প্রাচীন ভারতে শূদ্রেরা
(অনুবাদ: চন্দন দত্ত)
(নিম্নতর বর্গের আনুমানিক ৬০০ খৃষ্টাব্দের
পূর্বেকার এক সামাজিক ইতিহাস। ভারতের প্রথম সারির ইতিহাসবিদদের মধ্যে অন্যতম, প্রয়াত
শ্রদ্ধেয় রামশরণ শর্মা দ্বারা লিখিত ‘SUDRAS IN ANCIENT INDIA -- A Social history
of the lower order down to circa AD 600’ নামক প্রসিদ্ধ গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ।)
*অধ্যায়
- ২ / ৬*
*উৎস (Origin)*
অবশেষে শূদ্র উপজাতিও সামরিক ক্রিয়াকলাপ সম্পাদিত করেছে, যেমনটি আর্য উপজাতি ও তাদের উপজাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলি করেছিল। মহাভারতে, আমবাস্থা (Ambastha), সিবিস (Sibis), সুরসেনা (Surasena) ইত্যাদির সাথে শূদ্র জনসাধারণের সৈন্যবাহিনীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্ত সেটি শূদ্রদের সমগ্র উপজাতিকে ক্ষত্রিয় বর্ণে রূপান্তরিত হওয়ার দোষারোপ করতে পারেনি, যেমনটি আমরা জেনেছি, তার সমস্ত সুসঙ্গায়িত ক্রিয়াকলাপ ও বিশেষাধিকার সমূহ সম্পর্কে। কাজেই এই তত্ত্ব, যে ক্ষত্রিয়রা শূদ্রদের অবস্থানে হ্রস্বীকৃত হয়েছিল, কষ্টকরভাবেও প্রশংসিত হওয়ার যোগ্য নয়।
শূদ্র শব্দটির একটি বুৎপত্তিগত শিক্ষা দানের এই প্রচেষ্টা, চতুর্থ বর্ণের সৃষ্টিকালীন সময়ের অবস্থাকে প্রতিফলিত করতে এবং বর্ণের উৎপত্তিগত সমস্যাটিকে বিস্তারিতরূপে ব্যাখ্যা করতে কষ্টকরভাবেও কোনো সাহায্য করতে পারেনি। সবচেয়ে প্রাচীন একটি প্রচেষ্টা দেখা গিয়েছে বদরায়নের (Badarayana) বেদান্ত-সূত্রে (Vedanta-sutra), যেখানে শব্দটিকে দু'ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে --- সুক (suk), অর্থাত বিষাদ (grief) এবং দ্র্যা (dra), যেটি দ্র্যু নামক শিকড় থেকে উদ্ভুত, যার অর্থ ধাবিত হওয়া। এই রচনাংশের (passage) ওপর মন্তব্য প্রসঙ্গে শঙ্কর (Sankara), জনশ্রুতিকে (Janasruti) কেন একজন শূদ্র বলা হয়েছিল, তার তিনটি বিকল্প ব্যাখ্যা প্রস্তুত করেছেন --- (১) সে বিষাদের দিকে তীব্র বেগে অগ্রসর হয়েছিল (Sucam abhidudrava), (২) বিষাদ তার দিকে তীব্র বেগে অগ্রসর হয়েছিল (Sucava abhidudruva), এবং (৩) সে বিষাদগ্রস্থ হয়ে তীব্র বেগে রাকিভা'র দিকে অগ্রসর হয়েছিল (Sukava rakivam abhidudruva)। শঙ্কর এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে, শূদ্র শব্দটিকে অনুধাবন করা যেতে পারে একমাত্র এর উপাদানগুলির (Components) অর্থ ব্যাখ্যা করার মাধ্যমে এবং কখনোই অন্য কোনো ভাবে নয়।
বদরায়নের শূদ্র সম্পর্কিত শিক্ষাদীক্ষা এবং তার উপর শঙ্করের টীকাটিপ্পনী, অ-সন্তোষজনক হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। কথিত আছে, শঙ্করের জনশ্রুতি থেকে উল্লেখসমূহ চালিত হয়েছিল মহাভ্রাসা-দের মধ্যে, যাদের সম্পর্কে অথর্ববেদে বলা হয়েছে যে তারা ছিল দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতের বাসিন্দা। এটি সন্দেহজনক যে তারা শূদ্র বর্ণের মধ্যেই অবস্থান করত কি না। তারা হয় শূদ্র উপজাতির মধ্যে অবস্থান করত অথবা অন্য কোনো দক্ষিণ-পশ্চিমী জনসাধারণের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল, যারা ব্রাহ্মণ্যবাদী লেখকদের দ্বারা শূদ্র খেতাবে ভূষিত হয়েছিল।
পানিনি'র (Panini) ব্যাকরণে উনাডি-র উত্রাস (Unadi-s utras)-এর লেখক, শব্দটির অত্যন্ত অনুরূপ একটি উৎপত্তির বিবরণ দিয়েছেন, যেখানে শূদ্র শব্দটি পুনর্নির্ণীত হয়েছে দুটি উপাদানে, --- 'শুদ' এবং 'রা' অর্থাত শুদ + রা। প্রত্যয় 'রা'-এর কারণ দর্শানো কঠিন এবং এক্ষেত্রেও উৎপত্তির বিষয়টি মনে হয় কল্পনাপ্রসূত এবং অস্বাভাবিক।
পুরাণের ব্রাহ্মণ্যবাদী পরম্পরাও শূদ্র শব্দটিকে তার মূল 'শোক' (suc)-এর সাথে সংযুক্ত করেছে, যার অর্থ হতে পারে মনঃক্ষুন্ন হওয়া। এখানে বলা হয়েছে যে, "যারা শোকাকীর্ণ (grieved) ও পলায়নরত এবং হস্তসাধিত কাজে (manual task) আসক্ত হয়েছে তথা গৌরবহীন ও ক্ষীণ-দুর্বল, তারাই শূদ্র। কিন্ত শূদ্র শব্দটির এই ব্যাখ্যান, বুৎপত্তিগত শিক্ষা প্রদান করার পরিবর্তে বরং বর্ণটির পরের দিককার সময়ের অবস্থানকে প্রতিফলিত করেছে।
এই লক্ষ্যে, শব্দটির বৌদ্ধধর্মের ব্যাখ্যানও ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অনুরূপ এবং ততটাই কল্পনাপ্রসূত বলে মনে হয়েছে। বুদ্ধের মতানুসারে -- 'তারা, যারা ত্রাস সৃষ্টিকারী ও নীচ আচরণকারী মনোবৃত্তি সম্পন্ন ছিল, তাদেরই শূদ্র বলা হয়েছে', এবং এইভাবেই অস্তিত্বে এসেছে শূদ্র শব্দটি। গোড়ারদিকের মধ্যযুগীয় বৌদ্ধ শব্দকোষে, শূদ্র শব্দটি ছিল ক্ষুদ্র (ksudra) শব্দের সমার্থক, এবং এর ভিত্তিতে প্রস্তাবিত করা হয়েছে যে, শূদ্র শব্দটি উদ্ভুত হয়েছে ক্ষুদ্র থেকে। দুটি প্রতিবেদনই দার্শনিক দিক থেকে অ-সন্তোষজনক, কিন্ত প্রাচীন যুগের শূদ্র বর্ণের সাথে জড়িত ধারনাগুলির যে ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়েছে, সেগুলি গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে ব্রাহ্মণ্যবাদী প্রতিবেদনটি যেমন শূদ্রদের শোচনীয় অবস্থার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, বৌদ্ধ পরম্পরাগত মতবাদও সেক্ষেত্রে, সমাজে তাদের নীচ ও নিকৃষ্টতর অবস্থার উল্লেখ করেছে। বিদ্যমান সামাজিক অবস্থা কিভাবে বুৎপত্তিগত ও ভাষাবিদ্যাগত ব্যাখ্যাগুলিকে প্রভাবিত করেছে, প্রতিবেদন-দুটি সেইসব দেখাতে নিছকই ব্যার্থ হয়েছে। একজন সাম্প্রতিক লেখক শূদ্র শব্দটিকে আহরিত করেছেন তার মূল 'সুই' (sui) অর্থাত স্ফীত + মূল 'দ্র্যা' অর্থাত ধাবিত হওয়া থেকে এবং প্রস্তাবিত করেছেন যে এর অর্থ 'এমন একজন যে স্থূল জীবনের প্রতি ধাবিত হয় ; সেইজন্য তাঁর মতে, শূদ্রেরা ছিল কায়িক শ্রমের যোগ্য স্থূলবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ। এটি অস্বাভাবিক, তাঁর উচিত ছিল দুটি মূল থেকে শূদ্র শব্দটি আহরিত করা, এবং সেটিও কোনো বুৎপত্তিগত ভিত্তি ব্যতিরেকেই। এই শব্দটির ওপর তিনি যে অর্থ আরোপিত করতে চেয়েছেন, তার দ্বারা শূদ্রদের সম্পর্কে বিদ্যমান পরম্পরাগত মনোভাবের প্রতি কেবল বিশ্বাসঘাতকতাই করা হয়েছিল, কিন্ত তাদের উৎসের প্রতি কোনো আলোকপাত করা হয়নি।
শূদ্রদের উৎসকালীন সময়কার শোচনীয় ও উপেক্ষনীয় সামাজিক মর্যাদা কষ্টকরভাবেও বর্ণিত হয়নি ঋগবেদ ও অথর্ববেদ-এর সামাজিক চিত্রে। সংকলনগুলির কোনো জায়গায়ই দাস এবং আর্যদের মধ্যে অথবা শূদ্র এবং উচ্চতর বর্ণের মধ্যে বিবাহ বা খাদ্য সম্পর্কিত কোনো বিধিনিষেধের প্রমাণ নেই। একমাত্র প্রাচীন উল্লেখটি, যা এই ধরনের সামাজিক দূরত্ব সম্পর্কিত অর্থপ্রকাশ করেছিল, তা দেখা গেছে অথর্ববেদ-এ, যেখানে এটি দাবি করা হয়েছে যে রাজন্য ও বৈশ্যদের তুলনায় ব্রাহ্মণেরা, যে কোনো নারীর প্রথম স্বামী হওয়ার অধিকার ভোগ করে। শূদ্রেরা সেক্ষেত্রে এই বিবেচনায় স্থান পায়নি, কারণ সম্ভবত এই বর্ণটি সেই স্তরে কখনো অস্তিত্বেই আসেনি। আর তাই, দাসেরা বা শূদ্রেরা অশুদ্ধ ছিল বা তাদের ছোঁয়ায় উচ্চতর বর্গের খাদ্য বা শরীর অপবিত্র হয়ে যেতো, এমন কোনো কিছুও দেখানোর মতো ছিল না।
শূদ্র বর্ণের উৎস সম্পর্কিত আলোচনাটিকে সার-সঙ্কলিত করা যেতে পারে এই ভাবে যে, আর্য এবং প্রাক-আর্য জনসাধারণের একটি বিরাট অংশ এই অবস্থানে হ্রস্বীকৃত হয়েছিল অংশত বাহ্যিক ও অংশত আভ্যন্তরীণ সঙ্ঘাতের কারণে। যেহেতু সঙ্ঘাতগুলি কেন্দ্রীভূত ছিল প্রধানত গবাদিপশু এবং পরবর্তীতে সম্ভবত জমি ও জমির উৎপাদ-এর ওপর দখল কায়েম করার প্রশ্নে, সেহেতু যারা এই সমস্ত কিছু থেকে দখলচ্যুত হয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছিল, তারাই নতুন সমাজে পরিগণিত হয়েছিল চতুর্থ বর্ণ হিসেবে। এমন অভিমত, যে শূদ্র বর্ণ গঠিত হয়েছিল প্রাক-আর্যদের মধ্য থেকে, সেটি মনে হয় পক্ষপাতদুষ্ট এবং একই সাথে আরেকটি কল্পিত অভিমত যে তারা সঙ্ঘবদ্ধ হয়েছিল প্রধানত আর্য জনসাধারণের মধ্য থেকে, সেটিও তারই মতো অতিরঞ্জিত। এই সমাজবিদ্যাগত তত্ত্ব যে, সমাজের শ্রেণী-বিভক্ত হওয়ার বিষয়টি সবসময়ই জাতিগত বৈষম্যের সাথে জড়িত, সেটি কেবলমাত্র আংশিক ভাবে শূদ্র ও দাসেদের (ক্রীতদাস) উৎস সম্পর্কে অবগত করে। এটি অধিক সম্ভাব্য যে, দাসেরা এবং শূদ্রেরা যথাক্রমে নামাঙ্কিত হয়েছে তাদের উপজাতির নাম অনুসারে, যাদের সম্বন্ধ ছিল ইন্দো-আর্যদের সাথে, কিন্ত সময়ের সাথে সাথে তারা প্রাক-আর্যদের বৃহৎ গোষ্ঠীগুলিকে নিজেদের বর্ণে অন্তর্ভুক্ত করেছিল এবং আর্য জনসংখ্যাকে সংখ্যাগত দিক থেকে অধঃপতিত করেছিল, যাদের দাস বা শূদ্র উপজাতির সাথে কোনো জাতিগত সংযোগ ছিল না। এটি যুক্তিসঙ্গত ভাবে পরিষ্কার বলে মনে হয় যে ঋক-বৈদিক সমাজে পরিচয়যোগ্য কোনো শূদ্র-ক্রম ছিল না। যেহেতু এটি প্রধানত একটি উপজাতীয় ও যাযক সম্প্রদায়-ভুক্ত সমাজ ছিল, যার সামরিক প্রধান ও তার যাযকীয় সমর্থকেরা, তাদের উপজাতীয় সর্দার এবং অন্যান্যদের কাছ থেকে তেমন অধিক পরিমাণ উদ্বৃত্ত-উৎপাদ ও কাজের লোক, বলপূর্বক আদায় করতে পারতো না, যাতে তারা নিজেদের ক্রীতদাসতুল্য পদমর্যাদার ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন সাধিত করতে পারে। উপজাতীয় লোকেদের কাছ থেকে প্রাপ্ত শ্রদ্ধার্ঘ ও বলপূর্বক আদায় করা যুদ্ধ-জঞ্জাল সমূহ ইত্যাদি যা কিছু সংগৃহীত হতো, সেগুলির পুনর্বন্টন করা হতো জ্ঞাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে, উপজাতীয় সমাহারগুলিতে। প্রধানদের দ্বারা দখলীকৃত ঘোড়া, রথ ও ক্রীতদাস, সামাজিক শ্রেণীর কল্যাণের চেয়ে বরং তাদের ব্যক্তিগত পদ-মর্যাদা বৃদ্ধি করেছিল। একটি ক্রীতদাসতুল্য শ্রেণী সৃষ্টি করার প্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কেবলমাত্র পরেরদিকের বৈদিক পর্যায়ে, যখন মেষপালন ব্যবস্থা, কৃষিকাজ-কে এবং রাখালী যাযাবর বৃত্তি, বৃহদাকার জনবসতি ব্যাবস্থা-কে জায়গা ছেড়ে দিয়েছিল, যেমন দেখা গেছে অঙ্কিত ধূসর মাটির পণ্যসামগ্রী-সমৃদ্ধ স্থানগুলিতে এবং পরবর্তীতে বৈদিক রচনাসমূহে।
(ক্রমশ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন