বুধবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২

রাহুল দাশগুপ্ত

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

 

একটি অপরিকল্পিত হত্যার কাহিনী




 

(২১)

 

কয়েকদিন পর হঠাত একটা সুযোগ এসে গেল। হৃদয় মোবাইলে ফোন করতেই বিশ্রুত বলল, আমি একটু বাইরে আছি রে। ফিরতে বিকেল হয়ে যাবে।

হৃদয় আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে সোজা বিশ্রুতর বাড়ি গিয়ে হাজির হল। কলিংবেল বাজাতে দরজা খুলে দিল স্বয়ং বিশ্রুত। বাড়িতে সে একাই ছিল। হৃদয়কে দেখে প্রথমটা একটু চমকে গেল। আবার যেন খুশীও হল একটু। ঠিক বুঝতে পারল না হৃদয়।

হৃদয় সরাসরি জানতে চাইল, তুই এত মিথ্যা কথা বলছিস কেন?

বিশ্রুত একটু চুপ করে রইল। হৃদয়ের অভিযোগকে সে মোটেই অস্বীকার করল না। বরং কেমন যেন বিষণ্ণ হয়ে বলল, সে অনেক কথা।

আমাকে খুলে বল।

বিশ্রুত সবই জানাল। ওই ফুলের বাগানের কাছে যাওয়া নিয়ে ওদের বাড়িতে অশান্তি চলছে। বাবা-মা কেউই চায় না ও এই ধরনের কোনো উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হোক। ওরা  চায় যাতে ও তাড়াতাড়ি নাচের কোর্স শেষ করে মোটা টাকা রোজগার করে। কিন্তু ও নিজে কিছুতেই মনস্থির করতে পারছে না। হৃদয় একটু অসহিষ্ণু হয়ে বলল, কিন্তু তার জন্য এত মিথ্যা কথা বলার দরকার কী ছিল!

বিশ্রুত চুপ করে রইল। হৃদয় এই ব্যাপারটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না। কিন্তু বিশ্রুতর সঙ্কোচ কেটে গিয়েছিল। পরদিন থেকেই ফুলের বাগানের কাজে ও ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।

সাঁঝ পরে বলেছিল, তুই দেখবি, মিথ্যা কথা তারাই বলে নিজেদের চারপাশের মানুষ থেকে যারা নিজেদের লুকোতে চায়। নিজেদের পরিবারে যারা মন খুলে, সহজভাবে মিশতে পারে না। বিশ্রুতর পরিবারে ছোটোবেলা থেকেই একটা দমবন্ধকর পরিবেশ ছিল। মা-টি তো যেমন দাম্ভিক আর স্বৈরাচারী, বাপটি তেমনই ধূর্ত আর মেরুদণ্ডহীন। মা কাজ করে  পোল্ট্রিতে, বাপ বিক্রি করে লটারির টিকিট। টাকা ছাড়া দুজনের কেউ কিছু বোঝে না। বাড়িতে কোনো সাংস্কৃতিক পরিবেশ নেই। এই পরিবেশে মানুষের মনের সুকুমার প্রবৃত্তিগুলি নষ্ট হয়ে যেতে বাধ্য। বিশ্রুতর দাদার যেমন হয়েছে। একটা অমানুষে পরিণত হয়েছে ছেলেটি। বিশ্রুত বরাবরই আলাদা। এই পরিবারে কীভাবে জন্মালো, সেটাই একটা বিস্ময়ের। এই পরিবেশে মানুষ হয়েও নিজের হৃদয়ের সম্পদগুলকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। কিন্তু কোনওদিন নিজের মা-বাবার সঙ্গে মন খুলে, সহজভাবে মিশতে পারেনি। বরং নিজের মনের কথাগুলো মনের ভেতরেই চেপে রাখতে বাধ্য হয়েছে। এই জন্যেই ও এত মিশুকে, বন্ধু খোঁজে সব সময়, তাদের কাছেই নিজেকে প্রকাশ করতে চায়, নিজের ভাব ও ইচ্ছাগুলোকে বিনিময় করতে চায়। কিন্তু মিথ্যা কথা বলা থেকে নিজেকে ঠেকাতে পারে  না। ছোটোবেলা থেকেই একটা অস্বাভাবিক পরিবেশে সে থেকেছে, নিজেকে গোপন করেছে, নিজেকে লুকোনোর জন্য মিথ্যা কথা বলেছে। এটাই হয়ে গেছে ওর মজ্জাগত তাই মেধাবী, হৃদয়বান ও বন্ধুবৎসল হওয়া সত্বেও ও অনায়াসে মিথ্যা কথা বলে যেত, কিছুতেই মিথ্যা বলার এই দুঃখজনক প্রবণতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারত না।

ফিরে আসার পর বিশ্রুত কিন্তু পুরোপুরি পালটে গেল। ফুলের বাগানের জন্য ফুল কিনতে হবে নানা ধরনের। প্রচুর অর্থ চাই। হৃদয় ঠিক করল চাঁদা তুলে এই অর্থ জোগাড় করবে। সারাদিন ঘুরে ঘুরে ও, বিশ্রুত আর নির্মাল্য এই অর্থ জোগাড় করতে শুরু করল। কখনও ও হাঁপিয়ে যেত, পারত না। বিশ্রুত আর নির্মাল্য তখন আগ্নেয় বা অনির্বেদকে নিয়ে বেরোত। সেই সময় হৃদয় দেখেছিল ওর অমানুষিক পরিশ্রম করার ক্ষমতা। ফুলের বাগানের কাজটিকে একটি মহৎ কাজ বলেই ভাবতে শুরু করেছিল বিশ্রুত। এই কাজের প্রতি ওর দায়বদ্ধতা ছিল সবচেয়ে বেশী। অত্যন্ত সৎভাবে এবং নিষ্ঠা ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে এই কাজটি ও করছিল। এই কাজের জন্য গোটা বিশ্বের কাছে ও মিথ্যা কথা বলতে পারত। কিন্তু হৃদয়ের কাছে একটি মিথ্যাও ওর কাছে হয়ে উঠেছিল অসহ্য ও কল্পনাতীত। হৃদয়ের সঙ্গে ওর বন্ধন হয়ে উঠেছিল নিখুঁত, নিখাদ। ফুলের বাগানের কাজের জন্য ও নিজের সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।

এতদিনে হৃদয় একজন বন্ধুর মতো বন্ধু পেল।

বিশ্রুত পরে দিশারীকে বলেছিল, আমার ভিতরে অন্য একটা মানুষ লুকিয়েছিল। সে একটা অন্যরকম জীবন চাইত। সেই জীবন হবে খুব উদার, মুক্ত, রুচিশীল, আর সংস্কৃতিসম্পন্ন। বিশ্বের যা কিছু সুন্দর ও মহৎ, তাকেই সেই মানুষটা স্পর্শ করতে চাইত। এই মানুষটাকে আমি অনুমান করতাম, কিন্তু ঠিক চিনতাম না। হৃদয় সেই মানুষটাকে আমার ভেতর থেকে বার করে এনে তাকে আমার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। জীবনে কখনো সেই মানুষটাকে আমি আর অস্বীকার করতে পারি নি। যখন তাকে ভুলেও থেকেছি, তখন সে আমার পাশে পাশে ছায়াসঙ্গী হয়ে থেকেছে।

ঠিক এই সময়ে একটা ঘটনা ঘটেছিল। ফুলের বাগানের কাজ নিয়ে নির্মাল্যর বাড়িতেও খুব অশান্তি শুরু হয়েছিল। তার বাবাও অত্যন্ত পেশাদার ও জীবিকামনস্ক লোক। ছেলেকে দ্রুত নিজের পায়ে দাঁড়াতে দেখতে চান। ছেলেকে তিনি এমনি এমনি ক্যারাটে শেখাননি। এব্যাপারে তাঁর অনেক যোগাযোগ ছিল। যদিও ছেলেটির মা ছিল সম্পূর্ণ অন্যরকম। কোমল স্বভাবের, আন্তরিক ও শিল্পানুরাগী। তাকে দেখলেই মনে হত, জীবনে তিনি ঠিক সুখী নন। একজন হিসেবি ও স্বার্থপর মানুষের পাল্লায় পড়ে তার সংবেদনশীল মন বিপর্যস্ত হত। পরিবারে তার মতের কোনো গুরুত্ব ছিল না। নির্মাল্যর বাবাকে অগ্রাহ্য করার মতো সাহসও তার ছিল না। মা-র কাছ থেকেই নির্মাল্য পেয়েছিল তার সুকুমার প্রবৃত্তিগুলি। সে ফুল ভালোবাসত। চমৎকার ছবি আঁকত। হাতের কাজ জানত খুব ভালো। কিন্তু তার বাবা চাইতেন ক্যারাটে শিখে ছেলে বিদেশ যাক। প্রতিষ্ঠা পাক।

ফুলের বাগানের জন্য যখন চাঁদা তোলা হচ্ছিল, নির্মাল্য তখন প্রচণ্ড পরিশ্রম করেছিল। বিশ্রুত ছাড়া ওরকম পরিশ্রম আর কেউ করেনি। ওর সেই নিষ্ঠা দেখেই হৃদয় আকৃষ্ট হয়েছিল। একদম ঠিক সময়ে আসত, আর যতক্ষণ থাকত, ততক্ষণই পরিশ্রম করে যেত। আগ্নেয় আর অনির্বেদ ঠিক কাজ করতে চাইত না। সময় কাটাতে আসত। কিন্তু নির্মাল্য ছিল অন্যরকম। বিশ্রুতর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সে অক্লান্তভাবে পরিশ্রম করে যেত। হৃদয় সবচেয়ে বেশী নির্ভর করতে শুরু করেছিল এই দুজনের ওপরেই। এই দুজনেরই সাংগঠনিক ক্ষমতা ছিল সবার চেয়ে বেশী। এই সময়েই হৃদয় ও অনির্বেদ দু-জনেই একসঙ্গে নির্মাল্যের প্রতি তীব্র আকর্ষণ বোধ করতে শুরু করে।  

কয়েকদিন পরে হৃদয় কিছু প্রস্তাব রেখেছিল ওর বন্ধুদের কাছে। সে বলেছিল, আমরা ফুল ভালোবাসি। ফুল পবিত্র ও সুন্দর। আমাদের মনকেও সেরকমই পবিত্র ও সুন্দর করে তুলতে হবে। আর সেটা সম্ভব, যদি আমরা মনকে সম্পূর্ণভাবে সংস্কারমুক্ত করে তুলতে পারি। আমরা শ্রাদ্ধ বাড়িতে ঘটা করে কেন খেতে যাই? একজন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। শোকপ্রকাশের ও শ্রদ্ধা জানানোর নানা রকম ভাষা রয়েছে। আমরা খেয়েদেয়ে উৎসব পালন করি, নুন চিনি নিয়ে দরাদরি করে, এ ব্যাপারটা অত্যন্ত বর্বরোচিত। শ্রদ্ধা থেকে এসেছে শ্রাদ্ধ কথাটা। এইভাবে কি কোনো মৃত মানুষকে শ্রদ্ধা জানানো যায়? আমাদের শ্রাদ্ধবাড়ি যাওয়া বর্জন করা উচিত। এই প্রথা বৈষম্যের প্রতীক। সমাজের সব শ্রেণীর মানুষের এতে অধিকার নেই। যেদিন সেই অধিকার তারা পাবে, সেদিন আমরা নিশ্চয়ই এই অনুষ্ঠানে যাবো। কিন্তু এই বৈষম্যমূলক প্রথাকে আমরা সমর্থন করতে পারি না। ভাইফোঁটা, জামাইষষ্ঠী এসবেও আমার আপত্তি আছে। আচ্ছা, সমস্ত খাতির শুধু ছেলেদের করতে হবে কেন? তাদের জন্য অত অত আয়োজন, আড়ম্বর, সমারোহ কেন? মেয়েদের জন্য পুরুষরা এরকম কিছু করার কথা ভাবে না কেন?     

(ক্রমশঃ) 

 

 

 

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন