সমকালীন ছোটগল্প |
চাঁদের আলো
দরজার
বাইরে অনবরত ঢাকের শব্দ। তীরের ফলার মত বিঁধছে পূর্ণিমার। ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে ভেতরটা।
সোনাই দৌড়ে আসে সরু, মলিন, একফালি উঠোনটা থেকে।
-"মা! ঢাকি এসেছে, একটু চাল দিই?"
পূর্ণিমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই সোনাই রান্নাঘরে দৌড়য়। দশমীর পর এমনিই মেয়েটার মন খারাপ। পূর্ণিমা আটকায় না।
-"মা, দেখো চালের টিনে ফুটো! ইঁদুর ঢুকেছিল বোধহয়। কত চাল যে নষ্ট করেছে।"
একদিকে ঢাকের শব্দ, অন্যদিকে ছেঁড়াফাটা সংসারটায় অভাবের থাবা। তার মধ্যে এমন উপদ্রব! পূর্ণিমার চোখ ফেটে জল আসে। এমনিই পুজোর কটা দিন মেয়েকে খিচুড়ি বই কিছুই রান্না করে দিতে পারেনি। আজ একটু ঘি-ভাত করে দেবে ভেবেছিল। সে উপায়ও আর রইলো না। পরিস্থিতি, ভাগ্য এভাবেই ওকে রেহাই দেয় না।
-"মা!
কী করব?"
সোনাই
আবার প্রশ্ন করে।
-"ওই
নষ্ট চাল দিসনি ওদের। ওই ব্যাগটাতে দশটা টাকা আছে, আর দুটো আলু দিয়ে দে। "
মায়ের
কথায় সোনাইয়ের মুখ ভার হয়। পূর্ণিমার চোখ এড়ায় না কিছুই।
-"কাল নবমীর দিন ফুচকা খাব বলে দশটাকা চাইলাম তোমার থেকে। তুমি দিলে না। বললে অসুবিধা আছে। আজ ওদের দিয়ে দিচ্ছ! আমার যদি বাবা থাকতো, পুজোর দিনে আনন্দ করতে পারতাম।"
কথাগুলো বলেই সোনাই দশ টাকার নোট আর দুটো আলু নিয়ে দরজার বাইরে বেরোয়। দশমীর বিকেল জুড়ে বিষন্নতার ছায়া। পূর্ণিমাকেও ছুঁয়ে দিয়ে যায়।
ঢাকিরা বাজিয়েই চলেছে। বিসর্জনের পরের বাজনা। কী সুন্দর ছন্দ। পূর্ণিমার বাঁ হাতটা নড়ে উঠছে মাঝে মাঝে। ডান হাতে সেলাই-এর কাজ করছে ধীরে ধীরে। ভেতরের ক্ষতগুলো কোনো আঁধারভরা পথে এগিয়ে চলেছে যেন। জানলার বাইরে কৃষ্ণচূড়া গাছটা কত বছর ধরে ফুলহীন। ঝুঁকে পড়েছে জানলার দিকে। তাই আলো ঢোকে না ওদের স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে। আধো-আঁধার ঘর, বাইরে ঢাকের শব্দ পূর্ণিমাকে স্মৃতির অতলে ডুবিয়ে দিচ্ছে।
বাবার সাদা রংয়ের ঢাকটা বড় আদুরে ছিল পূর্ণিমার কাছে। পুজোর সময় কলকাতার প্যান্ডেলে বাবার বায়না থাকতো। পূর্ণিমা আসত। এভাবেই ঢাক বাজানোর হাতে-খড়ি। কলকাতায় পুরনো এক বাড়িতে বাজাতো বাপ মেয়ে। ওই বাড়ির বড়মা বলতেন- "পূর্ণিমা, তুই ঢাক বাজালেই আমাদের পুজোর দালান আলো-আলো হয়ে যায়।" বাবা চলে যাওয়ার পরে এই ঢাক বাজিয়ে পূর্ণিমা হাল ধরেছিল সংসারের। মা চলে যাওয়ার পরে ঢাক ছিল ওর একাকীত্বের সঙ্গী।
বিয়ের পর সব বদলে গেল। সমীর পছন্দ করত না। নিজে পছন্দ করে বিয়ে করেছিল। পূর্ণিমা বাবার ঢাকটা যত্ন করে রেখে দিয়েছিল। সমীর কাজে বাইরে গেলে মাঝে মাঝে ঢাকের কাঠি আর ওর দুই হাত একে অপরকে আদরে জড়িয়ে নিত। পূর্ণিমার ভেতরে তখন মাতৃমূর্তি জ্বলজ্বল করে উঠতো। সমীরের ফুচকার স্টলের পাশের প্যান্ডেলটায় দাঁড়িয়ে পূর্ণিমা শুধু ঢাকের বাজনা শুনতো। ছন্দের একটু এদিক ওদিক হলেই বুকে এসে বিঁধত পূর্ণিমার।
সোনাই তখন গর্ভে। সমীর সেবার দশমীর দিন একটু দূরে এগ-রোলের দোকান দিয়েছিল। দশমীর দিন আর আটকাতে পারেনি পূর্ণিমা নিজেকে। বাড়ির সামনের প্যান্ডেলে ঢাক বাজিয়েছিল। সিঁদুর খেলতে গিয়ে সামলাতে পারেনি নিজের জমানো ইচ্ছেদের। আলো হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। ওই প্যান্ডেলের ঢাকিরাও দুহাত তুলে আশীর্বাদ করেছিল পূর্ণিমাকে। পূর্ণিমার হাত জুড়ে সেদিন আলোর গন্ধ।
"শালী! মেয়েছেলে হয়ে ঢাক বাজাবি?" ওর সেই দুই হাত মুচড়ে ভেঙে দিয়েছিল সমীর। একবেলা কম খেতে পাওয়া, দুর্বল, সরু লিকলিকে হাত আর কোনদিন সারেনি। হাতের হাড় আর পূর্ণিমার ইচ্ছে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ধুলোয় মিশে গিয়েছিল। বিসর্জনের রাতে পূর্ণিমার গায়েও ছিল নিরঞ্জনের গন্ধ। নিজের ইচ্ছে আর সমীরের সংসার দুটোই ছেড়েছিল, সোনাইকে গর্ভে নিয়ে।
আজও টুকটাক রান্না, আর সেলাই মেশিনের কাজ বই ওই হাতে শুধুই ঢাক বাজানোর স্মৃতি। পূর্ণিমা ওর দুই হাতের দিকে তাকিয়ে থাকে।
-"মা,
তুমি নাকি ঢাক বাজাতে? রান্নাঘরে রাখা ওই ঢাকটা তোমার? তবে যে বলেছিলে, ওটা দাদুর স্মৃতি!
তাই তুমি রেখে দিয়েছো?"
সোনাই-এর
কথায় চমকে বাস্তবে ফেরে পূর্ণিমা।
-"তোকে
কে বললো?"
-"ওই
তো, যে ঢাকিরা এসেছিল! বলছিল পূর্ণিমা ঢাকির বাজনায় নাকি দুগ্গামায়ের মুখও আলো হয়ে
উঠতো? তোমার হাত এমন করে নষ্ট হলো কীভাবে মা? আমায় বলোনি কেন!
সোনাই
আকুলি-বিকুলি করে।
পূর্ণিমা
জবাব দেয় না খানিকক্ষণ। ছোট মেয়েটার মনে ‘বাবা’ নামের সম্পর্কের ছবিটা ভেঙেচুরে দিতে
ইচ্ছে করে না ওর।
-"আমি
আর তোর দাদু ঢাক বাজাতাম আগে, একটা এক্সিডেন্টে আমার হাত নষ্ট হয়ে গেছে মা।"
সোনাই
দৌড়ে এসে মায়ের হাতে হাত বুলোয়। পূর্ণিমার সারা শরীর জুড়ে বৃষ্টি নামে। মেয়ের
স্নেহভরা চোখ দেখে ওর ভেতরে নদী বয়ে যায়। তৃপ্তির জলরাশি উছলে পড়ে।
-"মা
! আমি সোনা কাকিমাদের বাড়ি থেকে একটু চাল চেয়ে নিয়ে আসছি। কাল তুমি ফেরত দিও। তারপর
এসে খিচূড়ি বসাবো। আমি দেখেছি দুটো ডিম আছে। রাতে খিচূড়ি আর ডিমভাজা খাবে?"
পূর্ণিমার
চোখে দুকুল ছাপিয়ে জল নেমে আসে।
শেষ
বেলায় মা-বেটিতে খিচূড়ি ডিমভাজা খায়। সোনাই মায়ের বুকে মাথা রাখে। "আমায়
ঢাক বাজানো শিখিয়ে দেবে মা? তোমার মত, দাদুর মত।"
পূর্ণিমার
চোখ দিয়ে জলের ধারা। বিসর্জন শেষের চাঁদটা পূর্ণিমার চাঁদের মতোই উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন