রবিবার, ১৩ নভেম্বর, ২০২২

জেন গল্প

 

পনেরোটি জেন গল্প

 

(অনুবাদ : অদিতি ফাল্গুনী)

 

জেন গল্প কি ও কেন?

(চৈনিক ভাষায় ‘পিনইন’ শব্দটি থেকে ‘চান’ শব্দটি সৃষ্ট হয়ে সেই শব্দই পরে জাপানে ‘জেন’, কোরিয়ায় ‘সিওন’ এবং ভিয়েতনামে ‘থিয়েন’ নামে পরিচিত  হয়েছে। জেন মূলত: মহাযান বৌদ্ধ ধর্মের একটি স্কুল যা চীণে তাং রাজবংশের শাসনামলে উদ্ভুত হয়েছিল। জেন কঠোর ধ্যানানুশীলন এবং মনের গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে গভীর আত্ম-সংযমের ফলাফল। হাজার বছর ধরে চিন-জাপান-কোরিয়ায় মানব জীবনের অস্তিত্ব বিষয়ক নানা সঙ্কট ও আত্ম-জিজ্ঞাসার কঠিন সব প্রশ্ন ‘জেন’ বা বৌদ্ধ গুরুরা ছোট ছোট সব নীতিগল্পের মাধ্যমে প্রকাশ করে  এসেছেন। জাপানী কবিতা হাইকু যেমন মাত্র তিন পংক্তির পরিমিতিতে উজ্জ্বল ও গভীর, জেন গল্পও তেমনি মিতায়তন, অনাড়ম্বর অথচ গভীর জীবনবোধে উদ্ভাসিত। এখানে ‘কালিমাটি‘-র পাঠকদের জন্য পনেরোটি জেন গল্পের অনুবাদ করা হলো।)

 

আচ্ছন্ন

 


দু’জন পরিব্রাজক ভিক্ষু একবার চলার পথে এক নদীর কাছে পৌঁছলেন যেখানে তাঁদের সাথে এক তরুণীর দেখা হলো। নদীর ঢেউ সেই মূহূর্তে ছিল উত্তাল ও  বিপদ-সঙ্কুল আর ভীত মেয়েটি তাই অনুরোধ করলো যে যদি তাঁরা (দুই ভিক্ষু) মেয়েটিকে দয়া করে বহন করে অন্য তীরে পৌঁছে দেয়! ভিক্ষুদের একজন দ্বিধা করলেও অন্যজন সাথে সাথে মেয়েটিকে কাঁধে তুলে সেই উত্তাল নদী পার হয়ে অন্য তীরে পৌঁছে দিলেন। মেয়েটি তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিল।

এরপর দুই ভিক্ষু আবার পথ চলছেন। তবে একজন কিছু একটা চিন্তায় গভীর ব্যস্ত ছিলেন। শেষমেশ নৈ:শব্দ্য আর রক্ষা করতে না পেরে তিনি বলেই ফেললেন, ‘ভ্রাত:, আমাদের আধ্যাত্মিক গুরুরা সবসময়ই আমাদের নারীসঙ্গ বিরহিত থাকতে পরামর্শ দিয়েছেন, কিন্ত আপনি দেখি ঐ মেয়েটিকে কাঁধে তুলে রীতিমতো বহন করলেন!‘

‘ভ্রাত:,’ দ্বিতীয় ভিক্ষু উত্তর করলেন, ‘আমি তাঁকে নদীর অন্য তীরে পৌঁছে দিয়ে  ছেড়ে দিয়েছি, কিন্ত আপনি তো তাঁকে এখনো বহন করে চলেছেন!’

 

সমৃদ্ধি



একবার এক ধনাঢ্য ব্যক্তি এক জেনগুরুকে বললেন একটি কাগজে তাঁকে এমন কিছু লিখে দিতে যাতে বছরের পর বছর ধরে তাঁর পরিবারে সমৃদ্ধি আরো বৃদ্ধি পায়। এমন কিছু একটা লিখে দেয়া হোক যেটা পরিবারটি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে লালন করতে পারে।

একটি বড় কাগজের টুকরোয় তখন জেনগুরু লিখলেন, ‘পিতার মৃত্যু, পুত্রের মৃত্যু, পৌত্রের মৃত্যু’।

ধনাঢ্য ব্যক্তি এই লেখা দেখে তো রেগে কাঁই। ‘আমি আপনাকে বললাম কাগজে  এমন কিছু একটা লিখে দিতে যাতে করে আমার পরিবারে সুখ ও সমৃদ্ধি আসে। তাহলে আপনি কেন এমন মন খারাপ করা কথা আমাকে লিখে দিলেন?’

জেনগুরু উত্তর করেন, ‘যদি আপনার ছেলে আপনার আগে মারা যায়, তবে সেটা আপনার পরিবারের জন্য অসহনীয় শোক বয়ে অনবে। আপনার পৌত্র যদি আপনার পুত্রের আগে মারা যায়, সেটাও গভীর শোক বয়ে আনবে। কিন্ত আমি যে ধারাক্রম লিখে দিয়েছি, সেই ধারাক্রমে যদি আপনার পরিবারের মানুষ প্রস্থান করে, তবে সেটাই হবে জীবনের স্বাভাবিক গতি। এটাই প্রকৃত সুখ ও সমৃদ্ধি’।

 

কেটে যাবে

 


এক শিক্ষার্থী তার ধ্যান শিক্ষার গুরুর কাছে গিয়ে বললো, ‘আমার ধ্যানের অবস্থা ভয়ানক! কিছুতেই মন বসাতে পারি না অথবা আমার পা ব্যথা করে, আর সবসময়ই ঘুম পায়। কী যে ভয়ানক অবস্থা!’

‘এই অবস্থা কেটে যাবে’। শিক্ষক বললেন খুব নিশ্চিন্ত ভাবে।

এক সপ্তাহ পরে সেই ছাত্র আবার এলো তার শিক্ষকের কাছে, ‘আমার ধ্যান খুবই ভাল হচ্ছে, গুরুদেব! আমি এত জাগ্রত, শান্ত আর সজীব বোধ করছি যে বলার নয়! এ এক অনির্বচনীয় অভিজ্ঞতা!‘

‘এই অবস্থাও কেটে যাবে’। শিক্ষক বললেন খুব নিশ্চিন্ত ভাবে।

 

স্বপ্ন


 

বিখ্যাত তাও গুরু চুয়াং ঝু একবার স্বপ্নে দেখলেন যে তিনি একটি প্রজাপতি হয়ে এখানে সেখানে উড়ে বেড়াচ্ছেন। স্বপ্নে নিজেকে তাঁর একবারও মানুষ বলে স্মরণ হয়নি। স্বপ্নে তিনি ছিলেন শুধুই একটি প্রজাপতি। সহসা ঘুম ভেঙ্গে দেখলেন যে তিনি তখনো শুয়ে আছেন এবং তিনি একজন মানুষ। তবে তখন তিনি নিজেই নিজেকে নিয়ে ভাবলেন, ‘আমি কি আগে এক মানুষ ছিলাম যে স্বপ্নে নিজেকে প্রজাপতি হিসেবে দেখতে পেয়েছে অথবা এখন আমি এক প্রজাপতি যে নিজেকে স্বপ্নে মানুষ হিসেবে দেখছে?’

 

এখনো জীবিত

 


রাজ্যের রাজা জেন শিক্ষক গুডোকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মৃত্যুর পর একজন বোধিপ্রাপ্ত মানুষের ক্ষেত্রে কী ঘটে থাকে?’

‘আমি কীভাবে সেটা জানব?‘ গুডো উত্তর করলেন।

‘কারণ আপনি একজন জেনগুরু!’ রাজা উত্তর করলেন।

‘হ্যাঁ, মহারাজা’, গুডো উত্তর করলেন, ‘কিন্ত আমি এখনো মৃত নই, এখনো  বেঁচে আছি’।

 



চঞ্চল মন

 


বাতাসে পতপত করে ওড়া এক পতাকা নিয়ে দুই লোক তর্ক করছিল। ‘আসলে বাতাস খুব উত্তাল তাই পতাকা নড়ছে’ বললো প্রথম ব্যক্তি।

‘না, পতাকাটি



নিজেই নড়ছে’, বললো দ্বিতীয় ব্যক্তি।

এক জেনগুরু পাশ দিয়ে হেঁটে কোথাও যাচ্ছিলেন। এই তর্ক তাঁর কানে এলো  এবং তখন তিনি তাঁদের থামালেন, ‘পতাকা না, বাতাসও না’, তিনি বললেন, ‘এটা মন, যা নড়ছে’।

 

বর্তমান মুহূর্ত

 


এক জাপানী যোদ্ধা একবার শত্রু সৈন্যদের হাতে আটক হলেন এবং কারাগারে নিক্ষিপ্ত হলেন। সেই রাতে তাঁর আর ঘুম আসছিল না, যেহেতু তাঁর ভয় লাগছিল যে পরের দিন তাঁকে অবশ্যই নানা জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে, অত্যাচার করা হবে এবং এমনকি তাঁকে মৃত্যুদন্ডও দেয়া হতে পারে। এভাবে এপাশ ওপাশ করতে করতে তাঁর মনে পড়ে গেলো জেন শিক্ষকের কথা, ‘আগামীদিন বলে কিছু নেই। এটা একটি মায়া। একমাত্র বাস্তবতা হলো বর্তমান সময়’।

এই কথাগুলো মনে পড়ায় যোদ্ধার মন শান্ত হয়ে এলো এবং তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন।

 

অহমবোধ

 


তাং রাজবংশের প্রধানমন্ত্রী রাজনীতিক ও সামরিক নেতা - উভয় হিসেবেই বিপুল সাফল্য অর্জনের জন্য জাতীয় বীর হিসেবে তাঁর দেশে মান্য হতেন। তবে এত খ্যাতি, ক্ষমতা ও সম্পদের পরও নিজেকে তিনি এক বিনয়ী ও একনিষ্ঠ বৌদ্ধ হিসেবেই বিবেচনা করতেন। প্রায়ই তিনি তাঁর প্রিয় জেনগুরুর কাছে শাস্ত্র পাঠ করতে যেতেন এবং দু‘জনের সম্পর্ক বেশ ভালই ছিল। এমনকি তিনি যে প্রধানমন্ত্রী, এই বিষয়টি কখনোই তাঁদের পারস্পরিক সম্পর্কে কোন ছায়াপাত  করেনি। এক অতি সম্মানিত শিক্ষক ও শ্রদ্ধাবোধ পরিপূর্ণ ছাত্র বলেই দু‘জনকে  মনে হতো।

একদিন যথারীতি শাস্ত্র পড়তে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী হুট করে তাঁর জেনগুরুকে প্রশ্ন করে বসলেন, ‘মহামান্য গুরু, বৌদ্ধ মতে অহমবোধ কী জিনিষ?’ সাথে সাথে  জেনগুরুর মুখ রক্তিম হয়ে উঠলো এবং তিনি খুবই বিদ্রুপাত্মক ও অপমানসূচক কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এ কোন্ ধরনের নির্বোধ প্রশ্ন?’

এই অপ্রত্যাশিত উত্তরে প্রধানমন্ত্রী এত আহত হলেন যে মুহূর্তেই তাঁর মুখ  কালো ও ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলো। জেনগুরু তখন হাসলেন এবং বললেন, ‘মহামান্য, এটাই হলো অহমবোধ!’

 

অপর প্রান্ত / ওপার

 


একদিন এক বৌদ্ধ তরুণ তার বাসা থেকে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে বের হয়ে অনেকটা পথ হেঁটে এসে এক প্রশস্ত, পাহাড়ি নদীর পাড়ে এসে থেমে গেল। সামনের তীব্র গতিসম্পন্ন পাহাড়ি নদী দেখে সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে ভাবতে থাকল যে, কীভাবে এত বড় বাধা পার হবে?

যখন সে হাল ছেড়ে দেবে বলে ভাবছে, তখন দেখতে পেল নদীর অপর প্রান্তে বা অন্য তীরে এক প্রাজ্ঞ বৌদ্ধ ভিক্ষু দাঁড়ানো। তরুণ বৌদ্ধ জ্ঞানী ভিক্ষুকে চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হে মহা প্রাজ্ঞ, আপনি কি বলতে পারেন যে কীভাবে নদীর ওপারে যেতে পারি?’

প্রবীণ ভিক্ষু নদীর দিকে একটি ক্ষণ মাত্র তাকিয়ে পাল্টা চেঁচিয়ে উত্তর করলেন, ‘তুমি তো ওপারেই আছো!’

 

মৃত্যুর সময়

জেন ভিক্ষু ইক্কিয়িয়ু শৈশবেও ছিলেন খুব বুদ্ধিমান। একবার যে প্রবীণ ভিক্ষুর কাছে তিনি শিক্ষাগ্রহণ করছিলেন, সেই ভিক্ষু তাঁকে খুব দামি একটি চায়ের কাপ দিলেন - একটি বিরল পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন। কিন্ত একদিন প্রবীণ ভিক্ষু বাইরে যাবার পর ইক্কিয়িয়ু পেয়ালাটি ভেঙ্গে ফেলে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে।  গুরুর পদশব্দ শুনে সে ভাঙ্গা কাপের টুকরোগুলো নিজের পেছনে লুকাতে চাইলো। গুরু আসতেই ইক্কিয়িয়ু তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মানুষকে কেন মরতেই হয়?’

গুরু বললেন, ‘এটাই প্রকৃতির নিয়ম। পৃথিবীতে সবাইকেই মরতে হয় তবু মৃত্যুর আগে কত লম্বা সময় আমাদের বেঁচে থাকতে হয়!’

ইক্কিয়িয়ু তখন ভাঙ্গা কাপের টুকরোগুলো জড়ো করে শিক্ষকের কাছে দিয়ে বললো, ‘গুরুদেব - আপনার চায়ের পেয়ালার মৃত্যুর সময় হয়েছিল।’

 

চাঁদকে যায় না চুরি করা

 


পাহাড়ের ঢালে রিওকান নামে এক জেন ভিক্ষু ছোট্ট একটি কুঁড়ে ঘরে সহজতম জীবনযাপন করতেন। এক সন্ধ্যায় এক চোর এলো তার ঘরে চুরির আশায়। এসে দেখে ঘরে সত্যি বলতে চুরি করার কিছুই নেই। এরই ভেতর রিওকান  বাসায় ফিরে চোরকে দেখে পাকড়াও করে বললেন, ‘এত দূর থেকে এসেছো, বাপু! এত কষ্ট করে যখন এসেইছো, তখন আমার ঘরে যেহেতু কিছু নেই, আমার গায়ের কাপড়টিই নিয়ে যাও।’

চোরকে হতভম্ব করে ভিক্ষু রিওকান বাস্তবিকই তাঁর গায়ের পীত বস্ত্রখানা খুলে চোরের হাতে দিলেন। চোর বেচারা কোনক্রমে কাপড়টি নিয়ে পড়িমরি চোঁ চোঁ দৌড়। !

নগ্ন দেহেই রিওকান বসে রইলেন। চাঁদের দিকে তাকিয়ে ভাবলেন, ‘বেচারা চোর - ইচ্ছে হচ্ছে ওকে এই সুন্দর চাঁদখানা যদি দিতে পারতাম!’

 

 দৃষ্টিভঙ্গি

জেন ভিক্ষু চুয়াং ঝু এবং তাঁর এক বন্ধু একবার এক নদীর তীর ঘেঁষে যাবার সময় এক মুহূর্তের জন্য দাঁড়িয়ে পড়ে দেখলেন নদীর জল কেমন স্বচ্ছ।

চুয়াং ঝু বললেন, ‘ঐ মাছগুলোকে দ্যাখো। তারা কীভাবেই না নিজেরা নিজেদের সময়কে উপভোগ করছে।’

‘তুমি কী করে জানো? তুমি তো আর মাছ নও যে নিশ্চিত করে জানবে যে  মাছেরা ভাল সময় কাটাচ্ছে কিনা?’ বন্ধুটি জবাব দিল।

‘তুমিও তো আমি নও,’ চুয়াং ঝু উত্তর করলেন, ‘কাজেই তুমি বা কী করে জানো যে মাছেরা ভাল সময় কাটাচ্ছে না?’

 

(নীতিকথা: অপরের দৃষ্টিভঙ্গি তোমার দৃষ্টিভঙ্গির মতই মূল্যবান। কাজেই দ্রুতই  কোন সিদ্ধান্তে যেও না।)

 

একসাথে একাধিক কাজ


 

মার্শাল আর্টের এক ছাত্র তাঁর শিক্ষককে একদিন জিজ্ঞাসা করলো, ‘আমি মার্শাল আর্টে আমার দক্ষতা বাড়াতে চাই। তবে আপনার কাছে শেখার পাশাপাশি আর একজন শিক্ষকের কাছে আরো একটি কৌশল রপ্ত করতে চাই। আপনার কি মনে হয় এটা একটি ভাল ভাবনা নয়?’

শিক্ষক বললেন, ‘যে শিকারী একসাথে দু’টো খরগোশ তাড়া করে, সে কোনটিই পায় না।’

 

অপমানের উপহার

 


বহু বহু দিন আগে জাপানে বাস করতেন এক নামী যোদ্ধা। যদিও অনেক বয়স হয়েছে, তবু যে কোন তরুণ যোদ্ধাও তখনো পর্যন্ত তাঁকে চ্যালেঞ্জ জানাতে ভয় পেত। যোদ্ধা হিসেবে তাঁর সুনাম গোটা দেশে এবং দেশ ছাড়িয়েও এতদূর ছড়িয়ে পড়েছিলো যে অসংখ্য ছাত্র তাঁর কাছে যুদ্ধবিদ্যা শিখতে সমবেত হতে থাকে।

একদিন এক কুখ্যাত তরুণ যোদ্ধা বৃদ্ধ যোদ্ধার গ্রামে উপস্থিত হলো। এই প্রবাদপ্রতিম বৃদ্ধ যোদ্ধাকে হারানোর বাসনা একমাত্র এই কুখ্যাত তরুণের ভেতরেই দেখা দিয়েছিল। দৈহিক শক্তিমত্তার পাশাপাশি কুখ্যাত এই তরুণের ছিল প্রতিদ্বন্দীর যে কোন দূর্বলতা চোখের পলকে বুঝে নেবার একরকম ভুতুড়ে ক্ষমতা। সবসময়ই যুদ্ধে তার নিয়মটি ছিল প্রতিদ্বন্দীকে প্রথম অস্ত্র তোলার আহ্বান জানানো। এবং প্রতিদ্বন্দী যখন অস্ত্র তুলতো, তখনি সে বুঝে ফেলত প্রতিদ্বন্দীর দুর্বলতাটি কোন্ জায়গায় এবং অকরুণ শক্তি ও আলোর গতিতে সে সাথে সাথে আঘাত করতো প্রতিদ্বন্দীর সেই দূর্বল স্থানেই। তার সাথে যে যোদ্ধাই  প্রথম অস্ত্র তুলেছে, সেই আর জিততে পারেনি। বেমালুম হেরে গেছে।

তা’ বুড়ো যোদ্ধা তার শিষ্যদের শত অনুরোধ উপেক্ষা করেও তরুণ যোদ্ধার সাথে দ্বন্দ্ব যুদ্ধের আহ্বান হাসি মুখে মেনে নিল। যখন দু’জনেই যুদ্ধ করার প্রস্ততি  নিচ্ছে, তখনি তরুণ যোদ্ধা বুড়ো যোদ্ধাকে অপমান করা শুরু করলো।

বৃদ্ধ যোদ্ধার মুখে রাস্তার ময়লা আবর্জনা আর থু তু নিক্ষেপ করা শুরু করলো সে। কয়েক ঘণ্টা ধরে মনুষ্যসমাজে প্রচলিত যত অপমানকর গালি ও অপমান রয়েছে, সবই সে বলে চললো। কিন্ত বুড়ো যোদ্ধা সেখানে নিষ্পন্দ, শান্ত ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে রইলেন। অবশেষে তরুণ যোদ্ধা ক্লান্ত ও অবসন্ন হয়ে পড়লো। নিজেকে পরাজিত ভেবে তীব্র লজ্জায় সে স্থান ত্যাগ করলো।

 

তাই বুঝি?

জাপানের এক গ্রামে অবিবাহিতা আর সুন্দরী একটি মেয়ে একদিন গর্ভবতী হয়ে পড়লো। মেয়েটির বাবা-মা ত’ রেগে টং, ‘বল্, এর বাবা কে?’ মেয়েটি শুরুতে কিছুতেই বলবে না যে অনাগত শিশুর বাবা কে? অনেক বকাবকির পর উদ্বিগ্ন ও বিড়ম্বিত মেয়েটি বললো গ্রামের পরম শ্রদ্ধেয় ও বিশুদ্ধ জীবনের অধিকারী হিসেবে পরিচিত জেন ভিক্ষু হাকুইন-ই তার সন্তানের পিতা। উত্তেজিত বাবা-মা গিয়ে হাকুইনের সাথে ঝগড়া শুরু করলে, হাকুইন শুধু উত্তর করলেন, ‘তাই বুঝি?’

শিশুটির জন্মের পর তরুণীর মা-বাবা এসে হাকুইনকে শিশুটি দিলো এবং বললো বাচ্চাটি যেহেতু হাকুইনের, তাকেই এই শিশুটিকে দেখতে হবে। গোটা গ্রামে হাকুইনকে তখন অস্পৃশ্য হিসেবে দেখা হচ্ছে। ‘তাই বুঝি?’ হাকুইন শান্ত ভাবে বললেন এবং শিশুটিকে গ্রহণ করলেন।

অনেকগুলো মাস চলে গেল। হাকুইন শিশুটির পরম যত্ন নিতে থাকেন। একদিন  তরুণী মেয়েটি নিজেরই বলা মিথ্যের ভার আর সইতে পারল না। বাবা-মা’র কাছে সে স্বীকার করলো যে শিশুটির পিতা আসলে গ্রামেরই আর এক যুবক যাকে সে বাঁচাতে চেয়েছিল। বাবা-মা ত’ ভীত আর লজ্জিত হয়ে পড়ি-মরি ছুটে গেলেন ভিক্ষুর কাছে আর বললেন শিশুটিকে ফেরত দিতে হবে। বারবার ক্ষমা চাইতে চাইতে তারা সব কিছু ব্যখ্যা করলেন। শিশুটিকে ফেরত দিতে দিতে হাকুইন বললেন, ‘তাই বুঝি?’

 

 

 



1 টি মন্তব্য: