ধারাবাহিক উপন্যাস
রূটম্যান
(৭)
দুয়ার
এঁটে ঘুমিয়ে আছে গ্রাম, মোহনগঞ্জ সেই গ্রামটির নাম
প্রায়
সারা রাতই বিভিন্ন পায়ের শব্দ রাস্তার পাশের বাড়িগুলো টের পায়। আর বারবার গৃহস্থের
ঘুম গাঢ় হতে না হতেই ভেঙে যায়। চোখে লেপ্টে থাকে তন্দ্রা। এমন চলাচল বর্ষায় বাড়ে। আর
সেই সাথে নদীর পার বরাবর আদিগন্ত বিস্তৃত পাট ক্ষেতগুলো ধাঁই ধাঁই করে গগনচুম্বি হতে
শুরু করে। শেয়ালের উৎপাত বাড়ার সাথে সাথে আরো অনেক ধরনের পদধ্বনি মানুষকে সব সময় আতঙ্কিত
করে রাখে। আর তাই কোন নববধূ যদি ঘুমের মধ্যে হঠাৎ করে বাড়ির পাশের সরু রাস্তা দিয়ে
মুহুর্মুহু চলাচলে উঠে বসে, তখন তার স্বামী তার মুখে নিজের হাত চাপা দিয়ে বড় ফিসফিস
করে বলে- ‘চুপ! সব অভ্যেস হয়ে যাবে’। এই বলে ভয়ে থরথর করে কেঁপে ওঠা বধূর শরীরটিকে
নিজের বুকের মধ্যে জাপটে নিয়ে মনে মনে আজীবন স্ত্রীকে এভাবেই আগলে রাখার শপথ নেয় সে!
একেবারে
ছিরিছাঁদ হীন মোহনগঞ্জের এই দরগাতলা। সারা গ্রামটারই এমন শ্রীহীন চেহারা। দিনের বেলায়
কচি কাঁচাদের হৈ হুল্লোর গ্রামটাকে যতটা না মুখর করে রাখে, তার থেকেও বেশি নিস্তদ্ধতায়
নিমজ্জিত হয় সন্ধার পর থেকেই। সবাই ব্যাপারটা জানে। তাই কেউ অতিরিক্ত কৌতুহলে ভুল করেও
জানলা খুলে স্বচক্ষে পরখ করার চেষ্টা করে না। সবাই ভাবে যেমন চলছে চলুক! তাই মাঝে মাঝে
পশুর গায়ের গন্ধের সাথে তার নাকের ‘ফোঁস ফোঁস’ শব্দ কানে এলেও গ্রামবাসীরা সবাই বাধ্য হয়েই তাদের রিপু দমন করে
রাখে। এটা দরগাতলার সব কচি কাঁচারাও জানে।
কিন্তু
কেন এমনটা হয়! দিনের মুখরিত হুল্লোরবাজ গ্রামটি কেন সন্ধার আস্তরণ গাঢ় হতে না হতেই
এমন অস্বস্তি বোধ করে! আর কেনই বা সারা গ্রামটাই সন্ধ্যার পরে পরেই দুয়ার এঁটে ঘরে
সিঁধিয়ে যায়! কেন কেউ বাড়ির বাইরে একান্ত অপারগ না হলে একা পা বাড়ায় না। অবশ্য এর কারণটা
অনেকের মতোই তসলিমও জানে। পাড়া বা গ্রামের সবাই জানে যে তসলিম একটু ক্ষেপাটে, সহজ-সরল
ছেলে। অনেক কিছুই মুখের উপর বলে ফেলে। কিন্তু এটাও ঠিক যে ও সবটা ভেবে বলে না। ক্ষেপাটেরা
যেমন হয় আর কি!
সেদিন
আকাশে চাঁদ লুকোচুরি খেলছিল মেঘের সাথে। সারাটা দিন জল ঝরিয়েও তখনও মেঘেরা একেবারে
জলভার থেকে মুক্ত হতে পারেনি। তবু তার মধ্যেই তারা চাঁদের সাথে খেলছিল। একবার মেঘেরা
আচ্ছাদিত করে নেয়, তো পরক্ষণেই চাঁদ ওদের নাগাল ছাড়িয়ে হাসতে হাসতে ভেসে ওঠে অন্যত্র।
তাই সারা গ্রামের রাস্তাগুলো যে একেবারে অন্ধকার ছিল তেমনটা নয়। ঐ বলা যেতে পারে আলো-আঁধারির
মতো ছিল। আর ছিল ঝিরঝিরে বৃষ্টির একটানা ঘ্যানঘ্যানে সুর।
গ্রামে
সবারই একটা করে ছাতা থাকে না। বাড়ির কর্তাই মূলত ছাতা মাথায় দেওয়ার অধিকারী হয়। আর
বাকিদের বৃষ্টির মধ্যে একান্তই যদি বাইরে যেতে হয় তাহলে একটি চটের বস্তাকে ডোঙার মতো
করে তা মাথায় চাপিয়ে নেয়। নতুবা মাথায় ঝাঁপি বা মাথাল ব্যবহার করে। কিন্তু ছাতা ছাড়া
বাকি যাই কিছু ব্যবহার করুক না কেন শরীরের দু’দিক ভিজবেই। যারা স্যারের বাড়িতে টিউশন পড়তে যাচ্ছে তাদের তো আর ডোঙা বা মাথালে কুলোবে
না। শরীরের দু’দিকের সাথে হাতের বইও ভিজবে।
তাই অনেকের মতোই তসলিমও অন্তত স্যারের বাড়ি যাওয়ার সময় বাড়ির একটি মাত্র ছাতার অধিকারী
হয়। একাই পুরো ছাতার অধিকার ভোগ করে সে। আর বইগুলোকে ভরে নেয় প্ল্যাস্টিকের ব্যাগে।
সেদিনও
বর্ষার প্যাচপ্যাচে জল-কাদার মধ্যে তসলিম রোজকার মতোই ছাতা মাথায় টিউশন থেকে বাড়ি ফিরছিল।
বাড়ি ঢোকার আগেই পাড়ার মোড়ে হঠাৎ অনবরত বাজির শব্দে তার পা জল-কাদায় আঁটকে যায়! তসলিম
বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। আর ওকে পাশ কাটিয়ে অনেক লোকই ছুটোছুটি করতে থাকে। একজন ওকে
ধাক্কা দিলে ও নিজেও পড়ে যায়। কিন্তু তার মধ্যেই ও দেখতে পায় পর পর দু’জন লোক ‘মা গে’
বলে রাস্তার ধারে ছিটকে পড়ে গেল! তাদের পা
দুটো বকরি কাটার মতো ছটফট করতে করতে এক সময় নিস্তেজ হয়ে যায়। অথচ তখনও অনবরত
বাজির শব্দের মতো ফট ফট শব্দ ভেসে আসে। কিছুক্ষণ ধরে ভারী পায়ের শব্দ ও ছুটোছুটির মধ্যে
তসলিম একই ভাবে বসে থাকে। এই মোড়ের কাছে বাবর চাচার বাড়ি হলেও সে কাউকেই ডাকতে পারে
না। হাজার চেষ্টা করেও সে গলা দিয়ে কোন শব্দ বের করতে পারে না। উঠে দাঁড়াতে চাইলেও
ভয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকে তার ভেজা শরীরটা ।
এর
পরের কিছুটা সময় তসলিম আর মনে করতে পারে না। সবটাই পুরনো কালো ছবির মতো ঝাপসা হয়ে গেছে!
আজো তা কিছুতেই স্পষ্ট হয়নি। স্মৃতি থেকে কিছু জিনিস হারিয়ে যাওয়ার মতো। তবে তারপর
থেকে বাকিটা আজো তার মনে ধরা আছে। সে তখনও বাবর চাচার দাওয়ায় বসে থরথর করে কাঁপছিল।
আর চাচি এক গেলাস গরম বকরির দুধ নিয়ে তাকে খেতে বলছিল। ওটা খেয়েই সে বলেছিল- ‘চাচি
হামি বাড়ি যামু’। আর চাচি ওর মাথায়–মুখে হাত বুলিয়ে
বারবার বলছিল- ‘যাবু বেটা, লিশ্চয়ই ঘর যাবু’।
এর
মধ্যেই বাবর চাচা তসলিমের বাড়িতে খবর দিলে ফরিদ আর ফতেমা ছুটতে ছুটতে বাবরের বাড়িতে
চলে আসে। নিজের মা-বাবাকে দেখেও তসলিমের কিছুতেই ভয় যায় না। সে বারবার বাবরের আঙিনার
দিকে বিহ্বল চোখে তাকায়। আর মাকে জড়িয়ে ধরে বলে- ‘মাগে, ভটকার শব্দে মোর খুব ডর লাগে।
আর হামি বাহিরে যাছি না’। এসব আজো তসলিমকে মাঝে মাঝেই তাড়া করে বেড়ায়। গ্রামে হিন্দুদের
কোন উৎসবে যথেচ্ছ বাজির শব্দে তসলিম আজো বাড়ির বাইরে পা রাখে না! তখন সে কিছুটা স্পষ্ট
এবং কিছুটা কালো অস্পষ্ট ছবি আজো দেখতে পায়। তবে সেদিনের মতো অমন ভাবে হতবাক হয় না।
পরের
দিন আর কোন বৃষ্টি ছিল না। তাই স্বভাবত ভাবেই ভোরের আলো ফুটতেই রোজকার মতো লোকের চলাচল
শুরু হয়ে যায়। ভিড় জমে যায় পাড়ার মোড়ে। গল্পের গরু মাঝে মাঝেই গাছে উঠে পড়ে। তবে কেউ
সাহস করে তসলিমকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে পারে না। কারণ সে তখনও গত রাতে চোখের সামনে ঘটে
যাওয়া ঘটনাটাকে সুঃস্বপ্নই মনে করছে। কিন্তু ওর চোখের সামনে ছিটকে পড়ে যারা-‘মাগে’
বলে কঁকিয়ে উঠেছিল তাদের কথা কেউ বলছে না!
এমনকি তার বাবা-মাও কিছু বলছে না!
বেলা
বাড়ার সাথে সাথে বিএসএফের দু’জন জওয়ান আসে দরগাতলার মোড়ে। আর গ্রামবাসীদের খবর দেয় যে গতকাল দু’জন লোক ওদের
সাথে লড়াই করতে গিয়ে মারা গেছে। তবে কাদের
গুলিতে মারা গেছে তা ময়না তদন্ত না করা পর্যন্ত কিছুই বলা যাবে না। গ্রামবাসীরা যেন
একবার বি এস এফ ক্যাম্পে এসে লোক দুটোকে সনাক্ত করে। তারপর বরং টাউনে নিয়ে যাওয়া হবে
ময়না তদন্তের জন্য।
এসব
ঘটনা দরগাতলা মোড়ে যতই ফিসফিস করে কেউ বলুক না কেন এক লহমার মধ্যেই তা বাতাসের পিঠে
চেপে বা কাকের মুখে মোহনগঞ্জের আশেপাশের পাঁচ-দশ গ্রামে ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগে না। ফলে
সেই সাথে বি এস এফ ক্যাম্পের ছোট প্রাঙ্গনে আর তিল ধারণের জায়গা থাকে না। সবাই একবার
করে লাশের সামনে এসে ভালো করে দেখতে চায়। নিজের নিজের বাড়ির মানুষেরা বাড়িতে থাকলেও
হয়তো পরিচিত মুখ বলে কাউকে চিহ্নিত করা যেতেই পারে। ফলে এক সাথে হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে
যায়। সকলেই লাশ দুটোকে এক সাথে দেখতে চায়। শেষে জওয়ানদের ব্যবস্থাপনায় একে একে সবাই
এসে দেখে এবং নির্বাক মুখে দূরে সরে যায়। আর তখনই একটু দূর থেকে পরণের লুঙ্গি দেখতে
পেয়ে দু’জন স্ত্রী মানুষ ডুকরে কেঁদে ওঠে এবং পাগলের মতো শৃঙ্খলা অমান্য করে ছুটে এসে লাশের উপরে হুমড়ি
খেয়ে পড়ে। আর তখনই লাশ দুটো যেন তাদের পরম আত্মীয়দের খুঁজে পায়।
এর
পর থেকেই তসলিম অদ্ভুতভাবে চুপচাপ হয়ে যায়। বিশেষ করে দরগাতলার মোড়ে এলেই ও দ্রুত পা
চালায়। নিজের অজান্তেই নয়নজুলির দিকে ওর চোখ চলে যায়। বি এস এফের জওয়ানরা বলেছিল তারা
ঐ লাশ দুটোকে নয়নজুলির পাশেই পড়ে থাকতে দেখেছিল। কোন কোন কচু পাতায় নাকি ভোরেও লেগেছিল
রক্তের ছিটেফোঁটা দাগ। বাকিটা ধুয়ে গিয়েছিল রাতের বৃষ্টিতে। তবে বেশ কিছুদিন মাটির
রঙটা কালচে হয়ে ছিল। আর বাতাসে ছিল বারুদের একটা ঝাঁঝালো কটু গন্ধ ।
সেই
রাতের গল্পটা কিন্তু আজো বেঁচে আছে মোহনগঞ্জের দরগাতলায়। গ্রামের লোকেরা ভুলতে চাইলেও
তসলিম তা হতে দেয়নি। অথবা বলা যেতে পারে ও নিজেই ভুলতে পারেনি। আজো সে মাঝে মাঝেই চমকে
ওঠে! বিশেষ করে যখন বর্ষায় এক নাগাড়ে বৃষ্টি ঝরে চলে। আর তাই তসলিম ওর ক্লাসের খাতায়
একদিন দুটো লাইন লিখে ফেলে। আর তা হল- ‘ভয়ে ভয়ে বসে থাকি দরজায় এঁটে খিল / একদিন রাতে
দরগাতলাটা হয়েছিল কার্গিল!’
ক্লাসের
স্যার দেখেছিলেন। বার বার পড়েও ছিলেন। তার পর একটু মৃদু গলায় বলেছিলেন- ‘তা হ্যাঁরে
তসলিম, তুই বুঝি আজো সেদিন রাতের ঘটনা ভুলতে পারিসনি?’
মাথা
নিচু করে তসলিম বার কয়েক দু’দিকে নাড়িয়ে বলেছিল- ‘না স্যার। হামি তো আইজো ঝরির দিনে
রাইতে চোখ বন্ধ কইরলেই দেইখতে পাই। বকরি কাটার ছটফটানি দেখি। আর শুইনতে পাই কারা যেন
চিল্লায় কহিছে-মাগে-‘।
সেদিন
ক্লাসের স্যার বুঝতে পেরেছিলেন যে এই দুঃসহ ভয়টা আর কোনদিনই তসলিমকে ছেড়ে চট করে যাবে
না। একেবারে লুতাতন্তুর মতো ওকে আজীবন আঁকড়ে থাকবে। তবে এর দিন কয়েক পর থেকেই অদ্ভুত
ভাবে ঘটনাটা একটা নামে রূপান্তরিত হয়ে যায়। আর তাই আজো কেউ কেউ মাঝে মাঝেই সেই ‘কার্গিল’
নামেই দরগাতলাকে চিহ্নিত করতে কুন্ঠা বোধ করে না! বরং তারা হাসতে হাসতেই বলে।
এখন
আর কোন জওয়ান সেই ঘটনার পর থেকে মোহনগঞ্জে খুব একটা নজরদারি চালায় না। এটা ইচ্ছে করে,
নাকি উপরওয়ালাদের নির্দেশে, তা গ্রাম বাসীদের জানা নেই। সবাই শান্তি চায়। কে আর সখ
করে স্বজন হারানোর বিয়োগ ব্যথা বুকে নিয়ে আজীবন বাঁচতে চায়! কে আর প্রতিদিন রাতের ঘুম
নষ্ট করতে চায়! বরং এই ভালো। গ্রামের মধ্যে বি এস এফ জওয়ানদের ছায়া যত কম পড়ে ততই মঙ্গল। তাই সবটাই কেমন যেন ঢিলেঢালা।
গ্রামবাসীরা সূর্যোদয় থেকে একেবারে সূর্যাস্ত পর্যন্ত গতানুগতিক কাজের মধ্যেই নিজেদের
ডুবিয়ে রাখে। তবে দরগাতলার মোড়ে সন্ধার আস্তরণ গাঢ় হতে না হতেই ক্রমশই অচেনা লোকের
চলাচল শুরু হয়। প্রশ্ন করলে তেমন সঠিক উত্তর পাওয়া যায় না। ওরা আকারে ইঙ্গিতে গঙ্গার
ঢালের দিকে দেখিয়ে দেয়। তারপর এক সময় ওরা দ্রুত অন্ধকারে মিলিয়ে যায়।
‘এমন
যদি হতো আমি পাখির মতো, উড়ে উড়ে বেড়াই সারাক্ষণ’। এ গানটা ওপার বাংলার ব্যান্ড ‘জলের’ গান বলে বিখ্যাত হয়েছে। আর এই গানটা এখন ওপার থেকে বাতাসে ভর করে কবে যেন এপারে চলে এসেছে। সেই সাথে এখন মোহনগঞ্জের সকল ছেলে-ছোকরাদের মুখে
মুখে ভেসে বেড়াচ্ছে অদ্ভুত এই গানের কলি। এমনকি জমিতে নিরানি দিতে দিতেও চাষিরা সীমান্তের
দিকে তাকিয়ে এই গানটা গেয়ে চলে। হয়তো যথেচ্ছ
খাবারের সন্ধানে ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই ওপারে উড়ে যাওয়া এবং সন্ধার প্রাককালে ফিরে
আসা পাখিদের দিকে তাকিয়ে গোচারণ থেকে ফেরা রাখালরাও এই একই গানের মাধ্যমে নিজেদের মনের
একান্ত ইচ্ছে জানিয়ে থাকে। এখানে কোন কাঁটাতারের সীমানা নেই। শুধু গঙ্গাই এমন ভাগ বাটোয়ারার
পাহারাদার হয়ে দেশ ভাগের বহু শতাব্দী আগে থেকেই মূল সাক্ষী হয়ে বয়ে চলেছে। স্থানীয়
গ্রামবাসী্রা তাই হয়তো রগড় করে ছড়া কেটে বলে- ‘এপার গঙ্গা, ওপার পদ্মা, একই রঙের পানি
/ তবু দুই সতীনের একই ঘরে নিত্য হানাহানি’।
মোহনগঞ্জের
দরগাতলার লোকদের মতো সীমান্তবর্তী গ্রামবাসীরা সামান্য কান পাতলেই বুঝতে পারে কার পায়ের
ধ্বনি কেমন। সাধারণত গ্রামবাসীরা ইচ্ছে মতো পা ফেলে নিজেদের গ্রামে হাঁটাচলা করতে ভালোবাসে।
কখনও বা তাদের পদচারণায় ক্ষিপ্রতাও থাকে। কিন্তু সন্দেহভাজন অচেনা লোকের পায়ের ধ্বনির
মধ্যে থাকে সতর্কতা। এমনকি পাতার মর্মর ধ্বনিও যেন কেউ শুনতে না পায়, এমনই মৃদু ও সজাগ
গতি! আর এই ফারাকটা গ্রামবাসীরা বোঝে। তাই নিত্য নতুন অচেনা পায়ের শব্দে গ্রামের প্রবীণদের
মনটা আবার কেঁপে ওঠে। মাঝে মাঝে তারা অশনি সংকেতও দেখতে পায়। মাঝে মাঝে তাদের স্মৃতিতে
কার্গিলের স্মৃতি হানা দেয়!
এখানে
কোন নির্দিষ্ট রুটম্যান নেই। যে কেউ সু-খবর দিতে পারে। খবরের ওজনের উপর তার দক্ষিণা
নির্ভর করছে। আগে রুটম্যান ছিল। কিন্তু যেবার দরগাতলায় রাতের অন্ধকারে কার্গিলের যুদ্ধে
দু’জন মারা গেল, তারপর থেকে এদিকে বি এস এফদের যাতায়াত বা নজরে অনেকটাই ঢিলেমি পড়েছে।
আসলে সেদিন রুটম্যানের কাছ থেকে বি এস এফরা যে আজ রাতে রেড করতে পারে এমন কোন খবর অগ্রিম
না পাওয়ায় অত বড় একটা ঘটনা ঘটে গিয়েছিল! কাজেই তারপর থেকে আর কোন একজনের দায়িত্বে রুটম্যানের
ভার দেওয়া হয়নি। অতএব এখন বলা যায় চারদিকে অনেকেই চোখ-কান খুলে ঘুরে ঘুরে রুটম্যানের
কাজ করে। আবার কাগজ কলমে একজনও রুটম্যান নেই।
এখানে
পদ্ধতিটা একটু ভিন্ন ধরনের। প্রায় রোজই স্থানীয় বাগাল বা রাখালেরা তাদের মনিবদের গবাদি পশুগুলোকে গোচারণভূমিতে নিয়ে
যায়। এমন কাজে তো আর বি এস এফের কাছ থেকে কোন অনুমতির ব্যাপার নেই। আর এটাও কারোর অজানা
নেই যে এভাবে গোচারণে যাওয়াটা দীর্ঘ শতাব্দীর একটা চিরাচরিত প্রথা। কথিত আছে যে স্বয়ং
নন্দলালও রোজ অন্যান্য বাগালদের সাথে গোচারণে যেতেন। তবে সেই গবাদিপশুরা যেন অন্যের
শস্যে ভাগ না বসায় সেটা রাখালদের দেখার দায়িত্ব। আর তাইতো তারা সদলে যখন গোচারণে যায়
তখন প্রায় প্রতিটি গবাদি পশুর মুখে এক ধরনের দড়ির বা বাঁশের কঞ্চি দিয়ে অথবা বাঁশের পাতলা ছিলা বা চটা দিয়ে হাতে বুনে এমন
একটা জিনিস বানানো হয় যা দিয়ে গবাদি পশুদের মুখটা ঢাকা থাকে। ওকে মুখাবরণ বলা যেতে
পারে। তবে বিভিন্ন গ্রামে এর আলাদা আলাদা নাম রয়েছে। শুধু মাত্র মাঠে গিয়ে বা খাওয়ার
সময় তা খুলে ফেলা হয়।
গ্রামের
রাস্তা সামান্য বৃষ্টিতে এতটাই কর্দমাক্ত হয়ে যায় এবং তার উপর দিয়ে সেই সকাল থেকেই
অনবরত এত পশু যাতায়াত করে যে তা সাধারণের ব্যবহারের উপযুক্ত থাকে না। তার উপর এখন তো
বর্ষা শুরু হয়ে গিয়েছে। নদীর এপার ওপার জুড়ে আদিগন্ত বিস্তৃত পাটগাছগুলো সেই জলের স্বাদ
পেয়ে ধাঁই ধাঁই করে একে অপরের থেকে লম্বা হওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে। তাই নদীর
ঢালে নেমে আর ওপার দেখা যায় না। এমনকি নদীও চোখের আড়াল হয়ে যায়। বিঘার পর বিঘা এভাবেই
নদী ও সীমান্তকে পাট গাছের আচ্ছাদনে মুড়ে ফেলে। কাজেই একেবারে নদীর কাছে যেতে হলে পাট
গাছ সরিয়ে সরিয়ে বা গাছ ভেঙে রাস্তা না করা পর্যন্ত উপায় নেই। আর তাই হয়তো পাট চাষিরা
বাধ্য হয়েই বিঘার পর বিঘা পাট গাছ সোলেমানদের মতো লোকদের কাছে বিক্রি করে দেয়। তা না
হলে কেউ জানেনা কার জমির উপর দিয়েই নিত্য যাতায়াতের রাস্তা বানানো হবে। তার থেকে কাঁচা
পাট বেঁচে দেওয়াই ভাল।
তাই
সকাল থেকেই বিভিন্ন গ্রামের বাগাল বা রাখালেরা মোহনগঞ্জ গ্রামের পথ ধরেই নদীর ঢালে
নেমে যাচ্ছে। কিছুটা এগিয়ে গেলে নদীর চর চিৎপাত হয়ে শুয়ে রয়েছে। ওর সারা শরীর জুড়ে
কচি কচি ঘাসের গালিচা পাতা। দেখলেই মানুষেরও লোভ হয় ঐ সবুজ গালিচায় শুয়ে পড়তে। আর গবাদিদের
মনে যে কী হয় তা বোঝার মতো ক্ষমতা ওদের নেই। কিন্তু ওদের মুখে মুখোশ পরানো থাকলেও মুখের
পাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে লালার স্রোত। তাই চারণভূমিতে এসেই বাগালেরা তাড়াতাড়ি সবার মুখ
থেকেই ঐ মুখোশটি খুলে দেয়। আর ওরাও এক সাথে মাথা নিচু করে গোগ্রাসে সবুজ ঘাস খেতে মেতে
ওঠে ।
এত
বড় চারণভূমিতে এখন সব গবাদি পশুরাই মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। কেউ ওদের আলাদা করে
বোধ হয় চিনতে পারবে না। এমন ভাবনাটা গ্রামের সবারই। কিন্তু তাদের ভাবনা ঠিক নয়। যে
রাখালেরা চারণভূমিতে গবাদি পশুদের ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে নিজেদের মধ্যে গল্প করে
বা তাস খেলে অথবা বাঁশি বাজায়, তারা এমন কথা শুনে হাসে। বেশি জোরাজুরি করলে হাসতে হাসতে
বলে- ‘কি যে কহিছ না তোমরাচ। হামাদের জিনিস হামরা আবার চিনবো না কেনে! এখান থেকে বসে
বসেই কহে দিব কুনটা হামার আর কুনগুলান ওদের। অবশ্য উয়ারাও হামাদের চেনে’।
গবাদি
পশুদের মানুষের এসব কথা শোনবার কোন ফুরসৎ বা বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। সামনে সাজানো এমন
সুখাদ্য ফেলে ওসব বাতুলতায় কান দিতে ওদের বয়েই গেছে। বরং আরো কিছুটা এগিয়ে যাওয়া যাক।
ওরা নদীর তটভূমি ধরে খেতে খেতে ক্রমশই এগিয়ে যায়। পেছনে পড়ে থাকে মানুষদের আড্ডা!
প্রশ্নটা
যারা করেছিল তারা বাগালির কাজই করে। তবে তাদের কোন বাঁধাধরা মুনিব নেই। যেদিন যে যেমন
বলে তেমন ভাবেই তাদের বাড়ির অবলাদের হাঁকিয়ে নিয়ে যায় গোচারণ ভূমিতে। আবার ফেরার পথে
সারা আকাশ ধুলোয় ধুসরিত করে যার যার অবলা তাদের নিজের নিজের বাড়ির সামনে রেখে শুধু
একটা হাঁক দিয়ে বলে দেয়- ‘তুমাদের গাইটাক বাছুর সমেত দিয়ে গেনু গো। উয়াকে ঘরত ঢুকায়
লিও’।
ব্যস!
এতেই কাজ হয়ে যায়। মালিক বা মালকিনীর আসতে সামান্য দেরি হলেই অবলারা নিজেদের বাড়ি চিনতে
পেরে মাথা দিয়ে ঠেলে বাতার পলকা বেড়াটা সরিয়ে নিজেরাই আঙিনায় এসে হাজির হয়। আর তখন
বাড়ির গিন্নিমা দুপুরের ভাতের ফ্যানের বালতিটা আর সবজির খোসা নিয়ে হাজির হয়। ওরা সেটাও
চেটে পুটে খেয়ে জিভ দিয়ে সারা মুখ চাটতে চাটতে গোয়াল ঘরের উদ্দেশে চলে যায়। আর সাথে
সাথে বাড়ির কেউ না কেউ বাছুরটাকে তার মায়ের কাছেই বেঁধে রাখে। তা না হলে ঐ দুষ্টু বাছুরটি
সারা রাত ধরে মায়ের শরীর নিঙড়ে সব দুধ খেয়ে নেবে! আর সকালে মালিকের হা-হুতাশে বাড়িতে
কাক বসতে ভয় পাবে। ফলে সব রাগ বা দোষ গিয়ে পড়বে গিন্নি মায়ের উপর। এমন খাতির যত্ন যে
শুধু মাত্র তার দুধের জন্য তা অবলারা দিব্বি বুঝতে পারে। কাজেই বাড়ি যতই মাথায় তোলা
হোক না কেন তাতে তাদের কিছুই এসে যায় না।
(ক্রমশ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন