প্রাচীন ভারতে শূদ্রেরা
(অনুবাদ: চন্দন দত্ত)
(নিম্নতর বর্গের আনুমানিক ৬০০ খৃষ্টাব্দের
পূর্বেকার এক সামাজিক ইতিহাস। ভারতের প্রথম সারির ইতিহাসবিদদের মধ্যে অন্যতম, প্রয়াত
শ্রদ্ধেয় রামশরণ শর্মা দ্বারা লিখিত ‘SUDRAS IN ANCIENT INDIA -- A Social history
of the lower order down to circa AD 600’ নামক প্রসিদ্ধ গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ।)
*অধ্যায়
- ০৩ / ১*
*উপজাতি
বনাম বর্ণ: (আনুমানিক ১০০০ খৃষ্টপূর্বাব্দ থেকে ৫০০ খৃষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত)*
পরের দিকের বৈদিক সাহিত্য, যেগুলি সেই
পর্যায়ে শূদ্রদের অবস্থান সম্পর্কিত বিষয়সমূহ অধ্যয়নের প্রায় একমাত্র উৎস ছিল, সেগুলি
প্রধানত ধর্মীয় রীতি-রেওয়াজসমূহ তথা জনজীবনের অন্যান্য বেশ কয়েকটি ব্যবহারিক দিক
সম্পর্কে বিবৃত করেছে। সর্বসাধারণে এবং ব্যক্তিগত জীবনে প্রচলিত প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ
আচরণসমূহকে উপযুক্ত ধর্মীয় রীতি-রেওয়াজ সমূহের অনুষঙ্গ করে নেওয়া হয়েছিল, যেগুলি
কদাচিৎ এই বিষয়টিকে ধর্তব্যের মধ্যে এনেছে যে সমাজটি বিভক্ত ছিল চারটি বর্ণে।
রীতি-রেওয়াজ সমূহ থেকে কুড়োনো তথ্যগুলিকে
প্রধানত কুরু বংশের জমি সংক্রান্ত বিষয়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত করা হয়েছে, যেগুলির উপযোগ
মারফত বৈদিক সাহিত্যের বৃহৎ একটি অংশ সঙ্কলিত হয়েছিল। এইসব সাহিত্য মোটামুটিভাবে আনুমানিক
খ্রীষ্টপূর্বাব্দ ১০০০ থেকে খ্রীষ্টপূর্বাব্দ ৫০০ পর্যন্ত পর্যায়কাল-কে অন্তর্ভুক্ত
করেছে, এবং সামাজিক বিকাশের বিভিন্ন পর্যায়কালের একটি স্থির পূর্বানুমান ক'রে, সেই
অনুযায়ী রচনাংশগুলিকে ক্রমানুসারে বিভক্ত করা হয়েছে। এইভাবে যজুর্বেদ-এর কৃষ্ণ-শিক্ষায়তনের
(Black school) সংকলনটি (সংহিতা-সমূহ) শুভ্র-শিক্ষায়তনের (White school) আগে স্থান
পেয়েছিল। ব্রাহ্মণ সমূহের মধ্যে শতপথ (Sata-patha) ব্রাহ্মণ এবং ঐতরেও (Aitareya)
ব্রাহ্মণ, যে দুটি বর্ণ সমূহের মধ্যেকার আন্তঃসম্পর্কের বিষয়সমূহে গুরুত্বপূর্ণ সব
বিবৃতি প্রদান করেছে, সেগুলি ছিল তুলনামূলক ভাবে আধুনিক, যেগুলির মধ্যে পঞ্চবিংশ
(Panchavimsa) ব্রাহ্মণ এবং তৈত্তিরিয়া (Taittiriya) ব্রাহ্মণ ছিল সবচেয়ে প্রাচীন।
এমনকি শতপথ ব্রাহ্মণ (Satapatha Brahmana) এবং ঐতরেয় ব্রাহ্মণ (Aitareya
Brahmana)-এর পরে আছে জৈমিনিয়া ব্রাহ্মণন (Jaimniya Brahmanana) এবং একই ভাবে কৌশিটাকি
(Kausitaki) অথবা শাঙ্খয়ানা ব্রাহ্মণন-ও (Sankhayana Brahmanana) আছে। বেশ কয়েকটি
ক্ষেত্রে, স্রৌতসূত্রসমূহ (Srautasutras) এবং ব্রাহ্মণসমূহের (Brahmanas) মাঝে একটি
রেখা টানা কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায় ; এইভাবে বৌধ্যায়ন স্রৌতসূত্র-কে (Baudhayana
Srautasutra) ধরে নেওয়া যেতে পারে একটি বিলম্বিত কালের ব্রাহ্মণ হিসেবে। আপস্তম্বা
স্রৌতসূত্র-ও (Apastamba Srautasutra) মনে হয় একই রকমের পুরাতন। এই সমস্তকিছুর অতিরিক্ত,
অন্যান্য মুখ্য স্রৌতসূত্রগুলির (উদাহরণ স্বরূপ - অশ্বলায়ন, কাত্তায়ান, শাঙ্খ্যায়ান,
লাত্যায়ান, দ্রাহিয়ায়ান এবং সত্যসাধা) রচনাকাল স্থিরিকৃত হয়েছে মোটামুটি খৃষ্টপূর্বাব্দ
৮০০ থেকে খৃষ্টপূর্বাব্দ ৪০০'র মধ্যে। কিছু কর্তৃপক্ষ এইসব রচনাংশগুলিকে খৃষ্টপূর্বাব্দ
৪০০ থেকে খ্রীষ্টপূর্বাব্দ ২০০'মধ্যে নির্ধারিত করেছেন, কিন্ত যেহেতু তাঁরা বিষয়টি
বিভিন্ন ধর্মীয় রীতি-রেওয়াজসমূহে, সংহিতা ও ব্রাহ্মণ সমূহে উল্লেখিত হওয়ার বিষয়টি
বিবৃত করেছেন, সুতরাং আমরা সেগুলিকে প্রধানত পরেরদিকের বৈদিক সমাজ সম্পর্কিত অধ্যয়নের
ক্ষেত্রে ব্যবহার করা উচিত মনে করেছি। যদিও গ্রহসূত্রসমূহের (Grhyasutras) সাথে সেগুলির
অধিক্রমণ (overlapping) হওয়ার সত্যতা-কে উপেক্ষা করা যায় না, তাই যেগুলির ব্যবহার
আমরা বৈদিক কাল পরবর্তী পর্যায়ে করেছি। বর্তমানে উপনিষদের সংখ্যা যদিও এমনকি দু'শো
অতিক্রম ক'রে গেছে, কিন্ত তার কেবলমাত্র ছ'টি-কে আরোপিত (ascribed) করা হয়েছে প্রাক-বৌদ্ধ
পর্যায়ে। পরের দিকের বৈদিক সাহিত্যের বিভিন্ন স্তর থেকে গৃহীত নানান উপাদানের পরীক্ষা
করলে, প্রতিটি স্বতন্ত্র রচনাংশের ভিন্ন ভিন্ন আপেক্ষিক তারিখ নির্ধারণ করার বিষয়টির
প্রতি অবশ্যই শ্রদ্ধা অর্পন করতে হবে। অধিকন্তু, পরেরদিকের সংহিতাগুলিতে, বিশেষ করে
ব্রাহ্মণগুলিতে, ঋগবেদ ও অথর্ববেদ-এর তুলনায় অনেক বেশি ইচ্ছাপ্রকাশক (optatives) শব্দের
ঘন ঘন (frequent) ব্যবহার দেখা গেছে। সুতরাং, পরেরদিকের বৈদিক সাহিত্যের অনেক বিবৃতিই,
যে সমস্ত ঘটনা প্রকৃতই ঘটেছিল, তার নথিভুক্ত রূপ-এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, বরং সেগুলিকে
ব্যাখ্যা করা যায় উপদেশ বা অদেশ রূপে। কিন্ত সেই সমস্ত ঘটনা যে প্রকৃতই ঘটেছিল, তার
নৈমিত্তিক প্রমাণ পাওয়া যায় মহাভারতের প্রধাণ বর্ণনামূলক অংশগুলিতে, যেগুলি সম্ভবত
পরেরদিকের বৈদিক পর্যায়ের ঘটনাসমৃহকে প্রতিফলিত করেছে। জয়া সংহিতা অথবা মূল মহাকাব্যের
৮০০০ শ্লোক সম্পন্ন একটি সুন্দর অংশ, যে অংশটিকে কিছুটা সেকেলে বলে মনে হয়, তবুও এই
অংশটির নানান তথ্যসমূহকে পরেরদিকের ঋক-বৈদিক রচনায় প্রতিস্থাপিত করার জন্য ব্যবহার
করা হয়ে থাকতে পারে।
পরেরদিকের বৈদিক পর্যায়ের সামাজিক বিকাশের
বস্তুগত প্রেক্ষাপট প্রস্তুত হয়েছিল 'রঙ্গিন ধূসর মৃৎপাত্র'র (Painted Gray Wire বা
PGW) প্রত্নতত্ত্ব দ্বারা। পি জি ডব্লিউ এবং পরেরদিকের বৈদিক রচনাসমূহ, উভয়ই ছিল একই
আয়তনের গুরুত্ব সম্পন্ন এবং একই পর্যায়-কালের। সুতরাং পি জি ডব্লিউ'র প্রামাণিক তথ্যসমূহকে
পরেরদিকের ঋক-বৈদিক পর্যায়ের অধ্যয়নের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেতে পারে। ৩১৫টি পি জি
ডব্লিউ প্রকল্প-স্থল (PGW Sites) সম্পর্কিত বিষয়টি জ্ঞাপিত (reported) হয়েছিল ১৯৭৫
সাল নাগাদ, কিন্ত এযাবত শুধু মাত্র হরিয়ানাতেই আরো ৩০০টি প্রকল্পস্থল খুঁজে পাওয়া
গেছে। তাই এর সামগ্রিক সংখ্যাটি হয়ত ৫০০ অতিক্রম করে গেছে। অনেকগুলি খনন প্রকল্পস্থল
থেকে প্রাপ্ত স্থির কার্বন-১৪ (Consistent Carbon -14)-এর অস্তিত্ব নির্দেশিত করেছে
যে, পি জি ডব্লিউ পর্যায়টি অন্তর্ভুক্ত ছিল আনুমানিক খ্রীষ্টপূর্বাব্দ ১০০০ থেকে ৫০০'র
মধ্যে। এটি বৈদিক জনসাধারণের মেষপালক অর্ধ-যাযাবর সম্প্রদায় থেকে একটি স্থায়ী কৃষিজাত
সম্প্রদায়ে রূপান্তরিত হওয়াকে নির্দেশিত করেছিল। কিন্ত মোটের ওপর এর গঠনপ্রনালী ছিল
দুর্বল এবং সেটি কোনো সামাজিক বিভেদ-ও নির্দেশিত করেনি। এতদসত্ত্বেও, সূক্ষ্ম পি জি
ডব্লিউ এবং কয়েকটি কাঁচের সামগ্রীর ব্যবহার হয়ত সমাজে একটি উপরি স্তর উত্থিত হওয়া
সম্পর্কিত ইঙ্গিত প্রদান করেছিল। উচ্চতর গঙ্গা অববাহিকায় প্রথমবারের মতো আবির্ভাব
হয়েছিল লৌহ সামগ্রীর, কিন্ত সেইসব ব্যবহৃত হয়েছিল প্রধানত যুদ্ধের জন্য এবং কারুশিল্প
বা খাদ্যশস্য চাষাবাদের ক্ষেত্রে তার কোনো গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল না। সেইজন্য এক্ষেত্রে
আমরা বিস্তর সামাজিক উদ্বৃত্তের আশা করতে পারি না, যে উদ্বৃত্ত উৎপাদন-এর ওপর নির্ভর
ক'রে অনেক পেশাদার যাযক, যোদ্ধা, কৃষি-মজুর ও অন্যান্য মজুর প্রভৃতির জীবনধারণ সম্ভবপর
হয়ে উঠতে পারতো। উৎপাদনের সংস্কৃতি বিকশিত হলে সামাজিক অসাম্য সৃষ্টি হওয়ার মতো পরিস্থিতি
তৈরি হতে পারতো, কিন্ত সেটি পরিলক্ষিত হয়েছিল কেবলমাত্র বৈদিক-যুগ পরবর্তী সময়ে।
যেহেতু শূদ্রেরা প্রধাণত একটি দাস শ্রেণী
হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছিল বৈদিক যুগ-পরবর্তী একটা সময়ে, তাই তাদের অবস্থান সম্পর্কিত
বিষয়সমূহের অধ্যয়ন আমরা শুরু করবো পরেরদিকের বৈদিক পর্যায় থেকে, তাদের অর্থনৈতিক
অবস্থার অনুসন্ধান সহ। একটি প্রাচীন উল্লেখে, তারা বিবৃত হয়েছে গবাদিপশুর অধিকারী
হিসেবে, যেগুলি উচ্চতর বর্ণের মানুষরা পশুবলির জন্য কেড়ে নিতে পারতো। এটি প্রতিপাদিত
হয়েছিল প্রাচীন ব্রাহ্মণ-এর আরেকটি উল্লেখে, যেখানে শূদ্রদের দেখানো হয়েছে ঈশ্বর-হীন
জন্ম সম্পন্ন এবং পশুবলি না দেওয়া মানুষ হিসেবে, অথচ তারা প্রচুর সংখ্যক গবাদিপশুর
(bahupasuh) অধিকারী ছিল। এটি স্বাভাবিক যে, শূদ্রেরা যেহেতু গবাদিপশুর স্বাধীন অধিকারী
ছিল, যেটি ছিল তাদের সম্পত্তির প্রধান রূপ, সুতরাং অন্যদের সেবা করার প্রয়োজনীয়তার
অধীনে তারা না-ও থাকতে পারে।
সে যাইহোক, গোলাম শ্রেণী হিসেবে শূদ্রদের
কাজকর্মের কিছু উল্লেখও আছে। জামিনিয়া ব্রাহ্মণে বিবৃত করা হয়েছে যে, শূদ্রদের সৃষ্টি
হয়েছে প্রজাপতি'র (Prajapati) চরণযুগল থেকে, ঈশ্বর ব্যতিরেকেই, আর সেইজন্য গৃহকর্তাই
ছিল তার ঈশ্বর। পরবর্তী একটি উৎসের (source) আরেকটি বিবৃতি অনুযায়ী, তাদের জীবনধারণ
করতে হবে উচ্চতর বর্ণের মানুষের সেবা করার মধ্য দিয়ে। পূর্ববর্তী উৎসটি আরও অবহিত
করেছে যে, অশ্ব-বলি'র (Horse Sacrifice or asvamedha) পরিণাম স্বরূপ পরিপোষণকারী
(nourisher) বৈশ্য'রা সম্পদশালী হয়ে উঠেছিল
এবং উদীয়মান শূদ্রেরা কুশলী কর্মী হয়ে উঠেছিল। এটি জানা নেই, 'কর্মকারা'
(karmakara) শব্দটি এখানে ব্যবহৃত হয়েছে কী ভাড়াটে শ্রমিক (hired labour) হিসেবে
? এমন একটি শব্দ - কর্মকারা, বৈদিক যুগ পরবর্তী পর্যায়ের সাহিত্যে সর্বদা এই অর্থেই
ব্যবহৃত হয়েছে। প্রাচীন উপনিষদে অবশ্য শূদ্রদের বলা হয়েছে 'পুসান' (pusan) অথবা পুষ্টি
প্রদানকারী (nourisher)। বৈশ্যদের ক্ষেত্রে একটি উপাধি, পোসায়িষ্ণু, (posayinuh) প্রযুক্ত
হয়েছে জামিনিয়া ব্রাহ্মণ-এ। অগত্যা, এটি হয়ত এমন নির্দেশিত করেছে যে, তারা ছিল জমির
হাল কর্ষণকারী, যারা সমাজকে টিকিয়ে রাখার জন্য পুষ্টিকর খাদ্য যোগান দেওয়ার কর্মকান্ডে
ব্যপৃত ছিল। সম্ভবত এই পর্যায়ের প্রথমদিকের অংশে বৈশ্যদের মতোই তারা শ্রদ্ধার্ঘ হিসেবে
তাদের উৎপাদ-এর একটি অংশ প্রদান করতো, কর্তব্যবন্ধন (obligation) মনে ক'রে, যার বিনিময়ে
বৈদিক-যুগ পরবর্তী সময়ে তারা মুক্তি পেয়েছিল।
কিন্ত এই মনোভাব, যে শূদ্রেরা একটি শ্রম
প্রদানকারী শ্রেণী হিসেবে গঠিত হয়েছিল, সেটি উপলব্ধ হয়েছে অন্যান্য কয়েকটি উল্লেখ
থেকে। পুরুষামেধ (purusamadh) অনুসারে, একজন ব্রাহ্মণ-কে উৎসর্গীকৃত হতে হবে যাযকবৃত্তিতে
(priesthood, একজন রাজন্য-কে চরিত্রমহাত্ম্যে (nobility), একজন বৈশ্য-কে মারুত-এ
(maruts), যার অর্থ কৃষকদের শ্রেণী, এবং একজন শূদ্র-কে কঠোর মেহনতে (toil)। বিবেচনাটি
ছিল এরকম যে, শূদ্রেরা হচ্ছে কঠোর পরিশ্রমের সমার্থক। বলিসংক্রান্ত তালিকায়, চারটি
বর্ণের সদস্যরা অনুসৃত হতো বিভিন্ন পেশা দ্বারা যেমন, রথ-প্রস্তুতকারী, ছুতোর, কুম্ভকার,
কামার, স্বর্ণকার, মেষপালক, পশুপালক, কৃষক, সুরা-প্রস্তুতকারী, ধীবর এবং শিকারী এবং
তার সাথে আরো কিছু মানুষ যেমন, নিষাদ, কিরাত, পর্ণক, পাউলকাস এবং বৈন্দ, যারা সম্ভবত
প্রশস্ত অর্থে (broad term) শূদ্রদের মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত ছিল। তালিকাটি সেইঅর্থে জাহির
করে যে যদিও সংখ্যাগত ভাবে কারুশিল্পের কাজ প্রসারিত হয়েছিল ভিন্ন ভিন্ন রূপ অনুসারে
কিন্ত সেই সমস্তকিছু 'ভিস'-দের দ্বারা আর অনুসৃত হতো না। তার পরিবর্তে এমন একটি ধারণা
প্রতিষ্ঠিত হতে থাকল যে শিল্প ও কারিগরী সংক্রান্ত বিষয়টি শূদ্রেরাই অঙ্গীভূত করেছে।
শূদ্রদের ও তাদের নিয়োগকর্তাদের মধ্যেকার
পারস্পরিক সম্পর্ক কেমন ছিল? বৈদিক সূচক-এর (Vedic Index) রচনাকাররা বলেন যে, ক্রীতদাসদের অবশ্যই শূদ্র শব্দের
অঙ্গীভূত করা হয়েছিল। কিন্ত ক্রীতদাসদের সংখ্যা মনেহয় খুবই কম ছিল। ঐতরেও থেকে আমরা,
অঙ্গিয়া (Angia) দ্বারা বিভিন্ন দেশ থেকে আটক করা এবং তার ব্রাহ্মণ পুরোতহিতদের দ্বারা
দান করা দশ হাজার নারী ক্রীতদাসদের কথা জেনেছি। সংখ্যাটি অবশ্যই অতিরঞ্জিত ও গতানুগতিক।
আরুনী ও শ্বেতকেতু'র (Svetaketu) পিতা, সদম্ভে বলেছিলেন যে, তিনি সোনা, গবাদিপশু, অশ্ব,
দাসী, অনুচরবৃন্দ এবং পোষাক-পরিচ্ছদ ইত্যাদির অধিকারী, কিন্ত পুরুষ ক্রীতদাসদের কথা
বলেননি। যুধিষ্ঠিরের মহা-রাজ্যাভিষেকের সময় ঐতিহ্য অনুযায়ী অর্ঘ্য নিবেদন উপলক্ষে
ব্রাহ্মণেরা নারী ক্রীতদাস পেয়েছিল, যে ঘটনাটিকে আরোপিত করা যেতে পারে পরেরদিকের বৈদিক
পর্যায়ে। এটি পরিষ্কার যে, সেই পর্যায়ে, শাসক-প্রধান এবং পুরোহিতদের পক্ষে অনল্প মাত্রায়
নারী ক্রীতদাসের অধিকারী হওয়া সম্ভব ছিল, কিন্ত পুরুষ ক্রীতদাসের ক্ষেত্রে তেমন হওয়া
সম্ভব ছিল না। দাস শব্দটি উল্লেখিত হয়েছে ঐতরেও এবং গোপাথা ব্রাহ্মণগুলিতে
(Gopatha Brahmanas), কিন্ত সেটি ক্রীতদাস অর্থে নয়। এটি লক্ষ্যনীয় যে নিঘন্টু
(Nighantu) প্রদত্ত তালিকায় (parikaranakaramanah) দাসেদের কোনো উল্লেখ নেই, যদিও
তাতে ভৃত্য বা গোলামের দশটি প্রতিশব্দ উল্লেখ করা হয়েছে। হতে পারে পুরুষ ক্রীতদাসের
সংখ্যা এতই নগণ্য ছিল যে সেটি দৃষ্টি আকর্ষন করার মতো কিছু ছিল না। স্বাভাবিকভাবেই
এটি পুরুষ শূদ্রদের ক্রীতদাস রূপে নিযুক্ত হওয়ার সম্ভাবনাকে বাতিল করে। সেইজন্য কেইথ-এর
(Keith) এই বিবৃতি যে, 'ব্রাহ্মণদের পর্যায়কালে কৃষকদের দ্বারা নিজেদের জমিতে কাজ
করার বিষয়টিকে খারিজ করা হচ্ছিল, কারণ জমির-মালিকেরা তাদের তালুকগুলির চাষাবাদ করতো
ক্রীতদাস নিযুক্তির মাধ্যমে', সেটি হয়ত বিষয়টির সঠিক প্রতিনিধিত্ব ছিল না।
ক্রীতদাসদের জমিতে কাজ করার বিষয়টি
প্রথম শোনা যায় স্রৌতসূত্রসমূহে (Srautrasutras), যেটি সঙ্কলিত হয়েছিল বৈদিক যুগের
শেষের দিকে এবং তার পরেও। এইসবের মধ্যে একটি উল্লেখ আমাদের অবহিত করেছে যে, দু'জন ক্রীতদাসকে
খাদ্যশস্য, লাঙল এবং গবাদিপশু সহ ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল, যার দ্বারা এটি নির্দেশিত হয়
যে ক্রীতদাসদের লাঙল চালানোর কাজে নিযুক্ত করা হতো এবং প্রভুরা তাদের স্বাধীন ভাবে
ছেড়ে দিতে পারতো। কিন্ত বেশ কয়েকটি রচনাংশে, জমি এবং তাতে কাজ করার লোকেদের উপহার
স্বরূপ প্রদান করার রীতিকে বিরূপ দৃষ্টিতে দেখা হয়েছে। এইভাবে, এটি বলা হয়েছে যে
অশ্বমেধ বলিদানে, বলিদান সংক্রান্ত পারিশ্রমিক স্বরূপ, জমি এবং তাতে কাজ করা লোকেদের
দান করার বিষয়টিকে সংযুক্ত করা চলবে না। পুনরায়, একদিবসীয় (ekaha) বলিদানের উপহার
সংক্রান্ত বিষয়েও বলা হয়েছে যে, সেইসব ক্ষেত্রে জমি এবং শূদ্রদের সমর্পিত করা
(bhumisudravarjan) চলবে না। সেক্ষেত্রে অবশ্য বিকল্পও রয়েছে যে, কোনো কোনো সময়ে
শূদ্রদের সমর্পিত করা যেতে পারে, কিন্ত তারসাথে এমন টিপ্পনি সংযুক্ত করা হয়েছে যে,
এটি করা যাবে কেবলমাত্র তাদের ক্ষেত্রে, যারা জন্মগত ভাবেই ক্রীতদাস। সংখ্যায়ন স্রৌতসূত্রে
(Sankhayana Srautasutra) অনুরূপ দুটি উল্লেখ রয়েছে। যার মধ্যে একটিতে বলা হয়েছে
যে, পুরুষমেধ বলিদানে (purushamedha sacrifice), বলিদান সংক্রান্ত পারিশ্রমিক হিসেবে
লোকজন সহ জমি সমর্পণ করা হয়েছে। অন্যটি পরিষ্কার নয় এবং সেটি হয়ত নির্দেশিত করেছিল
যে, বলিদানের প্রতিটি ক্ষেত্রেই (sarbamedha), লোকজন সহ জমি প্রদান করা হয়। এই সমস্ত
উল্লেখসমূহ একটি নতুন সামাজিক বিকাশের দিকে ঈঙ্গিত প্রদান করেছিল, সম্ভবত বৈদিক পর্যায়
শেষ হওয়ার পরে। শূদ্রদের ক্রীতদাস হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছিল নানান ব্যক্তি (বেশিরভাগই
শাসক-প্রধান) মালিকানাধীন জমিতে, এবং তাদের উপহার হিসেবে জমি সহ দান করা যেতো, যদিও
সেটি অশ্বায়ন (Asvayana) এবং কাত্তায়ন স্রৌতসূত্রের (Katayana Srautasutras) লেখকদের
চ্যালেঞ্জ বিহীন একটি বিষয় ছিল না।
এটি ধরে নেওয়া হয়েছিল যে, বৈদিক পর্যায়ে
শূদ্রেরা ছিল ভূমিদাস। ভূমিদাস শব্দটি বোঝায় এমন একজনকে, যারা তাদের মালিকের
(master) জমির সাথে নিবদ্ধ (attached)। সে এক টুকরো জমির অধিকারী ছিল, যার জন্য সে
তার মালিককে খাজনা প্রদান করতো ও তার জমিতে কাজ করতো, কিন্ত জমি সহ সে অন্য মালিকের
কাছে হস্তান্তরিত হতে পারতো না। সে তার ছোট জমি নিজের অধিকারে ধরে রাখতে এবং সেই জমি
চাষ করতে অনুমিত থাকতো কেবলমাত্র ততদিনই, যতদিন সে তার মালিকের বেশ বড়সড় জমিতে কাজ
করতো, এই পরিণাম সহ যে, ভূমিদাস প্রথার অধীনে ছোট জমিগুলি আর্থিকভাবে এবং আইনগতভাবে
বৃহত্তর বিস্তার সম্পন্ন জমির সাথে সংযুক্ত থাকতো। কিন্ত এমন একটি ব্যবস্থা বৈদিক পর্যায়ের
শেষ অবধি বলবৎ ছিল না, এবং সেইজন্য ভূমিদাস হিসেবে শূদ্র শব্দটির ব্যাখ্যা, প্রাসঙ্গিক
উল্লেখটির সাথে খাপ খায় না। প্রথমত বৈদিক পর্যায়ে, জমির ব্যক্তিগত মালিকানার বিষয়টি
অত্যন্ত সীমিত চরিত্র সম্পন্ন ছিল। মালিকানা বলতে বোঝায় সম্পত্তির অবাধ হস্তান্তরের
অধিকার, কিন্ত সংহিতায় জমির অনুদানের কোনো উদাহরণ নেই। অবশ্য চান্দোগ্য উপনিষদে
(Chandogya Upanishad) এইরকম একটি উদাহরণ আছে, যেখানে রাজা জনশ্রুতি (Janasruti) দ্বারা
রাইকভ-কে (Raikava) একটি গ্রাম প্রদান করা হয়েছিল। আরেকটি দৃষ্টান্ত পাওয়া গিয়েছিল
পরেরদিকের দুটি ব্রাহ্মণ-এ। সেগুলি আমাদের অবহিত করেছে যে, জমি প্রদান করা যেতে পারে
একমাত্র জাতির অনুমতিক্রমে, এবং এমনকি সেক্ষেত্রেও, ধরিত্রী স্থানান্তরিত করার বিষয়টি
অস্বীকার করা হয়েছিল। পূর্বেকার পর্যায়েও, শূদ্রদের জমি দেওয়ার কোনো উদাহরণ ছিল
না। এইসব বিকাশ সম্পর্কিত বিষয়ের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে কিছু স্রৌতসূত্রে
(Srautrasutras), কিন্ত একটি ভাষ্য অনুযায়ী এই শূদ্রেরা জন্ম থেকেই (garbhadasa) দাস
ছিল বলে প্রতীয়মান হয়। এটি এই তথ্য দ্বারা প্রতিপাদিত (confirmed) হয়েছে যে, বৈদিক-পর্যায়
পরবর্তী সময়েও শূদ্রেরা কর-প্রদানকারী কৃষক (tax paying peasant) হিসেবে প্রতীয়মান
হয়নি। ভাজপেয় (bhajapaya শব্দটি অর্থ শক্তিবর্ধক পানীয়), বর্ণিত হয়েছে বলিদান প্রদান
কারী ('ভিস' অথবা বৈশ্য) অভিজাতদের পানীয় হিসেবে। এটি সম্ভবত এই জন্য যে, বৈশ্যরা
দুর্বিপাক ও দুর্দশা-ক্লিষ্ট ছিল। ঐতরেও ব্রাহ্মণে, বৈশ্যেরা বর্ণিত হয়েছে কর প্রদানকারী
এবং ইচ্ছেমত নীপিড়ন করা যায় (ajeyeyyam) এমন ব্যক্তি হিসেবে। এই সমস্তকিছু ইঙ্গিত
করে যে, বৈশ্যদের উৎপাদনের একটি অংশ তৎকালীন শাসকদের দিতে হতো, যারা তার ওপর নির্ভর
করেই জীবনধারণ করতো। এই ধরনের ভূমিকা শূদ্রদের জন্য বিহিত না থাকার বিষয়টি দেখায়
যে, তারা কর প্রদান-যোগ্য কোনো সম্পত্তির অধিকারী হতে অনুমিত ছিল না। উপনিষদে সোম,
ব্রাহ্মণ ও রাজন্যদের দুই মুখ দিয়ে যথাক্রমে ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যদের খাওয়ার কথা বর্ণিত
করেছেন। এক্ষেত্রে রাজন্যেরা, ব্রাহ্মণদের এবং ব্রাহ্মণের রাজন্যদের শ্রদ্ধা নিবেদনকারী
হওয়ার প্রতিনিধিত্ব করেছে। যথারীতি শূদ্রদের এর বাইরে রাখা হয়েছে, কোনো কিছু প্রাপ্ত
হওয়ার ক্ষেত্রে তাদের অক্ষমতাকে কেন্দ্র করে।
বেদকীয় পর্যায়ে 'দাসত্ব' ও 'ভূমিদাসত্ব'
শব্দ-দুটির নিরিখে শূদ্রদের অবস্থান নির্ধারণ করা কঠিন। যদিও অনেক পরেরদিকের বৈদিক
সাহিত্যে পাওয়া উল্লেখসমূহ, শূদ্রদের শ্রমজীবী জনসাধারণ হওয়ার ইঙ্গিত দেয়, কিন্ত সাধারণভাবে
তারা দাস বা ভূমিদাস হিসেবে কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধীন ছিল, এমন মনে হয় না। আপাতদৃষ্টিতে,
ঠিক যেমন জনসমাজ (community), জমির ওপর কিছু মাত্রায় সাধারণ নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতো,
একই রকম ভাবে সেটি বজায় থাকতো শ্রমজীবী জনসংখ্যার নিয়ন্ত্রণের ওপরেও। এবং এই অর্থে,
শূদ্রদের খুব স্থূল ভাবে স্পার্টা'র হেলট'দের সাথে তুলনা করা যায়, এই পার্থক্য সহ
যে, তাদের সাথে ততটা অবজ্ঞা ও নিগ্রহমূলক আচরণ করা হয়নি।
(ক্রমশ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন