প্রাচীন ভারতে শূদ্রেরা
(অনুবাদ: চন্দন দত্ত)
(নিম্নতর বর্গের আনুমানিক ৬০০ খৃষ্টাব্দের
পূর্বেকার এক সামাজিক ইতিহাস। ভারতের প্রথম সারির ইতিহাসবিদদের মধ্যে অন্যতম, প্রয়াত
শ্রদ্ধেয় রামশরণ শর্মা দ্বারা লিখিত ‘SUDRAS IN ANCIENT INDIA -- A Social
history of the lower order down to circa AD 600’ নামক প্রসিদ্ধ গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ।)
*অধ্যায় - ৩ / ২*
*উপজাতি বনাম বর্ণ : (আনুমানিক ১০০০
খৃষ্টপূর্বাব্দ থেকে ৫০০ খৃষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত)*
যদিও পরের দিকের বেদকীয় পর্যায়ে, ভিস-দের
কারিগর অংশটি শূদ্রদের পর্যায়ে হ্রস্বীকৃত হয়েছিল, তবুও কারুশিল্প ও কৃষি ইত্যাদি
যেসব কাজে তারা নিযুক্ত ছিল, সেগুলিকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখা হয়নি। কৃষিকাজ সম্পর্কে
বলা যায়, সেক্ষেত্রে সহায়তামূলক, উদ্দীপনামূলক এবং সম্মান প্রদর্শনকারী কয়েকটি ইতিবাচক
(positive) মনোভাব লক্ষ্য করা গেছে, যেগুলি প্রদর্শিত হয়েছে গুণ কীর্তন ও বেশ কয়েকটি
গার্হস্থ আচার আচরণের মাধ্যমে। কারুশিল্প সম্পর্কে বলতে গেলে, অবনমনের কোনো লক্ষণ দেখা
যায়নি, এমনকি চর্মশিল্পের ক্ষেত্রেও। এটি
নির্দেশিত করে যে কাজের প্রকৃতি নির্বিশেষে ভেজাল সদৃশ কোনো অবিশুদ্ধতা দেখা যায়নি,
যা উত্তরকালীন পর্যায়েও ছিল অপরিবর্তিত। যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, স্রৌতসূত্রে একটি
বাণিজ্যসংক্রান্ত আইনকে বলা হয়েছিল শিল্প (silpa), এমন একটি শব্দ যা কারুশিল্পকেও
বোঝায়। পরের দিকের বেদকীয় পর্যায়ে, কায়িক শ্রমের প্রতি অবজ্ঞাসূচক অনুপস্থিতিকে
হয়ত তুলনা করা যেতে পারে গ্রিসের সমান্তরাল একটি বিকাশের সাথে, যেখানে হেসিওড
(Hesiod) থেকে সক্রেটিস (Socrates) পর্যন্ত পর্যায়কালে (আনুমানিক ৮০০ থেকে ৪০০ খৃষ্টপূর্বাব্দ
পর্যন্ত) এর প্রতি জনসমর্থন বিদ্যমান ছিল। পরের দিকের বেদকীয় পর্যায়ে কায়িক শ্রমের
প্রতি শ্রদ্ধামূলক দৃষ্টিভঙ্গিটি হয়ত পুরাতন সরল সমাজ থেকে প্রলম্বিত হয়েছিল, যে
সমাজে রাজা, লাঙল চালানোর কাজে হাত লাগিয়েছিল। রাজা জনকের বলিসংক্রান্ত অনুষ্ঠানে
বাস্তবিকই লাঙল চালানো এবং রাজপুত্র দুর্যোধনকেও সেই কাজ করতে বলার মহাকাব্যীয় দৃষ্টান্তটি
হয়ত সেকেলে বৈদিক সমাজটিকে প্রতিফলিত করেছে, যেটি পার্বত্য উপজাতীয় সমতা-কে
(equality) এখনও ধরে রাখতে অনেকাংশে সাহায্য করেছে। একজন উর্দ্ধতন রাজপুত্র লাঙল চালাচ্ছেন,
এমন দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় বৌদ্ধ ধর্মানুষ্ঠান ভাপ্পা-মঙ্গলায় (vappa-mangala)। যথেষ্ট
মজার ব্যাপার যে, ইহুদীদের প্রাচীন সমাজে, ইহুদী আইনজ্ঞরা নিজেরাই নিজেদের সমর্থন করেছিলেন
কায়িক শ্রম প্রদানের মাধ্যমে এবং শিখিয়েছিলেন যে, ঈশ্বর মানুষকে আজ্ঞাপিত
(commanded) করেছেন যে, রবিবারের দিনটি কেবলমাত্র
বিশ্রামের জন্যই নয় বরং সপ্তাহের অন্য ছ'দিন কাজ করার জন্য।
শূদ্রেরা মনে হয় সেই যুগের রাজনৈতিক
জীবনে অত্যন্ত সঙ্গতিপূর্ণভাবে ও গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূমিকা পালন করেছিল। ইন্দো-আর্য
প্রশাসনিক ব্যবস্থার গঠনমূলক পর্যায়ে, রাষ্ট্র পরিচালন ব্যবস্থায় তাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ
অংশগ্রহণ তারা উপভোগ করেছিল। এটি আকর্ষণীয় যে, রাষ্ট্রের প্রায় এক ডজন উচ্চ কর্মকর্তাদের
রত্নিন্স (ratnins - means jewel-holder) নামক একটি সমুচ্চ কাঠামোয় তারা স্থান পেয়েছিল,
যেটিকে তুলনা করা যেতে পারে 'বারো জনের পরিষদ' (Council of twelve)-এর সাথে, যেটি এমন
একটি প্রতিষ্ঠান ছিল যার প্রাচীনতার বিরাট কদর ছিল ওল্ড স্যাকসন্স (Old saxons), ফ্রিসিয়ান্স
(Frisians), সেল্টস (Celts) প্রভৃতি নামের বেশ কয়েকজন ইন্দো-ইউরোপিয়ান জনসাধারণের
কাছে। রত্নিন্স-রা এত গুরুত্ব সম্পন্ন ছিল যে, রাজসুয় বলিদান উপলক্ষে রাজাকে তাদের
গৃহসমূহের রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয়েছিল, সমারোহ অনুষ্ঠানে বিভিন্ন দেবতাকে নৈবেদ্য স্বরূপ
মণিরত্ন প্রদানের কাজ সম্পাদন করার প্রাক্কালে।
রত্নিন-দের তালিকা দর্শায় যে, সেটি
প্রতিটি বর্ণের প্রতিনিধিদের অন্তর্ভূক্ত করেছিল। এইভাবে দু'জন রত্নিন, রথকারা
(rathakara) এবং তাকসান (taksan), যাদের কথা বিভিন্ন সাহিত্যে উল্লেখিত হয়েছে, তারা
ছিল শূদ্র বর্ণের কারুশিল্পী বিভাগের অন্তর্গত। এই সত্য যে, গার্হস্থ্য সমারোহ অনুষ্ঠানে
সমস্ত ধরনের ধাতুকেই, বলিদান সংক্রান্ত পারিশ্রমিক
(fee) হিসেবে পরিগণিত করার বিষয়টি নির্দেশিত (prescribed) হয়েছিল, সেটি দেখিয়ে দেয়
যে, ধাতু-কর্মের সাথে সংযুক্তির কারণে শূদ্রেরা সমাজে গুরুত্ব অর্জন করেছিল। ইতিপূর্বেই
দেখানো হয়েছে যে, অথর্ববেদে, রাজা কীভাবে চেষ্টা করেছিলেন, কর্মকার এবং রথকার-দের সাহায্য
আদায় করার বিষয়টি নিশ্চিত করতে। কিন্ত পরবর্তী কয়েকটি সাহিত্যে, কর্মকারদে'র স্থান
ছিনিয়ে নিয়েছে তাকসান-রা (taksan), হয়ত রথকারদের (rathakara) সহযোগে সমস্ত ধরনের
ধাতু-কর্ম ও রথ প্রস্তুতকরণ বিভাগের ভারপ্রাপ্ত হয়ে বসেছিল, যেটি ছাড়া অধিকতর পূর্ব
প্রান্তে ও দক্ষিণে আর্যদের সম্প্রসারণ ও বসতি স্থাপনেরের (settlements) বিষয়টির অগ্রগতি সম্ভবপর ছিল না।
এই দুই রত্নিন (ratnin) সম্পর্কে যদিও 'শতপথ ব্রাহ্মণ'-এ উল্লেখ করা হয়নি, যেখানে
তাদের স্থান আধৃত (taken) হয়েছে গোভিকর্তনা (শিকারী) এবং পালাগালা-দের (বার্তাবাহক)
দ্বারা। এটি চিন্তা করার মতো একটি বিষয় যে, এই দুই ব্যক্তি অনার্য-জাতিভুক্ত
(non-aryanised) আদিবাসী ছিল, যাদের ধর্মানুষ্ঠানের মাধ্যমে শূদ্র বর্ণে অন্তর্ভুক্ত
করা হয়েছিল। নৈবেদ্য স্বরূপ মণিরত্ন প্রদানের অনুষ্ঠানটি অনুসৃত হয়েছিল রাজার প্রায়শ্চিত্তমূলক
একটি আচরণের মাধ্যমে, যিনি অ-বলিদানকারী শূদ্রদের বলিদানের সংস্পর্শে টেনে আনার জন্য
দোষী হিসেবে বিবেচিত হয়েছিলেন। সায়ানা (Sayana) অনেক দূর অগ্রসর হয়েছিলেন, যখন তিনি
এমনকি একজন সেনাপতি-কেও (commender) শূদ্র রত্নিন-দের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন।
সমস্ত রকমের সম্ভাবনার মধ্যে, অ-বলিদানকারী শূদ্রদের উল্লেখ প্রযুক্ত হয়েছে কেবলমাত্র
পালাগালা (palagala) এবং গোভিকর্তনায়ার (govikartana) ক্ষেত্রে। পালাগালা যে একজন
শূদ্র ছিল সেটিকে অনুমিত করা যেতে পারে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে, পালাগালা-কে একজন
শূদ্র হিসেবে উদ্দিষ্ট (addressed) করা হয়েছিল। অন্য একটি জায়গায়, পালাগালা শব্দটিকে
ব্যাখ্যা করা হয়েছে 'মিথ্যা দূত' হিসেবে (anrtaduta) রূপে ; এক্ষেত্রে পালাগালা'র
প্রতি গুণমান আরোপিত করা হয়েছে সর্বদা পরেরদিককার শূদ্রদের সাথে সম্পর্কিত থাকার সময়ে।
গোভিকর্তানা, যাকে শতপথ-এর পাশাপাশি অন্যান্য বেশ কয়েকটি তালিকায় একজন রত্নিন হিসেবে
উল্লেখ করা হয়েছে, তাকে সায়ন দ্বারা নির্দিষ্টকৃত করা হয়েছিল নিম্নজাতিভুক্ত
(hinajati) একজন ব্যক্তি হিসেবে। সম্ভবত তিনি শিকার-যোগ্য প্রাণীদের তথা অরণ্যের রক্ষক
ছিলেন এবং হয়ত একজন শূদ্র হয়ে ছিলেন। কেইথ (Keith), ক্সালটার-কে (ksaltr) রত্নিন-দের
একজন হিসেবে ধরেছেন, ভাস্কর (carver) অর্থে, যার মানে সেও একজন শূদ্র ছিল। কিন্ত এই
তর্জমা মনে হয় সন্দেহসূচক ছিল, কারণ মহাকাব্যে ক্সালটার-এর অর্থ গৃহাধ্যক্ষ
(chamberlain), এবং এটি মনে করার কোনো বিশেষ কারণ নেই যে ব্রাহ্মণগুলিতে এই শব্দটি
অন্য কোনো অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। রত্নিন-দের মধ্যে তাকসান-ই ছিল এমন একজন, যাকে শ্রেষ্ঠতর
একজন ভাস্কর হিসেবে পেশ করা যেতে পারে। এইভাবে এটি প্রতীয়মান হয় যে, রাজার মহান রাজ্যাভিষেক
ও বলিদান অনুষ্ঠানে, শূদ্র-বর্ণ থেকে আগত কিছু কারুশিল্পী, কিছু পশুপালক এবং পত্রবাহকেরা,
রাজা দ্বারা যথেষ্ট গুরুত্ব সম্পন্ন হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল।
কিন্ত শূদ্র-রত্নিনদের অবস্থান সম্পর্কে
অধিকতর ব্যাখ্যা প্রয়োজন। প্রথমত, বর্ণের নাম অনুসারে তাদের নির্দিষ্ট করা হয়নি,
যেমনটি ব্রাহ্মণ, রাজন্য ও বৈশ্যদের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে। দ্বিতীয়ত, ক্ষমতা
(power), কাজকর্ম এবং প্রতিনিধিত্বের নিরিখেও, ভারসাম্য প্রচন্ডভাবে ঝুঁকে ছিল শূদ্র-রত্নিনদের
বিরুদ্ধে, সময় অনুসারে রাজনৈতিক ধর্মানুষ্ঠানেও যারা আকৃতিগত ভাবে হ্রস্বীকৃত হয়েছিল।
ব্যক্তিগত তালিকায়ও শূদ্র-রত্নিনদের সংখ্যা দুই থেকে তিন-এর মধ্যে ঘোরাফেরা করতো।
এমন কিছুর অস্তিত্ব নেই, যার দ্বারা নির্দেশিত করা যেতে পারে যে, তাদের উপস্থিতি সমগ্র
শূদ্র বর্ণের প্রতিনিধিত্বকে সুরক্ষিত করেছিল, কিন্ত সম্প্রদায়ের কিছু অংশ অবশ্যই
রাষ্ট্রশাসন ব্যবস্থায় নিজেদের স্থান খুঁজে পেয়েছিল।
মণিরত্ন প্রদান মারফত অর্ঘ নিবেদন করার
শিষ্টাচারবিধি রত্নহবিষ্যি-কে (ratnahavimsi), জয়সওয়াল (Jaisawal) দেখেছিলেন একটি
মহান সাংবিধানিক পরিবর্তন হিসেবে, ঠিক যেমনটি শূদ্রেরা, "অবজ্ঞাত ও পদদলিত শ্রেণীর
মানুষেরা বর্তমানে আরাধিত (worshipped) হচ্ছে সেই ব্যক্তি দ্বারা, যিনি রাজা হতে চলেছেন।"
এটি এই অর্থপ্রকাশ করে যে, আর্য রাষ্ট্রশাসন ব্যবস্থায় পদানত প্রাক-আর্য জনসাধারণকে
ইচ্ছাকৃতভাবে উচ্চ পদমর্যাদা দেওয়া হয়েছিল। কিন্ত এটি পরিষ্কার যে, অন্তত দু'জন কারুশিল্পী,
সেই রথকার এবং তাকসান, তাদের উচ্চ পদমর্যাদা অর্জন করেছিল, আর্য রাজনৈতিক সংগঠন দ্বারা
পদানতদের উন্নীত করার কোনো স্বেচ্ছাপ্রণোদিত নীতির কারণে নয়, বরং আর্য উপজাতি সমাজে
তাদের আদিম সদস্যতার জন্য, যে উপজাতি-সমাজ ইতিমধ্যে বিভক্ত হয়ে গিয়েছে চারটি বর্ণে
; কারণ অথর্ববেদে, সেই রথকার এবং কর্মকারদের (যাদের স্থান ইতিমধ্যেই তাকসান দ্বারা
দখলীকৃত হয়ে গিয়েছে) বিবৃত করা হয়েছিল রাজার চারপাশ ঘিরে থাকা 'ভিস'-দের অংশ হিসেবে।
ধাতু-শিল্প ও রথ প্রস্তুত করার দক্ষ কারিগর হিসেবে তাদের অপরিহার্যতাও প্রাচীন সমাজে
তাদের গুরুত্ব স্থাপিত করতে সাহায্য করেছিল। যাইহোক, এটি অসম্ভাব্য নয় যে পরিণতি স্বরূপ
এই দুই রত্নিন-এর অস্তিত্ব কিছু প্রতিবিম্বিত গুরুত্ব অর্পণ করেছে শূদ্র বর্ণের অন্যান্য
অংশগুলিকে।
সেই পর্যায়ের রাজনৈতিক পরিমন্ডলে শূদ্রদের
অংশগ্রহণ পুনরায় প্রতীয়মান হয়েছে চাকতি-খেলা'র (game of disc) ধর্মানুষ্ঠানে, যেটি
রাজসূয় যজ্ঞের একটি আচার হিসেবে বিহিত হয়েছে (prescribed) এবং সেটি আমাদের কাছে উপস্থাপিত
করা হয়েছে দুটি সংস্করণে। প্রাচীন সংস্করণটি, যেটিতে উল্লেখিত হয়েছে কালো যজুর সাহিত্যে
(Black yajus text), যেখানে ব্রাহ্মণ, রাজন্য, বৈশ্য এবং শূদ্রেরা, চাকতি খেলায় অংশগ্রহণ
করেছিল এমন একটি গাভী জয় করার জন্য, যে গাভী-টি ছিল রাজার নিজের। পরের দিকের সংস্করণটি,
যেটিতে উল্লেখিত হয়েছিল শ্বেত যজুর (White Yaju) সাহিত্যে, সেটিতে বৈশ্য এবং শূদ্রদের,
উক্ত গাভী জয় করার প্রতিযোগিতার প্রার্থী-পদ থেকে অপসারিত করা হয়েছিল, যেটিতে বাজি
ধরেছিল রাজার জ্ঞাতিভাই (sajata) এবং তার হয়ে জয়লাভ করেছিল তদারকিকারী পুরোহিত অধভরায়ু
(adhvaryu)। মনে করা হয় যে, গাভী জয় করার এই প্রতিযোগিতা, প্রাথমিক ভাবে নেতার বুদ্ধিমত্তা
ও বিচক্ষমতা পরীক্ষা করার একটি উপজাতীয় প্রথা ছিল। সেই কারণে এটি উপজাতীয় সংহতি ও
সমসত্ত্বতা সমন্বিত (homogeneity) একটি পুরাতন ঐতিহ্য ছিল, যেটি চাকতি খেলায় সমস্ত
বর্ণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিল। কিন্ত সময় অতিবাহিত হওয়ার সাথে
সাথে এর আচার-আচরণ পরিবর্তিত হয়েছিল, বৈশ
এবং শূদ্রদের, খেলা থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। সে যাইহোক, এটি তাৎপর্যপূর্ণ যে, প্রথমদিকের
পর্যায়ে একজন শূদ্র-ও এই খেলায় প্রতিযোগী হিসেবে অংশগ্রহণ করতে পারতো, এই বিষয়টি
রাজার নানান আনুষ্ঠানিক বিবেচনা সমূহের অন্যতম প্রারম্ভিক একটি রূপ ছিল।
শূদ্রেরা পুনরায় দৃষ্টিগোচর হয়েছিল
রাজসূয় যজ্ঞের বলিদান সম্পর্কিত আরেকটি আচার-আচরণমূলক অনুষ্ঠানে, যে অনুষ্ঠানে বলিদানকারী
প্রথমে স্বর্ণ উৎসর্গ করতো একজন ব্রাহ্মণ-কে এবং তার বিনিময়ে জৌলুষ ক্রয় করতো ; তারপর
ধনুক সহ তিনটি তীর অর্পণ করতো রাজন্য-কে এবং তার দ্বারা ঔজ্জ্বল্য প্রাপ্ত হতো; পরবর্তীতে একটি অঙ্কুশ (কাঁটা সম্পন্ন ছড়ি)
প্রদান করা হতো একজন বৈশ্যকে এবং তার দ্বারা পুষ্টি ক্রয় হতো; এবং সবশেষে মটরশুটি
পূর্ণ একটি পাত্র প্রদান করা হতো একজন শূদ্রকে, যার মাধ্যমে দীর্ঘায়ু ক্রয় করা হতো।
যদিও বর্ণ বিভেদসমূহ প্রতিপালিত হতো এবং শূদ্রেরা (সম্ভবত) কৃষি-মজুরের প্রতিনিধিত্ব
করা সত্ত্বেও তাদের অন্ততপক্ষে রাজার সংসর্গে নিয়ে আসা হতো এবং তারা রাজার দীর্ঘায়ু
কামনা করতে পারতো।
শূদ্রেরা সম্ভবত রাজসূয় বলিদান যজ্ঞের
আরেকটি ধর্মানুষ্ঠানের সাথে সংযুক্ত ছিল, যার মধ্যে নব্য-প্রতিস্থাপিত রাজাকে আহ্বান
করা হতো আকাশের চতুর্কোণে আরোহণ করতে, যেক্ষেত্রে তাঁকে রক্ষা করার দায়িত্বে থাকতো
পূর্ব- কোণে ব্রাহ্মণ, দক্ষিণ কোণে ক্ষত্রিয়, পশ্চিম কোণে 'ভিস,'রা (people) এবং উত্তর-কোণে
ফালা (phala), ভারকাস (varcas) ও পুস্তাম-রা (pustam)। জয়সওয়াল বলেছেন যে, ঘটনাচক্রে
ফালা-রা ছিল শূদ্রদের পরিবর্ত। এই তত্ত্বকে ঘোষাল গ্রহণ করেননি, যিনি ধর্মানুষ্ঠানটিকে
বেদকীয় রাষ্ট্রশাসনব্যবস্থায় তিনটি উচ্চ
জাতির প্রভাবের প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করেছেন। এমন প্রস্তাবও করা হয়েছে যে, ফালাম বলতে
বোঝানো হয়েছে শিল্পীদের শ্রেণীকেসমূহ-কে। আমাদের মতে, ফালাম শব্দটি, যেটি বেদকীয় সাহিত্যে
ব্যবহৃত হয়েছে, তার আক্ষরিক অর্থ হিসেবে 'ফল' (fruit) শব্দটি বোঝায় এবং তার পরের
দিকের অপ্রধান অনুভূতি হিসেবে 'পরিণাম' (result) শব্দটিকে বোঝায় না, যেটি শূদ্রদের
উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাথে সম্পর্কহীন নাও হয়ে থাকতে পারে, কিন্ত একই কথা বলা যায় না
ভারকাস-এর ক্ষেত্রে, যার অর্থ জ্যোতি বা দ্যুতি। যেমন 'পুস্তম' (pustam) অর্থাত পুষ্টি
শব্দটি, সেটি সাধারণত বৈশ্যদের সাথে সম্পর্কিত, কিন্ত একটি রচনাংশে শূদ্রদেরও পুস্তম
বলা হয়েছে। সেইজন্য মোটামুটিভাবে এটি প্রস্তাবিত করা যায় যে পুস্তম এবং ফালম
(falam) শব্দগুলি শূদ্রদের উৎপাদনের ক্রিয়াকলাপকে প্রতিফলিত করে, যারা এইভাবে আহূত
হয়েছে উত্তর কোণে রাজাকে রক্ষা করতে।
'সভা পার্বন' (Sabha Parvan), যেটিকে
মহাভারতের অন্যতম একটি আদি-পর্ব হিসেবে পরিগণিত করা হয়, সেটি আমাদের অবগত করেছে যে,
সম্মানিত শূদ্রদের, যুধিষ্ঠিরের মহান রাজ্যাভিষেক উপলক্ষে আয়োজিত রাজসূয় যজ্ঞের
(rajsuya) বলিদান অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ করা হয়েছিল। পূর্বোল্লেখিত এই পরস্পরবিরোধী বিবৃতি
যে, কোনো অ-বলিদানকারী শূদ্রেরা এই উপলক্ষে উপস্থিত ছিল না, সেটি সম্ভবত শূদ্রদের রাজনৈতিক
ক্ষমতা থেকে অপসারিত করার পরের দিকের একটি প্রচেষ্টাকে প্রতিফলিত করেছে। যে কোনো অবস্থাতেই
এটি মনে হয় পরিষ্কার যে, শূদ্রদের অন্তত একটি বিভাগ, রাজার রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠানে
অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হয়েছিল। যজু সঙ্কলনের উভয় বিদ্যালয়ের একটি রচনাংশ অনুযায়ী,
রাজসূয় বলিদান উপলক্ষে ভিস-দের (people) মধ্যে প্রতিষ্ঠিত আর্য ও শূদ্রদের বিরুদ্ধে
কৃত পাপের (sin) প্রায়শ্চিত্তের জন্য রাজা
সূর্যের কাছে প্রার্থনা করেছিলেন। এক্ষেত্রে পনিণি'র ওপর নির্ভর ক'রে ভাষ্যকার উভাতা
(Uvata) এবং মহীধারা (Mahidhara), আর্য শব্দটির উচ্চারণ করেছিলেন বৈশ্যদের বোঝাতে।
এর থেকে বোঝা যায় যে, এই দুটি নিম্ন বর্গের মানুষদের নিগৃহীত করতে এমনকি রাজাও স্বতন্ত্র
ছিলেন না, - সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি অবস্থা, ঐতরেও ব্রাহ্মণ-এর চেয়ে, যেখানে বৈশ্য'রা
প্রতীয়মান হয়েছে নিগৃহীত হিসেবে এবং শূদ্রেরা প্রহৃত হিসেবে - রাজার চাপে।
অশ্বমেধ বলিদান যজ্ঞ, যেটি তার অনুষ্ঠাতাদের
সার্বভৌম ক্ষমতা অর্পণ করতে অনুমিত ছিল, সেটিতে
শূদ্রেরা প্রতীয়মান হয়েছিল সেইসব অশ্বসমূহের সশস্ত্র রক্ষক হিসেবে, যেগুলিকে বিশ্ববিজয়ের অভিযানে প্রেরণ
করা হয়েছিল।
শূদ্রেরা যে অস্ত্রের ব্যবহার জানতো,
সেই বিষয়টিকেও পুরনো একটি রচনাংশ থেকে অনুমান করা যেতে পারে, যেটি বিবৃত করেছে যে,
রাজার সাহায্যকারী হয়ে তারা হত্যা করেছিল রাজাকে, বৈশ্যদের সাহায্যকারী হয়ে বৈশ্যদের
এবং শূদ্রদের সাহায্যকারী হয়ে শূদ্রদের। মহাভারতের পুরুষানুক্রমিক বিবরণে দম্ভোদ্ভাবা (Dambhodbhaba) নামক একজন রাজাকে উল্লেখিত
করা হয়েছে, যিনি প্রতিদিন ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র শ্রেণীর সশস্ত্র সৈনিকদের এটি
প্রমাণ করার জন্য চ্যালেঞ্জ জানাতেন যে সংগ্রামে তারা তাঁর সমকক্ষ। যুদ্ধে নিযুক্ত
বিভিন্ন নেতা ও জনসাধারণের কথা বারংবার উল্লেখক্রমে মহাকাব্য, সমস্ত বর্ণের লোকেদের
যুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং তার ফলস্বরূপ তাদের দ্বারা অর্জিত ন্যায়পরায়ণতা, নিয়তি ও গৌরব ইত্যাদি বিষয়গুলির
উত্থাপন করেছে। এইভাবে, এইসব তথ্যের পরিবেশন, যে শূদ্রেরাও সৈনিকের ভূমিকা পালন করেছিল,
সেটি পুনরায় পুরাতন উপজাতীয় সমাজের বিধিবদ্ধ প্রভাব সমন্বিত হওয়ার বিষয়টির সাথে
বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, যে সমাজে প্রতিটি সদস্যই অস্ত্র ধারণ করতে পারতো।
(ক্রমশ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন