বুধবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২

ব্র্যাড ওয়েইসম্যান

 

Ôএক কবির শোণিত (জাঁ ককতো, ১৯৩২)

(ভাষান্তর: অদিতি ফাল্গুনী)




১৯৬৩ সালে মৃত্যুর দুই বছর  আগে, বিখ্যাত ফরাসী কবি ও চলচ্চিত্রকার জাঁ ককতো ২০০০ সালের উদ্দেশ্যে ভাষণ শিরোনামে সেলুলয়েডে তাঁর সৃষ্টি প্রক্রিয়া সম্পর্কে নিজস্ব ভাবনা-চিন্তা ব্যক্ত করেন। এই আলোচনায় দৈনন্দিনের জাঁ ককতো এবং শিল্পী ককতোর ভেতর তিনি একটি সীমারেখা টানেন। এই আলাপনে তিনি বলেন, Ôএকজন কবি যেন সেই কাজের হাত যে তার নিজের চেয়েও গভীরতর কোন কর্মে লিপ্ত হয়, যে কাজ সে নিজেই খুব ভাল জানে না, এক রহস্যময় শক্তি তাকে অধিকার করে রাখে এবং যে শক্তি সম্পর্কে সে নিজেই ভাল জানে না!’

ককতোর অর্ন্তনিহিত এই দ্বিধা-বিভক্তি তাঁর ‘অর্ফিক ট্রিলজি’-র সিনেমা ত্রয়ীতে ফিরে ফিরে আসে। এবং এই ট্রিলজির প্রথম সিনেমাই হচ্ছে ‘এক কবির শোণিত বা লো স্যাং দ্যুন পোয়েত (Le Sang d’un poète- The Blood of a Poet) | ট্রিলজির বাকি দু’টো ছবি হচ্ছে Ô Orphèe-1950’ Ges ‘Le testament d’Orphée- 1960|Ô প্রতিটি সিনেমাতেই মৃত্যু যেন স্বপ্ন ও দৃশ্যরাজির রাজ্যের অপরিহার্য দুয়ার হয়ে দাঁড়ায়, আর সেই রাজ্যে প্রবেশ করতে হলে ব্যক্তির সচেতন সত্ত্বাকে বাদ দিয়েই কেবল ঢুকতে পারা যাবে। ‘এক কবির শোণিত’ পরিচালক ককতোর নির্জ্ঞান মানসের অনিয়তাকার ভূদৃশ্যে প্রথম অভিযান, যেন বা মানব অবচেতনের পাতাল কুঠুরি খুঁড়ে সম্ভাব্য অর্থ দ্যোতনার মহামূল্যবান রত্নরাজি বের করে আনা। এই সিনেমায় প্রদর্শিত চিত্রকল্পগুলো  ককতোর কর্মজীবনে বারবার ফিরে আসবে। ফিরে আসবে আরো পরিশীলিত হয়ে।

ÔLe Sang d’un poète  নির্মাণের সময়ে ততদিনে ককতো ফরাসী সংস্কৃতির ‘বিপজ্জনক শিশু (enfant terrible)’ হয়ে উঠেছেন। কবি, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, ভিজ্যুয়াল আর্টিস্ট, নকশাকারসহ বহুমাত্রিক পরিচয়ে তিনি ইতোমধ্যেই পরিচিত। আধুনিক ফরাসী সঙ্গীত সুরকারদের দল ‘ছয়জনা - Les six’-কে তিনিই জনপ্রিয় করে তোলেন। এই ছয় সুরকার ছিলেন ওরিক, দ্যুরে, হোনেগের, মিলহৌদ, প্যুলেন্স এবং তেইলেফেরে। এঁদের মধ্যে ওরিক ‘এক কবির শোণিত‘-এর জন্য ওরিক সুর সৃষ্টি করেন। বস্তত: সিনেমার রাজ্যে ককতোর পথ চলতে আসা লুই বুনুয়েল এবং সালভাদর দালির শৈল্পিক প্রচেষ্টার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে থাকবে যারা কিনা বৈপ্লবিক দুই সিনেমা ‘আন্দালুসীয় সারমেয় ১৯২৯  (Un Chien Andalou), Ô এবং স্বর্ণ যুগ ১৯৩০ - L’age d’or’ বানিয়েছিলেন এবং এই সিনেমাদ্বয়ের কারণে দূর্বোধ্য এবং নিরীক্ষাধর্মী ছবির নির্মাতা হিসেবেও সমালোচকদের তকমা অর্জন করেছিলেন। ১৯৩০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে নির্মিত এই সিনেমাটি প্রদর্শিত হতে পরবর্তী ১৫ মাস অপেক্ষা করতে হয়েছিল। যেহেতু ইতোমধ্যেই বুনুয়েল এবং দালির কাজ নিয়ে প্রচুর হৈ চৈ বা তর্জন-গর্জন শোনা যাচ্ছিল।

এক কবির শোণিত মূলত: একটি রূপকধর্মী আত্মজীবনী। ককতো এই ছবিকে ব্যখ্যা করেন ‘শুধুমাত্র নিজের গভীরে অবগাহন, না ঘুমিয়েই স্বপ্ন দেখার কৌশল ব্যবহার, যেন বা আঁকাবাঁকা একটি মোম যা প্রায়ই রহস্যময় ভাবে নিভে যায় এবং মানবদেহের নিশীথরাতে বাহিত হয়। সেখানে এ্যাকশনগুলো ইচ্ছা খুশি একে অন্যের সাথে সংযুক্ত এবং এতই দূর্বল এক নিয়ন্ত্রণাধীন যা কিনা কেউ কোনভাবেই মনে আনতে পারবে না এবং বিশেষত: অপ্রাকৃত ঘটনাবলীর বাস্তববাদী তথ্যচিত্র হিসেবে মনে ত’ আনা যাবেই না (জাঁ ককতো, দ্য ডিফিকাল্টি অফ বিয়িং, নিউইয়র্ক: মেলভিল হাউস পাব্লিশিং, ২০১৩, পৃষ্ঠা: ৪৫)। একরৈখিক কোন আখ্যান বলার আকাঙ্ক্ষামুক্ত হয়ে ককতোর  চিত্রকল্পরাজি গোটা স্ক্রিন জুড়ে ভাসে ও ঘুরে বেড়ায় এবং শুধুমাত্র তাদের নিজস্ব, অভ্যন্তরীণ যুক্তির কাছেই যেন তারা নিবেদিত থাকে। ‘ইতিহাসের চেয়ে পুরাণকে আমি সর্বদাই শ্রেয়তর জ্ঞান করেছি যেহেতু ইতিহাস হচ্ছে সত্য দিয়ে গঠিত যা অবশেষে মিথ্যেয় পর্যবসিত হয়, যখন কিনা পুরাণ হচ্ছে মিথ্যে দিয়ে নির্মিত যা সবশেষে সত্যে পরিণত হয়,’ ককতো বলেন।  Ôএক কবির শোণিত’ কোন গল্প নয় বরং কিছু সারিবদ্ধ চিত্রকল্প যারা একটি অন্যটিকে প্রতিফলিত করে। এই সিনেমায় ককতোর নায়ক যে চিত্রশিল্পী (এনরিক রিভেরো নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন) একজন মহান সংগ্রামী। ক্রুদ্ধ এনরিক তাঁর নিজের আঁকতে থাকা একটি প্রতিকৃতির মুখ মুছে ফেললে (হয়তো নিজের আঁকা নিজের কাছেই পছন্দ হচ্ছে না বলে) দেখতে পান যে প্রতিকৃতিটি তাঁর হাতের তালুতে এসে জায়গা নিয়েছে এবং বাতাসের জন্য কাঁদছে। নিজেকে তখন তিনি নিজেরই হাত/মুখ দিয়ে স্পর্শ করেন যা মূলত: একটি আত্মরতিমূলক দেহভঙ্গি। সবশেষে তিনি প্রতিকৃতিটি মুছে একটি ধ্রুপদী ভাস্কর্যের গায়ে লাগালে সেই ভাস্কর্যের দেহে লাগানো প্রতিকৃতি তখন শিল্পীকে একটি পূর্ণাবয়ব আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গভীরতর স্বপ্নরাজ্যে অবগাহণ করতে বলে। শুরুতে অন্ধকারে হারিয়ে গেলেও, শিল্পী একটি করিডোরে হামাগুড়ি দিয়ে এবং দরজার ফুটো দিয়ে নিষিদ্ধ বস্তু  দেখায় মত্ত হয়ে ওঠেন। আর এই দেখন প্রক্রিয়ার সময় শিল্পী যেন অন্ধকারে হারিয়ে যান।

কি দ্যাখেন এই শিল্পী? একজন মেক্সিকান বিপ্লবীর ফাঁসি হয়েছে, বারবার সেই বিপ্লবীর ফাঁসি হচ্ছে। চাবুক হাতে এক নারী একটি শিশুকে শেখাচ্ছে কিভাবে উড়তে হয়। এক পুরুষের ছায়ামূর্তিকে দেখা যাচ্ছে আফিম টানার পাইপ প্রস্তুত  করছে (ককতো নিজে সারাজীবন তাঁর আফিমের নেশার সাথে যুদ্ধ করেছেন)। নিশ্চল-গতি একটি ছবিতে অর্দ্ধ-জৈবিক, অর্দ্ধ-প্রতীকী জীবনমুখী পুষ্পসম্ভার দেখা যায়। পলায়নের এই চিত্রকল্গগুলো শিল্পীকে যেন আত্মহত্যার দিকে নিয়ে যায় যা অবশ্য তিনি পরে প্রত্যাখ্যান করেন এবং উল্টে দেন, নিজের আত্ম-বিনাশী কাজগুলো রহিত করে নিজেরই যেন পুনর্জন্ম ঘটান।

শিল্পী এরপর অন্য দিকে তাঁর যাত্রা হতে ফিরে আসেন এবং ভাস্কর্যটি ভেঙ্গে ফ্যালেন। ‘মূর্তি বা বিগ্রহ ভাঙা’র মাধ্যমে ব্যক্তি নিজেকে নিজের মত হয়ে ওঠার ঝুঁকি নেয়, সিনেমাতে বলা হয় এবং তারপর ঠিক তেমনটিই ঘটতে থাকে। ভাস্কর্যটির পায়ের কাছে স্কুলবালকেরা খেলা-ধূলা ও বরফের ভেতর মারামারি করতে থাকে যতক্ষণ না একজন মারা যায়। সহসা এক ফিটফাট দম্পতিকে দেখা যায় মৃত বালকটির দেওে উপর তাস খেলতে ঠিক যেমন অপেরা দেখার বক্সে বসে ধনাঢ্য ব্যক্তিরা অপেরার দৃশ্যকেই উপেক্ষা করে যায়। পুরুষ তাস-খেলুড়েটি (আমাদের শিল্পী) মৃত বালকের পকেট থেকে হৃদয়চিহ্ন অঙ্কিত তাস বা টেক্কাটি বেরর এবং এক কালো দেবদূত এসে বালকটিকে ‘শুষে নেয়’ এবং বালকটি অন্তর্হিত হয়।

সবশেষে, নারী তাস-খেলুড়ে (আগে যে ভাস্কর্য ছিল) পুরুষটির হাত থেকে হৃদয়চিহ্ন অঙ্কিত টেক্কাটি নিয়ে নেয় এবং পুরুষটি নিজেই নিজেকে আবার গুলিবিদ্ধ করে। দর্শক-শ্রোতৃবর্গ করতালিতে ফেটে পড়ে। সবশেষে সেই  ভাস্কর্য/কাব্যলক্ষী বিশ্রামে চলে যান এবং একটি ভূ-গোলক ও একটি বীণা দোলাতে থাকেন আর ককতো একেই কিনা অভিহিত করেন ‘অমরতার নৈতিক শ্রান্তি’ হিসেবে।

এই সব চিত্রকল্প থেকে আমরা কি বুঝতে পারি? ককতো আমাদের সব কিছু ভেঙ্গে বলতে খুব আগ্রহী নন। তিনি লিখেছেন, এক কবির শোণিত স্বপ্ন বা প্রতীকরাজি থেকে কিছুই গ্রহণ করে না... এর ব্যখ্যা করতে গেলে অগণিত বিষয় ব্যখ্যা করতে হবে। আমাকে যদি সেসব প্রশ্নের একটিরও উত্তর দিতে হয়, তবে আমার পক্ষে সেই উত্তর দেয়াটা খুবই কষ্টকর হবে (জাঁ ককতো, টু স্ক্রিনপ্লেইজ: লন্ডন, মেরিওন বোয়্যার্স পাবলিশিং, ১৯৮৫)। একথা বলে কবি যেন দর্শকের মনে বৈদ্যুতিক শর্ট-সার্কিটের মত কান্ড ঘটান। ‘এক কবির শোণিত’ মূলত: যেন এক ধাঁধাঁ যে তার নিজের শর্তেই টিঁকে থাকে, এক দিকে মুক্ত ও প্রসারিত এবং যে কোন ধরনের ব্যখ্যা-বিশ্লেষণ বিরোধী। এই সিনেমাটি যেন এক দৃশ্যকাব্য যার  ছন্দ আছে তবে কোন যুক্তি নেই।

ককতো, যেন বা এক আনন্দময় আত্ম-বৈপরীত্যে, আরো বলেন, Ôএই ছবিটির সংক্ষিপ্ত- সার বলতে কিছু নেই। আমি নিজেই শুধু এর কিছুটা ব্যখ্যা দিতে পারতাম। আমি আপনাদের বলতে পারতাম যে কবি নির্জনতা তাঁর নিজের কাছেই এত গুরুত্বপূর্ণ যে তিনি যখন বাঁচেন তখন এতই তীব্রতার সাথে কিছু সৃষ্টি করেন যে তাঁর কোন সৃষ্টির মুখ তাঁরই হাতে একটি ক্ষতের মত লেগে থাকে এবং তিনি সেই মুখটিকে ভালবাসেন, আসলে নিজেকে ভালবাসেন; সেই ভালবাসা এত পরম যে এক সকালে ঘুম থেকে উঠে তিনি দ্যাখেন যে মুখটি এক আগন্তÍকের মত তাঁর দেহে সেঁটে আচে, এবং তখন তিনি মুখটির হাত থেকে রক্ষা পাবার চেষ্টা চালান এবং এটা তিনি করেন ভাস্কর্যটিতে মুখটি স্থাণান্তর করার প্রচেষ্টার মাধ্যমে, এবং তখন এই ভাস্কর্যটি জীবন্ত হয়, প্রতিশোধ নেয়, এবং তাঁকে ভয়ানক সব অভিযানের দিকে ঠেলে দেয়। আমি আপনাদের বলতে পারতাম যে বরফের গোলা নিয়ে বালকদের এই মারপিট আসলে কবির ছোটবেলা এবং যখন কবি খ্যাতি অথবা তাঁর ভাগ্যের সাথে তাস খেলছেন, তখন তিনি তাঁর শৈশব থেকে কিছু এনে প্রতারণা করছেন যা আসলে বরং তাঁর নিজের কাছ থেকেই নেয়া উচিত ছিল। এরপর আমি আপনাদের আরো বলতে পারতাম যে নিজস্ব পার্থিব খ্যাতি অর্জনের জন্য কবি যখন চেষ্টা করছিলেন, তিনি মূলত: Ôঅমরতার মরণশীল ক্লান্তি’র ঘেরে নিক্ষেপিত হয়েছিলেন এবং কবি এসময় অনুরুদ্ধ হয়েছেন প্রতিটি বিখ্যাত সমাধি বা কবর দ্বারা। এবং আপনাদের একথাগুলো বলাটা আমার ঠিক হবে, এবং ভুলও হবে, যেহেতু এই কথাগুলো ঘটনাবলী এবং দৃশ্যকল্পসমূহের পরে লেখা কোন পাঠ্যবস্ত হবে... যদি আমরা প্রত্যেকে এই ছবিতে যার যার নিজস্ব অর্থ খুঁজে পাই, তাহলে আমি বিবেচনা করব যে আমার উদ্দেশ্য অর্জিত হয়েছে  (জাঁ ককতো, At the Theatre du Vieux-Colombier, January 1932, via the Wellington Film Society) |Ô

প্রায় ৫৫ মিনিটের এই ছবির পরিচালনা, চিত্রনাট্য রচনা ও সম্পাদনা করেছেন জাঁ ককতো এবং আবহ সঙ্গীত নির্দেশ করেছেন জর্জেস ওরিক। অভিনয় করেছেন এনরিক রিভেরো, লি মিলার, বারবেত্তে, পলিন কার্টন।

 

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন