ফ্ল্যাশব্যাকে থিয়েটার
পাঁচালি : রঙ্গনা
প্রতি,
বঙ্গের পুজোর থিয়েটার হল আরেকরকম আকর্ষণ। শহর জুড়ে কাশের গোছায় ঢাকির দল
ইতিউতি বাদ্যি বাজাচ্ছেন। নীল আকাশে সাদা মেঘ। বোঝাই যাচ্ছে শরৎ আগত। এবং শারদীয়ার
ধুম লেগেছে। আবার নতুন জামাকাপড়ের সঙ্গে অনেক নতুন মানুষের শহরে পুজো দেখতে আসা।
শুধু পুজো নয়, মেলা, কেনাকাটা এবং শহরের থিয়েটার দেখতে পাওয়া। যখন যা থিয়েটার চলছে
তাই। শারদীয়া কেন্দ্রিক উৎসবের বিশেষ প্রস্তুতি শুধুমাত্র পোশাক, সাজগোজ বিপণনে
চলে না। চলে থিয়েটারের চলমান দলেও। থিয়েটার পাড়ার গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়গুলো সময়ের
সঙ্গে সঙ্গে কী প্রযোজনা হবে তারই তোড়জোড় শুরু করে দেয়। নতুন নাটক নামে। আবার তৈরি হয়ে যায় নতুন থিয়েটার। যেখানে বাংলা
সংস্কৃতির বিশেষত্বে থিয়েটার পাড়া। একদিকে ঢিল ছোঁয়া দূরে কত হল মানে থিয়েটার বা
মঞ্চ। তারই মধ্যে নতুন একটা মঞ্চ তৈরির পরিকল্পনা যেন জোয়ার আনে ফ্ল্যাশব্যাকের
থিয়েটার পাড়ায়। কলকাতা জুড়ে তখনো সিনেমা এবং থিয়েটারের দুনিয়ায় অ্যাডভান্স
বুকিংয়ের রমরমা। হলে ব্ল্যাকে টিকিট কেটে পুজোর আনন্দ দ্বিগুণ। উত্তর কলকাতার এমনই
দর্শক দুনিয়ায় থিয়েটারের বাজারও কিছু পিছিয়ে ছিল না। শহরের বাইরের দর্শকে ভরে উঠত কলকাতার
হাতিবাগান পাড়া। লম্বা রাস্তা পেরিয়ে প্যান্ডেলে ঘুরে বেরান যেমন। পাশাপাশি তেমন
চলত নাটক দেখা। এবং শারদ উৎসবের জন্যে থিয়েটারের শো বাড়িয়েও দেওয়া হত। আর এই কাণ্ড
শুধুমাত্র পেশাদারি মঞ্চে নয়, চলত গ্রুপ থিয়েটারেও। দর্শক-ইথারে গুঞ্জিত হত
প্রেক্ষাগৃহের আসন। মুখর সেই আসরে অভিনয় মানে মাচান শোয়ের মতন নাচাগানা কেবলই নয়।
সেই থিয়েটার নাটক ছিল দর্শকের জন্যে বিশেষভাবে ভেবে করা। হ্যাঁ, একুশ শতকের দিক থেকে ভাবলে বিষম লাগে ঠিকই। এও কি
সম্ভব! হ্যাঁ, বিশ শতকের কলকাতায় পুজো মানে থিয়েটারের মেলা। সেই থিয়েটার মানে
নাটক, মঞ্চনাটক। পুজোয় চলে ডাবল শো। পুজো কেন্দ্র করে শহরমুখী মানুষের ভিড়ে জমে
উঠত প্রেক্ষাগৃহ। সেকালের হাতিবাগান পাড়ার ক্ষেত্রসমীক্ষায় একালের হারিয়ে যাওয়া থিয়েটার, জমে ক্ষীর হয়ে ওঠা। একদিকে মহালয়ার সেই
সুর। তার সঙ্গে নাটকের রিহার্সাল তুঙ্গে। এই নাটক বাংলা নাটক, মানে প্রফেশনাল
থিয়েটার, মানে স্পষ্ট করে বললে কলকাতার
সম্পন্ন সংস্কৃতি হল পেশাদারি থিয়েটার। যে পেশাদার মঞ্চ কত শিল্পীর সংস্থান
চালিয়েছে একসময়। যেই থিয়েটারে অভিনয় করেছেন তাবড় গ্রুপ থিয়েটার-শিল্পী থেকে
সিনেমার শিল্পীরা। হাতিবাগান বাজারের অনতিদূরে জমজমাট ভিড়ে এক অনির্ণীত সমাধানে
হাতছানি দেয় থিয়েটারের পাড়া। যে আবছা স্মৃতির সৌধ নেই। নেই মঞ্চগুলো আর। শুধু
রয়েছে ইতিহাস। অথচ এই তো সেদিনের কথা। পিঠোপিঠি কত মঞ্চ কত থিয়েটার। সেবার এমনই
শারদীয় পুজো-পঞ্চমী। কলকাতায় খুলবে নতুন
এক পেশাদারি থিয়েটার। বাংলা সন ১৩৭৭। ইংরেজী ১৯৭০ সাল। সেবার পুজোর পঞ্চমী ছিল ৫
অক্টোবর। ২০২২ সালে পঞ্চমীর থেকে মাত্র ৫
দিন আগে। বাংলার থিয়েটারের বিচিত্র জগতের খুব চেনা নাম রঙ্গনা। এর সূচনা হয়েছিল
দেবীপক্ষে।
ফিরে দেখা বা ফ্ল্যাশব্যাক থিয়েটারের হারিয়ে যাওয়া বন্ধ হয়ে যাওয়া সংস্কৃতির
বাহক এক নামী প্রেক্ষাগৃহ। রঙ্গনা থিয়েটার। ডাকনাম রঙ্গনা। সংস্কৃতির সঙ্গে
বাঙ্গালিয়ানা যত বিশ্বায়ন পরিচিতি পেয়েছে, তার সঙ্গে দ্রুতগামী অনুচ্ছেদে হারিয়েছে
বাংলার পেশাদারি মঞ্চের ঐতিহ্য। কারণ, বাঙালি ইতিহাস ধরে রাখতে পারে না। থিয়েটারের
বাণিজ্যে বাঙালি ব্যবসাদারের ভাগ্যে শিকে ছেড়ে না। কেবলই মালিকানার লড়াই, মকদ্দমায় অর্থ ব্যয়। যা
থিয়েটারের অবলুপ্তির কারণ। তাও তোড়জোড় কত না। রঙ্গনার প্রথম নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল
‘নট-নটী’। প্রথমে এর আসন সংখ্যা ছিল ৮৫০টি। পরে বেড়ে যায় ৯০৫টি। তবে, শুরুর কথাই
আগে। মঞ্চের নাম দিয়েছিলেন নাট্যাচার্য অহীন্দ্র চৌধুরী। তাঁকে কে না চেনেন!
মঞ্চের উদ্বোধনের তারিখে ফ্ল্যাশব্যাকে গেলে উজ্জ্বল ইতিহাস। ওই লগ্নে মঞ্চের
শুরুর দিনে এসেছিলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়। যিনি
একদা আগ্রহী ছিলেন নাটক লেখায়। ছিলেন সংবাদজগতের বিশিষ্টজন বিবেকানন্দ
মুখোপাধ্যায়। এবং বাংলা নাটকের বিশেষ গবেষক শিক্ষক আলোচক অজিতকুমার ঘোষ।
প্রথমদিনের অভিনয়ের গল্পও অন্যরকম। যে দুটো নাটক অভিনীত হয়। এক, ‘বিনি পয়সার ভোজ’।
দুই, ‘য়্যায়সা যা ত্যায়সা’। দ্বিতীয় নাটকটি আগেই অভিনীত হত শ্রীমঞ্চে। এবং সেদিনের মঞ্চায়নের
ইতিহাসে বন্ধু-মঞ্চ হিসেবে রয়েছে শ্রীমঞ্চ। শুধু নাটকটিই নয়, সেটের পর্দা, কাঠের
পাটাতন সহ কিছু মঞ্চ-উপস্থাপনের সাজসজ্জার উপকরণ এসেছিল শ্রীমঞ্চ থেকেই। সাধারণভাবে
যে কোন নাট্যমঞ্চের নিজের বোর্ড করেই নাটক হয়ে থাকে। কিন্তু রঙ্গনার প্রথম দিকের
নাটক ছিল গ্রুপ থিয়েটারের নাটক। উদ্বোধনের পরও রঙ্গনা নিজের নাটক প্রযোজনা করতে
সমর্থ হয় না। এরজন্যে অপেক্ষা করতে হয় তারিখকে। ১৯৭৫ সাল থেকে ‘নট নটী’ নাটক দিয়েই
এর চলা শুরু। পরে নাটকটির অভিনয় চলতে থাকে নিয়মিত। তবে নতুন মঞ্চের নতুন পরিকাঠামোয় ধীরে
ধীরে সপ্তাহে তিনদিন চলল নাটকের শো। সেই নাটকে অভিনয় করেছিলেন প্রখ্যাত অভিনেত্রী
চলচ্চিত্রজগতের অতি পরিচিত মলিনা দেবী। সঙ্গের সহ-শিল্পীরাও একেকজন দিকপাল ও
বিখ্যাত অভিনেতা। যথা, গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, চেনামুখ জটায়ু-চরিত্রের সন্তোষ
দত্ত। দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, বিমল দেব। অভিনেত্রীদের মধ্যে ছিলেন দীপিকা,
বাসন্তী, মমতা, হিমানী প্রমুখ। শোয়ের সময় ছিল শুক্রবার সাড়ে ছটা। আর শনিবার বেলা
তিনটেয়। এবং রবিবার সকাল দশটায়। প্রথম নাটকের নির্দেশনায় ছিলেন অভিনেতা গণেশ
মুখোপাধ্যায়। যিনি একাধারে নাটকের শিক্ষকও। তিনি শিক্ষকতা করেছেন রবীন্দ্রভারতী
বিশ্ববিদ্যালয়য়ের নাটক বিভাগে। এক অর্থে তিনিই এই মঞ্চের জন্মদাতার এক প্রাণপুরুষ।
যিনি প্রথম ভেবেছিলেন নাটকের জন্যে আরেকটি মঞ্চ চাই। উক্ত নাটকের শোয়ের সংখ্যা
প্রথমদিকে আনুমানিক ও পাওয়া হিসেবে ৪৫ রজনী। যদিও, রজনী বলে উল্লিখিত, তবে
রবিবারের শোয়ের সময় ছিল সকাল দশটা। বিচিত্র এই রঙ্গালয়ের ইতিহাসের উল্লেখের সময়ও
গতে বাঁধা। নিজের বিশ্লেষণে তাই পৃথক করে উল্লেখ করার যে, রজনী অভিনয় কিন্তু
পেশাদারিত্বে এক প্রকাশ। এরসঙ্গে যাত্রাপালার অভিনয়ের যোগ বেশি। শব্দটি থিয়েটার
প্রিয় বাঙালির সাধারণ রঙ্গালয়ের পরের ইতিহাসেও সংযোজিত হয়ে যায়। এবং, থিয়েটারের
পরিক্রমায় একটি বিশেষ যোগসূত্র হয়ে মৌলিকত্বের দাবি রাখে। যা একদিকে ইংরেজি ভাষার
'নাইটস' থেকে প্রাপ্ত হলেও, এর বাংলা শব্দটিও বেশ মানানসই। থিয়েটারের অনেক বৈশিষ্ট্যের
মতন ঢেঁকুর তোলে না ইতিহাস অজীর্ণ বাঙালির। ফলে, ইতিহাসে রজনী বৃদ্ধি পেল। আর ফ্ল্যাশব্যাকে
থিয়েটারের কথা তৈরি হতে থাকল। উক্ত নাটকের
শোয়ের সংখ্যা আনুমানিক ও পাওয়া হিসেবে ৪৫৫ রজনীতে পৌছায়। যা তারিখে জনপ্রিয়তায়
ইতিহাস। এমনভাবে চলতে পারা থিয়েটারকে বলা যায় বাণিজ্য সফল। অর্থাৎ, প্রথম থিয়েটার
চলেছিল এক বছরেরও বেশি। ভাবা যায় না। এই তথ্য অভ্রান্ত, দু-একটি সংখ্যা রজনীর
পার্থক্য হলেও হতে পারে। তবে, তা নিশ্চিতভাবে তথ্য সারণিসূত্রে বিশেষজ্ঞ
মতামতনির্ভর।
আলোচনা সূত্রে পরের প্রযোজনা ‘বহ্নি’,
১৯৭৮ সালে। রচনা সাহিত্যিক বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়
ওরফে বনফুল। এখানেই ইতিহাস হয়ে ওঠে। এবং ইতিহাস মানেই ফ্ল্যাশব্যাক। যেমন,
দেবনারায়ণ গুপ্ত, তাঁর পরিচালনা গুচ্ছ নাটক নিয়ে আসেন নব নির্মিত নাট্যমঞ্চায়নে।
সঙ্গে তিনি নিজেই নাট্যকার এবং থিয়েটারের বোদ্ধা। তাঁর একাধিক থিয়েটারের লেখা,
আলোচনা কালানুক্রমিক ব্যাপ্ত। সঙ্গে তিনি রঙ্গনার ইতিহাসেরও এক পালক। যথাক্রমে
তাঁর নির্দেশনায় মঞ্চস্থ হয় ‘চন্দ্রনাথ’, ‘জয় মাকালী বোর্ডিং’, ‘সুন্দরী লো
সুন্দরী’, ‘অঘটন’-এর মতন বহুজন আলোচিত ও প্রশংসিত নাটক। এইসময়ে তাঁর সঙ্গে প্রযোজক
ছিলেন হরিদাস সান্যাল।
বিশ শতকের কলকাতার বাজার-অর্থনীতিতে থিয়েটারের মুনাফায় তখনও। নাটকের দ্বারা উপার্জন হত বলেই না, ওখানে অভিনয়ে যুক্ত হতেন শিল্পীরা। যাঁরা এই সিরিজের নিয়মিত পাঠক, তাঁদের আর বলে দিতে হয় না যে, নাটক থিয়েটার নিয়ে তখন কত মাতামাতি চলত। একদিকে প্যান্ডেলে ঘোরা, অন্যদিকে কলকাতার থিয়েটার দেখতে পারা দর্শক। যাঁদের দৌলতে শারদীয়ার নাটক বা থিয়েটার। আগের কিস্তিতে উল্লেখ করা হয়েছিল যে, দর্শক নাটকের তিন মাত্রার এক মাত্রা। তাহলে এত এত রজনী অতিক্রান্ত হল। এত হিট নাটক সত্ত্বেও আবার প্রশ্ন তো ওঠে, রঙ্গনা থিয়েটার কেন চলল না? হিট মানে মুনাফা। কিন্তু বাংলার থিয়েটার শুধু যে লোকসানে ডুবে যায় তাও নয়। অনেক সময় সাফল্যের সুফল সত্ত্বেও হারিয়ে যায়। তবে এর সমসাময়িক কাল পেরিয়েও প্রবন্ধে উঠে আসা মানে কি হারিয়ে যাওয়া? নাকি চতুর্থ মাত্রার অর্থ বহন করে থিয়েটারের জন্যে উঠে আসা গবেষণার বিষয় হয়ে? ফ্ল্যাশব্যাকে থিয়েটার মাননীয় সম্পাদক কাজল সেন-এর সস্নেহ লৌকিক উপস্থাপন। তিনি থিয়েটার পিপাসু। তিনি মান্য সাহিত্যিক, যিনি অতীত হতে থাকা থিয়েটারকে তুলে আনতে প্রয়াসী একুশের চলমান মাধ্যমে। তাঁকে এবং পাঠককূলকে জানাই থিয়েটারের বর্ণব্যঞ্জনে উৎসব শুভেচ্ছা। যেখানে এক নটী সংলাপ বলছেন, "মাননীয় একুশ শতকের উপস্থিতজন, শুভেচ্ছা জানবেন। থিয়েটার পাড়ার পক্ষ থেকে ডাবল শোয়ের আয়োজন সার্থক করে তোলার এককে, আপনিও একজন। তাই আপনিও আজ থেকে রইলেন পেশাদারি রঙ্গালয়ের ইতিহাসে।
_ ইতি
একুশ শতকের ফ্ল্যাশব্যাক সত্ত্বাধিকারী
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন