শনিবার, ১৩ আগস্ট, ২০২২

মৌসুমী মুখোপাধ্যায়

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

 

দিগন্তসেনা




 

(৭)

 

প্লাতন ও সোক্রাতেসের সঙ্গে আলাপচারিতার শেষে এক নিঃসঙ্গতার মাঝখানে শ্যামাঙ্গীর মনে পড়ে যায় এক সুদূর অতীতের কথা। উন্মাদনাপ্রবালগাথার একটা বড় জায়গায় বেশ কিছু বাছাই করা লোকজনকে নিয়ে শ্যামাঙ্গী মতামত আদানপ্রদানের ব্যাবস্থা করল। তা থেকেই ও জানতে পারল নানা তথ্য। আরবরা স্পষ্টতই জানাল যে আরবী মেয়েদের পায়ে শিকল পরিয়ে একাধিক বউকে নিয়ে স্বামী ওই শিকলটা ধরে টানতে টানতে রাস্তা দিয়ে যায় আর প্রত্যেকের মাথা ও হাতে বেঁধে দেওয়া হয় গন্ধরাজ ফুলের তাগা। বউদের মাথা থেকে পা অবধি ঢেকে দেওয়া হয় কালো কাপোড়ে। ফরাসীরা জানাল, তাদের দেশেও মেয়েদের জন্য পুরোপুরি আলাদাএক রক্ষণশীলতায় মোড়া জীবনের ব্যাবস্থা। গ্রীস এবং রোমেও প্রাচীন যুগ থেকে আজ অবধি নারীকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে ক্রীতদাসের মত খাটানোটাই ঐতিহ্য আর এর বাইরে বেরানোটা তারা তাদের ঐতিহ্যে আঘাত বলেই মনে করে শত্রুপক্ষের দিকে কমলালেবু ছুঁড়তে থাকে। মিশরের এক প্রাচীন মমির সূত্রেই জানা যায় প্রাচীন যুগের মেয়েদের ওরা ক্রীতদাসের মতই ব্যাবহার করত এবং বহুবিবাহের মধ্যে দিয়ে ওরা নিজেদের সামাজিক মর্যাদা ও প্রতিপত্তি বাড়াত। সেই রীতি মধ্যযুগেও ছিল। কিন্তু আধুনিক জুগে একটু পালিশ একটু আধুনিকতার মোড়ক লাগানো হয়েছে শুধু। ঈজিপ্টেও নারীরা আজ ক্রীতদাসের মতই গৃহকাজেই ব্যবহৃত হয়। চৈনিক নারীরা প্রাচীনযুগে সারাদিন স্বামীসেবায় ব্যাপৃত থাকত শুধু নয়, স্বামীর কাছে যাওয়ার আগে তার শরীর থেকে সমস্ত গয়নাগাটি, কাপড়চোপড় খুলে নিয়ে তাকে লাল ভেল্ভেটে মুড়ে একটা বিশাল আকৃতির থালায় স্থাপন করে কর্মচারীরা দিয়ে আসত। সেই প্রথা আজও বলবত রয়েছে। শুনতে শুনতে শ্যামাঙ্গীর মনে হল ওর কানে যেন কেঊ গরম তেল ঢেলে দিচ্ছে। ও ভিঞ্ছিলেক আর রঁলাদালুক এই দুটো জায়গায় তথ্যগুলোর সত্যতা যাচাই করল। সঙ্গে সঙ্গেই ওকে অবাক করে দিয়ে বেড়িয়ে এল আরও নানান চাঞ্চল্যকর তথ্য।  এযাবৎ কাল অব্দি পাওয়া সমস্ত তথ্যের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য ও যখন সমস্ত ঐহিক গ্রামগুলোতে যাবে বলে ঠিক করল ততক্ষণে অলঙ্কৃতা এসে খবর দিল একশ বাহান্নটা ধর্ষণজনিত খুনের ঘটনা ঘটে গেছে। ও অলঙ্কৃতাকে জিজ্ঞেস  করল যে কখন এত সব ঘটনা ঘটেছে। তাতে ও বলল যে প্রায় গত বত্রিশ  ঘন্টায়। ও কি করবে না করবে ভাবতে ভাবতেই সংখ্যা  সাতশ ছয়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে আর রাতটুকু  কাটিয়ে ভোর হতে না হতেই সেটা তিন হাজার চারশ পঁচিশে দাঁড়িয়েছে। সমস্ত পরিস্থিতি দেখে এবং সমস্ত মানুষই যখন একেবারে চুড়ান্ত ক্ষেপে গিয়ে প্রায় নিজেদের মাথার চুল নিজেরাই ছিঁড়তে শুরু করেছে, ও তখন ঠিক করল দেশের প্রধানদের সঙ্গে কথা বলবে।  আর ও যতক্ষণে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়া শুরু করতে যাচ্ছে তখন সংখ্যাটা তিন শ কোটি পাঁচ হাজার  চোদ্দয় পৌঁছেছে। ও ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখল যে শুধু একজনের মৃত্যু কিম্বা হত্যাই যে হয়েছে তাইই নয়, গোটা মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা শেষ পর্যন্ত এর দশগুণ বা একশ গুণে গিয়ে পৌঁছাবে। কেননা তখন বেতারে  মন্ত্রীজী জানাচ্ছেন, ‘সমস্ত অপরাধীই কঠোর সাজা পাবে’। মন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতটা হয়ে দাঁড়াল ওর কাছে নিতান্তই অর্থহীন। ও কোথায় কী হচ্ছে দেখার জন্য রাস্তায় নেমে পড়ল। ওর পেছন পেছন অলঙ্কৃতা, সুদাম, মানময়ী, অনঙ্গ, উপমা লগ্নলতা, সুলক্ষী, বারূড, পুপু, ভাঁটি, দুজ্ঞা, তার মা, আরবদের পরিবারের সবাই, গোটা তীর্থসরোবর অঞ্চলের সমস্ত বাসিন্দারা, উন্মাদনাপ্রবালগাথার সমস্ত  নতুন বাসিন্দারা, গণসংবাদালয়ের প্রতিটি পরিবারের প্রতিটি সদস্য, সম্রাট, বুচি, গুরুজী, গুরুমা, নিহিতপাতালপুরীর তিনটে ব্লকের প্রতিটি পরিবারের প্রতিটি সদস্য হাঁটতে শুরু করেছে। ও একবার পেছন ফিরে দেখল মানুষের বন্যার ঢল নেমেছে রাস্তায়। আশেপাশের বাড়ি থেকে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ শোনা যাচ্ছে,  ‘এই কঠিন পরিস্থিতিতে আপনারা শান্ত থাকুন। প্রত্যেক অপরাধীর সাজা অবশ্যম্ভাবী আর আপনারা দিনে দুবার করে মাথায় নবরত্ন তেল মেখে চারবার করে স্নান করুন’। শ্যামাঙ্গী কিছু একটা যেন ঠাওর করতে চেষ্টা করল। বোঝার চেষ্টা করল ও বা ওরা সবাই এখন ঠিক কোন বিন্দুতে  দাঁড়িয়ে আছে – সময়ের, সমাজের  এবং সভ্যতার! আর ঠিক তখনই ও শুনতে পেল, কেউ কেউ বলে উঠল, ‘রাস্তাই আমাদের একমাত্র রাস্তা এখন’। সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য মানুষের এক সঙ্গতিপূর্ণ ঐকতান শোনা গেল, ‘রাস্তাই আমাদের একমাত্র রাস্তা এখন’।

 

কিছুটা দূর যেতেই শ্যামাঙ্গী, তার পেছনের অন্যরা অনুভব করল অল্প অল্প করে বৃষ্টির ফোঁটা  পড়তে শুরু করে দিয়েছে, যে বৃষ্টিটা কমছেও না, বাড়ছেও না, আগেও পড়ছে না, পেছনেও পড়ছে না। বৃষ্টিটা পড়ছে শুধু ওদের মাথার ওপর, শুধু তাইই নয়, বৃষ্টিটা ওদের মাথা বা গা হাত-পার ওপর পড়ার পরও এতক্ষণ  ধরে ওরা কিন্তু ভিজেও যাচ্ছে না। কেননা ওটা ওদের শরীরে পড়া মাত্রই ত্বক ছোঁওয়ার মুহূর্তেই বাস্পীভূত হয়ে যাচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা, বৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে  একটা অসম্ভব সুন্দর গন্ধ ওদের মধ্যে ছড়িয়ে যাচ্ছে। কখন গোলাপ, কখন গন্ধরাজ, কখন হাস্নুহানার গন্ধ সেটা। চারদিকের অসংখ্য বাড়িঘরদোরের অগুন্তি মানুষজন ওপরে, নীচে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের দেখছে। কেউ কেউ ওদের পেছন পেছন হাঁটতেও শুরু করে দিয়েছে। বেশ কিছু দূর যাবার পর ওরা দেখল সেনাবাহিনীর একটা দল ওদের জন্যই ওদের অপেক্ষাতেই যেন দাঁড়িয়ে আছে। ওই অব্দি পৌঁছাতেই ওরা এসে জানালো যে ওরা আর সামনের দিকে যেতে পারবে না। কেন জানতে চাইলে ওরা বলল যে সেটা নাকি বারণ আছে। কারা বারণ করেছে সেটা জানতে চাইলে ওরা বলল, ‘ওপরতলা’। কোন ওপরতলা  জানতে চাইলে ওরা বলল, ‘প্রশাসন’। এবার শ্যামাঙ্গী জানতে চাইল কেন বারণ আছে। তখন ওরা বলল যে ওরা সেটা জানে না। তবে সম্ভবত এত লোক এইভাবে যাতায়াত করলে আইনশৃঙ্খলার সমস্যা হতে পারে, সেইজন্য। তখন শ্যামাঙ্গী বলল, ‘তাহলে আপনার কথার মানে হচ্ছে, ওদের বাদ দিয়ে আমি যদি যেতে চাই একা,  তাহলে যেতে পারি, তাই তো?’ ওরা সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ল।  তখন শ্যামাঙ্গী পেছন ফিরে সকলের উদেশ্যে বলল ওরা সবাই যেন এবার বাড়ি চলে যায়। পরিস্থিতি বিবেচনা করে ওরা বাড়ি ফিরে যেতে শুরু করল। আর শ্যামাঙ্গী একা সামনের দিকে এগিয়ে গেল। বেশ কিছু দূর যাওয়ার পর ও দেখল  পেছনে একটূ একটূ করে আবার মানুষের সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে। ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখল রাস্তার আশেপাশের বাড়িগুলো থেকে যারা দেখছে, তাদের কেউ কেউ ওদের ওপর ফুল ছুঁড়ে দিচ্ছে। আর ওর পেছনে যারা হাঁটতে শুরু করেছে আগের মত লম্বা আর বড়সড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ততক্ষণে শ্যামাঙ্গী দেশের সীমার একেবারে প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। তাই ও আর কোন ঝুঁকি নিতে চাইল  না। পেছন ফিরে সবাইকে বলল চলে যেতে। ওর কথা মেনেই ওরা সবাই চলে গেল। সীমান্তে কোন সৈন্য বা কেউ এসে ওকে না আটকালেও সীমান্তরক্ষী যারা  ছিল তারা ওকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত তল্লাশি করে ছেড়ে দিতেই ও গিয়ে পা রাখল অন্য একটা দেশে, যেটা হল আসলে পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের লারকানা জেলা। ও এবার সামনের দিকে এগিয়ে গেল। দেখল নানা রকমের স্থাপত্যের বাড়িঘরদোর যার বেশির ভাগেই হিন্দি আর উর্দু ভাষায় লেখা একটা করে সাইনবোর্ড রয়েছে। এখানেও ও লক্ষ করল আশেপাশের বাড়িগুলো থেকে লোকজন দেখছে, কেউ কেউ আস্তে চাইলেও সেপাইরা বাধা দিচ্ছে। ও কোন দিকে না তাকিয়ে অনেকটা দূর অব্দি গেল। কিছুক্ষণ পরই পেছন ফিরতেই দেখতে পেল বেশ কিছু জরাজীর্ণ কঙ্কালসার মানুষ ওর পেছনে পেছনে আসছে। ও ওদের বেশভূষা  আর চেহারা আর চালচলন দেখে খুব অবাক হয়ে গেল।  পেছন ফিয়ে সোজা দাঁড়িয়ে ও প্রশ্ন করল, ‘তোমরা কারা? কী চাও?’ প্রশ্ন শেষ হলে একটা থুরথুরে বুড়ি এগিয়ে এসে বলল, ‘এই যে মেয়ে, শোন, আমি হলুম গিয়ে হরপ্পা নগরীর সারগনের রাজত্বকালের এক গম-চাষির বউ। তা ধর গিয়ে  মোটের  ওপর আমার এখন বয়েস হল গিয়ে দুহাজার তিনশ বছর। আমার স্বামী চাষ করে প্রভূর কর ঠিক মত দিতে না পারায় একদিন দুপুরে বাড়িতে যখন কেঊ ছিল না, তখন আমাকে তুলে নিয়ে যায় আর ছুঁড়ে ফেলে দেয় রাজার সিংহাসনের সামনে। রাজা কিন্তু আমাকে ছুঁয়েও দেখেনি। তাঁর নির্দেশেই পাইক বরকন্দাজ এসে আমাকে ঘেঁটি ধরে তুলে নিয়ে গিয়ে একটা ঘরে আটকে রাখে। তারপর রাতের অন্ধকারে একটা ষণ্ডাগণ্ডা লোক এসে আমার ওপর অত্যাচার চালাতেই থাকে যতক্ষণ না আমি মরে যাই। আমার মৃত্যুর পর লাশটা তুলে ফেলে দিয়ে আসে কাছের জঙ্গলে আর একটা বাঘ এসে আমাকে খেয়ে ফেলে’। এরপর আরও একজন অভিজাত বৃদ্ধা এগিয়ে এসে জানায় যে তারও বয়েস দুহাজার একশ দশ বছর। উরের তৃতীয় রাজবংশ চলাকালীন তার স্বামী ছিল একজন একজন রীতিমোটো নামীদামী বণিক। বাণিজ্য করে ফেরার পথে  সামুদ্রিক ঝড়ের কবলে তার প্রাণটা যাবার খবর পাওয়া মাত্রই একজন পদস্থ কর্মচারীর জোরপুর্বক বলাৎকারের  শিকার হয়ে সে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছিল। আর একজন কমবয়সী বউ এবার নিজেই এগিয়ে এসে জানায় যে তার বয়স নাকি উনিশ’শ কুড়ি, জন্ম ও বেড়ে ওঠা লারসার রাজে গুঙ্গুনুমার  রাজত্বকালে। স্বামী স্বর্ণ ব্যবসায়ী ছিল। এমনিতে বিয়ের পর সুখেই ঘরকন্না করছিল। কিন্তু সন্তান জন্ম দেওয়ার পর যখন কন্যাসন্তান প্রসব করে তখনই তাকে একটা জঙ্গলে রেখে আসা হয়। দীর্ঘদিন অনাহারে, তেষ্টায় শরীর যখন আর দিচ্ছিল না তখন নদীর জলে ডুবে আত্মহত্যা করে। আরও বেশ কয়েকজন  নানা বয়সের নানা শ্রেণীর মেয়েরা জানায় তারা কেউ হরপ্পা, কেউ মোহেঞ্জদর, কেঊ কালিবাঙ্গা নগরে বাস করত। ধর্ষণ বা অন্য কোন অত্যাচারে মারা যাবার পর কেউই আর তাদের খোঁজ নেয়নি। এর মধ্যেই সবচেয়ে পেছনের সারি থেকে অন্যদের সরিয়ে সরিয়ে একজন মেয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। সে তার নিজের পরিচয় দেয় যে সে মেসোপটেমিয়া এক বণিকের মেয়ে ছিল। বিবাহসূত্রে সে সিন্ধু উপত্যকার অভিজাত এক নাগরিকের স্ত্রী হয়। স্বামীর মৃত্যুর পর তার আত্মীয় পুরুষরা তার ওপর নিত্য নৈমিত্যিক অত্যাচার চালাত আর তাতে তার খুব লাগত, খুব কষ্ট হত। একদিন সেই কষ্ট  সহ্য করতে না পেরে সে আত্মঘাতী হয়।

শ্যামাঙ্গী এবার আফগানিস্তানের মাটিতে পা রাখল। সেখানেও ওর পিছু নিতে শুরু করল অসংখ্য মেয়ে যারা তাদের গোটা শরীরের ওপরটা আর মাথা ঢেকে রেখেছে তাদের ওড়না আর দোপাট্টা দিয়ে। এদের মধ্যে আবার বেশ কিছু মহিলা  আছে যারা কালো ও নানা রঙের বোরখা পরা। ওর মনে পড়ে গেল সেই সকালের কথা, যেদিন বৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে প্রচুর বরফ পড়ছিল, প্রচন্ড গ্রীষ্মের সেই রাতে ও যখন সাংঘাতিক জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকে যাচ্ছিল, তখন মানময়ী সারা রাত ধরে ওর মাথায় জলপট্টি দিয়ে জ্বরটাকে শুধু তাড়িয়েই ছাড়েনি, গোটা বাড়িতে যাতে আর কারোর শরীরে গিয়ে আস্তানা গাড়তে না পারে তার জন্য পরিবারের সকলকে ধরে ধরে নিমপাতার শরবৎ গিলিয়ে ছেড়েছিল। সেই দিনই  ও মার একটা নাম শুনেছিল যে নাকি অন্ধকারের রাজকন্যা, অনমনীয় তেজ আর জেদে সে একাই লড়ে গিয়েছিল অন্ধত্ব ছড়ান সেই সব মানুষের বিরূদ্ধে যারা ওকে শেষমেশ খুন করেই ফেলেছিল, কিন্তু ও যাদের সাহায্য নিয়ে ওর লড়াইটা চালিয়ে যচ্ছিল, সেই আলোর দেশের রাজা মন্ত্রী্রা সবাই মিলে ওকে বাঁচাবার এক অভুতপূর্ব লড়াই করেছিল আর তাতেই সেই মেয়েটা আবার বেঁচে উঠে তার লড়াই শুরু করেছিল। কি যেন বলেছিল মা তার নাম, কিছুতেই মনে আসছে না শ্যামাঙ্গীর। ও আবার পেছনের দিকে ফিরে তাকাল। জিজ্ঞেস করল, ‘কী চাও তোমরা?’ ভিড়ের ভেতর থেকে  বেশ কয়েকজন উত্তর  দিল, ‘তোমাকে ঘিরে রাখতে আর পাহারা দিতে’। ও বলল, ‘কিন্তু কেন?’ ওরা বলল, ‘এখানে জায়গাটা ভালো নয়। যে কোন মুহূর্তে তোমার ওপর হামলা হতে পারে। ও আর কথা বাড়াল না। সামনের দিকে তরতর করে এগোতে থাকল। ইতিমধ্যে  আর নতুন কিছু মানুষ এসে যোগ দিয়েছে। জিজ্ঞেস করে জানল ওরা মুঘল হারেমে থাকা নারী ও পুরুষ। ও আবার এগিয়ে যেতেই ঘাঘরা আর চোলি পরিহিত  ওড়না দিয়ে ঢাকা বেশ কিছু সংখ্যক সুন্দরী নারী যারা আসলে রাজপুত। ও এবার আবার পেছনে ফিরে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমরা এখানে এসেছ কেন? কী চাও তোমরা?’ ওরা বলল, ‘তৃপ্তি,স্বাধীনতা’। শ্যামাঙ্গী এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না, হেসে ফেলল। তারপর বলল, ‘নারী তো শুধু শাড়ি আর গয়না  পেলেই বর্তে যায়। আর কিচ্ছু চায় না’। ওরা বলল, ‘তোমার বিদ্রুপ সত্যিই আমাদের প্রাপ্য। কর। আরও কর। আমরা তোমার বিদ্রুপে নিজেদের আত্মাকে ডুবিয়ে, স্নান করে পরিশুদ্ধ হতে চাই’।

শ্যামাঙ্গী এবার ইরানের মাটিতে পা দিল। আর তখনই হঠাত খেয়াল করল বেশ কিছুদিন ধরে নিমপাতার তেলটা না মাখা হওয়ার  জন্য ওর গা থেকে আবার সেই গন্ধটা বেরাতে শুরু করেছে। ও খুব অস্বস্তিতে পড়ে গেল। তারই মধ্যে একবার পেছন ফিরে দেখল, বেশ কিছু  মহিলা আর কজন পুরুষ ওর পিছু নিয়েছে। ইরান থেকে ইরাকের দিকে পা ফেলতেই ওর মনে হল সৌদি আরবের  পরিস্থিতিটা কী তা জানা হল না। ইরাকেও একদল মেয়ে ওর পেছনে পেছনে  আসতে শুরু করেছে। ও কিছু বলল না। তারপর সিরিয়া পেরিয়ে তুর্কী হয়ে বুলগেরিয়া পেরিয়ে ইতালিতে প্রবেশ করার মুখে পেছন ফিরে সবাইকে চলে  যেতে বলল। কেননা এত মানুষ একসঙ্গে যাতায়াত করলে অন্যদের সমস্যা হতে পারে। তখন ওরা বলল যে ও যেন এসব নিয়ে চিন্তা না করে।  কেননা ওদের কেউই দেখতে পাবে না। ইতালিতেও বহু মানুষ ওর পেছনে চলতে শুরু করল। সীমান্ত পেরিয়ে ফ্রান্সে পা দিতেই একদল মহিলা এসে ওকে ওদের দুর্ভাগ্যের  কথা জানাল। যারা কথা বলল তারা মূলত ওর সমসাময়িক। ওদের প্রধান বক্তব্য যে ওখানে সমাজ খুউব গোঁড়া, বিশেষত মেয়েদের জন্য। সামাজিক যত নিয়ম কানুন সব মেয়েদের বেলা। তাই ওরা সব কিছু ছেড়ে ওর সঙ্গে যেতে চায়। শ্যামাঙ্গী জিজ্ঞেস করল ওদের, ‘কোথায় যেতে চাও তোমরা?’ উত্তর এল, ‘তুমি যেখানে যাবে, সেইখানে’। ও বলল, ‘আমি তো শুধু পরিস্থিতিটা দেখতে  বেড়িয়েছি আর তারপর পায়ে পায়ে হেঁটে এখানে এসে পড়েছি’। ওরা কোন কথা শুনল না। সীমান্ত পরিয়ে ও এবার স্পেনে পা রাখল। কিছুদূর যেতেই ও একটা কান্নার আওয়াজ পেল, তারপরই বেশ কিছু মহিলা আর কয়েকজন পুরুষ, দেখল, ওদের দলে যোগ দেবার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। ও ওদেরকেই জিজ্ঞেস করল, ‘কান্নার শব্দটা কোথা থেকে আসছে? কে কাঁদছে?’ ওরা বলল, ‘স্পেন’। ও খানিকটা ধাঁধায় পড়ে গেল বলে ওদের মনে হল। ওরা খোলসা করে বলল, ‘এই দেশের আত্মা’। কেন জানতে চাইলে ওরা বলল যে ফ্রাঙ্কোর রাজত্বকালে  এই ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠপুত্র ফেদেরিকো গার্থিয়া লোরকাকে তার মাত্র সাঁইত্রিশ বছর বয়সে শয়তানটা এমনভাবে খুন করে তার লাশটাকেও গায়েব করে দিয়েছে  যে গোটা দেশ আত্মীয়স্বজনরা তাঁর মৃতদেহটাকেও শ্রদ্ধা জানাবার সু্যোগ পায়নি।  এই জন্যেই দেশমাতৃকার এই ক্রন্দন। শ্যামাঙ্গী সম্মতিসূছক ঘাড় নাড়তেই ওরা বুঝল এই বিষয়টা আগে থেকেই ও জানত। তারপর ওরা বলল, ফ্রাঙ্কোর রাজত্বকালেই কীভাবে মেয়েদের ঘর থেকে টেনে নিয়ে এসে দিনের পর দিন, একের পর একজনকে ধর্ষণ করে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হত। পুরুষরাও জানাল  তাদের ওপর ফ্রাঙ্কোর অত্যাচার আর জুলুমের কথা। তারপর শ্যামাঙ্গী চলতে শুরু করল আর ওর পেছন পেছন ওরাও চলতে শুরু করল। শ্যামাঙ্গী এবার জার্মানী পেরিয়ে পোল্যান্ড হয়ে  হাঙ্গেরি আর অষ্ট্রিয়ায় পা রাখল। এইবার শ্যামাঙ্গী পেছন ফিরে দাঁড়াল আবার আর জিজ্ঞেস করল নতুনদের, ‘কী চাও তোমরা? কী করতে পারি আমি তোমাদের জন্য? বল। আমাকে বল। কী তোমাদের লক্ষ্য?’ ‘হিটলারের জার্মানী, মুসোলিনীর ইতালী আর যুদ্ধপ্রবণ জাপানের সঙ্গে ইংলন্ড, ফ্রান্স আর মার্কিনীদের সম্মিলিত জোট সোভিয়েতের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ ঘোষণা করে গোটা পৃথিবী কাঁপিয়ে তুলেছিল এবং শেষমেশ হেরে গিয়েছিল,’ ওরা জানাল, ‘এতে আমাদের সত্যিই কোনও ভূমিকা ছিল না, তুমি বিশ্বাস কর। অথচ ওই ক’বছরের যুদ্ধে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলাম আমরা। প্রচুর পরিমাণে সৈন্যদের প্রাত্যহিক ক্ষিদে মেটানোর জন্য আমরা দিনের পর দিন শুধু ব্যবহৃত হয়ে গেছি’। একজন কম বয়সী জার্মান বউ এবার এগিয়ে এল। তারপর বলতে শুরু করল, ‘হিটলার নিজেও কিছু কম ভয়ঙ্কর ছিল না। যুদ্ধের বাইরের হিটলারের চেহারাটা এই আমি দেখেছি। দিনের পর দিন ক্ষমতার তপস্যা করত, খিদে পেলে হাতের কাছে যাকে পেত তাকে দিয়েই খিদে মেটাত আআর শেষ হয়ে গেলেই ছুঁড়ে ফেলে দিত জলে জঙ্গলে। আমার ক্ষেত্রেও ঘটনাটা তো অমনই হয়েছিল। আমার ঘরসংসার নিয়ে আর পাঁচটা মেয়ের মত আমিও সুখেই ছিলাম। আমার দু’দুটো যমজ বাচ্চাও ছিল। একদিন দিনে দুপুরে এসে বাড়িতে চড়াও হয়ে আমাকে তুলে নিয়ে গেল। তারপর কদিনের ক্ষিদে মিটিয়ে আমাকেও ছুঁড়ে ফেলে দিল সেনাদের মাঝখানে। তারপর শুরু সেইসব সেনাদের লাগাতার প্রসাদ ভক্ষণ’। জাপানের একটি মেয়ে ওকাকুরা ওসিওমা, এগিয়ে এসে দেখাল তার শরীরে কীভাবে সেনারা এক চিরস্থায়ী ছাপ এঁকে দিয়েছে। সে তার পোশাকের নিচের অংশটা তুলে দেখাল কীভাবে তার জড়ায়ু আর ক্ষুদ্রান্তের বেশিরভাগ অংশটা বেড়িয়ে এসে একেবারে নীল হয়ে আছে। শ্যামাঙ্গীর মুখ দিয়ে কোন কথা সরল না। ও ওর দুচোখ বন্ধ করে ফেলল। আর একটি পোলিশ মেয়ে এবার এগিয়ে এল। সে জানাল, উনিশ’শ উনচল্লিশে জার্মান পোলান্ড যুদ্ধ চলাকালীন জার্মান সৈন্যরা  তাকে তুলে নিয়ে যায় তাদের ছাউনিতে আর এক রাতেই একের পর এক অনবরত তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তার জীবন শেষ করে দেয়।  আর একজন  পোলিশ মেয়ে বলল, ‘পোলিশ সৈন্যরা যে সাধুপুরুষ ছিল তা ভাবার কোন কারণ নেই,’ বলে সে নিজের দিকে আঙুল দেখাল, ‘তার জলজ্যান্ত প্রমাণ এই আমি। যুদ্ধ বেঁধেছে আমার দেশের সঙ্গে অন্য দেশের। কিন্তু আমার দেশের সেনার ক্ষিদে মেটাতে আমাকে প্রতি রাতে ছিঁড়ে খুঁড়ে  ফেলা হত। আর আমার কাজ ছিল  চুপচাপ সহ্য করে যাওয়া। আমাকে বলা হয়েছিল যে এটাও নাকি এক ধরনের দেশপ্রেম!’

শ্যামাঙ্গী যত শোনে তত যেন ঘোরের মধ্যে চলে যেতে থাকে। কেউ একজন এসে ওকে একটা পাত্রে জল দেয়। ও সেই জলটা ঢকঢক করে খেয়ে নেয়। তারপর সোজা আর শক্ত হয়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করল। ঠিক সেই সময় এক অস্ট্রিয়ান মেয়ে আর এক চেক মেয়ে এগিয়ে আসে আর ওকে জানায় যে জার্মানরা ওদের নিয়ে গিয়ে বন্দী হিসেবে হিটলারের সামনে ফেলে।  তারপর অস্ত্রিয়ান মেয়েটি বলে, ‘সেটা ছিল উনিশ’শ একত্রিশ। মাত্র একমাসের শিশুকে নিয়ে বাড়ি ফিরেছি। শিশুকে খাওয়াচ্ছি। হঠাত ওরা আমাকে পেছন থেকে টেনে নিয়ে গেল। আর বাচ্চাটা চিৎকার জুড়ে দিল। ওর সেই কান্না আজো আমি শুনতে পাই, জানো। খুব ইচ্ছে করে ওকে দেখতে’। বলে সে বেচারা কাঁদতে থাকে। চেক মেয়েটির সবে নতুন বিয়ে হয়েছিল আর তখন সে সাত মাসের পোয়াতি। সৈন্যরা তাকেও ছাড়েনি। তাই তার অনিবার্য ছিল মৃত্যু। সে তাই মারা যায়। শ্যামাঙ্গী দেখল যে ওর সামনে আরও অসংখ্য নারী দাঁড়িয়ে আছে, যাদের কাউকেই ও চেনে না। কিন্তু তারা যে অভিজ্ঞতার শরিক তা যেন কিছুটা এই মেয়েগুলোর মতই। ওর মনে হতে থাকল, এইসব ধর্ষণ আর অত্যাচারগুলো যেন ওর ওপরেই হয়ে গেছে আর সেটা একেবারে এইমাত্র। মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। ও ঝাড়া ঝাপ্টা দিয়ে উঠে দাঁড়াল আর নিজেই নিজেকে বলল, ‘ভেঙ্গে পড়লে চলবে না। চল। ওঠ’। ও এবার সত্যি সত্যিই উঠে পড়ল। তারপর আবার চলতে শুরু করল। ও নিজেও জানে না কবে, কখন, কোথায় এ চলার শেষ হবে। তবু চলতে হবে। ও তাই আবার হাঁটতে শুরু করল। কিছুটা দূর যেতে না যেতেই ওর মাথার ওপরের আকাশ গুটিয়ে কুন্ডলী পাকিয়ে যেতে লাগল যেন, আর ও নিজে ওর চোখের সামনেই দেখতে পেল একগুচ্ছ ভাঙা কাচের বাসনের মত ফরাসী বিপ্লব আর ইতালীয় রেনেসাঁস মাটিতে, ধুলোতে পড়ে একেবারে গড়াগড়ি খেতে  থাকল। এরকম একটা পরিস্থিতিতে ও কী করবে ভেবে পেল না। মিশেল ফুকোর মতই দেখতে একজন আর একজনের হাত ধরে চলে গেল। আর ঠিক তখনই শ্যামাঙ্গী দেখতে পেল জঁ পল সার্ত্র আর সিমোন দ্য বোঁভয়া কলেজে পড়তে আসা একটি ছেলেকে সদ্য ফুসলিয়ে তুলেছে। জ্যাক দেরিদা ততক্ষণে দর্শন  শাস্ত্রকে নিজের দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা দিতেই জ্যামিতিক নৈপুণ্যের ওপর নির্ভর করে পৃথিবী পরিক্রমণের পরিকল্পনা করে যাচ্ছে একদম শ্যামাঙ্গীর নাকের ডগায় বসে। ও কেন এসেছিল মুহূর্ত খানেকের জন্য সেটা ভুলে গিয়ে ফ্যালফ্যাল করে   দেরিদাকে দেখতে ব্যস্ত হয়ে গেল। আর ঠিক তখনই মানময়ী তুলসীগাছে  সন্ধ্যারতি করতে করতে শ্যামাঙ্গীর কথা ভাবতে থাকে আর অনঙ্গ নিশ্চিন্তে বসে বসে গথিক আর্য গোষ্ঠীর একটা প্রোটোটাইপ তৈরির প্লান করতে থাকে যেটা শ্যামাঙ্গী ফিরলে তার হাতে দেবে বলে ভাবে।

 

(ক্রমশ)


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন