সমকালীন ছোটগল্প |
মানুষের রঙ
(এক)
মুঠো ভর্তি কলমগুলি সন্তপর্ণে মেয়ের দিকে
বাড়িয়ে রিয়ানার বাবা বললেন-
-নে ধর, আরে সাবধানে ধর, এখুনি বক্সে
ঢুকিয়ে রাখ। ও হ্যাঁ, সবগুলো কলমের মাথা ঘষে ঘষে চালু করেছিস তো?
-হুঁ। আচ্ছা, আজ তাহলে তাড়াতাড়ি খাওয়া
দাওয়া সেরে ঘুমাতে হবে কাল সকাল সকাল উঠতে হবে। কই, খাবার রেডি? স্ত্রী সোমার দিক থেকে আবার মেয়ের দিকে
ফিরে একটু গলা নামিয়ে বললেন
-শোন, ইয়ে কলমগুলো চৈতালীকে ধরতে দিস না, গলা আরো
নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে, মানে না দেয়াই ভালো আরকি, বুঝিস
না... হুজুর বাবা খুব ভাল করে ফুঁ দিয়ে দিয়েছেন। বুঝলে গো,
নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ফুঁ দিয়ে নিয়েছি। উনি তো আমাকে বিশেষ স্নেহের চোখে দেখেন, বললেন- কোন ভয় নাই
পরীক্ষা ভাল হবে।
বাবার এসব বিটকেলে কথা শুনলেই মেয়ের
চোখমুখ শক্ত হয়ে যায়। মেয়ে বিরক্ত চোখে মায়ের দিকে
তাকায়, সোমার মনে হয় সেই ১৯৪৮এর সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর লালসালুর রঙ এখনও এই একবিংশ শতাব্দীতে কী করে এত
টকটকে থাকে! সে ঠান্ডা দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকায়, যার অর্থ এখন শান্ত থাকো। তারপর
চলে যায় খাবার রেডি
করতে। রিয়ানার বাবা অফিফের ব্যাগ হাতে তুলে নিয়ে ঘরে যায় ফ্রেস হতে।
আগামীকাল থেকে রিয়ানার এস এস সি পরীক্ষা।
এতদিন ধরে মেয়েটা কঠিন পরিশ্রম করেছে। বিভিন্ন স্যারের কাছে কোচিং করা, নানা রকম
পরীক্ষা দেয়া, রাত জেগে লেখাপড়া - খুব নিষ্ঠার সাথে করেছে। সে ঢাকার একটি নামকরা
স্কুলের স্টুডেন্ট। সেই প্রথম শ্রেণি থেকেই ক্লাশে সে প্রথম
৫ জনের মধ্যেই থাকে। পরীক্ষার জন্য রিয়ানার কলম
পীরবাবার কাছে নিয়ে গিয়ে ফুঁ দিয়ে নিয়ে এসেছে। যেটা সোমা বা রিয়ানা কেউ পছন্দ করছে না। পছন্দ না হলেও কিছু
বলার নাই।
চৈতি রিয়ানার ছোটকালের বন্ধু। স্কুল, কোচিংএ
যাওয়া আসা সব করে একসাথে। চৈতির বাবা একজন ডাঃ ওদের গাড়িতে
করেই ওরা দুজন স্কুল ও কোচিংএ যায় আসে। ওর পুরো নাম চৈতালী ব্যানার্জী, সবাই ওকে চৈতি বলে
ডাকলেও রিয়ানার বাবা পুরো নাম ধরে ডাকে। ফ্ল্যাট কেনার সুবাদে এই দুই
পরিবার পরস্পরের প্রতিবেশী।
পরে দেখা গেল ডাঃ সাহেবের ছোটমেয়ে চৈতি আর ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের একমাত্র সন্তান
রিয়ানা এক স্কুলে একই ক্লাশে পড়ে। ধীরে ধীরে দুই পরিবারের মধ্যে গড়ে ওঠে এক চমৎকার
সম্পর্ক। বিশেষ করে সোমা ও চৈতির মা যেন দুই সহোদরা হয়ে ওঠে। চৈতির মা
কিছুটা সিনিয়র হওয়াতে তিনি সবসময় বড়বোনের মত মায়াবী আচরণ করেন সোমার প্রতি। সোমাও ধীরে ধীরে এই অনাবিল অপত্য স্নেহের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে।
মেয়েদেরকে স্কুলে, কোচিংএ নিয়ে যাওয়া, সেখানে বেতন দেয়া, টিচারদের সঙ্গে কথা বলা সব করে
সোমা, চৈতির মা বাইরে খুব একটা বেরুতে চান না, আর্থারাইটিসের ব্যথার কারণে। আর চৈতি রিয়ানার বন্ধুত্ব হতে সময় লাগে না। ওরা তো আগে থেকেই মুখ পরিচিত ছিল তাছাড়া কোনকিছু যাচাই বাছাই না করেই বন্ধুত্ব
গড়ে তুলতে শিশুদের জুড়ি নেই। ওরাই জগতে সাবলীল এবং সত্য। প্রথমদিন দুই পরিবারে
আলাপ পরিচয় হওয়ার পর থেকে এই দীর্ঘ বছরে দুই ফ্ল্যাটের দরজা কখনও বন্ধ হয় না, খোলা দরজা
দিয়ে যে কোন সময় ওরা আসা যাওয়া করে। প্রথমদিন আলাপের পর রাতে ঘুমানোর আগে রিয়ানার
বাবা সোমাকে কিছুটা হতাশার সুরে বলে-
-প্রতিবেশী মনোমত
না হলে খুব মুশকিল...
-এনাদেরকে তো ভালই মনে হচ্ছে, সময় যাক
দেখা যাক একদিনের আলাপেই কি ভালমন্দ বোঝা যায়!
-আরে বাবা,
ভালোমন্দ বুঝতে সময়ের দরকার কিন্তু জাত বুঝতে তো আর সময়ের দরকার হয় না!
-মানে? সোমার বিস্মিত কণ্ঠস্বর।
-ওরা তো হিন্দু।
-তো?
-আরে! বোঝ না কেন, আমাদের মত হলে ভালো
হত।
সোমা খুব অবাক হয়ে চোখ গোল করে তাকিয়ে থাকে অন্ধকারে, একথার উত্তরে কি বলবে সে
ভেবে পায় না।
-কি, ভাল হত না? তুমি বুঝতে পারছ, কিন্তু না বোঝার ভান করছ। একটা শ্বাসের সঙ্গে ‘জানি না’ বলে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পরে
সোমা। অহেতুক
কে তর্ক করতে যায়! রিয়ানার বাবা নিজে
যেটা বুঝবে তার উপর কোন কথা চলে না। একথা খুব ভালো করেই জানে সোমা। কাজেই মুখ বুজে
থাকা বুদ্ধিমানের কাজ। এবং সেই বুদ্ধি ও
কৌশল দিয়েই সোমা এতগুলো বছর স্বামী, সন্তান, প্রতিবেশী নিয়ে প্রতিটি আগামীকাল
পেরিয়ে এতদূর এসেছে। তবে এ বিষয় নিয়ে মাঝে মাঝেই যে ঝামেলা বাঁধেনি তা
নয়।
আলো হাওয়ার মত সবাই যখন তখন যাতায়াত বা দুই বাড়ির
খাবার দাবারে স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহণ করে থাকে। রিয়ানা বৌদির হাতের স্ন্যাকস
আর বেকারী খাবারের পোকা
আর চৈতির বাবা সোমার হাতের গরুর মাংসের দারুণ ভক্ত। বিশেষ দিনে বা ঈদের সময় উনি
আগেই বলে রাখেন-
-সোমা, দেখ মাংস যেন শর্ট না পড়ে।
ভেবেচিন্তে ফাষ্ট ক্লাশ মাংস কিনবে। সোমাও রান্না শেষে প্রথমেই উনাদের বাসায় একবাটি দিয়ে আসে। আবার বাসায় টেবিলে মাংসের বিভিন্ন আইটেম পর্যাপ্ত
পরিমানে পরিবেশন করে। খেতে খেতে বৌদি দাদার দিকে ঝামরে উঠে-
-দেখ একটু বুঝে শুনে খাও, ভুঁড়ি তো
দিনদিন আকাশ ছুঁতে চাচ্ছে... বৌদির কথার মাঝখানেই দাদা গমগম করে ওঠেন-
-দেখ, এই খাবার সময় লারেলাপ্পা কিছু বলবা
না। আমি যথেষ্ট ব্যায়াম করি, হাঁটি, ও ভুঁড়ি টুড়ি ঠিক কমিয়ে ফেলব। দেখ না আমি কত
ফিট। কোন অসুখ বিসুখ নেই। সোমা তোমার বৌদিকে চুপ থাকতে বল আমি তো আর রোজ মাংস খাই না। সোমা
হাসিমুখে দাদা বৌদির খুনসুটি উপভোগ করে। খাবার পর্ব চলে অনেক সময় নিয়ে সেই সাথে আড্ডাও
চলে।
দাদা যে কত গল্প জানে! নিজে একজন ডাঃ হলেও তিনি সাহিত্যের প্রচুর বই পড়েন। তার বাসায়
দেয়ালজুড়ে বিভিন্ন বিষয়ের বই আর বই। সোমাও বই পড়তে ভালবাসে, চৈতি রিয়ানা সবাই বই
পড়ে। বৌদি বই না পড়লেও খুব সুন্দর রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়।
দাদা বৌদির বড় মেয়ে চন্দ্রিমা, সে একজন ডাঃ। এখন কানাডায় থাকে। বছর তিনেক আগে একটি ডাঃ ছেলের সাথে বিয়ে হওয়ার পর সে কানাডায় চলে যায়। বিয়ের
সময় সোমা ও রিয়ানার বাবা, দাদা বৌদির পাশে থেকে সবরকম সাহায্য সহযোগিতা করেছে।
রিয়ানার বাবা প্রতি সপ্তাহে ছুটির দিনগুলোতে
দেশের বাড়িতে যায়। সেখানে তার ছোট ভাইয়ের ছেলেমেয়েকে পড়ায়, অংক গ্রামার, ব্যকরণ সে নিজে ভালোভাবে তাদেরকে শেখায়। বৃহস্পতিবার রাতের ট্রেনে গিয়ে আবার শনিবার রাতে রওয়ানা দিয়ে রোববার এসে অফিস
করে। এটা
তার নিয়মিত কাজ। এরকম সময়ে হঠাত একদিন রিয়ানা ভীষণ অসুস্থ্ হয়ে পড়ে। সকাল থেকেই শুরু হয় বমি এবং ঘন ঘন ওয়াশরুমে
যাতায়াত। সোমা চিড়া ভিজিয়ে নরম করে খাওয়ায়, জাউ (গলা ভাত) করে খাওয়ায়, পাশাপাশি ওর
স্যালাইন চলতে থাকে কিন্তু রাত বাড়ার সাথে সাথে অবস্থা কঠিন আকার ধারণ করে,
প্রচন্ড জ্বরে মেয়ে বেহুঁশের মত হয়ে যায়, সাথে চাল ধোয়া জলের মত তরল বের হয়ে যেতে থাকে। মাঝরাতে অবস্থা বেগতিক হলে সোমা বৌদির দরজায় নক করে। দাদা নিজে
গাড়ি ড্রাইভ করে মেয়েকে ধানমন্ডি পপুলার ক্লিনিকে ভর্তি করান। তারপর ফোনে উনার
ডাঃ বন্ধুকে অনুরোধ করে মেয়ের পাশে আনান। ক্লিনিকে যাওয়ার আগে দাদা অবশ্য একচোট চেঁচামেচি করেন
সোমা ও বৌদির উপর-
-তোমরা, এই মেয়েরা কোনো বিষয়ের গুরুত্ব বোঝ না! কোনটা ইম্পরট্যান্ট সেটাই
তোমাদের মাথায় ঢোকে না! বাচ্চাটা সারাদিন এতবার বমি করেছে, এতটা অসুস্থ্ তোমরা
আমাকে জানাওনি! কোন ব্যবস্থা নাওনি! আশ্চর্য! এমনিতে তো কথা বলে বলে কানের পোকা
বের করা দাও, কিন্তু দরকারী কথা বলতে তোমাদের জিহ্বা লক হয়ে যায়। বৌদি মিনমিন করে বলার চেষ্টা করেছিল, আমরা ভাবছিলাম সেরে যাবে, বৌদির কথা
শেষ হবার আগেই দাদা হুংকার দিয়ে উঠেন-
-ব্যস চুপ কর। এখন প্রার্থনা করো মেয়েটা
আগে সুস্থ্ হোক। সোমার দিকে তাকিয়ে একই কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন-
-ভাইকে খবর দিয়েছ, সোমা? নাকি তাও করনি?
উপর নিচ ঢক করে মাথা নাড়িয়ে জানায় সোমা, হ্যাঁ দিয়েছি।
সারাটারাত সবাই মেয়ের পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে
রইল। দাদাও
একটিবার বসলেন না পর্যন্ত। সকালের দিকে মেয়ে অনেকটা সুস্থতার দিকে আসে, গায়ের তীব্র তাপমাত্রাও কমে আসে। রিয়ানার বাবা ফিরে এসে দাদাকে খুব কৃতজ্ঞতা
জানায়।
একজন হুজুর নিয়মিত আসেন রিয়ানাকে আরবী পড়াতে। রিয়ানা কোনোদিন পড়তে বসে বেশিরভাগ দিনই বসে না। বসলেও ১০ মিনিটের বেশি পড়ে না। এই করে করে এখন সে কোরানশরীফ পড়ছে। অপেক্ষায় আছে কবে খতম হবে। রিয়ানা না পড়লেও হুজুর নিজে কোরনশরীফ তেলাওয়াত করে নাস্তা পানি খেয়ে চলে যান। মাসে একবার খাম দেবার সময় সোমার সাথে হুজুরের কিছু কথাবার্তা হয়। রিয়ানার অসুস্থতার খবরে হুজুর দুশ্চিন্তায় ছিলেন তিনি ছাত্রীর জন্য বিশেষভাবে মোনাজাত করেছেন। সোমা খামটি হুজুরের হাতে দিয়ে কুশল জিজ্ঞেস করে-
-কেমন আছেন আপনি?
-জী, আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো আছি। মামণির
শরীর এখন ভালো আছে ত আপা? একটু সাবধানে থাকা দরকার। মা’ টার উপর দিয়ে এত বড় ধকল
গেল! যাক, আল্লাহর অসীম দয়া সুস্থ্ হয়ে গেছে। ভাগ্য ভালো পাশের বাসার দাদারা
ছিলেন। তবে আপা,
আপনাদের মত দুই পরিবারে এত মিল আমি আর কোথাও দেখিনি। অনেক জায়গায় তো পড়াতে যাই।
এটা খুব ভালো আপা, আল্লাহতায়ালা পছন্দ করেন। চকিতে, সোমার মাথায় একটু দুষ্টুমি
খেলে যায়-
-কিন্তু ওরা যে হিন্দু, আল্লাহ
পছন্দ করবেন!
-আপা, কি বলেন! আপনি মনে হয় মস্করা
করছেন! হিন্দু তাতে কি! আল্লাহপাক ইরশাদ
করেছেন- “ঈমানের দাবীদার প্রতিটি মুসলিম যেন পরধর্ম বা মতাদর্শের প্রতি পরমসহিষ্ণুতা
ও শ্রদ্ধা দেখান”। প্রতিবেশীর সাথে মহব্বত অবশ্যই আল্লাহ পছন্দ করেন। আর এই যে দুই মামণির এত বন্ধুত্ব, বোনের মত এত গলায় গলায় ভাব এটা তো একটা উত্তম ব্যাপার
আপা - মাশাল্লাহ! মাশাল্লাহ! আমি ওদের জন্য আল্লাহর কাছে খাস
দিলে দোয়া করি, রহমত ভিক্ষা চাই। ওরা বড় মানুষ হোক। চিরজীবন বোনের মত থাকুক।
(দুই)
দুর্গা পুজোর দিন রাতের
বেলা রিয়ানার বাবার সাথে সোমার তর্ক একসময় বিষম ঝগড়ার দিকে মোড় নেয়। আজ রাতে রিয়ানা ও চৈতি, চৈতির
রুমে মুভি দেখবে বলে আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। রিয়ানা কেন পুজোর রাতে চৈতিদের বাসায়
থাকবে এই ইস্যুতেই ঝগড়া।
-আজকের দিনে মেয়েটাকে ও বাসায় যেতে দিলে কেন? সব সময় তো
যায়, আজকেও যেতে হবে কেন! একেবারে কি ওদের কাছে মাথা বিক্রি করে দিয়েছ?
-তুমি এসব কি বলছ! মাথা বিক্রি! আর, আজকের
দিন আবার আলাদা হল কেন? সব সময় ত যায়-
-আমিও ত বলছি সব সময় যায় থাকে খায়, আজও কেন
যেতে হবে! আমি ও বাসায়
যাওয়া আসা এত মাখামাখি পছন্দ করি না, তুমি বোঝ, বুঝেও চুপ করে থাকো। আমার পছন্দ অপছন্দ
তোমার গায়েই লাগে না। ঐ শালা মালাউনের এত টাকাকড়ি, এত ঐশ্বর্য, ওখানে কানাডার বাতাস এসবই
তোমার ভালোলাগে আমি বুঝি না! তোমাকে আমি চিনি না! তোমার নজর তো আকাশমুখী! শালা
মালাউন!
শালা গরুখোর!
সোমা হতভম্ভ! কি বলে এসব! মানুষটার
কি মাথা খারাপ হয়ে গেল! এটা একটা বিষয় হল! যে মেয়েটা এতগুলো বছর ধরে যাওয়া আসা
করছে আজ আবার নতুন করে কি হল! সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে এই মানুষটা এসব কি বলছে! মুখের
লাগাম একেবারেই নেই! হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে যা তা বলছে... এই এক ইস্যুতে বিদ্ধ হতে
হতে সোমার আজকাল বড্ড ক্লান্ত লাগে। সে গলা নামিয়ে ধীর স্থির
ভাবে বলে-
-প্লিজ বি প্র্যাকটিকাল, বি র্যাশনাল, উনি ওনার
জায়গায় তুমি তোমার জায়গায়। তোমারো টাকাপয়সা কম নাই, কিন্তু তুমি থাকো ফকিরের মত, চলো কৃপণের মত তাতে
কার কি! কই তুমি নিজ ধর্মের আর কোনকিছু তো পালন কর না, নামাজ পড় না, জাকাত
দাও না,
জীবনে দেখিনি কাউকে ১০টা টাকা দান করেছ! কেবল অন্যের ধর্ম নিয়ে কেন
মিছে এই অভদ্রতা! উনি কি খাবেন না খাবেন সেটা উনার বিষয়, তোমার তাতে কি! আর এই
মানুষটা মাত্র কদিন আগে তোমার সন্তানের অসুখের সময় কি করেছে তুমি ভুলে গেলে! তুমি
তো তখন বাড়িতে মাস্টারি নিয়ে ব্যস্ত ছিলে! তুমি কি একটা মানুষ! এই তোমার শিক্ষা! ভদ্রতা! সোমা
তাকিয়ে দেখে ক্রোধে অন্ধ নাকের পাটা ফাতনার মত দুলছে...
-কিহ! কি বললে তুমি! এটা অভদ্রতা! তুমি নিজে
কি! তুমি কি একটা ভদ্রমেয়ে! তোমাদের বাড়িতে কিসব শিক্ষাদীক্ষা ছিল আমি জানি না! তোমার বাপের বাড়িতে হিন্দু মুসলমানে মাখামাখি! আমাকে ভদ্রতা শেখাতে এসেছে! কাল থেকে ঐ মালাউনদেরকে
যেন আর না দেখি আমার বাসায়। আর আমার যখন সময় হবে আমি নামাজ পড়ব, জাকাত দেব, সবই করব... আমাকে শেখাতে
এসো না!
-আচ্ছা এই দীর্ঘ বছরের সম্পর্ক, তারা যে আমাদেরকে
এত মায়া করেন, ভালোবাসেন, মেয়ে দুটির মাঝে এত হৃদ্যতা, তাদের কোনো একটি আচরণ কি
তোমার কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায় না! তুমি কত বড় বড় প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করেছ! কতবার
বিদেশে যাচ্ছ! কত মানুষের সাথে তোমার ওঠাবসা তবু তোমার ভেতরে এত সংকীর্ণতা
কেন! অনেক হয়েছে, আর এসব ভালো লাগে না। বেশ, তুমি মেয়ের স্কুলে যাবার ব্যবস্থা করো, ওদের গাড়িতে
করে আর যাব না। কবে থেকে বলি একটা গাড়ি কেন...
-গাড়ি কি তোমার বাপ কিনে দেবে! কিনব কি
কিনব না সেটা আমার ব্যাপার। এ নিয়ে তুমি কথা বলবা না। সোমা কথা না বাড়িয়ে একদম
নিশ্চুপ হয়ে যায়।
রাতের ঝগড়া দিনের আলোয় আর তেমন একটা প্রাণ
পায় না,
তবে সোমা মনে মনে আরো সাবধান হয়ে যায়। এতদিনের ঘনিষ্ট সম্পর্ক, সাবলীল যাতায়াত
বৌদি অনেক কিছুই বুঝতে পারে কিন্তু দাদা কিছুই বোঝেন না। দিলদরাজ মানুষ আয় করে
দুহাতে, আনন্দ মৌজ করে প্রাণভরে। এসব ক্ষুদ্রতার মধ্যে তিনি নেই। বৌদিও বিষয়টা যতই
বুঝতে পারে সোমার প্রতি তার স্নেহের মাত্রা আরো বাড়তে থাকে...
এই জায়গায় সোমা একেবারে দুর্বল। বৌদির
অকৃত্রিম স্নেহের কাছে। মানুষের
ব্যবহার, বিবেক, মনুষ্যত্ব অবশ্যই বিচার্য
কিন্তু হিন্দুত্ব কারো বিচারিক মাপকাঠি হতে পারে এটা সে মনে মনেও স্বীকার করে না। কারণ তার বাবার
বাড়িতে দেখেছে কত হিন্দু প্রতিবেশী বা বন্ধু বা কাজের সহায়তাকারী। পড়তে গিয়ে ক্লাশে কত অন্য ধর্মের
বন্ধু ছিল, কই তাদের সাথে মিশতে, শেয়ার করতে এতটুকু সমস্যা তো হয়নি! ছোটবেলা
থেকে বেড়ে ওঠার কালে বাবা মা অনেক আদেশ নির্দেশ উপদেশ দিয়েছিল কিন্তু
অন্য ধর্মের কারো সাথে মেশা যাবে না তাতো ঘুণাক্ষরেও বলেনি। সোমার খুব হতাশ লাগে।
এই ঘটনার মাসখানেক পরের
কথা, রিয়ানার বাবা দেশে গিয়েছে মাস্টারি করতে। বাবা না থাকলে রিয়ানা খুব স্বতস্ফুর্ত
থাকে। সারাক্ষণ মাথার উপরে ট্যাক ট্যাক টিক টিক আর কাঁহাতক সহ্য হয়। আজ বৌদি সোমাকে রান্না বান্না করতে মানা করে দিয়েছে। অবশ্য রিয়ানার
বাবার অনুপস্থিতে প্রায়ই বৌদি এমন বলে-
-মাত্র দুজন মানুষ, তোমাকে আর
রাঁধতে হবে না। একসাথে সবাই খেয়ে নিলেই হবে। খাবার টেবিলে দাদা সেই পুরনো কথা আবার বলেন-
-ভাই থাকলে আরো জমত। আহা, বেচারা সব
ছুটিতেই বাড়ি যায়। ভালো, ভালো, খুব দায়িত্ববান মানুষ। ভাইয়ের বাচ্চাদের জন্য এত
স্যাক্রিফাইস আজকাল কেউ করে না। এতদূর থেকে প্রতি সপ্তাহে যাওয়া আসা মুখের কথা না, এ
যেন রাম লক্ষ্মণ। স্বভাবসুলভ প্রসন্নতায় দাদা নিজের মনে কথা বলে যান। এমন সময়
সোমার ফোনে একটা কল আসে। ফোন ধরে একটু কথা বলার পরই সোমা ফ্যালফ্যাল করে টেবিলের
উলটো দিকের চেয়ারে বসা রিয়ানার দিকে তাকিয়ে থাকে। সবাই উৎকণ্ঠিত হয়ে প্রশ্ন করে-
-কি হয়েছে? কি হয়েছে? সোমা কথা বলতে পারে না। বৌদি
এঁটো হাত উপরে তুলে আরেক হাতে জড়িয়ে ধরেন... এক দুর্বিসহ অনন্তকাল যেন লেপ্টে
থাকে কদর্য হাত পা ছড়িয়ে...
পরে বিস্তারিত জানা যায় রিয়ানার বাবা যে
বাসটিতে ফিরছিলেন সেটি ভয়াবহ দুর্ঘটনায় পড়েছে। অনেক যাত্রী স্পট ডেড। টিভি অন করলে দেখা যায় সেখানে স্ক্রলে ব্রেকিং নিউজ যাচ্ছে।
আজ দুদিন ধরে সবাই ক্লিনিকে। দাদা বৌদি
রিয়ানার মামা খালা সবাই। দুদিন বাদে আজ উনার জ্ঞান ফিরেছে। প্রথমে তো মৃত্যুর খবর এসেছিল। তা নয় তবে
খুব বাজে ভাবে আহত হয়েছে। শরীরের প্রায় সব জায়গায় জখম ছিল গুরুতর। একটা পা শেষ পর্যন্ত টিকবে কিনা এখনও বলা যাচ্ছে না। আর এত
ব্লাড চলে গেছে যে আরেকটু হলে কেবল রক্তশূন্যতায় অন্যরকম কিছু ঘটতে পারত। একইরকমভাবে আবার হাল ধরেন দাদা। তিনি বৌদিকে বলেন-
-তুমি সোমা রিয়ানাকে দেখ আমি এদিকটা
সামলাচ্ছি...
আরো কয়েকদিন পরে ক্লিনিক থেকে ছেড়ে দিলে সবাই বাসায় চলে
আসে। ক্লিনিকে এই কয়েকদিন রিয়ানার বাবা দাদাকে ছাড়া যেন কিচ্ছু বোঝেনি। জ্ঞান
ফেরার পর থেকে দাদা যতক্ষণ থাকেন দাদার হাত ধরে থাকে। আসলে ভীষণ ভয় পেয়েছে। এমন দেখে একদিন রিয়ানা
ওর মায়ের দিকে একটা চোখ টিপে বলে-
-‘তেঁতুল হুজুর’ এবারে ঠান্ডা হয়ে গেছে...
হিহিহিহি। সোমা মেয়েকে কৃত্রিম ধমক দেয় আবার জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে বলে-
-সব কিছু ঠিকঠাক হয়ে যাক রে, এই মানুষগুলোর
এত ঋণ কিভাবে শোধ করব!
-আরে, দেখই না সব এবারে ঠাণ্ডা হয়ে যাবে,
বুঝছ মা, খারাপেরও একটা ভালো দিক থাকে, বাবা আর কাকুদের নিয়ে বাজে কথা বলবে না, আমি
খুব খুশি হিহিহি...
বেডরুমে সোমা রিয়ানা ওর বাবাকে ঘিরে বসে
আছে। জানালা দিয়ে ঢাকা শহরের শুভ্র রোদ মেঝেতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাদা বিড়ালের মত
গড়াগড়ি দিচ্ছে। রিয়ানার কলেজ ছুটি। সেও বাবার কাছেই ঘুরঘুর করে
সারাক্ষণ, ওর বাবার পা প্লাস্টার
করা, শরীরের এখানে ওখানে ছোটবড় ব্যান্ডেজ, আজই প্রথম পেছনে বালিশ দিয়ে মাথার দিকটা
সামান্য একটু উঁচু করা হয়েছে। সোমা এখনও স্বাভাবিক হতে পারেনি, ওর চোখে মুখে
ভয় শংকা। মাথার কাছে সোমা বসে বসে রিয়ানার
বাবার মাথায় খুব আস্তে হাত বুলাচ্ছিল এমন সময় সে ডাকল-
-শোন, মুখটা আরো কাছে এনে সোমা বলে –‘হুঁ বল’
-আমি কি আর বাঁচব! সোমা মুখে কিছু না বলে মাথায় হাতের স্পর্শে কিছু বোঝাতে
চায়। ওর
চোখ ছলছল করে।
একটা লম্বা শ্বাস টেনে রিয়ানার বাবা আবার বলে-
-আমাকে রক্ত দিতে হয়েছে না?
-হ্যাঁ, তোমার শরীর থেকে এত রক্ত চলে গিয়েছিল যে, খুব জলদি রক্তের ব্যবস্থা করতে
হয়েছে। রক্ত দিয়েছে দাদা।
এবারে রিয়ানা এগিয়ে আসে খুব আগ্রহ নিয়ে
উজ্জ্বল মুখে বলে-
-হ্যাঁ বাবা, কাকু না থাকলে খুব প্রবলেম হত। ভাগ্যিস কাকুর
সাথে তোমার ম্যাচ করেছে, এদিকে মা বা আমার সাথে তো মিলত না। সেসময় ব্লাড পাওয়াও
যাচ্ছিল না, আমাদের সাথে ম্যাচ করছে না তা জানার আগেই কাকু... মেয়েকে থামিয়ে দিয়ে তিনি আবার বললেন-
-কত ব্যাগ রক্ত লেগেছে!
মেয়ে এবারে আরো উৎসাহ নিয়ে বলে তার প্রিয়
বন্ধুর বাবার কথা। কাকুর সাথে বাবার যে একটা দূরত্ব সেটা ভালো লাগে না ওর। ও
জানে, এবারে বাবা কাকুর উপর প্রসন্ন হবে। কাকু বাবার জন্য যা করেছে! এবারে সবাই মিলেমিশে আনন্দ করা যাবে।
-কাকুই তো সব ব্যবস্থা করল বাবা, ভাগ্যিস
কাকুর নিজের গ্রুপ জানা ছিল তাই চটজলদি তোমাকে দিতে পেরেছে। কেবল ব্লাড দেয়া না বাবা, কাকু তোমাকে নতুন জীবন দিয়েছেন, আমাদের সবাইকে
রক্ষা করেছেন। জানো বাবা... আবার মেয়ের কথার মাঝখানেই বলে ওঠে-
-আমি তোমাদের জন্য এত করি, আর তোমরা তার প্রতিদানে...
এ পর্যন্ত বলেই হাহাকারের এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দুচোখ বন্ধ করে ফেলে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন