রবিবার, ১৩ নভেম্বর, ২০২২

মৌসুমী মুখোপাধ্যায়

 

ধর্ষণ অভিযোজন সামাজীকিকরণঃ এক গূঢ বুদ্ধিদীপ্ত কৌশল

 


পৃথিবী ও প্রকৃতি  - এই দুইয়ের তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে একাধিক বিষয়ের মধ্যে একটা আন্তঃসম্পর্ক বিদ্যমান মানে আমি বলতে চাইছি পৃথিবীর কয়েকটা বিষয়, ধরা যাক A, B, C, D এবং প্রকৃতির কয়েকটি বিষয় P, Q, R, S তো A, B, C, Dএর মধ্যে Aএর সঙ্গে D এবং  B এর সঙ্গে Aএর একটা আন্তঃসম্পর্ক থাকে ঠিক সেই রকমভাবেই প্রকৃতির নিজস্ব বিষয়গুলোর মধ্যে একটা আন্তঃসম্পর্ক কমবেশি রয়েছে এছাড়াও পৃথিবীর বিষয়গুলোর সঙ্গে প্রকৃতির বিষয়গুলোর একটা আন্তঃসম্পর্ক কমবেশি আমরা খুঁজলে পেয়ে যাব অর্থাৎ A এর সঙ্গে Q, B এর সঙ্গে S, C এর সঙ্গে P এবং D এর সঙ্গে Rএর একটা আন্তঃসম্পর্ক কিছু না কিছু থাকে ঠিক সেইরকমই ধর্ষণ বিষয়টা পৃথিবী তথা সমাজের একটা বিষয় অন্যদিকে অভিযোজন বিষয়টা আসলে একাডেমিক বিষয়ের অন্তর্গত হলেও আদতে এটা প্রকৃতিরই একটা নিজস্ব অবিরাম ঘটমান একটা ব্যাপার আর আমার এখনকার বক্তব্য বিষয় ধর্ষণ ও অভিযোজনএই দুটো বিষয়ের মধ্যে যে আন্তঃসম্পর্ক বিদ্যমান, সেইটা

শুনতে অবাক লাগলেও ধর্ষণ অভিযোজনের মধ্যে একটা আন্তঃসম্পর্ক বিদ্যমান প্রকৃত প্রস্তাবে ধর্ষণ ঘটে একটা নারী শরীরকে কেন্দ্র করে  এবং যে ধর্ষণ করে সাধারণত সে একজন পুরুষই হয় আবার মানুষের দেহ আসলে প্রাকৃতিক উপাদান অন্যদিকে অভিযোজন এক নিঃশব্দ প্রাকৃতিক পরিবর্তনের প্রক্রিয়া, যা কিনা নিরন্তর ঘটে চলে মানবদেহের ওপর সেই আদিম যুগ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় মানব শরীর অভিযোজনের কারনে অনেক রকমের বাঁক, অনেক রকমের পরিবর্তনের সম্মুখীন হয়ে আজকের মানবদেহে রূপান্তরিত হয়েছে এই পরিবর্তন যেমন নারী শরীরে হয়েছে ঠিক তেমন পুরুষ শরীরেও হয়েছে আদিম নারী ছিল সবলা সে শিকারে যেমন পটু ছিল, তেমনি সন্তান ধারণ ও জন্ম দেওয়ায় রীতিমত সক্ষম ছিল সে আধুনিক নারীদের মত সিজারিয়ান পদ্ধতির সাহায্যে সন্তানের জন্ম দেবার সুযোগ পায়নি সম্পুর্ণ প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে আর দশটা জীবজন্তু যেমন করে প্রসব করে তেমন ভাবেই প্রসব করত এবং প্রসবের পরে অনুমান করতে পারি পরিস্থিতিগত কারণেই আবার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিজের জীবনযুদ্ধে ফিরে যেতে হত আদিম নারী যে সবলা ছিল, পুরুষের মত শিকারে বা অন্য যে কোন কাজে যে পটু ছিল এটা খুব একটা আলোচিত, সর্বজনবিদিত তথ্য নয় কিন্তু প্রজাতির অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে আদিম নারীর নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা হয়েছিল এভাবে দীর্ঘদিন প্রায় কয়েক সহস্র বছর চলার ফলে তার শরীরে শক্তি ও সামর্থের দিক থেকে একধরনের সীমাবদ্ধতা তৈরী হয় এই সীমাবদ্ধতাটা তৈরী হয়েছে অভিযোজনের কারণে অভিযোজনের কারণে মানবদেহে মূলত দু ধরনের পরিবর্তন হয়েছে একটা হল শারীরবৃত্তীয়, অন্যটা হল মনস্ত্বাত্বিক মেয়েরা এই পরিবর্তনে দৈহিকভাবে কম শক্তিশালী এবং মানসিকভাবে অত্যন্ত ধৈর্যশীল, বিচক্ষণ  হয়ে উঠেছে আবার পুরুষরা এই অভিযোজনের কারণেই শারীরিক ভাবে অত্যন্ত শক্তিশালী ও মানসিকভাবে অস্থির, অধৈর্য, এরকম আরও বেশ কিছু গুণসম্পন্ন হয়ে উঠেছে

এখন এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আমাদের দেখা উচিত যে এই পরিবর্তন কি চিরস্থায়ী? বর্তমানে আমাদের সমাজে ধর্ষণকে কেন্দ্র করে যে পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে তাতে করে সকলেই এই বিষয়ে যথেষ্ট উত্তেজিত এবং বিরক্ত এখানে আরও একটা জিনিস উল্লেখের দাবী রাখে আজকাল গণধর্ষণের ঘটনা খুব বেশি ঘটছে একক ধর্ষণের পাশাপাশি

ধরা যাক এই বর্তমান পরিস্থিতিতে ধর্ষণের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য খুব কম বয়স থেকেই মেয়েদের আত্মরক্ষার ট্রেনিংটা আমাদের সমাজে আবশ্যিক করা হলসমাজের সব রকম বয়েসের মেয়েদেরই এই ট্রেনিংএর আওতায় আনা হল। এভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম, শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে এই ট্রেনিং চলতে থাকল। আমি আবারও আমার পাঠকদের বলছি ‘ধরা যাক’। বিষয়টাকে হাইপথেটিকালি নিতে বা কল্পনা করতে। যদি সত্যি এরকমটা ঘটে, তাহলে ভবিষ্যৎ সময়ের একটা পর্যায়ে গিয়ে দেখা যাবে মেয়েরা কোনরকম ট্রেনিং ছাড়াই একধরনের শারীরিক শক্তির অধিকারী হয়েছে এবং নিজেরাই নিজেদের রক্ষা শুধু করতে পারছে তাইই নয়, তারা অন্যদেরও রক্ষা করতে সমর্থ হচ্ছে। এই যে পরিবর্তনটা মেয়েদের শরীরে হল – একেবারে শক্তি না থাকা থেকে শুরু করে একেবারে পূর্ণ মাত্রায় নিজেকে এবং প্রয়োজনে অন্যকেও রক্ষা করবার একটা ক্ষমতা অর্জন করা – এই ঘটনাটা ঘটবে কিন্তু অভিযোজনের কারণে। অর্থাৎ যে অভিযোজনের কারণে একদিন সবলা নারী অবলা হয়ে উঠেছে, সেই অভিযোজনের গতিমুখটাকে আবার উল্টো দিকে ঘুরিয়ে নেওয়া সম্ভব হল মানুষের বুদ্ধিদীপ্ত কৌশলের কারণে।

এবার অন্য একটা হাইপথেটিকাল ঘটনার কথা বলব ধরা যাক এত ধর্ষণের ফলে সবাই বিরক্ত হয়ে গিয়ে সমাজে এমন একটা অনুশাসন চালু করল যাতে করে ছেলেদের বাড়ি থেকে বেরানো, খেলাধুলো সব বন্ধ করে দেওয়া হল সেক্ষেত্রেও প্রজন্মের পর প্রজন্ম, শতাব্দির পর শতাব্দি এইভাবে চলতে চলতে তারপর কোন একদিন দেখা যাবে, ছেলেরা এখন যতটা শক্তি ধরে সেই ততটা শক্তি তারা তখন আর ধরতে পারছে না ঠিক এইভাবে উপরোক্ত অনুশাসনের (যেটা আসলে সামাজিকীকরণের একটা রূপ) মধ্যে যদি তাদের অর্থাৎ ছেলেদের ভাবনাচিন্তার মধ্যে এরকম একটা ধারণা ঢুকিয়ে দেওয়া হয় যাতে তারা আস্তে আস্তে কথা বলবে ও চলাফেরা করবে, চুপ করে বসে থাকবে, কাউকে অযথা আক্রমণ করবে না ইত্যাদি ইত্যাদি, তাহলে কয়েক শতাব্দি বাদে গিয়ে দেখা যাবে ছেলেরা সত্যিই আর এখনকার মত ভাবনা চিন্তা বা আচার আচরণ করবে না এটাও আসলে আগের উদাহরণের মতই একটা অভিযোজনের গতিমুখ ঘুরিয়ে দেওয়া বুদ্বিদীপ্ত কৌশল যেটা আসলে এক ধরনের সামাজিকীকরণ ছাড়া আর কিছুই নয়

তাহলে আশা করি এবার বুঝতে পারছি আমরা ধর্ষণের সঙ্গে অভিযোজনের আন্তঃসম্পর্কগুলো কী রকমের এবং কত রকমের হতে পারে তাহলে আর তো কোন সমস্যা থাকার কথাই নয়। উপরোক্ত পদ্ধতিতে খুব সহজেই আমরা আমাদের সমাজজীবনের নেতিবাচক দিকগুলোকে পরিবর্ত্তন করে অনায়াসেই ইতিবাচক করে ফেলতে পারি। অনুমান করতে পারি পাঠক এই শেষ লাইনটা পড়ে কিঞ্চিত দ্বিধাগ্রস্ত হলেন এই ভেবে যে এটা তো স্রেফ একটা মোটা দাগের ক্যালকুলেশন হয়ে গেল। সমাজে এইভাবে কোন বিষয় প্রয়োগ করা আদৌ সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে আমার বক্তব্য, পাঠক একদম সঠিক কথাই ভেবেছেন। সমাজে এই বিষয়গুলো উপরোক্তভাবে প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে আরও অন্যান্য নানা ফ্যাক্টর কাজ করে যেগুলো এড়িয়ে গিয়ে এরকম কোন একবগগা সিদ্ধান্ত নেওয়া আদৌ সম্ভব নয়। তবে যদি পরিস্থিতি অত্যন্ত জোড়ালো হয়, তখন কখনও কখনও এমন একবগগা সিদ্ধান্ত নিতে হয় বৈকি। আর ইতিহাসে তেমন নজির খুঁজলে খুব একটা কম পাওয়া যাবে না।

অতএব ধর্ষণের বহুচর্চিত সমস্যার আগুনে আমরা জ্বলতে জ্বলতে সামাজিকীকরনের মাধ্যমে অভিযোজনের এই সম্ভাব্য সুশীতল প্রলেপের কথাটা যেন ভুলে না যাই। কেননা এটা হল মরীচিকা ভর্তি প্রান্তরে যেন একটা সত্যিকারের খাঁটি মরূদ্যানের মত।  কে বলতে পারে হয়ত সত্যিই কোন একদিন  এই পথ ধরে আমাদের বর্তমান সমাজ কোন একটা দিশা পেয়ে যাবে। বস্তুত ১৯৭৯ সালে মানবসভ্যতায় সর্বপ্রথম রাষ্ট্রসংঘ পরিচালিত সিডও কনভেনশনে যে সমস্ত প্রস্তাবগুলো উল্লেখ করা হয়েছে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের সমাধান পরিকল্পনায়, সেটা যদি সত্যি সত্যিই পৃথিবীর সব দেশে, সব রাষ্ট্রে বাধ্যতামুলক করা যায় অর্থাৎ অনুশাসন করে মেনে নেওয়ানোর কোন প্রক্রিয়া শুরু করা যায়, তবে তার ভবিষ্যতটাও অকল্পনীয় রকমের ভালো কিছুই যে হয়ে উঠবে শেষ পর্যন্ত অদূর ভবিষ্যতে, এ ব্যাপারে আমার কোন সংশয় নেই।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন