সমকালীন ছোটগল্প |
মাচিনদা
“ভোট এলে একটু ভয়ে
থাকি... পার্টিতে পার্টিতে সন্ত্রাস। ফলস্বরূপ চোরাগোপ্তা খুন, রক্তপাত... আমরা
গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড়ো উৎসবে কখনও লাট্টু, কখনও লেত্তি।”
[ভোটে আমার
অস্তিত্বের সঙ্কট, দেবশঙ্কর হালদার, আনন্দবাজার, ১৮ এপ্রিল ২০১৯]
‘এই যে মহাশয়, কাউকে খুঁজছেন?’— এই জিজ্ঞেসটায় আমার যত
স্বাভাবিক থাকার কথা ছিল,
ঠিক
ততটাই আমাকে বিস্ময়বিহ্বল করে তুলেছিল। অপরাহ্ণ শেষ
হবার আগেই আমি মাচিনদা পৌঁছে গিয়েছিলাম। এক দৈনিক পত্রিকার সাংবাদিক হিসেবে এই
মুহূর্তে আমার আশু কাজ ছিল,
প্রাক-নির্বাচনের
সময়গুলোতে শহরের নিকট আর দূরের কিছু সংখ্যক গ্রামগুলোর ওপর সমীক্ষা চালানো, নির্বাচনে জিতে
আসা জনগণের প্রতিনিধিরা গত পাঁচ বছরে কী কী কাজ করেছে মানুষের জন্য, তাই নিয়েই আমার
সমীক্ষা। ঠিক এই কারণেই আমার মাচিনদায় আসা। অন্য জায়গাগুলোতে সমীক্ষা চালানোর
জন্য যে-কৌশল আর পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলাম এখানেও ঠিক তাই করেছিলাম, অর্থাৎ প্রথমেই গিয়ে
পঞ্চায়েত বা প্রশাসনের দপ্তরে গিয়ে হাজির হব না, সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষের কথাই আগে
শুনব... আসলে এই সময়টা বেছে নিয়েছিলাম এই কারণেই যে, চাষিরা ক্ষেতের কাজ শেষ করে ঘরে ফেরার আগে
চায়ের দোকানে বা কোথাও কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম নেবে, নিজেদের জীবনের সুখ-দুঃখের বিষয়গুলো পরস্পরের
কাছে তুলে ধরবে, নতু-বা নোনা হালকা
রসে ভরিয়ে তুলবে তাদের বিশ্রামের আসর।
রাজপথ ছেড়ে আমি প্রেসের
স্টিকার না-সাঁটা বাইক নিয়ে সোজা ঢুকে পড়েছিলাম গ্রামের ভেতর। যে-রাস্তাটা দিয়ে
এগিয়ে যাচ্ছিলাম বোঝাই যাচ্ছে আসন্ন নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে পুরনো পিচ
রাস্তাটা ওপর ওপর মেরামত করা হয়েছে; যেখান যেখান থেকে খুবলে চটা উঠে গিয়েছিল ঠিক সেখানটুকুই
পুরু প্রলেপ পড়েছে। তা-ও ভেতরে যত ঢুকছি আগেকার ক্ষয়ে যাওয়া চেহারাটাই ক্রমশ
বেরিয়ে আসতে থাকল। দু’পাশে ধু ধু করছে
আদিগন্ত মাঠ, আমার বুকের ওপর
এখন আছড়ে পড়ছে উচ্ছল প্রেমিকের মতো চৈতালি বাতাস, শহর ছাড়িয়ে প্রকৃতিকে এভাবে কাছে পাওয়া
আমাদের মতো শহুরে নাগরিকদের কল্পনারও অতীত। কিন্তু মাচিনদায় প্রবেশের কিছু পরেও এখানে না-পেলাম কষককে, না-পেলাম কোনও চায়ের
দোকান বা ওরকম কিছু। মনে হল,
অসীম
শূন্যের নীচে নিঃসঙ্গ পড়ে থাকা জনমানবহীন এক সবুজ সভ্যতা। অবশেষে দূর থেকে দু-জনকে আসতে দেখে তাদের সামনে গিয়ে বাইক থামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা দাদা, এটাই তো মাচিনদা, না?’
কিন্তু অদ্ভুত! আমার জিজ্ঞেসের কোনও উত্তর দিল না,
দেখেও
না-দেখার ভান করে। মন এক
উদাসীনতা নিয়ে এড়িয়ে গেল ওরা! আরও কিছুটা এগিয়ে গেলাম আমি, দেখলাম বহু প্রাচীন এক
বিশাল বটগাছ, তারই ডালপালার
নিচে শ্যাওলা ধরা বহু পুরনো ইটের দেওয়াল আর টালির ছাউনি দেওয়া মা কালীর মন্দির, ছোটো মন্দির, কাউনির নিচে
সামনের উঁচু অপ্রশস্ত চাতালের ঠিক মাঝখানে সিঁদুরমাখা হাড়িকাঠ। যদিও এখানেও কেউ নেই। বাইকের গতি এখানে অনেক কম। এক নির্জন নিঃসঙ্গতা আর
কাগতিয়মাণ বৈকালিক আলো —
যত
তাড়াতাড়ি সম্ভব এই তল্লাট ত্যাগ করাতেই উৎসাহিত করল আমায়, মনে হল, আদি-অন্তহীন মহাকালের
স্থবিরতা যেন এখন থেকেই গ্রাস করতে শুরু করেছে আমাকে, যে-দিক থেকে এসেছিলাম আমি আমার যানের অভিমুখ
সে-দিকেই ঘুরিয়ে দিলাম,
কারণ
তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছিলাম, যদি মাচিনদায় আবার আসি তো সকাল-সকাল আসাটাই সমীচীন হবে...
কিন্তু আমার ফিরে যাওয়া হল না,
শুনলাম
স্পষ্ট মানুষের কণ্ঠস্বর,
‘এই
যে মহাশয়, কাউকে খুঁজছেন?’
আমার দুই চাকার যানটিকে
এবার থামাতেই হল, পেছন দিকে
তাকাতেই দেখি চাতালের হাড়িকাঠের পাশেই বসে রয়েছে এক কালো বেড়াল ডান-থাবা তুলে
ইশারায় আমায় ডাকছে,
‘হা
মহাশয়, আপনাকে, আপনাকেই আমি ডাকছি।’
আমাকে অনেক অবাক করলেও
কাছে গিয়ে পালটা প্রশ্ন করলাম,
‘আমি
কি কোনও পৌরাণিক যুগের রূপকথার দেশে চলে এলাম?’
সে জ্ঞানী প্রবীণদের মতো
ঘাড় কাত করে উত্তর দিল,
‘কেন, কীসে তোমার এরম মনে হল?’
—না মানে... বাপের জন্মে তো
কোনও জন্তুকে মানুষের মতো এ’রম কথা বলতে দেখিনি…
‘পৃথিবীতে কবে কী
ঘটে যাবে মানুষ তা কী আগে থেকে জানতে পারে? যাইহোক, যা দেখছ তার মধ্যে সত্যি খোঁজার চেষ্টা কর।
—আমি কী ঠিক মাচিনদাতেই
এসেছি?
‘এ-ব্যাপারে কোনও
সন্দেহ নেই বলতে পারি।’
—আসলে আমি এখানে...
ও আমার মুখের কথাটা
কেড়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘তোমার
এখানে আসার কারণ?’
—ইয়ে মানে... রিপোর্টার...
‘প্রমাণ?’
প্যান্টের পেছনের পকেট
থেকে মানিব্যাগ বের করে কার্ডটা দেখালাম। ডান থাকা দিয়ে সেটি নিয়ে এক ঝলক পরখ
করল ও, তারপর ’৫০-’৬০-এর মধুবালার
মতো ভ্রূ-যুগল বেঁকিয়ে আমার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে কার্ডটা ফেরৎ দিয়ে বলল।
সাংবাদিক... বসো এখানে...’
চেয়ার-সমান উঁচু
চাতালটায় বসামাত্রই শুনলাম,
কী
জানতে চাও বলো এবার।
—সামনেই নির্বাচন।
গ্রামের মানুষদের, মানে ওই কৃষকদের
সঙ্গে একটু কথা বলতে এসেছি।
বাঁ-থাবা
দিয়ে নাকের পাটাগুলোকে ঘষে নিয়ে বলল, ‘তুমি কাউকেই সেভাবে এখন পাবে না।’
—কিন্তু এখন তো ভরা চাষের
সময়?
‘এখানে চাষ আর তেমন হয়
কই। ক্ষেতমজুররা তো সেই সুদূর দক্ষিণে চলে গেছে। ওখানে রোজের পয়সা বেশি।
—কিন্তু যাদের সামান্য
জোতজমি আছে?
‘বিড়ি আছে?’
—না, সিগারেট। চলবে?
‘চলবে না মানে? দাও দিকিনি একখানা।’
জামার পকেট থেকে
প্যাকেটটা বার করে নিজে একটা নিয়ে ওকেও একটা দিলাম। আমার জ্বালিয়ে দেওয়া
লাইটারের আগুনের শিখা থেকে সিগারেটটা ধরিয়ে ওকে দেখলাম প্রথমেই এক লম্বা সুখটান
দিতে, তারপর ধীরে ধীরে
ধোঁয়া ছাড়ার পর জিজ্ঞেস করল,
হা...
কী জানতে চাইছিলে? গরিব চাষির কথা...
—মানে... যাদের একটু
জোতজমি আছে... তাদের দেখা পেলে?
—আসার পথে দু-জনের দেখা পেলাম। কিন্তু আমার কথা কানেই দিল না।
‘তোমার কথাই শুনতে পায়নি
তারা।’
—ওদের সামনে গিয়ে জোরেই
কথা বলেছিলাম।
ওকে দেখলাম আবারও একটা
লম্বা সুখটান নিতে। তারপর কণ্ঠের পেশিগুলোর চাপে ক্ষেপে ক্ষেপে দু’বার ধোঁয়ার রিং ছাড়ার
পর বলল, ‘তোমার কথা শুনবে
কি করে! ওদের সবাই তো বোবা! দীর্ঘদিন হল ওরা বাকশক্তি হারিয়েছে।’
—বোবা? মানে... কোনও মহামারি বা
ওই জাতীয় কোনও রোগটোগ হয়েছিল না-কি?
‘সেরম কিছু জানি না। তবে
আমি জন্ম থেকেই দেখে আসছি মাচিনদার লোকগুলো কথা বলতে পারে না।’
—কিন্তু সব
কিছুর মধ্যেই তো একটা কারণ থাকবে।
‘কারণ-টারণ অত
জানি না বাপু। তবে আশপাশের লোকেরা বলে মাচিনদা একটা ভূতের গ্রাম। ফি বছর একটা-দু’টো-তিনটে
করে গরিব চাষি মরে। আমার মা-দিদার মুখ থেকে শুনে আসচি— এই
মড়ক চলে আসছে বহুদিন ধরে। শুনেছি মৃত্যু ভয়েই এরা না-কি দিনে দিনে বাকশক্তি
হারিয়ে ফেলেছে। এই তো, তুমি আসার মাস খানেকের মধ্যেই আইনুল আমাদের ছেড়ে
চলে গেল। তরতাজা যুবক। কী এমন বয়স... বেচারা নিজের সাইকেল বন্ধক রেখে বিষ কিনে
এনে খেয়েছিল।
—কেন সরকারের
কিষানমাণ্ডি তো ছিল?
‘তা থাকলে কি হবে। সব ফসল ওই ভগবান সিং-এর লোকেদের কাছেই
নিয়ে যেতে হবে।’
—কিন্তু
আইনুল কি বোকা? মাণ্ডিতে সে সরাসরি যেতে পারে না!
—না, পারে না। ঠিক নিয়ম না-হলেও
প্রচলিত রীতিই বলতে পারো।
—তো কে
এই ভগবান সিং?
ভগবান
প্রসঙ্গে অনেক কথা অনেকক্ষণ ধরে
বলে চলছিল ও। ও কথাগুলো বলে যাচ্ছিল; আর আমি, বাঁ-হাতে
ধরা মুঠোফোনের আলোয় আমার থাইয়ের ওপর রাখা ছোটো নোটবুকে ছোটো ছোটো নোট নিয়ে
যাচ্ছিলাম...
—তাহলেও
সব বিষয় ঠিক পরিষ্কার হল না।
‘আর
কী বিষয়ে জানতে চাও?’
—পঞ্চায়েত, সরকার, সরকারি
অফিসার, গণতন্ত্র
এসবের কোনও ভূমিকা নেই বলতে চাও?
‘আমার
কথায় তোমার সে’রম কিছু মনে হল?’
—হ্যাঁ, সের’মই।
‘সেটা
তোমার সমস্যা, আমার নয়; তুমি
সাংবাদিক,
খবর নিতে এয়োচ, অমি তোমাকে ঘটনা বলছি মাত্র, কিন্তু
কারওর বিরুদ্ধে নয়...’
—তাহলে
আশাই করতে পারি এখানে বাকি ঘটনা শোনার জন্য।
‘যেমন।’
—এই যেমন
সরকারি অফিসার বা পঞ্চায়েতের কথা।
‘খুব ভালো কথা। এদের মতো ভালো লোক আর-হয় না মশায়। যেমন ধরো, কোনও চাষির
ঋণের দরকার হলে সরকারিবাবুরা সঙ্গে সঙ্গে ব্যাঙ্ক থেকে তা করিয়ে দেয়। আবার এটাও ঘটনা, তারা অধিকাংশই সে-ঋণ শোধ করতে পারে না। তাতে কোনও
অসুবিধা হয় না উভয় পক্ষের। ব্যাঙ্কের হাতে তখন ভগবান সিং-এর মতো মহাজন রয়েছে। এতে তিন পক্ষেরই লাভ। কী বুঝলে?’
—প্রাথমিক
শিক্ষা... সেকেন্ডারি এডুকেশন…
‘মাচিনদার বাচ্চারা ফোর-ফাইভের বেশি যায় না। তারপর তারা বড়োদের
সঙ্গে ওই সুদূর দক্ষিণে নাবাল খাটতে যায়। কেউ কেউ অবশ্য আট কেলাস অবধি যায়। সরকারের
লোক সেকেন্ডারি স্কুলের জন্য পয়সা ঢালতে যাবে কেন?
তাকে ভূতে না কুকুরে কীসে কামড়েছে? অবিশ্যি
অবস্থাটার একটু পরিবর্তন হয়েছে এখন। এই মাচিনদা থেকে প্রায় ১০-১২ কিলোমিটার দূরে
একটা স্কুল আছে...’
—রাস্তাঘাট?
‘সেইটা
যদি বলো,
সেখানেও বলব উন্নয়ন এখানে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। আমার মায়ের মুখে শুনতাম তো
অনেক কথা,
এমনকি গত বারো-চোদ্দ বছর আগেও পুলিশ আধা-সামরিক বাহিনী ঢুকতে পারত না, রাস্তার
এমনই হাল ছিল! আর এখন দেখ, দিন নেই, রাত
নেই, যখন-তখন তারা
আসছে আর যাচ্ছে। বাবুদের চারচাকাও এখন দিব্যি যাতায়াত করে। আর তাছাড়া, এখানে
আগের মতো চরমপন্থীরাও আর নেই…’
—একশো
দিনের কাজ?
‘হ্যা, সবাই পায়, পুরো একশো দিনই কাজ করে। কিন্তু কেউ কেউ অভিযোগ
করে— তারা পায় না। তবে সরকারের তরফ থেকে কোনও
অন্যায় হচ্ছে এমনটা বলা সমীচীন হবে না। কারণ তারা খাতা খুলে দেখিয়ে দেবে যাদের
পাওয়ার কথা সবার নামই নথিভুক্ত আছে— পুরো একশো দিন কাজ করেছে, তার
বিনিময়ে টাকাও পেয়ে গেছে। আসলে মাচিনদায় সবাই আইনকে খুব মেনে চলে। এমনকী ভাগবান
সিং-ও।’
খানিক
বিরক্তি প্রকাশ করে বললাম, ‘ওফ, আবার ভগবান...’
‘চুপ
চুপ চুপ। নামটা আস্তে উচ্চারণ করো। রাতের মাচিনদা পুরোটাই প্রেতাত্মায় ভরা। কখন
কে কী শুনে ফেলবে...’
—তো কী
হয়েছে তাতে? ভূত হয়েছে তো শুধু গরিব চাষিরাই। তাদের কিসে
ভীমরতি ধরল!
‘না-না, ভগবানের
লোকও আছে।
—কী
রকম?
‘আমার
মা বলেছিল,
একবার এখানে একটি কিশোরী মেয়েকে রেপ করা হয়। যে করেছিল তার কি হয়েছিল কিছু
জানা যায় না। কিন্তু মেয়েটার যৌনাঙ্গে যৌনরোগ হয়ে গিয়েছিল। মাচিনদায় খবরটা
চাওর হতেই না-কি ভগবান বেশ কয়েকজন লোককে পাঠিয়েছিল ওর চিকিৎসার সুরাহার জন্য। কিন্তু কিছুতেই কথা
শুনল না মেয়েটি। ও তখন সদ্য যৌবনে পা দিয়েছে। বোধ হয় কথা না-শোনার জন্যই
মেয়েটি আবার একদিন রেপ হল। এবার এক সঙ্গে পরপর চার-জন।
সারাটা মাচিনদায় তুষের আগুনের মতো খবরটা ছড়িয়ে পড়ল। এরপর বছর দুইয়ের মধ্যেই
ওই চার-জনের অপঘাতে মৃত্যু হল! কে
বা কারা মারল জানা গেল না! কিন্তু তখন কেউ কেউ বলেছিল, ওই
ধর্ষণকারীরা না-কি সবাই ভগবানের লোক। এ আজ থেকে প্রায় বছর পনেরো আগের ঘটনা।’
এবার ‘দাঁড়াও
একটু’ বলেই
ওকে দেখলাম উঠে যেতে। বিগ্রহের সামনে থাকা একটা তেলের প্রদীপ ধরিয়ে দিল ও, তারপরে
দেখলাম হাড়িকাঠের পাশে রাখা একটা শামাদানের বাতিতে আলো জ্বালিয়ে দিতে। ওর এই
কাজের ফাঁকে আমার চোখ আমার
সামনের মাচিনদার দিকে চলে গিয়েছিল— ওর শরীরে এখন কালো আদিম অন্ধকারের চাদর— ঠিক ওর গায়ের রঙের মতন...
‘তো যা বলছিলাম, মাচিনদার মানুষরা বলে—
মৃত্যুর পরেও না-কি ওরা ভগবানকে ছেড়ে যায়নি। গাঁয়ের কোনও গাছের ডালে বসে থাকা
কাকের পায়খানা জমির কোথায় পড়ল— সব খবরই না-কি তারা ওকে দেয়।
আর গরিব চাষাগুলোই-বা ফি বছর মরে কী করে...’
নোটবুকের সামনের
দু’টো
পাতা শেষ হয়ে গিয়েছিল। ডান দিকের পাতা উলটে নতুন করে নোট নিতে থাকলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘তা এ-ব্যাপারে
পঞ্চায়েতের কী ভূমিকা?
‘এখেনের
পঞ্চেত? ওই
ধরে নাও ভগবান সিং-ই।’
—ভগবান সিং? ও-ই
কি প্রধান?
‘পোধান
কেন হবে! কিন্তু পঞ্চেতের পোধান-সদস্য-কর্মচারী সবই ওই ভগবানেরই লোক...’
—এই ব্যাপারে
বিরোধী নেতা, পুলিশ-বিডিও সব চুপ?
‘দ্যাকো, একেনে
কোনও বিরোধী-টিরোধী নেই। থাকার দরকারই-বা কী? দল
টাকা চাইলে ভগবান দেবে; তুমি পঞ্চেতের পোধানবা সদস্য হতে চাও?— ভগবানের
কাছে যাও,
কিছু-না-কিছু একটা হয়ে যাবে। চাষারা কর্জ চাইলে ওই ভগবানই দেবে। তারপর ধরো মাচিনদায়
উন্নয়ন হচ্ছে, সাংবাদিক-মিডিয়া যাতে সত্যি কথাটা ভালো করে লেখে বা বলে— তার জন্যও
তো তাদেরকে খুশি করতে হয় ওই ভগবানকে… ও এখানকার
ঈশ্বর!
—অন্য
ব্যাপার না-হয় ছেড়েই দিলাম, কিন্তু চাষিকে ঋণ দেবে তো ব্যাঙ্ক?
‘মাচিনদায়
থাকো দু’দিন, বুঝতে
পারবে… তোমার এমন ভাট প্রশ্নের নিজেই উত্তর পেয়ে যাবে… বলি, আজকাল চাষের বহুত হ্যাপা। ফি
বছরই নতুন করে সার, বীজ, কীটনাশক কিনতে হয়। এখানে গুচ্ছের খরচা।
এমনিতেই রাসায়নিক সার আর বিষে চাষের পর জমিগুলো আধ-মরা
মানুষের মতো হয়ে থাকে। বিলিতি সারগুলো যেন তান্ত্রিকের মন্ত্রের মতো! দিলেই আবার
ম্যাজিকের মতো জেগে ওঠে জমিগুলো। তো চাষার দুঃখে ব্যাঙ্ক ঋণ দেয়। সরকারও ফসলের
দাম বেঁধে দেয়। কিন্তু দালাল-ফড়েদের কথাও তো তোমায় ভাবতে
হবে! তারাও তো মানুষ! মোদ্দা কথা, ভগবান
তোমায়
দেকছে, তুমিও
ভগবানকে দেকো।
কিছু বুঝলে?’
—বুঝলাম।
তারপর?
‘তারপর
আর কী। মাচিনদার চাষাদের কাছে তখন যে-কোনও একটা পথই খোলা থাকে। নয় আকাশ, নয়
ভগবান! আর তাছাড়া ভগবান নিজেও চায় না— মাচিনদা
আর গ্রাম থাকুক।’
—মানে?
‘খুব
পষ্ট। প্রধানমন্ত্রী সড়কের ধারেই গ্রাম। প্রায় কাছেই রেলস্টেশন। ভগবান চায় মানুষ একানে পোকিতির খোলা হাওয়ায় বাস করুক।
মাঠের পর মাঠ চাষজমি বিকিয়ে গেছে। একদিন শহর হয়ে যাবে মাচিনদা...’
যাইহোক, আমি দেখলাম— অন্যান্য গ্রাম-সমীক্ষাগুলোর
সঙ্গে মাচিনদার অনেকটাই যেমন মিল আছে, অমিলও বেশ কিছু আছে। আর এই অমিলটাই হল ভগবান
সিং। ওর সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমি এই সিদ্ধান্তেই এসেছিলাম যে ভগবানের একটা
সাক্ষাৎকার না-নিলে আমার মাচিনদার রিপোর্ট অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। বললাম, ‘আজ তো
আর সম্ভব নয়, যদি কাল কিংবা পরশু ওর একটা ইন্টারভিউ... থাকে
কোথায় এখানে সে?’
ও ওর পেছনের
ডান-পায়ের
থাবা দিয়ে নিজের মুখ চুলকানোর বলল, ‘কোতায় পাবে তাকে? আমার কথা
বাদ দাও,
মাচিনদার প্রায় কেউই জানে না— সে থাকে
কোতায়, কীরকমই-বা
তাকে দেখতে। সবাই আমরা আমাদের মা-বাপ বা দাদু-ঠাকুমাদের মুখ থেকে শুনেছি ওর কথা।
বলতে পারো,
ওর নামটাই যথেষ্ট।
—পুলিশ-প্রশাসন
বা পঞ্চায়েত, এমনকী বিডিও—
কেউই কী একটা খোঁজ দিতে পারে ওর ব্যাপারে?
‘মনে
তো হয় না। তবে আইন মোতাবেক সবাই ওই একই কথা বলবে। ওই নামে এই তাবৎ অঞ্চলে কেউ-ই
থাকে না— সমস্ত খাতা নথিপত্র সব দেখিয়েই তারা তা
প্রমাণ দিয়ে দেবে। হয়তো তারা বলবে, মাচিনদার মতো শান্তিপূর্ণ গ্রাম আর নেই!
শেষ পর্যন্ত
খুবই হতাশ হলাম। জিজ্ঞেস করলাম, উপায়?
তাহলে উপায়!
‘উপায়...’
দেখলাম
মুহূর্ত কয়েকের জন্য সে চুপ করে গেল। মনে হল, মহাকালের
অন্ধকারের মতো কালো মাচিনদার শরীরে জ্বলতে থাকা ওর সবুজ চোখদুটো যা এখন আমার পুরোটাকেই
গ্রাস করে ফেলেছে। তারপর বলল, ‘কোনও এক অমাবস্যার রাতে আসতে পারো মাচিনদায়?’
আমি বললাম, কেন?
‘দেখবে
মাচিনদা আর গ্রাম নেই! আস্ত এক শহর! সেখানে সে থাকলেও
থাকতে পারে...’
নির্বাচন
শুরুর দিন কয়েক আগে, সকালে আমার চলমান দূরভাষটি হঠাৎই বেজে উঠল।
অজানা নম্বর। ‘অ্যানসারে’-এ
আঙুলে চাপ দিতেই বুঝে নিয়েছিলাম এটা ওর-ই কণ্ঠস্বর। নিজের পরিচয় দিয়ে বলল, ‘আজ
রাতে একবার আসতে পারো মাচিনদায়? পারলে চলে এসো। এই নম্বরে আর
ফোন করার দরকার নেই।’ বলামাত্রই ফোনটা কেটে গেল।
কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত থাকলেও, আমি আমার মধ্যেকার কৌতূহল দমিয়ে রাখতে পারলাম
না কোনওমতেই। সে-রাতেই চলে গিয়েছিলাম সেখানে। দেখি, সত্যিই
মাচিনদা আর গ্রাম নেই! যেন মহাকাশ ছুঁয়ে আছে বাড়িগুলো। যেন এক
মায়াবী শহর! কিন্তু পথ খুঁজে খুঁজে আমি চলে গিয়েছিলাম সেই বহু প্রাচীন বট আর তার
লাগোয়া পুরোনো মন্দিরের কাছে। কিন্তু এ-দু’টোর কিছুই
পালটায়নি। বিগ্রহের সামনে প্রদীপ আর চাতালে শামাদান জ্বলে চলেছে, আগের
দিনের মতোই।
শুধু হাড়িকাঠের দুই দিকে, ওর ধড় আর মুণ্ডু আলাদা হয়ে রক্তের স্রোতধারার
মধ্যে পড়ে রয়েছে।
ভালো লেগেছে।
উত্তরমুছুন