সমকালীন ছোটগল্প |
শেষ দৃশ্য
আদালত রায় দিয়েছেন - “লেখক নাট্যকার দীপক ঘোষ পাঁচ তলার ছাদ থেকে পড়ে গেলেও (বা তাঁকে ঠেলে ফেলে দেওয়া হলেও) পতনজনিত মৃত্যু তাঁর ঘটেনি। মৃত্যুর কারণ একটি গুলি, যেটা তাঁর মগজের অনেকটা অংশ নিয়ে উড়ে গেছে। আর উঠতি তারকা সিদ্ধার্থ সরকারের মৃত্যু ঘটেছে খুব ক্লোজ্ রেঞ্জের থেকে আর একটি গুলিতে, যেটা তার হৃদপিন্ড ফুটে করে দিয়েছে। দুটি গুলিই পর পর একই রিভলভার থেকে ছোঁড়া হয়েছে, যেটা আসামী গার্গী ঘোষের কাছেই পড়ে ছিল তার আঙ্গুলের ছাপ নিয়ে।”
পরিপূর্ণ আদালতের সামনে টিয়া ওরফে গার্গী ঘোষকে জোড়া খুনের দায়ে ২০ বছর এবং ২২ বছরের সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত করা হল। তবে বন্দী দশায় তাঁর ডাক্তারী শুশ্রূষা চলতে থাকবে। দুই ডাক্তারের একটি প্যানেলের তত্ত্বাবধানেই আপাত বাকশক্তি রহিত নির্বাক গার্গীদেবীকে রাখার নির্দেশও দিয়েছেন মহামান্য আদালত।
ইন্সপেক্টর বরাট খোলা জানলা দিয়ে ট্রাম বাস আর জনসমুদ্রের দিকে অলস দৃষ্টি ছড়িয়ে চৌরঙ্গী লেনের সশস্ত্র ডাকাতির কথাই ভাবছিলেন। জোড়া খুনের মামলাটাতে তেমন কোন জটিলতাই হয়নি। আর এত বড় একটা খুনের নিষ্পত্তি করে বরাট স্বভাবতই খুশী। পুলিশের নিখুঁত সাজান কেসে কোন সমস্যাই ছিল না আর ও পক্ষের জোরালো যুক্তির অভাবেও বোধহয়, আদালত বেশী সময় নেয়নি। মনের আনন্দধারাটা জিইয়ে রাখতেই বরাট গত কয়েক মাসের ঘটনাগুলোর মনের চালচিত্রে ভাসিয়ে দিলেন –
সেদিন ছিল রবিবার, সন্ধ্যে তখন আটটা হবে। ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে আর পাড়া জুড়ে সেদিনকার দিন-রাত্রির ক্রিকেটের উদ্দীপনার ঝাঁঝ ফুঁড়ে হঠাৎ ‘বেণুবন’ সোসাইটির পাঁচতলার উত্তর কোণের ফ্ল্যাট থেকে আওয়াজটা ছিটকে বেরোল - গুড়ুম! গুড়ুম! অনেকেরই মনে হয়েছিল পাড়ার ছেলেদের আনন্দ উচ্ছাস এটা - শচীনের ৭৫তম শতরানকে অভিনন্দন, আতশবাজী দিয়ে। আসলে আবাসনের কেউই কঠিন ইস্পাতের নল থেকে ঐরকম আগুনে সংকেতের সঙ্গে পরিচিত নয়।
ঠিক পাশের ফ্ল্যাটগুলি থেকে অবশ্য ঐ কানফাটানো শব্দটা শোনা গেছে খুবই জোরে। আর তার একটু পরেই নীচে ঝপ করে একটা অষ্পষ্ট আওয়াজও শুনেছে কেউ কেউ। তারপর একটা দুটো করে বিস্মিত কৌতূহলী কন্ঠস্বর প্রচন্ড উত্তেজিত সমবেত কোলাহলে পৌঁছে যেতে দেরী হয়নি। দারোয়ান, আবাসনের স্টাফ, ড্রাইভার আর সংগে পথচলতি অগণিত মানুষের তুমুল উত্তেজনা সরাসরি তুঙ্গে। আপাতত নিস্পন্দ পাড়া মিনিটের মধ্যে লোকারণ্য। টুকটাক করে আবাসনের প্রতিটি জানলায় জ্বলে উঠলো আলো আর জানলার ফ্রেমে জীবন্ত হয়ে উঠল মানুষজনের সিলহিউট। অন্ধকার একমাত্র পাঁচতলার ফ্ল্যাট নাম্বার ৫২০।
তখন একতলার ছাদ বরাবর সেফটি নেটটাতে অস্বভাবিক উথালপাথাল আর তার ভেতরে একজন মানুষের অষ্পষ্ট অবয়ব ছটফট করছে। ভাল করে বোঝার আগেই ঐ দেহ শেষবারের মত মোচড় দিয়ে অন্ধকারের মধ্যেই ঝিমিয়ে পড়ল। হায় হায় করে উঠলো পাঁচিলের ভেতরে বাইরে জমে থাকা প্রায় শ’দুয়েক মানুষের উৎকন্ঠা। বেণুবনের প্রেসিডেন্ট, সেক্রেটারী তৎপর হয়ে উঠলেন, গেটে তালা পড়ল - সিকিউরিটি সজাগ। নিজেদের বুদ্ধিমতন সবাইকে প্রশ্ন করতে লাগলেন তাঁরা। পুলিশ, এ্যাম্বুলেন্সে ফোন করা হয়ে গেছে, ইলেক্ট্রিসিয়ানের দোকান খুলিয়ে লম্বা মই আনার জন্যে লোক গেছে। ৮১২ নম্বরের ডাক্তার ব্যানার্জি মাটি থেকে একটু লক্ষ্য করে বলে উঠলেন, ‘হায় ভগবান, বোধহয় আর নেই!’
জমাট উত্তেজনার মধ্যে পুলিশের গাড়ি এসে গেল। কিছু অতি উৎসুক মানুষ ছাড়া বেশির ভাগই পুলিশী আঁচ বাঁচাবার জন্যে নিরাপদ দূরত্বে। নিজের নিজের প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ নিয়ে চাপা গুঞ্জন, স্বভাবতই পুলিশের কান বাঁচিয়ে। ছবি তোলা , মাপজন, নোট নেওয়া হয়ে গেল, ডাক্তার ব্যানার্জির সঙ্গে আলোচনার পর ভালো করে মৃতদেহ খুঁটিয়ে দেখলেন ইন্সপেক্টর বরাট। আবাসনের স্তম্ভিত বাসিন্দারা একবাক্য রায় দিলেন, ‘ইনি দীপক ঘোষ, ৫২০ নম্বরের বাসিন্দা’। সেলোফেন ব্যাগে মুড়ে দেহ তোলা হলো এ্যাম্বুলেন্সে।
ফ্ল্যাটের দরজা খোলাই ছিল, এর মধ্যে অনেকেই জমা হয়েছেন সেখানে। বসার ঘর থমথমে। শোবার ঘর অন্ধকার - একটা চাপা গোঙানী ভেসে আসছে বন্ধ দরজার ওপার থেকে। ঘরের আসবাবপত্র সাধারণ - জানলা ঘেঁষে সোফার ওপর ফ্যাকাশে মুখে পড়ে আছে রক্তাক্ত এক যুবক – মৃত। তখনও রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে গাঢ নীল পোলো টি-শার্ট ভেদ করে, হাতটা অসহায়ভাবে ঝুলছে। অনেকেই তাকে দীপক আর টিয়ার পারিবারিক বন্ধু হিসেবে চেনেন। ঘরের মাঝামাঝি মেজেতে একটা ০.৩২ বোরের নিকষকালো রিভলভার পড়ে আছে। পিস্তলটা সন্তর্পণে তুলে নিয়ে ছবি, মাপজোখ, inspection এবং ডাক্তারী পরামর্শ শেষ করে দেহ দুটিই মর্গের উদ্দেশ্যে চলে গেল।
বরাটের কর্তব্যপরায়ণ কর্কশ স্বরে বাধ্য হয়ে টিয়া দরজা খুলে বেরিয়ে এল শোবার ঘর থেকে। গোলাপী শাড়ি, কালো স্লিভলেস চোলি, ঘষটানো আই লাইনারে অবাধ্য চুলের রাশিতে সুন্দরী টিয়া এখন বিষাদকন্যা। ভেজা কোঁচকানো আঁচল, চোখের লালচে আভা আর নাকের ফোঁসফোঁসানি জানিয়ে দিচ্ছে এতক্ষণ শাড়ির আঁচল ঘষে ঘষে সে চোখের জল থামাবার চেষ্টা করছিল। পুলিশী কন্ঠস্বরে যথাসম্ভব কোমলতা এনে ইন্সপেক্টর বরাট বললেন - নমস্কার। আপনি কি…
-টিয়া
- গার্গী ঘোষ। ইন্সপেক্টর, কী হয়ে গেল, এ আমি কী করলাম? দীপক বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল আর… ফোঁপানো কান্নাতে দুহাতের মধ্যে
মুখটা লুকিয়ে ফেলল টিয়া।
-ঠিক
আছে, ঠিক আছে ম্যাডাম, আপনি একটু স্হির হয়ে বসুন। আপনাকে নিয়ম মতন একটু বিরক্ত করব।
তারপর
সমবেত জনতার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনারা?
আবাসনের
প্রেসিডন্ট মি: পাকড়াশী বললেন, অফিসার, আমরা সবাই এ বাড়িরই বাসিন্দা। আমিই প্রেসিডন্ট,
কিন্তু আমরা খুবই আশ্চর্য…
-ঠিক
আছে, আপনারা সবাই নিজের নিজের এ্যাপার্টমেন্টে ফিরে যান, কেউ বাইরে যাবেন না। দরকারমত
আমি কারুর কারুর জবানবন্দী নেবো। আর আপনি আমাকে বাসিন্দাদের পুরো তালিকা পাঠিয়ে দিন
এখনই - ও.কে?
সবাই
নি:শব্দে অনিচ্ছাসত্বেও বেরিয়ে গেলো। বরাট একটা চেয়ার টেনে ডাইনিংয়ের টেবিলে টুপি
আর রুলারটা রেখে শুরু করলেন, আচ্ছা গার্গীদেবী -
আর
ঠিক তক্ষুণি টিয়া থরথরিয়ে কাঁপতে কাঁপতে সোফা থেকে কার্পেটের ওপরে অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে
গড়িয়ে পড়লো। ‘উফ্ - মা গো’ বলে সেই যে তার কথা বন্ধ হল, আজ পর্যন্ত সে বাকশক্তি রহিত।
জবানবন্দীগুলো ক্রমপর্যায়ে এসে যাচ্ছিল বরাটের মনের মধ্যে - দীপক সাতটা নাগাদ কাজে বেরোবার কথা বলে ৫২০ নম্বর থেকে বেরিয়েছিল সেটে গিয়ে শব্দযন্ত্রীদের সংগে ওদের নাটকের কিছু দরকারী আলোচনা করতে। ওর লেখা ‘শেষ পর্ব’ নাটকটা টিয়া আর সিদ্ধার্থ রিহার্সাল দিচ্ছিল - পাশের ফ্ল্যাটের মিসেস মিত্রের কথা অনুযায়ী। উনি ওঁর বাড়ির চাবিটা দিতে এসে ওদের সঙ্গে কথা বলে যান একটু সময় - দুজনে সাধারণ ভাবেই হাসিখুশী ছিল। টি ভি সিরিয়ালের শ্যূটিংটা পরের সপ্তাহেই শুরু হবার কথা বলেছিল ওরা। গার্গীর তিনজন বান্ধবী আর কাজের মেয়ে বলেছে, পিস্তলটা প্রায়ই এখানে সেখানে সোফার ওপরে বা টেবিলের কাছে পড়ে থাকতো, আর ওটাতে কখনই গুলি ভরা থাকত না।
‘আমাদের
কাছে রিভলভার আছে’ আজকালকার দিনে এই কথাটা জানান দেবার জন্যেই নাকি ওটা এখানে সেখানে রাখা হত। তারা আরও
বলেছে, টিয়া নাকি মাঝে মাঝেই ট্রিগার টিপে ফাঁকা আওয়াজ করে ওদের সঙ্গে তামাশা করতো।
দীপকের
ব্যাপারটাই একটু তালগোল পাকাচ্ছিল। ত্রিকোণ প্রেমের ব্যাপার হলেও বাড়ির মধ্যেই গুলি
করে জানলা দিয়ে স্বামীকে ফেলে দিয়ে প্রেমিককেও খুন? তাও রবিবার ভর সন্ধ্যেবেলায়, যখন
আবাসনে শতকরা ৯০ জন মানুষ উপস্হিত থাকে! অঙ্কটা পুরোপুরি মেলাতে পারেননি ইন্সপেক্টর
বরাট। আসলে নির্বাক, মানসিক ভারসাম্যহীন গার্গীর কাছ থেকে আজ পর্যন্ত কোন কথাই শোনা
যায়নি। ডাক্তারদের মতে প্রচন্ড মানসিক বিপর্যয় আর হঠাৎ পড়ে যাওয়াতে ব্রেনে অস্বাভাবিক
আঘাত ওকে বাকশূ্ন্য করে দিয়েছে। তারপর তিনতলার মিসেস তপতী সিংহানিয়ার জবানবন্দীটা খুবই
গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
উনি
টিয়ার সঙ্গে মডার্ণ স্কুলে পড়াশোনা করেছেন, প্রথম থেকেই খুবই কাছের বান্ধবী। ওদের
মধ্যে নিজেদের পারিবারিক জীবনের অনেক আলোচনাই চলত - খুশী, আনন্দ, সমস্যা সবই ওরা ভাগ
করে নিতো নিজেদের মধ্যে।
-কয়েক মাস থেকেই টিয়া আর দীপকের মধ্যে চিড ধরতে শুরু করে। টিয়ার ধারণা হয়েছিল দীপক শ্যূটিং-এর ফাঁকে পার্শ্বনায়িকা বিপাশার দিকে ঝুঁকছে। দীপককে বলাতে ও ব্যাপারটাকে সোজাসুজি ঈর্ষা প্রণোদিত মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিয়েছে। ওকে ফেরাবার জন্যেই ও আর সিদ্ধার্থ মিলে একটা নাটক সৃষ্টি করে।
-মানে?
-টিয়া
আর সিদ্ধার্থের সম্পর্ক নিষ্কলুষ ভাই বোনের - এটা জোর দিয়েই হলফ করে বলতে পারি। গতবার
দীপক যখন আউটডোর শ্যূটিঙে বাইরে ছিল, টিয়া বাড়িতে দীপক আর আমার হাসবেন্ডকে ডেকে ঘটা
করে ভাইফোঁটা দিয়েছিল, এমন কি আমাকে দিয়েও ফোঁটা দেওয়া করিয়েছে দীপককে।
-তা
এরকম নাটক কতদিন চলতে পারে?
-সমস্যাটা আয়ত্বে আনার চেষ্টা ছিল ওদের। দীপককে ঈর্ষান্বিত করে ওকে কাছে টানার জন্যেই টিয়া ইচ্ছে করেই ওর সঙ্গে সব পারিবারিক প্রোগ্রাম ক্রমাগত নষ্ট করে যাচ্ছিল। সিনেমা যাওয়া, সপ্তাহান্তে বাইরে খাওয়া, আত্মীয় বন্ধুদের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ - সবই একটা একটা করে বানচাল করে দিচ্ছিল। বাহানা, ঐ সিরিয়ালের আলোচনা আর রিহার্সাল। ওরা তখন সত্যিই ২-৩টে সিরিয়ালে একসঙ্গে কাজ করতো এবং ওদের মেলামেশাটা সত্যিই দীপকের মনে সন্দেহের আগুন জ্বালাত। এটাই বোধহয় টিয়ার ইচ্ছা ছিল। ও খুব মজা করেই এইসব গল্প আর দীপকের রিঅ্যাকশন নিয়ে আলোচনা করতো আমার সঙ্গে। আমি কিন্তু এই বিপজ্জনক খেলার সম্ভাব্য পরিণতির কথা ওকে সাবধান করে দিয়েছিলাম কয়েকবার। ও হাসতো আর বলত, আরে দ্যাখ না আর দুটো সপ্তাহ। পয়লা এপ্রিল তোদের সকলের সামনেই শেষ দৃশ্যটা হবে - ক্যামেরা আনিস, দীপকের বোকা বোকা মুখের ছবি তুলে রাখিস। সিদ্ধার্থ আর টিয়াকে তো অনেকদিন দেখছি, কারোরই কোনরকম দুর্বলতা ছিল না।
-তাই
যদি হয়, তবে সিদ্ধার্থকে গুলি করলেন কেন গার্গীদেবী?
-জানি
না অফিসার, আমি জানি না।
কেসটাতে
কোন গোঁজামিল নেই, গার্গীই দোষী। কিন্তু মানসিক অঙ্কটা? যাক্ গে, কন্সটেবল বীরেন্দ্রকে ডাকাতির পরের ছবিগুলো আনতে
বললেন।
-গুড
মর্ণিং ইন্স্পেক্টর। আমি দেবব্রত বিশ্বাস বলছি, গার্গী ঘোষের বড়দাদা। আজ ভোরেই নিউ
ইয়র্ক থেকে পৌঁছেছি - ওখানেই থাকি আমি। আমার কাছে দীপকের লেখা একটা চিঠি এসে পড়েছিল,
কবে থেকে জানি না। গার্গীদের বাড়িতে ফোন করেছি, কেউ ধরছে না। বাড়িও তালাবন্ধ অত সকালে।
-কবে পেয়েছেন।
-অনেক আগেই হবে। আমি ইউনিভার্সিটির কাজে কয়েক মাস বাইরে ছিলাম। কাজের চাপে তার মধ্যে কারোর সংগেই যোগাযোগ সম্ভব হয়নি। কিন্তু এটা কী অফিসার, আমি তো খুব নার্ভাস ফিল করছি। চিঠিটা পড়ে পরের এ্যাভেইলেবল ফ্লাইটটাই ধরেছি।
-আপনি
কি নিশ্চিত যে চিঠিটা দীপকবাবুরই লেখা?
-হ্যাঁ
হ্যাঁ, কোন সন্দেহই নেই।
-আপনি
লেক মার্কেট থানায় এক্ষুণি চলে আসুন, গাড়ি আছে?
-হ্যাঁ,
আমি আসছি। ওরা কোথায় আছে, কেমন আছে, কাউকে জিজ্ঞেস করতেও ভয় লাগছে অফিসার।
-সবই
জানতে পারবেন - চলে আসুন আপনি।
চিঠিতে লেখা ছিলঃ
প্রিয় দেবুদা
অনেক ভেবে চিঠিটা আপনাকেই লিখছি। পৌঁছতে সময় লাগবে আর ততদিনে প্ল্যানমত আমার কাজও হয়ে যাবে। দেবুদা, আমি স্যুইসাইড করতে যাচ্ছি। কালই, তবে তার আগে আমার আর একজনের সঙ্গে বোঝাপড়ার দরকার আছে - সিদ্ধার্থ সরকার। আর আমি চরম শাস্তি দিতে চাই আপনার বোনকে - দু:সহ জীবনে বাঁচিয়ে জেলে রেখে বা ফাঁসির কাঠে।
খাল কেটে কুমীর এনেছিলাম আমিই দেবুদা। সিদ্ধার্থ কোথাও ব্রেক পাচ্ছিল না, আমার গল্পটা তখন ফ্লোরে যাচ্ছে। ওর মধ্যে সম্ভাবনা দেখেছিলাম, তাই সুশান্তকে বলে ওকে ঢুকিয়ে দিলাম আমার নাটকে। আমার ভাই-এর মতই ছিল। দারুণভাব উৎরে গেল নাটক - এখন ওটা টিভি সিরিয়াল করবে, তাতেও ওকেই নেওয়া হচ্ছে, আর টিয়া স্বভাবতই নায়িকা। কিন্তু সিরিয়ালের রাস্তা বেয়ে বিষের ধোঁয়া ঢুকলো বাড়িতে - অবিশ্বাসের ঝড়। আমার চোখের আড়ালে চলতে লাগলো ওদের অবাধ প্রেমলীলা আর আমার সঙ্গে বিপাশার অলীক সম্পর্ক বানিয়ে নিয়ে তুমুল অশান্তি। সমাজে, বন্ধুমহল এমন কি বেণুবনে অনেকেই নীরব বিদ্রূপে মুখর। বাড়িতে টিয়া কিন্তু পরম পতিব্রতা গৃহিণী - আমার সব ব্যাপারেই নজরদারী, নির্ব্বিকার অভিনয়। সিদ্ধার্থের আসা যাওয়া চলছেই অবিরাম আমার বর্তমানে অবর্তমানে, বিপাশার ব্যাপারটা যে ভূয়া, সে কথাটা তোলার কোন সুযোগই হচ্ছে না। আমাদের সামাজিক, পারিবারিক সম্পর্কগুলি ইচ্ছে করে নষ্ট করে চলেছে। কারণ বলা হচ্ছে - অভিনয়টাকে অতি স্বাভাবিক করে তোলা। ওদের অভিনয় যে কতটা ‘স্বাভাবিক’ সেটা আমি ছাড়া কেউ ভাবতে পারবে না।
একদিন টেলিফোনে মেসেজ শুনলাম সিদ্ধার্থ পরশু আসবে সন্ধ্যেবেলায় - যেদিন দুপুরে আমার রামপুরহাট যাবার কথা। গেলাম না, একটা এসপার ওসপার না করলেই নয়। আমি হেরে যাচ্ছি। পর্যুদস্ত রাতের ঘুম, দিনের চিন্তা। শান্তি কেড়ে নিচ্ছে একজন, আমার কলজেটা ছিঁড়ে নিচ্ছে একটু একটু করে। তার ওপর, আমার নাটক আর চলছে না এখন। নতুনরা এসে অসামাজিক গল্প, পরকীয়া প্রেমের অম্লমধুর তাপ আর অশ্লীল নাটক পুনরাবৃত্তি করে বাজার দখল করে নিচ্ছে ক্রমশ:। বাড়িতেও পরকীয়ার আগুন। টিয়াকে ফেরাতে পারছি না, আর ফিরলেও সেই আগের স্বপ্নসঙ্গিনী হয়ে ফিরবে না কিছুতেই। তাই চললাম আমি - বহু প্রচলিত পথে, বেনুবণ থেকে, দুনিয়া থেকে। পৃথিবীতে শান্তি নেমে আসুক, সবাই ভাল থাকো।
রিভলভারটাতে আমি ছ’টা গুলিই ভরে রেখেছি - টিয়া জানে না। আমার নাটকের শেষদৃশ্যে নায়িকা পিস্তল তুলে ভয় দেখাবে, ট্রিগারও টিপবে, কিন্তু গুলি বেরোবে না। কারণ, গল্পের নায়ক কাজের লোকের সহায়তায় গুলিগুলো সরিয়ে ফেলেছে - কাজেই নিশ্চিন্তে হয়েই সে এগোবে নায়িকার দিকে, লালসার তৃপ্তির উদ্দেশ্যে। এই ক্লাইম্যাক্স দৃশ্যটা স্টেজে দুর্দান্ত হাততালি পেয়েছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক অভিনয় এবং আলোছায়ার অসামান্য কারিকুরিতে। কিন্তু এবার? আসল জীবনকাহিনীতে অঙ্কটা একদম উল্টে যাবে। পিস্তলে গুলি ভরা থাকবে আর টিয়া অজান্তে ট্রিগারও টিপবে - আহ্! আমরা দুজনে, সিদ্ধার্থ আর আমি, চিত্রগুপ্তের সামনে একসঙ্গে বসবো হিসেব নিকেশ করতে। আর টিয়া? ও তো থানা, পুলিশ, কোর্ট, উকিল, দৈনিক সংবাদপত্র আর বেণুবনের সরস আলোচনার পথ পেরিয়ে ফাঁসির মঞ্চে। কিম্বা যদি ও জজসাহেবকে অভিনয়ে মুগ্ধ করতে পারে, অন্তত: যাবজ্জীন? টিয়ার তুমুল অনিচ্ছায়, আমরা এখনও পর্যন্ত আমাদের বংশে কাউকে আনিনি দেবুদা, তাই গল্পের পরিণতিটা এই পথে নিয়ে যেতে আমার কোন ভাবনাই রইল না। তবে আমি বলে যাচ্ছি, মহামান্য আদালত ওকে যে সাজাই দিন, ওর আসল বিচার হবে - ওপারে, আমি অপেক্ষা করবো ওখানে।
চলি দেবুদা, অনিচ্ছা সত্বেও চলে যেতে হচ্ছে। তোমার বোনের জন্যে দু:খ কোর না। ফাঁসির দড়ি এড়িয়ে বেঁচে থাকলেও ওকে তোমার কাছে, পৃথিবীর ঐ প্রান্তে গিয়ে মুখ লুকাতে হবে।
দীপক
আদালতের রায় স্বাভাবিকভাবেই বদলে গেল। আসল খুনী গার্গী ঘোষ নয়। যে আসল দোষী আইনের চোখে, সে পিস্তলে গুলি ভরে রেখেছিলো - সেই তো মারা গেল।
মাসদুয়েক
লাগলো টিয়ার ভারসাম্য মোটামুটি ফিরে পেতে। এতদিন দেবব্রত ছুটি নিয়ে টিয়াকে খানিকটা
সুস্হ করে তুলেছে। ব্রিটিশ এয়ারের উড়ান ১৯৮ ফ্লাইট সেদিন আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তীরবেগে
রানওয়ে ছেড়ে আকাশে ডানা মেললো। দেবব্রত স্নেহভরে বোনের সিটের বাঁধনহার ঠিক করতে গেলো,
ঠিক তখনই হাতের পিঠে গরম জলের ফোঁটা। টিয়ার এতদিনে চোখের জলের বাঁধ ভেঙেছে। দু চোখ
বন্ধ, জমে থাকা বাষ্প ফাটিয়ে তার ক্ষীণ স্বর শোনা গেল-
দাদা
গো, সিদ্ধার্থর চলে যাওয়াটা তাও কোনদিন সামলে নিতে পারবো। কিন্তু দীপক? কখনও পারবো
ওর অন্তিম চেহারাটা ভুলতে? নিয়মমতোই পর পর দুবার ট্রিগার টিপেছি আমি। প্রথমবারেই ওরকম
ভয়ানক অবিশ্বাস্য কান্ড হয়ে যাওয়াতে আমি বেসামাল হয়ে গিয়েছিলাম। তাই হয়তো দ্বিতীয় গুলিটা
আমার কাঁপতে থাকা অবশ হাত থেকে বেরিয়ে জানলা দিয়ে উড়ে যায়। অবুঝ দীপককে কি ঠিক তখনই
ছাদ থেকে লাফ দিয়ে এই জানলার সামনে দিয়েই পড়তে হল? নইলে তো দাদা নীচের সেফটি নেটটা ওকে বাঁচিয়ে দিতো
আর আমি, সিদ্ধার্থ আর তপতী মিলে ওকে আমার বোকামীর পুরো কাহিনীটা বোঝাতে পারতাম! উফ্
–
গার্গী
দাদার চোখের জলে ভেজা মুখটা লুকোবার জন্যে শরীরটা ঝুঁকাতে গিয়েই টের পেলো সিট বেল্টের
শক্ত বাঁধন তাকে মাঝরাস্তায় আটকে দিয়েছে। ফ্লাইট ১৯৮ তখন অনেক স্মৃতি বিজড়িত, চিরচেনা
বেণুবনকে অনেক নীচে ফেলে, কলকাতার সব আকর্ষণ কাটিয়ে, উদ্ধত ভঙ্গিতে ওপরে, আরো ওপরে
উড়ে যাচ্ছে - নিউ ইয়র্কের পথে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন