কবিতার কালিমাটি ১২২ |
বাতিঘর
আমাদের সামনে
পেছনে কখনও কোনোদিন কোনো বাতিঘর ছিল না
আশৈশব ঝুপড়ি
ঘরে চাঁদের স্নিগ্ধ আলোয় এ ওর মুখের বলিরেখা দেখে
কাটিয়ে দিতাম
রাত,
ভ্যাপসা গরমে
শরীর থেকে ঘামের নুন ঝরে পড়তো মেঝেতে
রূপকথার গল্প
শোনাতো বয়স্ক সদস্যরা
হাতি-ঘোড়া রাজা-বাদশা
রাজপ্রাসাদের স্বপ্নাতুর জীবনের গল্প মোহ জাগাতো
আটপৌরে মনে,
গল্পে গল্পে
ভোর হলে বাতিঘরের কথা নিভন্ত উননের মতো উধাও হতো;
সারাদিন রৌদ্রের
খরতাপ,
উদয়াস্ত পরিশ্রম,
অনাহারী শরীরের
উলঙ্গ উল্লাস
ক্ষুধাকে প্রতিহত
করতো কী এক জাদুরকরী ক্ষমতায়,
হেলায় ফেলায়
কেটে যেত ক্ষুধাহীন স্বপ্নহীন বাতিঘরহীন কৈশোর;
তারুণ্যের সিঁড়ি
বেয়ে ওপরে ওঠা হলো না আর,
নিচে নামতে
নামতে বার্ধক্যের পোড়ো বাড়িতে এসে পৌঁছেছি,
আজও নেই বাতিঘর
আছে চাঁদের
স্বল্প আলোয় অস্পষ্ট গৃহস্থালি
আছে পুরনো বাসনপত্রের
অনিবার্য ঠোকাঠুকি
আছে সিঁদকাটা
চোরের সঙ্গে লুকোচুরি খেলা।
ধূপছায়া
বিদ্যুৎবিহীন
ঘরে জ্বলন্ত মোমবাতির শিখা কেঁপে কেঁপে উঠছিল,
অথচ দেয়ালে
প্রতিফলিত আমাদের আলিঙ্গনের ছায়াটি ছিল স্থির
স্তব্ধতার সংজ্ঞাকে
ধারণ করে আমাদের নির্বাক সময় অতিবাহিত হচ্ছিল
নিরুত্তাপ উদ্বেগে
;
প্রথাসিদ্ধ
ভালোবাসায় আমাদের কোনো বিশ্বাস ছিল না
বালিহাঁস উড়ে
গেলে তার ডানার শব্দের রেশ থেকে যায়,
অথচ নিঃসঙ্গ
বকটি উড়তে পারেন না বলে কোনো শব্দই আর
অবশিষ্ট থাকে
না;
পুরাতন ভালোবাসায়
জড়িয়ে থাকে জীর্ণতার খোলস,
নতুন ভালোবাসায়
জড়িয়ে থাকা উচ্ছল আবরণটি বারবার খসে পড়ে
সংশয়, শঙ্কা,
দ্বিধা ও দ্বন্দ্বের দিগন্তে এসে মাথা কুটে
মরে
এই ভালোবাসাগুলো;
তবু ভালোবাসা
ছিল, আছে
আমাদের ভালোবাসা
কি ছিল, আছে!
জ্যোৎস্নার বৃষ্টিতে
জ্যোৎস্নার
বৃষ্টিতে ভিজছে রাতের মহানগরী
বহুতল ভবনগুলোর
গা বেয়ে বেয়ে ক্ষীণধারা ঝরনার মতো
গড়িয়ে পড়ছে
জ্যোৎস্নার জল,
এ্যাপার্টমেন্টগুলোতে
ঘুমকাতুরে মানুষদের চোখে চোখে
স্বপ্নের যে
আলোছায়ার খেলা তা ভেজে
কিনা যায় না
দেখা।
তবু মানুষ ঘুমায় স্বপ্ন দেখে
স্বপ্নের ভেতরে
আরও এক স্বপ্নের মহানগরীতে চলে যায়
সেখানে রাতের
নকশাকাটা ফুটপাতগুলোতে শুয়ে থাকে না ছিন্নমূল মানুষ,
রাজপথগুলো স্বচ্ছ
করতোয়ার মতো শান্ত স্থির,
হাইড্রোলিক
হর্ন দূষিত করেনা শব্দের ঘর-বাড়ি,
নিশাচর পথিক
আকণ্ঠ পান করে নেয় জ্যোৎস্নার সুপেয় জল,
ঘরে ঘরে মায়েরা
ঘুমপাড়ানি গান গায়,
শিশুদের হাতে
হাতে ঠাকুরমার ঝুলি,
কবিতা-পিপাসু
তরুণীর হাতে জীবনানন্দ তুলে দিচ্ছেন বনলতা সেন,
বর্ষার প্রথম
কদমফুল হাতে পৃথিবীর প্রথমা নারীর মতো
দাঁড়িয়ে থাকে
একাকী গাছ ভোরের প্রতীক্ষায়
জ্যোৎস্নার
বৃষ্টিতে ভেজে তার ছিপছিপে মায়াবী শরীর।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন