শুক্রবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২২

সমরেন্দ্র বিশ্বাস

কবিতার কালিমাটি ১২২



সত্তর দশক

পিস্তলের খসে যাওয়া গুলির গোপন শব্দে কলকাতার সকাল হয়ে যায় সরোজ দত্ত। থানার লকআপে বেবী রায়ের দুপুর জুড়ে থার্ড ডিগ্রী, চাপা আর্তনাদ চপারের মতো। চীৎকার সময়ের হুইসেলে, আতঙ্ক মনের চিলেকোঠায় – কারণ তখন সত্তর দশক!

লাল বাবুলাল লেখা পাঁচিলের উপর মরা রোদ, গ্রামের হাওয়ায় টাঙ্গির ফিসফাস, সরকারী দপ্তরের পিচ্ছিল হুমকি আর নিরোধহীন বুলেট। শীষের সবুজ হাতছানি, বাবুই পাখিদের দিগন্ত জোড়া দরজি স্বপ্ন। কিছু যুবক হৃৎপিন্ড উপড়ে বানিয়েছিলো আঁকার সরঞ্জাম, নিজেদের রক্তে আঁকতে চেয়েছিলো ক্যানভাস। স্বদেশকে পালটে দেয়ার দামাল ছবি – কারণ তখন সত্তর দশক!

কেন ঘুমের মধ্যে পাগলা ঘন্টা, কেন সত্তর দশক জুড়ে তীরবিদ্ধ প্রশ্নের শায়িত শরশয্যা, কী তার উত্তর – পুরোটা আজও জানি না! কবিতাকে ফেস্টুন বা  শ্লোগান করে বিপ্লব? যারা বলেছিল তারা কি চিরস্মরণীয় - জানি না! গ্রাম দিয়ে সত্যি সত্যি যাকে ঘিরে ফেলা যায়, সেই শহরের রঙটা কেমন – জানি না!  লোহার যে শেকল ছাড়া শ্রমিকদের হারাবার আর কিছুই নেই, কী তার ধাতব  প্রণালী - জানি না! হৃৎপিন্ডকে ঝান্ডায় ঝুলিয়ে পথ হেঁটেছিলো যে দিনগুলো, তার পদক্ষেপ কতটা সময়সাপেক্ষ - জানি না! দুনিয়ার মেহনতি মানুষেরা এক হবে,  তাদের মানসিকতার জৈবিক বয়নটা কি জানাও জরুরী? – জানি না!

সেলাম কাড়া নিভন্ত সত্তরের দশকটা আমার সামনে ঝুলিয়ে রাখে কিছু আলো, কিছু অন্ধকার। ঝুলিয়ে রাখে ‘জানি’ আর ‘জানি না’র বিচিত্র ক্যালেন্ডার। ঠিক তখনই এক বন্ধু দূরান্ত থেকে খবর পাঠায় – ‘এখনও মন্থন আর ইস্তেহার চলুক’। সময় এখন  মধ্যবর্তী, আরো একটা নতুন দশক শুরু হওয়ার আগে আশা নিরাশার লন্ঠন জ্বলে। শহরের স্টেশনে, গ্রামের বারান্দায়, অবেলার আলো আঁধারিতে, আমাদের আজও এই ছিন্ন বিচ্ছিন্ন অপেক্ষা!

 

সময় সফরের জানালায়

পৃথিবীর প্রাচীন পুঁথির উপর ঢলে পড়ছে জোৎস্নার জন্ডিস। রক্ত বমিতে ভেসে যাওয়া হলুদ ক্ষেত, বিষ ছিটানো মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে তক্ষক। ঝড়ো হাওয়ায় লোকাল ট্রেনের পেন্টোগ্রাফের হাত ভাঙা। মস্তিষ্কের ওভারহেড তার ছেঁড়া, পায়ের চাক্কা স্থির। স্থানু রেললাইনের ওপর দৃষ্টিকটু মল ও উদ্বায়ী পেচ্ছাপ। ট্রেনের কামরায় আধা ঘুমন্ত প্রৌঢ়ের ব্যক্তিগত থলির ভেতর নেতিয়ে পড়ে ব্যর্থ রমণীসঙ্গম। ভীড়ের ভেতর যুবতীর মাই-ছোঁয়া ইলেক্ট্রিক শক  আচমকাই ফিরে যায় হলদেটে বাল্বের দিকে। সফরের জানালায় দিগন্তব্যাপী জমির শস্যহীন আকুলতা। শুকনো ন্যাড়া গাছে ঝুলে থাকে ফাঁসির রজ্জু। খরা চৌচির জমির ফাটলে ফাটলে আটকে আছে মৃত দিনমজুরের বেওয়ারিশ আত্মা। বাতিল যুবশক্তির আবদ্ধ খোঁয়াড়ে উড়ে এসে পড়ে এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জের ডানা ভাঙা লেফাফা। কড়কড়ে ছাপা নোটের শরীরে লেগে থাকে বেশ্যার নিরাময়হীন হাসি, দিশাহীন বীর্য স্ক্ষলনের নোংরা ছাপ। বুলেট ট্রেনের মতো গতিময় দেশ, তার দখল হয়ে যাওয়া ভূমিতে বসে যায় কর্ণের রথের চাকা। চলমান সফরের গোপন যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাচীন পুঁথির সন্ত্রাস। আবহমান শকটের জানালায় ক্লান্ত রোদ, শস্যের বিষাদময় মৃত্যু, অনাবশ্যক সংবাদের পুনরাবৃত্তি আর ঝুরো কার্বণের গন্ধ। টার্মিনাল স্টেশনের সময়কে উলটে দিয়ে আকাশের সভাগারে উড়াল দেয় ধূর্ত বণিক আর পঙ্গু বুদ্ধিজীবির দল। কোথায় যাবার ছিলো, কোথায় এলাম?

 

উন্মুক্ত এক পাঠশালা

সাবালক বয়স তাকে পৌঁছে দেয় পাঠশালা নামক একটা রেলস্টেশনে। সেখানে তার জন্যে অপেক্ষা করছে প্রাচীন পুঁথি, আধুনিক ভূগোল। ট্রেন আসে। সফর চলতে থাকে পরের স্টেশনের দিকে। একটার পর আরেকটা স্টেশন। স্কুলের পর স্কুল। স্কুলের ইউনিফর্ম বদলে বদলে যায়। রাশি রাশি বই। একের পর এক রেল স্টেশনে, তর্কের পর তর্ক, একের পর এক মীমাংসা।

অবিরাম এই যাত্রাপথে সে দেখে, কিছু পুঁথি জেগে উঠে এসেছে রহমানের চাষের ক্ষেতে, কিছু কিতাব লেখা হচ্ছে কারখানার জমায়েতে। লোকাল ট্রেনের ভীড়, ঝুপড়িবস্তির অস্তিত্ব, দালালের খবরদারী, সহযাত্রীর স্নেহপ্রবণতা - এসব কিছুই হয়ে যায় তার প্রকৃত শিক্ষক। ক্রূদ্ধ হয়ে টিকিট চেক করতে আসে তার দৈনন্দিন জীবন। তবুও থোকা থোকা স্নেহ ঝুলে থাকে গাছে গাছে। পলাশের ফুল থেকে সে আহরণ করে মেধা। দুপুরের রেললাইন কখনো কখনো তাকে ফিরিয়ে দেয় ক্রোধ ও উত্তাপ। ট্রেন চলতে থাকে পরের স্টেশনের দিকে। চলমান জীবনের ক্লান্তি।

শিয়ালদা স্টেশনের প্লাটফর্মের বাইরে ফুটপাথে সে ঘুমিয়ে পড়ে। স্বপ্নের মধ্যে তার পিতা উঠে আসে, দুহাত তুলে আশীর্বাদ জানায় সন্তানকে। মাঝরাত্রে ঘুম ভেঙ্গে যায়। দেখে, সে শুয়ে আছে উন্মুক্ত এক পাঠশালার সামনেই, কোমল ঘাসের জমিতে, তাকে ঘিরে রয়েছে জনসমুদ্র, মাথার উপরে আকাশে ঝুলে আছে একের পর এক তর্ক, একের পর এক মীমাংসা। চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিতাব, বই পুস্তক - অগুন্তি, অসীম। অনেক শিক্ষক, অনেক পরীক্ষক। রাস্তার গাছপালা, কুকুর বিড়াল, পোষ্টারে জেগে থাকা নায়িকার স্তন এ সমস্ত কিছুই পুস্তক হয়ে তার কাছে আসে! সে জানে, দুনিয়াদারির এই পাঠশালায় লেখাপড়া শেখার জন্যে সে কোনদিনও কোন সার্টিফিকেট পাবে না।

  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন