি কেয়া! জানতে না।
-ও। তুমি জানতে বুঝি! বেশ!বেশ!
তা কোথায় দেখা হয়েছিলো তোমার সঙ্গে মিসেস রাধিকা মুখার্জীর! এ বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা করতে
তো অনেক সময় দরকার!
-প্রতীকের বাবা, মানে সংরাগ মুখার্জীর
কথা জানো নিশ্চয়ই!
-না। তাঁর সাথে আমার কোনো গোপন
আলাপচারিতা নেই। নামও জানতাম না। তোমার কাছেই তার নাম শুনলাম এইমাত্র!
-অযথা বাজে কথা বলছো কেন কেয়া!
একথা বলে তুমি কী মিন করতে চাইছো?
-মিন করবো কেন? স্পষ্টই বলছি!
সে ভদ্রলোকের সাথে আমার চেনাশোনা নেই।
-ভদ্রলোক! ওই মুখার্জীলোকটা ভদ্রলোক? একটা নষ্ট লোক। পাজি লোক।
-এটাও নিশ্চয়ই মিসেস রাধিকা মুখার্জীর
কাছ থকেই শোনা তোমার!
-সেটা কোনো কথা নয় কেয়া! যার
কাছেই শুনি না কেন! শুনেছি, বাইরে অনেক মেয়েদের সঙ্গে লোকটার এ্যাফেয়ার্স আছে। মাঝে মাঝে এদের কেউ কেউ
ঘরেও আসে। মানে লোকটা ডাকে নিশ্চয়ই! আর্টিস্ট ছন্দবাণীকে তো প্রায়ই দেখা যায় সংরাগের
বাড়িতে! রাধিকা, আই মিন মিসেস মুখার্জী অফিসে থাকেন সারাদিন। ব্যাংকের উঁচু পোস্টে
আছেন তিনি। একজন আর্টিস্টকে বিয়ে করে জীবনটা…। এগুলো কি একজন মহিলার চরম ডিপ্রেসনের
কারণ নয়! ছেলেকে নিয়ে ভদ্রমহিলা স্বামীকে ছেড়ে
চলে এসেছেন।
-ও! তা হলে তো চুকেই গেছে!
-না, মানে চাকরি সামলিয়ে একা
ছেলেকে মানুষ করা! তার সমস্ত চাহিদা মেটানো। একটু কিছু মনোমত না হলে ছেলের মেজাজ সহ্য
করা। এসব সময়ে প্রতীক নাকি তার মা’কেই দোষ দিচ্ছে, বাবার কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে
তার জীবনটা নষ্ট করে দিয়েছে বলে। সাফ কথা শুনিয়ে দিয়েছে নাকি প্রতীক যে মায়ের জন্য
নিজের জীবন সে নষ্ট করবে না। এই প্রচন্ড মানসিক চাপের টেনসন নেওয়া একজন মহিলার পক্ষে…!
মিসেস মুখার্জী তো ছেলেটার ভালো করতেই এসব করেছেন। ওই বাজে পরিবেশে থাকলে ছেলেটা কি
মানুষ হবে কোনদিন! জানো তুমি, মানসিক অস্থিরতার চাপ আচমকা হার্ট ফেলিওর ডেকে আনে? সবাই
জানলো, রাধিকা্র হঠাৎ হার্ট ফেলিওর হয়েছে। কেমন ইনডাইরেক্টলি খুন করা!
-তা এতসব ভীষণ ব্যপার কে বলেছে
তোমাকে!
-কে বলেছে মানে? রাধিকা নিজে,
মানে মিসেস মুখার্জী নিজের মুখে বলেছে!
-কাকে বলেছে?
-আমাকে। আমাকে বলেছে! বলেই একটু
থতমত সৈকত।
কেয়া শান্তভাবে বললো তার স্বামী সৈকতকে, বাঃ! এসব শোনবার দিব্যি অনেক
সময় আছে তো তোমার কাছে! কবে এপাড়ায় এসেছেন যেন ভদ্রমহিলা! মেয়েদের সাথে মিশলেই পুরুষরা
নষ্ট হবে কে বলেছে? আমি তো তোমাকে নষ্ট ভাবছি না?
-এই যে ব্যাপারটা চলছিল, সেটা তো সংরাগ মুখুজ্জে চালিয়ে যাচ্ছিলো ইচ্ছে করেই, যাতে
মিসেস মুখার্জীকে চাপ দেওয়া যায়! এমন ব্যাকগ্রাউন্ডে একজন মহিলা্র তো হার্ট ফেল করতেই
পারে! এ তো জানা কথাই! আমি বলছি কেয়া, ওরা বাপ-ছেলে দুজনেই তোমাদের এই সো-কলড ‘আকাশ
ভেঙে পড়া’র জন্য দায়ী। দেখতে গেলে ওরা দুজনেই মিসেস মুখার্জীর খুনি। ইয়েস! ওরাই খুন
করেছে রাধিকাকে।
শান্তভাবে কেয়া জিজ্ঞেস করলো,
-এর মধ্যে কবে তুমি ব্যারিস্টারি
পাশ করেছ আমি জানি না তো! কোন ইয়ারে পরীক্ষা দিলে!
-কেন এসব বাজে কথা বলছো কেয়া!
এসব বাজে প্রশ্ন করছো কিসের জন্য বল তো! কি প্রমাণ করতে চাইছো তুমি?
-রাধিকা মুখার্জীর পক্ষে মামলা
লড়ে, কত সহজেই তুমি রায় দিয়ে দিলে, তাই বলছিলাম আর কি! তা উকিল না হলে তবে তুমি ডিডেকটিভ…
-এ তো সাধারণ মানুষই বলে দিতে
পারে! এর জন্য কোনো লইয়ার বা ডিটেকটিভের দরকার পড়ে না। শুধু শুধু বাজে প্রশ্ন করে চলেছো
তখন থেকে!
-সাধারণ মানুষের মতো কথা তুমি
কেন বলবে! আমি তো তোমাকে অসাধারণ একজন বলেই জানি! এত সাধারণ কথায় তুমি কেন! আর এসব কথা রাধিকা
তোমার সঙ্গেই বা কিসের খাতিরে আলোচনা করেছে,
তুমি উকিল নও ব্যারিস্টার নও, ডিটেকটিভ নও, তাও!
রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে কেয়া
সেনের স্বামী সৈকত সেন দাঁতে দাঁত চিপে বললো,
এইসব ফালতু ব্যাঙ্গ করা প্রশ্নাঘাত
একজন মানুষকে কতটা নষ্ট করে দিতে পারে জানো তুমি কেয়া!
কেয়া সেন একটুও উত্তেজিত না হয়েই
তার তীরটা ছুঁড়লো, এটাও তো হতে পারে সৈকত, যে এইভাবে অযথা প্রশ্নাঘাত পেতে পেতেই প্রতীকের
শিল্পীমনস্ক বাবা মিঃ সংরাগ মুখার্জীও নষ্ট হয়েছে! হতে পারে না এমনটা?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন