সমকালীন ছোটগল্প |
সময়
ফোন বাজছে। অচেনা নম্বর। তুলতে ইতঃস্তত হয়। অচেনা নম্বরে যথেচ্ছো প্রতারণার ফাঁদ ঝনঝন করে প্রায়ই। বা বাজে কথার ঢল। কিংবা সম্পাদকের লেখা দেওয়ার রিকোয়েস্ট বা রিমাইন্ডার। কোনটাই ভালো লাগে না। ফোন ধরবার ডিসিসন নিতে খানিক সময় নেয়। বাজতে বাজতে সে বন্ধ হয়ে যায়। যাক ল্যাঠা চুকেছে ভাবতে ভাবতেই অন্য নম্বরে দ্বিগুণ জোরে বেজে ওঠে। বুঝতে পারে চোকেনি। আগেরটার নম্বর থেকেই বাজছে কিনা সে বুঝতে পারে না। দুনিয়ার মানুষের ফোননম্বর মনে রাখা যায় না। যদিও আজকাল সংখ্যা দিয়েই মানুষ চেনা বা মানুষকে চিহ্নিত করার যুগ। অনেকদিন আগেই বিশ্বকবি যার সংকেত দিয়েছিলেন! ব্যঙ্গ করেছিলেন, তাইই এখন সশব্দে এসে পড়েছে। সংখ্যা কি সত্যিই কোনো মানুষকে চেনাতে সক্ষম হতে পারে? একটা ডিজিটাল আইডেনটিটি মানুষকে বহন করতে হবে! হাজার চিন্তা মুহূর্তের মধ্যেই এসে প্যারেড করতে থাকে মনে-মস্তিষ্কে। এবং এসবের মধ্যেই নম্বরটা ক্রমশঃ আকর্ষণ করতে থাকে…
-হ্যালো…
-আপনার লেখাটি পড়লাম ম্যাডাম।
হা হা হা হা…
-কে বলছেন? কী লেখা? কিসের লেখা?
হাসছেন কেন?
- আচ্ছা ক্যারাটে ঝেড়েছেন বটে!
নানচাকু ঘুরিয়ে কুপোকাৎ করার দারুণ ক্যারিশ্মা! ওঃ! এই করেই জিতে গেলেন!
-মানে?
-মানে বোঝাতে হবে? আপনাকে? না
বুঝেই লিখেছেন তা’হলে? সত্যি, আপনারা পারেনও বটে!
-এত ‘বটে’ ‘বটে’ করবেন না তো!
-ওহো, দু বার বলেছি, না? বেশ
খেয়াল রেখেছেন তো! অথচ কোন লেখার বিষয়ে বলছি বুঝতে পারছেন না! হুঁ। জানি, আপনি অনেক
লিখছেন। দু হাতে লিখছেন। তাই কি মনে করতে পারছেন না? সেরকম তো হবার কথা নয়!
-মানে?
-অত মানে মানে করছেন কেন? বাংলা
ভাষারও মানেবই দরকার! আপনি আদতে বাঙালি তো!
অবশ্য বাঙালি হলেই বাংলাভাষা
জানতে হবে, বুঝতে হবে সেরকম কোনও কথা নেই!
না জানাটাই নিজেকে কেতাদুরস্ত রাখার নমুনা! আপনি কিন্তু জেনে বুঝেও না বোঝার নাটক করছেন।
-অবজেকসন! কী বলতে চাইছেন?
-বেশী লিখলে লেখার স্ট্যান্ডার্ড নেমে যায়
বলে একটা কথা আছে। বুদ্ধিজীবীমহল অবশ্য সেটা বলে না! আপনার ক্ষেত্রে এ কথাটা এখনো পর্যন্ত
খাটেনি যদিও! তাই এমন কথা আপনাকে বলতে পারছি না! আমি জানি আপনার লেখা কোনদিন সাবস্ট্যান্ডার্ড
হচ্ছে এখনও তেমন কথা কেউ বলেনি। আমি তো আপনার স্পেশ্যাল পাঠক। তাই বলে আমিও কখনও বলবো
না, এমন কথা কিন্তু নয়! এই তো সেদিন ‘রুচিরা’ পত্রিকায় অনেকদিন পর একটা প্রেমের গল্প
দিয়েছেন! কোনোদিন ভুলতে পারবো না জানেন! আসলে
সেখানে আমাকেও দেখতে পেয়েছি ভীষণরকম! কত সফ্ট আপনি সেখানে! জাস্ট ভাবা যায় না! একজনের
মনের ভেতর এতখানি কী ভাবে যে ঢুকেছেন! একেবারে
যাচ্ছেতাই ভাবে ঢুকে পড়েছেন। আমি তো আমাকে দেখতে পেয়ে কেঁদেই ফেলেছিলাম। ভেবেছি এত
কিছু জেনেও নিজে এত কী করে কংক্রিটকঠোর থাকছেন?
এত অবজ্ঞা কী করে আসে আপনার! এত এ্যালুফনেস? যাকগে, তার পরেই ‘উন্মাদ’ পত্রিকায় জেন্ডার-বৈষম্য
তুলে এমন ঝেড়েছেন! একদম বাজে ভাবে লিখেছেন। না না লেখার ভাষার কথা বলছি না! সেখানে
আপনি ঠিক আছেন। আপনার চালাকি তো এখানেই! তো কোন গল্পটার কথা বলছি এবার নিশ্চয়ই বোঝা
গেছে! না মনে করতে পারলে আমি বলছি ম্যাডাম।
প্রত্যেকটা লাইন আমার কন্ঠস্থ।
-থাক! অত পরিশ্রমের দরকার নেই
আপনার! নাম বলুন।
-কার! আমার না গল্পের!
-দুটোই বলুন! আমার সময় নষ্ট করবেন
না।
-তার মানে! কোন গল্পের কথা বলছি
আপনি এখনও বুঝতে পারেননি বললে আমি বিশ্বাস করবো?
-সে আপনার নিজস্ব ব্যপার! আপনি
যা খুশি তাই করতে পারেন! তা ভেবে আমি সময় নষ্ট করতে যাবো কেন?
-যা খুশি করতে আর পারছি কোথায়!
তা’হলে তো অনেকদিন আগেই…, যাকগে, ছাড়ুন…, আপনার কাছে সময়ের দাম মানে মুল্য প্রচুর সে
আমি জানি। ইনফ্যাক্ট সকলের কাছেই সময়ের মূল্য থাকা উচিত। যাকে ধরে রাখা যায় না সে ভীষণ
দামীই হয়। হ্যাঁ ম্যাডাম, ভীষণ দামী। ভয়ানক রকমের দামী! যেমন আপনি নিজেও নিজেকে মনে
করেন! জানি আপনার সময়, প্রতিটি সেকেন্ড মিনিট
ধরে অর্থ বহন করে। বড় অর্থবাহী আপনার সময়। শুধুই অর্থমূল্যবহনকারি সময়ের সঙ্গে সহবাস
করতে করতে আপনি নিজেকে কেমন সরিয়ে রাখছেন জানেন! আপনি কি নিজেকে ‘অধরা মাধুরী’ মনে
করেন? ভুল করছেন। মাধুরীর কাছেও সময়ের দাম খুব বেশী। সময় চলে গেলে মাধুরীও চলে যায়, যে সত্যটা আপনি ভুলতে
বসেছেন। বা ভুলেই গেছেন! সময় এমন বলবান নয় যে আজীবন সম্পদ বহন করবে।
- আরে, কে আপনি? বড্ড জ্ঞান দিচ্ছেন
যে!
-স্যরি টু সে দ্যাট, আপনার কাছ
থেকে এরকম প্রশ্ন আশা করা যায় না। এই, ‘জ্ঞান দিচ্ছেন’ ‘বাকতাল্লা মারছেন’ ‘বকোয়াস
করছেন’—এসব ল্যাঙ্গুয়েজ তো আমাদের মতো মাটিতে পা দিয়ে চলা এলিমেন্টের ভাষা! আপনার মতো
রোপওয়েতে ঝুলে থাকা মানুষের ভাষা তো নয়! পার্থক্য থাকা উচিৎ ছিল। আপনাকে এতদিন ধরে
যা বুঝেছি- কেবল সীমারেখা টানা, কেবল ইচ্ছে করে দূরত্ব টানা, কেবল আঁতলামী, কেবল বিঁধিয়ে
বিঁধিয়ে বলা…
- আরে নাম বলুন! নামটা বলুন!
-ম্যা’ম, এখনও নাম মনে করতে পারলে
না আমার! আমি কিন্তু তোমাকে ভুলতে পারিনি কোনদিনও প্রিয় ছন্দবাণী। সবাই যখন তোমাকে
তোল্লা দিয়ে রাখে, আমি তোমার লেখার ক্ষুদ্র ছিদ্রগুলো দেখিয়ে দিই, যাতে সাপ বাঘ শেয়াল
সেখান দিয়ে সেঁধোবার আগে বুঝতে পারো। সময়কে কিন্তু ধরে রাখা যায় না! প্রত্যেক মানুষের
ওপর দিয়ে সময় দর্পিত পদক্ষেপে হেঁটে যায়। ভাবনা বদলে বদলে দিয়ে তার হাঁটা। ফ্রেস পাঠ
নাও তার কাছ থেকে। তাকিও নিজের দিকে একবার!
আস্তে ফোন নামিয়ে রাখে ছন্দবাণী বসু। নিজের দিকে তাকায়। একটু একটু ফাটল ধরছে কি সেখানে! বিশ্বাসের ফাটল! কত কথা তো আজ আর বিশ্বাস করে না ছন্দা! লিখতে গেলে অথচ সুতোয় গাঁথা পুরনো বিশ্বাসগুলোর ওপর বুলডোজার চালাতে হাত কাঁপে। যশ খ্যাতি কাঁকড়ার দাঁড়াগুলোর মতো গলা টিপে ধরে। ও যে সময়কে ধরে রাখতে চায় তা ক্রমশঃ পচে উঠছে! তা কি বোঝে না ছন্দবাণী! বোঝে।
ছন্দবাণী বসু এই ফোন নম্বরটা
মনের মতো নামে সেভ করে রাখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মনের ভেতর থেকে তিনদশক আগের সেই নামটা
উঁকি দিয়ে যায় কি? যার ওপর তার ‘ইগো’ বুলডোজার চালিয়ে দিয়েছিলো?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন