বুধবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২

শ্রাবণী দাশগুপ্ত

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

 

লাল-নীল-পেন্সিল




 

(৩০)

 

সচরাচর মা হোয়াটস্যাপ করে না, ভাবছিল হর্ষ, কথাবার্তা যা হয় ফোনেই। সেদিন কথা বলার বেশ ক-দিন পরে হর্ষর হোয়াটস্যাপে একটি মেয়ের ফোটো পাঠিয়েছে লিপিকা। লিখেছে, ‘আমার বন্ধু মণীষার মেয়ে, ওর নাম শাম্ভবী। পরে তোকে ফোন করবো বাবুল, ছবিটা দেখিস। বাবুল উদাসমুখে দেখল, ভালো দেখতে, শান্ত-শান্ত বাঙালি চেহারা। গুরগাঁওতে আছে, চাকরি পেয়েছে। লিপিকা বেশ ক-দিন ভাবার সময় দিল ছেলেকে, মাঝখানে আর ফোন করল না। হর্ষও করেনি। অল্প চিন্তা হচ্ছিল লিপিকার, কাজটা ঠিক হল? কে জানে কীভাবে নিয়েছে ফোটো পাঠানোর বিষয়টা। মণীষা বিয়ের পর থেকে কল্যাণীতে, সম্প্রতি মেয়ের কাছে। ‘জানাশোনা ভালো ছেলে থাকলে জানাস’ বলে মনীষা ফোটো পাঠিয়েছিল। বেশ লেগেছিল ছবি, আভাস দিলেও কোনো কমিটমেন্ট দেয়নি। ফোটোটা সামনে খুলে খুঁটিনাটি ভাবছিল, চারদিকে চোখ বোলাচ্ছিল, বাবুল আর বৌ এসে থাকবে মাঝে-মাঝে। এঘরে কবেকার সিংগল বেড, পর্দাগুলোও পুরনো। হোম-সেন্টার থেকে পছন্দ করে ফার্নিচার ও ফার্নিশিং-এর বন্দোবস্ত করতে হবে, নতুন পেইন্টে ঝকঝক করবে বাড়ি, কেনাকাটি, নিমন্ত্রণ মনের মধ্যে গুনগুন লিপিকার।

“বাবুলের সুন্দর বউ আসবে। কিন্তু অন্য

শোভন বলল। লিপিকা ঘুরে তাকাল, কখন এসেছে খেয়াল করেনি। শোভনের কথা ঠিকমতো শোনেনি বলে জিজ্ঞেস করল,

“এই কী বলছ? এই দ্যাখো মেয়েটি যথেষ্ট সুন্দর!”

“নাম কী?”

“শাম্ভবী। দ্যাখোছবিটা!”

“আমার ঠাকুমার নাম”।

“এই নাম?”

“হ্যাঁ। ভবানী”।

শোভন ছবিটা একবার দেখে মোবাইল ফিরিয়ে দেয়। অস্থির আনচান, বিছানায় বসে, পা নাচায়, ছটফট করে। ক্ষণিক আলোর ঝলকানি মুছে শোভনের অস্থিরতা লিপিকাকে ভারাক্রান্ত করে ফেলে। শোভন কয়েক মিনিট পর সুস্থির হয়। আবার বলে,

“অন্য একজন”।

“কী বলছ তখন থেকে? বুঝতে পারছি না!”

“বাবুলের কাছে মত নিয়েছো?”

লিপিকা মনঃসংযোগ করে শোভনের দিকে তাকায়, বোঝার চেষ্টা করে। কথাবার্তা সামান্য অসংলগ্ন হলেও প্রশ্নটা সৎ ও স্বাভাবিক। সত্যিই বাবুলের মতামত, পছন্দ ইত্যাদি কোনো বৃত্তান্ত জানা হয়নি। সে নীচু গলায় বলে,

“না। তাই তো একবার,”

“যাওয়া দরকার অবশ্যই”।

বলে শোভন হাসে। লিপিকার হাত থেকে মোবাইল নেয়, আবার ছবি দ্যাখে।

“বউমা? তোমার বউমা? আচ্ছা প্যাস্টেলের সাদারঙ আঁকার কাগজে ফুটবে মনে  হয়? পেন্সিলরঙ তখন ফুটত না। ঠিক বলেছিল মাম্‌পিমাম্‌পি”।

আশ্চর্য ছবি আঁকছে শোভন, অতি প্রত্যক্ষভাবে সময় উঠে আসছে। মোড় ঘুরলে বাগানঘেরা ছোটো একতলা তাদের বাড়ি, সামনে জামরুল গাছ। ছোটো গেট হাট করে খোলা। উঠোনে মাটিতে শোওয়ানো আছে একজন, সাদা কাপড়-ঢাকা আপাদমস্তক। ঠাকুর্দার দু-তিনটে ফোটো ছিল শোভনের দাদার কাছে চেয়ারে ঠাকুরদা, ঠাকুমা, তারা তিনভাই। পাসপোর্ট সাইজের একটা ছবিও ছিল মনে পড়ে আর একটা শেষ অবস্থার এমন ছবি।

মাথার কাছে পুঁটুলির মতো কে বসেছে, পাশে নীল শাড়িতে আর কেউ। শোওয়ানো মানুষের পায়ের দিকে হাঁটু গেড়ে মাথা ঝুঁকিয়ে বসেছে লম্বামতো একজন, এদিক-ওদিক দাঁড়িয়ে তিনটে ছেলে, গেটের কাছে জটলা।

দ্রুত আঙুলে প্যাস্টেল ঘষে, ছোট্ট কাগজের কুচি দিয়ে মিশিয়ে দেয় অসমান অংশ। লিপিকা তার কাঁধে হাত রেখে ডাকে,

“বাবুলের সঙ্গে কথা হল এখন”।

শোভন লিপিকার দিকে তাকায়, সেই দৃষ্টিচোখের পর্দা লাল হয়ে আছে। লিপিকা আলতো ঝাঁকুনি দিয়ে শোভনের মাথাটা নিজের গায়ে টেনে নেয়, অনুযোগ দেওয়ার মতো বলে,

“তেমন কিছু কেন,”

“আমি নিজেকে কষ্ট দিচ্ছি না -- আমি — খুঁজতে অনেক – অলিগলি!”

লিপিকা নীরব থাকে। শোভন আস্তে করে মাথা সরিয়ে নেয়,

“কই বলো?”

লিপিকা সরে দাঁড়ায়, জবাব দেয় না, দু-এক মিনিটে নিঃশব্দ পায়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। শোভন বিড়বিড় করে কী যেন বলে।

পুজোর ছুটির সময়ে হস্টেল থেকে ছোটো ভাই অঞ্জুকে আনতে গিয়েছিলেন বাবা। ফিরে দেখেন, ঠাকুর্দার দেহ তুলসীগাছের নীচে শোওয়ানো।

“প্রকাণ্ড হার্ট অ্যাটাক জানো উপায় ছিল না! আর ওসব জায়গায় চিকিৎসানেই”।

বাক্যটি বলে মুখ ফিরিয়ে শোভন দেখে লিপিকা ঘরে নেই। শোভন দেওয়ালে তাকায় তিরতির করে কাঁপছে সেদিনের শেষ সূর্য। অঞ্জুর ট্রাঙ্ক, বেডিং নামিয়ে বাবা হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছেন শোভন আস্তে করে দাদার হাত ধরে, বিজন শক্ত মুঠো করে ফিসফিস,

“বাবা কাঁদছে!”

তারা জানে বাবা কাঁদে না, বিজু-শোভু কাঁদবে না, রঞ্জু বড়ো হলে আর কাঁদবে না। মা কাঁদে বাবার সঙ্গে ঝগড়া করলে মা কাঁদে, ঠাকুমা বকলে মাও বকে আর কাঁদে, ঠাকুমাও তাই। মেয়েরা কাঁদে, ছেলেরা নয়। শোভু শুকনো চোখে কাঠ হয়ে থাকে। দেখে মা উঠোনে আছাড়ি-পিছাড়ি, ঠাকুমা কেমন অচেতন, ধরে ভেতরে নিয়ে যাচ্ছে কারা। এরপর দাদুর জন্য খাটিয়া এলে কতজন মিলে কাঁধে নিয়ে শ্মশানঘাটে চলল খৈ ছড়াতে ছড়াতে। এতক্ষণে রঞ্জু এসে পাশে দাঁড়িয়ে ডাক দেয়, “ছোড়দা!”

বাবাকে ঘাটফেরত দেখে উথালপাতাল লাগে। মাথা নীচু করে বসে থাকে বাবা, কথা বলে না। ঘিরে থাকে কতজন। ওরা তিনভাই বাচ্চা বেড়ালের মতো গা ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকে। দাদার সর্দারি নেই, রঞ্জু হস্টেলের নতুন গল্প কলকল করে না শোভন তক্তপোষে শুয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। রাত জুড়ে পাশের ঘর থেকে ঠাকুমার গোঙানির শব্দ। অনেক রাতে তন্দ্রামতো আসে, ভোররাতে কেটে যায়। পরিচিত কেমন গন্ধ বাতাস বয়ে নাকে এসে লাগে দাদুর গন্ধ! জানালার বাইরে কাকে দেখতে পায় শোভন, কে যেন হঠাৎ সরে গিয়ে কুয়োতলায় গিয়ে দাঁড়ায়। গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে, তলপেটে প্রবল চাপ লাগে। পাশে ঘুমন্ত দাদাকে ঠেলে, “দাদা রে দ্যাখদাদু ওখানে!”

বিজু জাগে না, বিরক্তভাবে একটু সরে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ে। শোভন খাট থেকে নেমে জানালার পাশে আসে, কুয়োর পাশে আকাশের দিকে তাকিয়ে যে দাঁড়িয়ে আছে সে তাদের শরীরী বাবা, প্রেতযোনি কেউ নন। আলো ফুটেছে আবছা হয়ে আকাশতলিতে। সদ্য পিতৃহারা দীর্ঘ মানুষটি শেষরাতের নরম বাতাসে, আবছা তারাদের নীচে পিতৃতর্পন করেন চোখের জলে। শোভনের বুক গলা পেঁচিয়ে কান্নার ঢেউ আসে। ‘ছেলেদের কাঁদতে নেই’ শিক্ষা ভুলে দু-হাতে জানালার শিক ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। কিন্তু কী কষ্ট, কার জন্য কষ্ট বুঝতে পারে না।

অনেকক্ষণ পরে লিপিকা এসে দেখে, রঙ খাতা সব ছড়িয়ে মধ্যেখানে ঘুমিয়ে আছে শোভন। দু-চোখের কোলে শুকিয়ে যাওয়া জলের দাগ।

 

(ক্রমশঃ)

 

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন