শনিবার, ১৪ মে, ২০২২

কাজী লাবণ্য

 

সমকালীন ছোটগল্প


বিচ্যুতিবলয়

(১)

অনেক বছর আগে এই ক্যাম্পাস, এই ভবন, এই ঘাসে ছাওয়া মাঠ, বৃক্ষরাজি একটা ফ্রেমে বাঁধিয়ে নিয়ে চলে গিয়েছিলাম, আজ আবার ফিরে আসলামআজ আমি এই মেডিকেল কলেজে একজন গায়নোকোলজিস্ট হিসেবে জয়েন করলাম। একদিন এই মেডিকেল কলেজেই আমি ছাত্রী হিসেবে চিকিৎসাশাস্ত্রের জটিল ধাপগুলো একটি একটি করে অতিক্রম করেছিলাম। এখানেই আমরা সবাই ইন্টার্ণ করেছিলাম দল বেঁধে বন্ধুত্ব ভাগাভাগির মধ্য দিয়ে। আমরা ‘ডিউটি’ ধার করে আবার ‘ডিউটি’ শোধ দিতাম। কী অদ্ভুত আর আনন্দময় ছিল সেসব দিন!  
আনন্দময় স্মৃতির সাথে সাথে বেদনাময় স্মৃতিও থাকে
যেমন গোলাপের সাথে থাকে কাঁটা মনে পড়ছে সোমার কথা, বিরলতম বন্ধু সোমার কথা। সবাই বলত -
‘রিমি সোমা দুই শরীর এক আত্মা’

সেদিন আমার রাত্রিকালীন ডিউটি ছিল। আমরা হষ্টেলে থাকতাম। কিন্তু বিয়ের পর থেকে সোমা শ্বশুরবাড়িতে থাকত।  
আমি ডিউটিরুমে বসে আছি,
সবেমাত্রই ওয়ার্ড থেকে ফিরেছি। বাইরে একটা  গোলযোগ উঠলো। সরকারি হাসপাতালে গোলযোগ লেগেই থাকে, তাই বলে এই  মাঝরাতে! সরকারি হাসপাতালেও রাত নিশুতি হয়। চিকিৎসকরা জেগে থাকলেও অন্য মানুষজন ব্যথা বেদনা হজম করে নিদ্রা আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করে।
বাইরের গোলযোগ থেকে দু তিনবার উচ্চারিত হলো ‘সোমা’ ‘সোমা’। জানি
না কেন যেন বুকের ভেতরটা ধবক করে উঠলো। কে যেন আর্তনাদ করে উঠলো-
-সোমাকে ওটিতে নিতে হবে, ওটিতে নিতে হবে...
গায়ের এ্যাপ্রন, গলার স্টেথো উড়িয়ে আমি দৌড়াতে লাগলাম গোলযোগের দিকে
হাসপাতালের সুদীর্ঘ করিডোর যেন আরো দীর্ঘ এক পাইথন। কানে আসছে জলির চিৎকার-
-সোমা এসেছে! সোমা এসেছে!

সোমা এসেছে তাতে চিৎকার করার কী হলো! জানি তো আজ ওর ডিউটি নেই, তাহলে অন্য কারো ডিউটি করতে কি এসেছে! তাছাড়া ওদের তো হানিমুন সেরে  কক্সবাজার থেকে আজই ফেরার কথা। আমরা বন্ধুরা ওকে বেশি ডিউটি করতে দি না। সদ্য বিয়ে হয়েছে তো!

হ্যাঁ সেদিন আমার বন্ধু সোমাই এসেছিল, কিন্তু পায়ে হেঁটে নয়। একটা বাঁশের  চাটাই দিয়ে মোড়ানো অবস্থায়। ফেরার পথে বাসে, বাসের হেল্পার আর কয়েকজন মিলে ওকে ক্ষত বিক্ষত করে হত্যা করেছিল। পাথরের মূর্তি ছাড়া, ওর জন্য আমাদের আর কিছুই করার ছিল না। লাশকাটা ঘরে ওর ময়নাতদন্ত দেখতে গিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম।
আজও ওর জন্য বুকের গহীনে এক জমাট বাধা নিদারুণ দুঃখ আর ব্যর্থ ক্ষোভ বয়ে বেড়াই, যা আমৃত্যু যাবে না
প্রিয় বন্ধু আমার!   
থাক ওর কথা
পুরনো গন্ধের সিন্দুকটা বন্ধ করে কর্তব্যে মনঃসংযোগ করি


(২)

জয়েন করার একমাস পার হয়ে গেছে। চেম্বারে আছি। রোগিদের উপচে পড়া ভিড় হালকা হয়ে আসছেঘড়ির দিকে তাকাই। কর্তব্য করে যাচ্ছি কিন্তু মনটা পড়ে আছে বাসায় ছোট মেয়েটার জ্বর, একটু তাড়াতাড়ি যদি ফিরতে পারতাম!

একজন বয়স্ক মহিলা একটি বালিকার হাত ধরে প্রবেশ করলেনবসতে বললাম।

তিনি চেয়ারে বসে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন

-বলুন, কী সমস্যা? কথা বলতে বলতে আমি বাচ্চা মেয়েটির দিকে তাকাই। আশ্চর্য,  মেয়েটি ঘন ফ্রিলের ফোলা যে ফ্রকটি পরেছে, ঠিক এমন একটি ফ্রক আমার  মেয়েরও আছে। হাসি পেল, আড়ং নামের বুটিকশপের অনেকগুলি আউটলেট এই শহরে ছড়িয়ে আছে। অবাক হবার তো কিছু নেই!   

-আমি একটু একা কথা বলতে চাই।

অনুমান করতে কষ্ট হয় না, বাচ্চা মেয়েটি হয়ত প্রথম পিরিয়ডের মুখোমুখি হয়েছে। গার্জেনরা দুশ্চিন্তায় পড়েছে অহরহ এমন গার্জেনরা আসেন, একা কথা বলতে চান, অথচ পিরিয়ড বা মাসিক মেয়েদের নির্দিষ্ট বয়সে একটি স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া, যা আদর্শ ক্ষেত্রে প্রতি আঠাশ দিনে একবার হয়ে থাকে এবং কয়েকদিন ধরে চলে।     
-অসুবি
ধে নেই, আপনি বলুন।

তারপরও উনি কিছু না বলে আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পিয়ন শিরিনের দিকে তাকান। আমি হাত ইশারায় ওকে বেড়িয়ে যেতে বলি। এরপর উনি মেয়েটির দিকে চোখের ইশারা করে বলেন-

-তুমি ওকে পরীক্ষা করে বল তো ওর কী হয়েছে?  

-আচ্ছা, পরীক্ষা করব। তার আগে বলুন ওর সমস্যা কী?

কোন উত্তর নেই।  

-বলুন আপনি, ও কী কী অসুবিধের কথা বলে? আচ্ছা আপনি ওর কে হন? নিরুত্তরকেমন যেন মরা মাছের চোখে উনি তাকিয়ে থাকেন আমার মুখের দিকে।   

-দেখুন, আপনি খুলে না বললে আমি কীভাবে ওর চিকিৎসা করব?

আরো কিছু সময় বয়ে যাবার পর উনি হুড়মুড় করে এসে আমার হাত চেপে ধরেন

-মা, আমাকে বাঁচাও মা, ও আমার নাতনী। ওর বয়স কম, ও খুব ছোট, ওর মা অসুস্থ... বাচ্চাটা আমার মরে যাবে মা... লোকে জানলে কী হবে... আমি এখন কী করব মা...

অবাক হয়ে বাচ্চাটির দিকে তাকাচ্ছি। ওর সামনে এমন করা, এভাবে প্রলাপ বকা কতটা শোভন হচ্ছে?

-তুমি ওকে পরীক্ষা কর। ওর পেটে হাত দিয়ে দেখ...

এবার চমকে গিয়ে ভালো করে মেয়েটির দিকে তাকাই আমার বুক নতুন  ডাক্তারদের মতো ঢিব ঢিব করতে থাকে। উঠে ওর হাত ধরে বেডের কাছে নিয়ে যাই। শুয়ে পড়লে ওর জামাটা তুলে পেটে হাত দেবার আগেই ঘটনা বুঝে যাই। আমার পায়ের নিচের মাটি দুলে উঠে!
-তোমার নাম
কী মা? কী বললে?

নাম শুনে আমি আরো যেন হতবিহ্বল হয়ে যাই। একটা ঘোরের ভেতরে চলে যাই।   
চেয়ারে বসে কলিংবেলে হাত রাখলে শিরিনের প্রবেশ। ওকে বুঝিয়ে দিয়ে, বললাম

-একে নিয়ে যাও

ওরা চলে গেলে মুখ ফেরাই ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে বললাম,  

-এবারে বলুন তো, ঘটনা কী?  

-মা, আসলেই কি ঘটনা সত্যি? আমরা যা আশংকা করছি সেটাই? ও বাঁচবে তো মা...
মাথায় ঝড় বইছে, ভাবছি আমার ডায়াগনোসিস যেন ভুল হয়
মুখে বললাম-

-আপনি বসুন, আমি আসছি।   

আল্ট্রা সনোগ্রাম শেষ হলো  তিন পেরিয়ে চার মাসে পড়েছে। এসব ঘটনা আজকাল আমাকে এক অন্ধকার নিতল বিবরে ঠেলে দেয়, বিষাদ্গ্রস্থতায় ভুগি। আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারি না। মাঝে মাঝে মনে হয় গাইনীতে এসে ভুল করেছি। আমি একজন চিকিৎসক, বিষাদ, হতাশা আমার জন্য বিলাসিতা। রোগ আর রোগিই আমার কঠিন বাস্তবতা। কিন্তু ঘরে আমার এই বয়সের একটি ছোট্ট মেয়ে আছে, যার মুখে এখনও মায়ের দুধের গন্ধ লেগে আছে! যার পরনের ফ্রক,  বয়স আর নামের সাথে এই বাচ্চাটির কাকতালীয় এবং অদ্ভুত এক মিল! তাই বলে এতটা মিল! কেন এই মিল! মিল না থাকলে মনে হয় স্বস্তি পেতাম। আবার ভাবি, মিল থাকতেই পারে। এক একটা সময়ে এক একটি নামের হিড়িক পরে। সমবয়সী অনেকের নাম একই হয়। আমাদের ক্লাসেও এমনটা ছিল। এক রিমিই ছিল তিনজন। সোমা ছিল চারজন।   

()    

-এবারে আপনি বলুন, এমন ঘটনা কী করে ঘটল!
-মা! তুমি আমার চেয়ে বয়সে ছোট, তাই তুমি করে বলছি। তাছাড়া আমি এক সময় গার্লসস্কুলের প্রধানশি
ক্ষিকা ছিলাম। আমার মেয়েও শিক্ষিকা। সেই ওর  ব্যাপারটা প্রথম বুঝতে পেরেছে

মহিলার কন্ঠ এবারে গভীর, শান্ত।  
-মেয়ের এই খবর ওর মা নিতে পারেনি। অনেকগুলো ট্যাবলেট খেয়ে ফেলেছে, সে এখন হাসপাতালেতুমি আমাদেরকে রক্ষা কর মা! আমার অনুরোধ...

তাঁর কথার মাঝখানে হঠাৎ আমি অসহিষ্ণু স্বরে চিৎকার করে উঠলাম-
-বাচ্চাটির যা করা
আমি করব।

যদিও মাথায় ঝড় বইছে, এই অবস্থায় এবরশন অনেক রিস্কি হবে।

-ওকে সুস্থ করে তুলব, ওকে আমি বাঁচাবোকিন্তু কাজটি করেছে কে? কোন  নরাধম? ওর কাজিন? কাজের ছেলে? কে? আপনি বলুন দরকার হলে আমি নিজে থানায় যাব... সেই জানোয়ারটার শাস্তি হওয়া দরকার। এসব নোংরা লোকেরা সমাজের কলংক, বিষফোঁড়া, এদের বাঁচার কোন অধিকার নেইবলুন কে করেছে? এসব ধামাচাপা দেবার বিষয় নয়, লুকানোর বিষয় নয়! তাছাড়া, আপনারা বাসায় করেন কী? বাচ্চাদের দেখেশুনে রাখতে পারেন না! আজব! এত্তটুকুন মেয়েকে কোন সে হারামজাদা এভাবে...
ক্রোধে মাথা ফেটে যেতে লাগলো
সম্ভবত আমার জ্বর আসছে, মাথা দপদপ করছে। চোখমুখ দিয়ে গরম আঁচ ছড়াতে লাগল।

চোখের চারপাশে কালি, ফ্যাকাসে ছোট্ট মেয়েটার মলিন মুখ ঘরময় ভাসতে লাগল।
-আপনি কথা বলছেন না কেন? কথা বলতে লজ্জা লাগছে? নাম বলুন!

মাথা দপ দপ করছে... গায়ের উত্তাপ বেড়ে যাচ্ছে... নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছি...

এমন সময় চেম্বারের বাইরে একটা গোলযোগ ওঠল। শোরগোল বেড়ে যাচ্ছে, কে যেন আমার নাম ধরে চিৎকার করছে। কে? এ কার গলা? এ তো সোমা! সোমা আমার মেয়ের নাম ধরে আর্তনাদ করছে! এখানে সোমা আসবে কোত্থেকে? কিন্তু আমি শুনতে পাচ্ছি ওর আর্তনাদ-
-রিমি, ওকে বাঁচা রিমি! ওকে বুকে তুলে নে, ওকে মরতে দিস না
এরা এভাবে মরতে পারে না!

আমি দৌড়াতে থাকি... দৌড়াতে...থাকি... অনিঃশেষ দৌড় ফুরায় নাকরিডোর ধরে দৌড়াতে দৌড়তে শেষ মাথায় দেখি আমার নিজের মেয়েটাকে চাটাইয়ে পেঁচিয়ে নিয়ে আসছে... আমার মেয়ে! আমার ছোট্টমেয়ে! না, না, আমার মেয়ে নয়, এ তো প্রেগন্যান্ট মেয়েটি! আসলে কোন মেয়েটি? আমি বুঝতে পারি না!    
ঘামে জবজব হয়ে যায় আমার শরীর
জ্বর, প্রচন্ড জ্বর, পিপাসা...

পিওন শিরিন এসে আমাকে ধরে ফেলে,
-ম্যাডাম, আপনার
কী হয়েছে? খারাপ লাগছে? মাথা ঘুরছে? চলেন বাসায় চলেন...
সম্বিত ফিরে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত আমি শিরিনের ঘাড়ে নিজের মাথাটা এলিয়ে
দিই, আবার সামলে উঠি।

(৪)

বালিকার নানি নিশ্চুপ। চোখের চশমা আর কানের মেশিনটা খুলে হাতে নিয়ে স্থির বসে থাকেননৈঃশব্দের এক ঘেরাটোপ সমস্ত কোলাহলকে গিলে খায়।

একজন পরাজিত শিক্ষিকা। সারাটা জীবন তিনি অজস্র প্রশ্নের উত্তর দিয়ে এসেছেন কিন্তু আজ তিনি জানোয়ার, হারামজাদা, নরাধমের সাথে কিছুতেই ‘পিতা’ শব্দটি উচ্চারণ করতে পারলেন না!  
 

    

  
 
   
  


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন