ফ্ল্যাশব্যাকে
থিয়েটার পাঁচালি : রবীন্দ্রনাথ
প্রতি,
থিয়েটারের জন্যে কতজন কতকিছু করেছেন। অনেকেরই নাম সময় ডটকমে
হারিয়ে গিয়েছে। খুব কম সেই ধারায় রয়েছেন, যাঁদের নাম থিয়েটারের সঙ্গে সঙ্গে মুছে
যায় না। এমন দুই নাট্য প্রতিভা এবারের ফ্ল্যাশব্যাকে। দ্বৈত ভূমিকায় রয়েছে
রঙ্গালয়। একদিকে রয়েছেন স্বনামধন্য কবি ও নাট্যকার রবীন্দ্রনাথ, যেখানে সময় খুঁজে পায় এমন এক সত্তাকে, যিনি সাহিত্যের
প্রতিভা। আবার নাটকেরও। যিনি সাহিত্যের বহুভুজ শালপ্রাংশু। যদিও আলোচনা নাটকের,
মঞ্চের, অভিনয়ের। তবুও একজন বিশেষ হয়ে তাঁর অবদান কালের মাত্রা ছাপিয়ে ওঠে। তাঁর
লেখা নাটক, নৃত্যনাট্য, গল্প, উপন্যাস, এমনকি কবিতা, চিঠিপত্রও নাট্যরূপ নিয়ে
উপস্থাপনার বিষয় হয়ে উঠেছে। তাঁরই অবদানে এক রঙ্গালয় বেঁচে গিয়েছিল। তাই তাঁর
ইতিহাস লেখা যাচ্ছে। বিশ শতকের রঙ্গালয়ের
ইতিহাস তাই ইতিহাস শুধু নয়। আর ফ্ল্যাশব্যাকে থিয়েটারের অলিন্দে ঘুরলে এত তারিখের
একটি নাম ও তারিখ হয়ে রয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। নাট্যকার রবীন্দ্রনাথ। নাটকের
প্রযোজনার তারিখ সাধারণ রঙ্গালয়ের সঙ্গে যুক্ত। যেখানে রঙ্গালয় যুগের অবসান হলেও,
রবীন্দ্রনাথ নাট্যকার যুগ পেরিয়ে বর্তমান ও আধুনিকতম বিশেষ। এবারে রঙ্গালয়ে মানে
বোঝা গেলেও, সাধারণ রঙ্গালয় মানে বোঝাতে হবে। থিয়েটার যা ছিল সাধারণ দর্শকের
জন্যে। থিয়েটার বরাবরই সাধারণ দর্শকের জন্যেই ছিল। কিন্তু সাধারণ দর্শক তখন কোথায়,
কীভাবে রয়েছে! এক, তাঁরা কীভাবে, থিয়েটারে আসবেন। থিয়েটারের স্থান কোথায় -- সেটা তো কলকাতায়। তাহলে? গ্রামের মানুষ
আসবেন কীকরে? কোথা থেকে আসবেন - প্রচার কীভাবে জানবেন, কী নাটক চলছে!
যে দুই কারণে থিয়েটার বা যে কোনও কাজের প্রচার চাই। বস্তুত
অধিকন্তু ন দোষায় হলেও একুশ শতকের প্রচারের ধারে কাছেও ছিল না তখনকার প্রচার।
নাটকের কথা দর্শক জানতেন মুখে মুখে। আর সংলগ্ন এলাকায় লিফলেট বিলি করে। পত্রিকায়
বিজ্ঞাপন দিয়ে। কিন্তু সাধারণ মানুষের জন্যে নাটকের রঙ্গালয় কতটা কাছের। কারণ,
বাংলার দর্শকের বেশি পছন্দের যে যাত্রাপালা – সেকথা নাট্যমঞ্চ চালাতে গিয়ে বারবার
উপলব্ধি করেছেন নাটকের কর্তাব্যক্তিরা। যথা, গিরিশচন্দ্র ঘোষ মহাশয় থেকে আধুনিকতম
সময়ের নাট্য-নির্দেশক অভিনেতা নাট্যকার উৎপল দত্ত। অর্থাৎ, এই এক প্রবণতা টের
পাওয়া যাচ্ছে। দর্শকের অবস্থান কীভাবে কোথায় বুঝতে তৎকালীন সময়ের সমাজ সময়
উল্লেখের।
বিশ শতকের ওই সময় তো বিশেষ টালমালাট। কলকাতার
বাজার-অর্থনীতি, নাটকের চেয়েও আরও কোনদিকে চলে যাচ্ছে। ফলে, নাটকে আর তেমন টাকা
লাগাচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা। তাহলে সাধারণ রঙ্গালয় কেন সাধারণ, তা বুঝতে আরও কিছু
শব্দ সময় খরচ করতে হবে। সাধারণ কি তার উপস্থাপনা ছিল। নাকি সাধারণ-এর জন্যেই এমন
নামকরণ। না, উপস্থাপনা সাধারণ মানের করতেও একটা নাটকের আয়োজন যে বিপুল। তা স্বীকার
করবেন যাঁদের নাটক প্রযোজনা চালানোর সরাসরি অভিজ্ঞতা রয়েছে। আর এর মানে বিপুল
অর্থের আনয়ন। আর তার জন্যেই ঋণগ্রস্ত
থিয়েটারের ইতিহাস। আর তাই রঙ্গালয়ের ফ্ল্যাশব্যাকে বারবার যেতে হয়। যেমন, ১৯৫৪ সাল। শিশিরভাদুড়ী মহাশয় ঠিক করলেন তিনি ‘তপতী’
নাটক মনস্থ করবেন। অর্থাৎ,
বোঝা যাচ্ছে, কাহিনির প্লট তাই স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ নন, রবীন্দ্রনাথের থিয়েটার। রবীন্দ্রনাথ
ততদিনে অনেক নাটক লিখেছেন।
ফ্ল্যাশব্যাকে গেলে মিলছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই সময়ে ‘প্রজাপতির
নির্বন্ধ’ নাট্যরূপ দিয়েছেন। যা চেনা নাটক ‘চিরকুমার সভা’ নামে। নাট্যকারের
স্বাধীনতা সবসময় থাকে যে, তিনি কাকে তাঁর
নাটক করতে দেবেন। ফ্ল্যাশব্যাকে ১৯৩৩ সালের ইতিহাস থেকে জানা যাচ্ছে। যে, নাট্যকার
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর নাটক দেবেন নতুন এক বাঁচতে চাওয়া থিয়েটারকে। লড়াই করার পর
যে ছাই বা অবশেষ থেকে গড়ে উঠতে চাইছে আরেকটা থিয়েটার। এমনই এক থিয়েটারের আন্তরিকতা
বেছে নিলেন নাট্যকার রবীন্দ্রনাথ। তাঁর ঝুলিতে অনেক
নাটক। তাঁর ঝুলিতে খুব জনপ্রিয় নাটক ‘রাজা
ও রানী’। ‘চিরকুমার সভা’। ‘গৃহপ্রবেশ’। ‘বশীকরণ’।‘বিদায় অভিশাপ’।‘শোধবোধ’। ‘চিত্রাঙ্গদা’।
‘পরিত্রাণ’। ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’। চলছে। রবীন্দ্রনাথ যে নাট্যকার সেটাও
প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু ট্র্যাজেডি হল এই যে, শিশিরকুমার
ভাদুড়ি ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যুগলবন্দী হয়নি।
১৯২৩ সাল। শুরু হল আর্ট থিয়েটার। একই বাড়ি, শুধু
নাম নতুন। স্টার থিয়েটার থেকে আর্ট থিয়েটার। ১৯২৩ সাল থেকে ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত আর্ট থিয়েটার
চলেছিল। কিন্তু ওই যে ট্র্যাজেডি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন শিশির ভাদুড়িকে নাটক না দিয়ে,
দিলেন আর্ট থিয়েটার-এর শিল্পীদের। তখন আরও নাট্যকারদের নাটক চলছে রঙ্গালয়ে। অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, মন্মথ রায়, নির্মলশিব বন্দ্যোপাধ্যায়,
অমৃতলাল বসু, সৌরীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় প্রমুখের। এসময়ে সবচেয়ে বেশি যাঁদের নাটক চলছিল,
তাঁদের মধ্যে অপরেশচন্দ্রের নাম বারবার ফিরে আসছে। নাটকের এমত সময়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর
লেখনীপ্রসূত নানান নাট্যরূপ দিয়ে চলছে। আর পৃথিবী জুড়ে চলেছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ১৯১৪
সাল থেকে ১৯১৮ সাল। জাতীর জীবনে যেমন এর প্রভাব পড়েছে, তেমনই তখনকার কলকাতার নাট্যালয়ে।
ব্যবসা চলছে না। রঙ্গালয় বন্ধ হচ্ছে। কীভাবে চলতে পারে, তাই দর্শক টানার চেষ্টায় রঙ্গালয়
কর্তৃপক্ষ। এরই মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রয়েছেন জনপ্রিয়তায়। কারণ, আর্ট থিয়েটার জনপ্রিয়
হচ্ছে। ফলে, ১৯২৩ সাল থেকে রবীন্দ্রনাটকের প্রযোজনা শুরু হয়। এবং যা সাধারণ রঙ্গালয়
পেরিয়ে গেলেও চলছে।
এখানেই এবারে ফের ফ্ল্যাশব্যাক। এই যে এতদিন
যাঁরা এই সিরিজ পড়ছেন, তাঁরা বুঝে গিয়েছেন যে, দর্শকের সঙ্গেই নাটকের চলা না চলা, হিট
নাটক আর মার খাওয়া। দর্শক নাটকের তিন মাত্রার এক মাত্রা। যেখানে নাটকের বৃত্ত সম্পূর্ণ
হবে না, যদি না রঙ্গালয়ের নকশার একের তিনভাগে দর্শক না থাকেন। ফলে, বোঝাই যায়, শিল্পের
চেষ্টা সফল হয়ে ওঠে দর্শকের সান্নিধ্যে। সেই দর্শকের কাছে পৌঁছে গেল রবীন্দ্র-নাটক,
রবীন্দ্র ভাবনা। এর মূলে রইলেন অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। নিজে উদ্যোগ নিয়েই তো চালিয়ে
ছিলেন আর্ট থিয়েটার। এখানেই একটা সম্পৃক্ততা তৈরি হয়। শিল্প, শিল্পী, নাট্যকার এবং
রঙ্গালয়ের ইতিহাস তৈরি হয়। আবার প্রশ্ন তো ওঠে স্টার থিয়েটার নাম দিয়ে কেন চলল না।
কেন আর্ট থিয়েটার নাম নিতে হল। একটা কারণ এও হতে পারে স্টার থিয়েটার শুধু বাণিজ্যে
নয়, তার কালিমালিপ্ত ইতিহাসেও বাণিজ্যের সেই তুখোড় মাত্রা ধরে রাখতে পারে না। ঘটনা
হল তাই যে, নাটকের পরিচালকমণ্ডলী ঠিক করলেন যে, নতুন নাম নতুন চিন্তা নিয়ে আত্মপ্রকাশ
করছে। এরই নেপথ্যে আরও একজন রয়েছেন অদৃশ্য নটী। যিনি দূরত্বে থেকে অবলোকন করছেন স্টার।
এখানেই রঙ্গালয়ের শেষ দৃশ্য কিনা। তাই, যেখানে
নতুন নামের থিয়েটারকে রবীন্দ্রনাথ তাঁর নাট্যরূপ দিচ্ছেন। এবং শিশিরকুমার নন, অপরেশচন্দ্র
মুখোপাধ্যায়কে তিনি ভরসা করছেন। পরের ইতিহাস তো জানা, নাট্যকার সফল হলেন, সঙ্গে নাটকও
রয়ে যায় ইতিহাসের প্র গবেষণার জন্যে। না দর্শকের জন্যে পাঠের বিষয় হয়ে। এমনই নাটকের
ইতিহাসে ১৯৩৩ সালে আর্ট থিয়েটার বন্ধ হবে। ওই একই সালে অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় চির
বিদায় নেবেন। তাঁর মৃত্যু ১৯৩৪ সালের ১৫ মে। আর রবীন্দ্রনাথের নাটকে তিনি অভিনয়ও করলেন।
ভূমিকা লেখার আগে, নাটকের নাম লেখা প্রয়োজন। সেই চিরস্মরণীয় নাটক ‘চিরকুমার সভা’। তিনি
রসিক- চরিত্রের ভূমিকায়। এখানেই শেষ নয়, আরও উল্লেখের যে, রবীন্দ্রনাথ এই নাটকের প্রযোজনার
অংশও হয়ে ওঠে। যেমন, তাঁর কথানুসারে গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর নাটকের মঞ্চসজ্জা, দৃশ্যপট
মানে সেট, করে দেন। আর গানের সেই সাধক দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুর গান লিখে দেন।
অর্থাৎ, এও বলা যায় যে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরের
আর্ট থিয়েটার দ্বারা নাটকের রবীন্দ্রনাথ সাধারণ রঙ্গালয়ের একজন হয়ে ওঠেন। আবার, এ এক
সময়ান্তর যে, নাটকের সঙ্গে সঙ্গে থিয়েটার টেকে না। ইতিহাস বয়ে চলে, এই নাটকের দ্বারা
একদিকে অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, অন্যদিকে শিশির
ভাদুড়ী – উভয়েই রবীন্দ্র-নাটকের প্রযোজনা
করে থাকেন। বলা যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রত্যক্ষ সমর্থন ছিল বলেই প্রযোজনা সার্থক
রূপ পায়।
সেখানে ফের যতক্ষণ শিশির ভাদুড়ী রইলেন, ততক্ষণ রবীন্দ্র-নাটকের
প্রযোজনা চলতে থাকে। যেমন, ১৯৪১ সালের ৭ আগস্টে তিনি প্রয়াত হলেন। কিন্তু শিল্প নাটক
যা তিনি রেখে গেলেন – তা চলতে থাকে।
আর সেসময়ের পত্রিকায় রবীন্দ্র-নাটকের প্রযোজনা
সুখ্যাতি হয়। আর স্টার থিয়েটার ফের নিজের নাম ফিরে পাবে কিনা, তা চলতে থাকে তারিখের
সঙ্গে সঙ্গে। কিন্তু থিয়েটারের সঙ্গে সঙ্গে আসেন নতুন নাট্যকার নাতুন নামে। বা, কখনও
কালের উত্তীর্ণ হয়ে নাট্যকার নতুন প্রযোজক নতুন অভিনেতার সঙ্গে সঙ্গে জন্ম নেন। যা
শিল্পের ধর্ম। শিল্পের প্রকাশ কালের নিয়মে নবতম সংযোজনে পুনরায় আলোচিত হয়ে থাকে। যাকে
জাঁক দেরিদার চেনা তত্ত্ব জনপ্রিয় তাত্ত্বিক নামে ডাকে বিনির্মাণ তত্ত্ব। সেখানেই নাটকের
উত্তরণ ঘটে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আগামি নাট্যকারদের সঙ্গেও রইলেন। এই ধারাতেই পরবর্তীতে
নাটকের অভিনয়ে আসেন আরও অভিনেত্রীরা। আর প্রাজ্ঞ নাট্য-নির্দেশক অভিনেতা শিশিরকুমার
ভাদুড়ি চেষ্টা করতে থাকেন রবীন্দ্র-নাটক প্রযোজনার।
সেখানে গিয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন সাধনা রায়চৌধুরীরা দুই বোন। শিশির ভাদুড়ি চেয়েছিলেন
যে, রবীন্দ্রনাথের সংলাপ যথাযথ বলতে পারা ভালো অভিনেত্রীর সন্ধানে ছিলেন। সম্পাদক কাজল
সেন-এর ‘কালিমাটি অনলাইন’ আন্তর্জালিক মাধ্যমে এবারের কিস্তিতে #রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর # সাধারণ রঙ্গালয় #থিয়েটার।
সঙ্গে উল্লেখের যে, সংলাপ শেষ হলেও নাটকের কাজ চলছে থাকে। ওই যাকে বলে রেশ।
সেই রেশ যা থিয়েটার হল থেমে গেলেও, ব্যবসায়িক পুঁজি সরে গেলেও চলতে থাকে। কারণ,
সময় একমাত্রা, অভিনেতা দুই মাত্রা। আর
তৃতীয় মাত্রায় দর্শক থাকলে, চতুর্থ মাত্রায় নাট্যকার# রবীন্দ্রনাথ। সংযোজিত
অভিযোজিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কোন এক কালের মধেয় তো থাকেন না, সর্বাত্মক হয়ে ওঠেন
নাট্যগুণে। এবং, আন্তর্জাতিক আন্তর্জালিক মাধ্যমে কবিগুরু ও নাট্যকার রবীন্দ্রনাথ
রইলেন গুচ্ছ নাটকের সমারোহে। প্রাপ্তি ঘটে এই যে একুশ শতকে রবীন্দ্রনাথ নাট্যকাররূপে
এক বিশেষ কিস্তিমাত করছেন। এবং সেদিনের মতনই একুশ শতকের ক্ষয় হতে থাকা নাটকের
ইচ্ছুক শিল্পের সঙ্গত দিতে থাকে। কারণ, তিনিই যে নিজেই এক মাত্রা।
একুশ শতকের ফ্ল্যাশব্যাক সত্ত্বাধিকারী … ০৯ ০৯
২০২২ শান্তিনিকেতন
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন