শনিবার, ১৪ মে, ২০২২

অঞ্জন সেনগুপ্ত

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

 

রূটম্যান




(৪)

 

অফিসার তার ড্রয়ার খুলে দুটো মোবাইল বের করে টেবিলে রাখলেন। হরি আর হরেন একে অপরের মুখের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে নিল। ওরা ভাবলো তাহলে কি তারা আজ মোবাইল ফেরত পেতে পারে। যদি তাই হয় তাহলে আর কোন চিন্তাই থাকে না। অফিসার মৃদু হেসে আবার বললেন- এই দুটো তোমাদের। কিন্তু কোনটা কার তা আমার জানা নেই। এবার তোমরা বল কোন মোবাইলে ফোন আসত?

হরি বলল- স্যার আগেই বলেছি যে হরেনের ফোনেই কথা হত। ঐ যে লালটা স্যার।

-ঠিক আছে। হরেন তোমার তো ওদের ফোন নম্বরটা জানাই আছে?

হরেন মাথা নাড়লে অফিসার টেবিলের উপরে রাখা একটা মোটা জাবেদার ভিতর থেকে একটা লেখা কাগজ বের করে হরেনের সামনে দিয়ে বললেন- এটা একবার পড়ে নাও। আর এই নাও তোমার ফোন। কাগজে যেমন যেমন লেখা রয়েছে তুমি ওদের তাই তাই বলবে।

-কিন্তু স্যার, এতো বাংলায় লেখা রয়েছে! ওরা তো হিন্দিতেই কথা বলে। হরেন জানতে চায়।

অফিসার হেসে বলেন- আরে তাতে অসুবিধাটা কোথায়। তুমি এই লেখাগুলোই হিন্দি করে ওদের বলবে। তারপর ওরা কি বলছে তা জেনে নাও।

হরেন লেখাটা আবার ভালো করে পড়ল। দিব্বি বোঝা যাচ্ছে যে ওদের ফাঁদে ফেলা হচ্ছে। কিন্তু এ ব্যাপারে ওর কিছুই করার নেই। বাঁচতে হলে এখন পুলিশের কথাই শোনা উচিত। হরেন দেখল যে ওর ফোনের রেকর্ডিংটা অন করে রাখা আছে। তার মানে দুজনের কথাই রেকর্ডিং হয়ে যাবে। ও একবার অফিসারের দিকে তাকাতেই তিনি চোখের ইশারায় কথা শুরু করতে বললেন।

-হাঁজি, ম্যায় হরেন।

-ইতনে রাত মে কিধার সে আপ বোল রহে হো? লোকটি জানতে চায়।

-কিঁউ ঘরসে।

-ম্যায়নে শুনা আপ লোগনে পাকড় গয়ে। লোকটি অবাক হয়ে বলে।

-কৌন বোলা ইয়ে বাত? ম্যায় তো ঘরপে হুঁ।

-আরে ভাই হামারা ভি এক-দো জানপহচান আদমি হ্যাঁয়। লোকটি হাসে।

-আপনে সহি শুনা থা। লেকিন থানা বুলায়া থা হামারা গাড়িকা কাগজাত দেখনেকে লিয়ে। দেখনে কে বাদ ছোড় দিয়া। অব শুনিয়ে এক বাত। আপকো মাল তৈয়ার হ্যাঁয়?

-হ্যাঁয়। লেকিন ইতনে জলদি কিঁউ? লোকটি বিস্মিত হয়ে জানতে চায়।

-কাল-পরশু দো দিন কমিশনারেটসে কৈ অফিসার নাকা চেকিংমে নহি আয়েগা। ইয়ে হামারে লিয়ে এক মওকা হ্যাঁয়।

-তুমহারা খবর পাক্কা হ্যাঁয়? লোকটি একটু চুপ করে থেকে জানতে চায়।

-বিলকুল। আভি আভি মুঝে খবর মিলতেহি আপকো ফোন কিয়া। পহলে পাক্কা নহি থা?

-হাঁ, উ তো সহি থা। ঠিক হ্যাঁয় কাল সুবে বাতায়েঙ্গে। লোকটি ফোন রেখে দিলে হরেনও অফিসারকে ফোন ফিরিয়ে দেয়।

অফিসার আগে রেকর্ডিংটা বন্ধ করে বলেন- আমি অবাক হচ্ছি একটা কথা ভেবে যে তোমরা যে পুলিশের হাতে ধরা পড়েছ তা লোকটি জানল কী করে!তবে তুমিও বেশ ভালই বলেছ। সব তো আর ওখানে লেখা ছিল না। তোমাকে বানিয়ে অনেকটাই বলতে হয়েছে। এখন যাও। কাল ফোন এলে তোমাদের আবার ডেকে পাঠাব।

-স্যার ফোন দুটো কি পাওয়া যাবে না? হরি করুণ সুরে আবার একই অনুরোধ করে।

অফিসার হেসে বলেন- বুঝতে পারছি তোমরা ফোনটা পেলে সময় কাটাতে পারবে। বাড়ির লোকের সাথে কথাও বলতে পারবে। কিন্তু মুশকিলটা হচ্ছে তোমাদের তো আগেও বলেছি যে কোন কিছু নিয়েই জেলে ঢুকতে পারবে না। সব কিছু ওরা জমা করে রাখবে। তাহলে দুজায়গায় জিনিস জমা থাকলে পরে তোমাদেরই খোঁজ খবর করতে অসুবিধা হবে। তাই এখানেই যখন তোমাদের সবই জমা রয়েছে তখন ফোনগুলোও থাক। ছাড়া পাওয়ার পরে এখানে এসে রসিদ দেখিয়ে নিয়ে যাবে। অফিসার উঠে দাঁড়ালে ওরাও চলে আসে।

মানুষের লোভের কোন সীমা পরিসীমা থাকে না। এ ব্যাপারে সংযমী ব্যবসায়ী খুব কমই আছে। বিশেষ করে যে সব ব্যবসায় দুর্নীতি রয়েছে অর্থাৎ আইনানুগ নয়। সেসব ব্যবসায়ীদের গগন চুম্বী লোভ। আর এদের হিসেবের খাতা খুব কমই থাকে। সব সময় কাঁচা পয়সার ঝনঝন শব্দ না শুনলে এদের ঘুম হতে চায় না। আর তাই হরেনের কথায় এবং পুলিশের ফাঁদে এক সাথে দুটো গাড়িতে প্রায় একুশটি গরু অর্থাৎ হরিদের কথায় অবলা ধরা পড়ল ফুলবাড়ির আগেই নাকা চেকিং-এ। দুটো গাড়িতে মোট পাঁচজন ছিল। প্রচুর টাকায় রফা করতে চেয়েছিল সাজাদ। উপস্থিত পুলিশ অফিসারের মনটা যে একবারের জন্যও চঞ্চল হয়নি তা হলপ করে বলা যাবে না। কিন্তু আগামী দু’মাস পড়েই একটা প্রমোশন লিস্ট বের হওয়ার কথা আছে। তাতে তার নাম না থাকলেও এমন ভালো কাজে  স্বাভাবিক ভাবেই ঢুকে যেতে বাধ্য। আর কে না চায় পদোন্নতি। তাই অনেক কষ্টে চঞ্চল মনটাকে বুঝিয়ে কিছুটা ঠান্ডা করে ঐ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে সোজা থানায় নিয়ে এসে অফিসার মনে মনে তার ছকের ঘুঁটি সাজাতে লাগলেন।

ড্রাইভার আর খালাসিদের টুকটাক কথা জিজ্ঞাসা করে তাদের গারদে পাঠিয়ে দেওয়া হল। আর সেদিনই রাত আড়াইটে থেকে শুরু হল জেরা। সকলে অপরাধী হলেও মূল ব্যক্তি ছিল সাজাদ আলি। সে যে খোদ ইয়াকুবের লোক তা বুঝতে অফিসারের বেশি দেরি হল না। তাই শুধু তাকেই জেরা করার জন্য নিয়ে আসা হল।

-আপকা শুভ নাম বাতাইয়ে। অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন। পাশে বসে একজন তা লিখে নিচ্ছে।

-সাজাদ আলি। লোকটি নির্লিপ্ত গলায় বলে।

-কবসে আপ ইয়ে কাম মে জুরি হুঁই হ্যাঁয়? অফিসার জানতে চান।

-লগভগ পাঁচ সাল হোগি।

-আপনে বাতায়া ইয়াকুব হ্যাঁয় কিংপিন। তো ঠিক হ্যাঁয়। লেকিন আপকা কাম কেয়া থা?

-ট্রাককা সাথ যানা অর মাল ডেলিভারি দেনা।

-ইয়ে বয়েল কিধার সে খরিদ করতে হ্যাঁয়?

-ইয়ে আতি হ্যাঁয় গোপালগঞ্জ, কিসানগঞ্জ, আরারিয়া, ফরবেশগঞ্জসে।

- বিহারমে তো কই না কই নাকা চেকিং হোগি? লেকিন উধার চেকিং নহি হোতি?

-উ আদমি কেয়া করেগা স্যার। উসকো বাপকা সাথ হামারা মাস মাহিনা কনট্রাক্ট হ্যাঁয়। এক ফোন আয়েগা তো ইউনিফর্ম গিলা হো জায়েগি। মেরা কাম হ্যাঁয় সড়ককা ঝুট ঝামেলা মিটানা অর রুটম্যানকো রুপিয়া দেনা। লোকটি এবার ওর বিশাল গোঁফের ফাঁক দিয়ে মুচকি হেসে বুঝিয়ে দেয় যে ওদের হাত কতটা লম্বা ।

-আগলি বরসমে মাথাভাঙাকা ঘোকসাডাঙাসে পুলিশনে পঁচাশ বয়েল অর তিন আদমিকো গ্রেপ্তার কিয়া থা। উসমে এক আদমি থা পূর্ণিয়াকা। উ আদমি কেয়া তুমহারা গ্যাং কা থা?

-নহি স্যার। উসকা দুসরা গ্যাং থা। উসকা মালিক থা মহম্মদ সরফরাজ। অব সরফরাজ আসামমে জেল বন্দি হ্যাঁয়। ম্যায় পহলে উসকা সাথ কাম করতে থে। দেখিয়ে সাব ইয়ে ধান্দা কভি কই রুক নহি পায়েগি। কিঁউকি সব উপরবালা অফিসার, মালিককা জেব মে হ্যাঁয়। লেকিন আপকা মাফিক ইমানদার আদমি ম্যায়নে পহলে কভি নহি দেখা স্যার। ইতনে রূপিয়াকা অফার আপনে পাওসে ঠক্কর দিয়া। ম্যায়নে ইসকে পহলে কিসিকো ইতনে জাদা অফার নহি কিয়া স্যার। ফের একবার সোচ তো লিজিয়ে স্যার। লোকটি অবাক হয়ে অফিসারটির দিকে তাকিয়ে থাকে ।

অফিসারটি মনে মনে ভাবে- সে যে কোন গাড্ডায় পড়েছে তা যদি এই লোকটি একবার জানত তাহলে বিচার করতে পারত কোনটি মূল্যবান। পদোন্নতি, নাকি বিপুল অর্থের হাতছানি। এই দুটো নৌকাই তার ঘাটে এসে দাঁড়িয়ে আছে। এখন শ্যাম রাখি,না কূল রাখির দ্বন্দ্বের মধ্যে লড়াই চলছে। একেবারে শ্বেতশুভ্র পোশাকে দাঁড়িয়ে আছে পদোন্নতি। আর ঠিক তারই পাশে নিঃঝুম রাত্রির নিকষ পোশাকে দাঁড়িয়ে মুচকি মুচকি হাসছে বিরাট প্রলোভনের হাতছানি। যেই না সাদা পোশাকটি এক পা এগিয়ে আসছে, অমনি কালো পোশাকটি ওর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ছে! এমন চিরন্তন দ্বন্দ্বের লড়াইয়ের হাত থেকে এখনও নিস্তার পায়নি পুলিশ অফিসারটি! সে নিজেও হয়তো জানেনা তার পরিণতি কী হবে! একটা সিগারেট ধরিয়ে বার কয়েক টান দিয়ে নিজের বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া দিয়ে নেয়। তবু ভয়ের র‍্যাপারটি ওকে জড়িয়ে থাকে! অফিসারটি বাথরুমে যাওয়ার নাম করে বাইরে এসে দাঁড়ায়। ঠান্ডা বাতাসে মাথার মধ্যে গড়ে ওঠা জ্যামের জটটা একটু একটু করে খুলতে থাকে। সে হিসেব কষতে শুরু করে। এই মুহূর্তে সে একজন এস আই। এর পরে সে হতে পারবে হয়তো কোন থানার ইনচার্জ। তার পর একেবারে চাকরির শেষ প্রান্তে এসে হয়তো সার্কেল ইন্সপেক্টর অর্থাৎ সি আই। ব্যস! এখানেই যবনিকাপাত! কিন্তু আজকে সে যদি এমন অঢেল উপঢৌকনটিকে পায়ে ঠেলে দেয় তাহলে সে চোখ বন্ধ করে বলতে পারে কমপক্ষে তিন-চার বিঘা ধানি জমির ভোগ দখল হারাবে অথবা সে শহরে একটি বসত বাড়ির জমি হাত ছাড়া করবে। ভাবা যায়! সে যতই জাদরেল পুলিশ অফিসার হোক না কেন এমন জটিল মুহূর্তে সে দেখেছে স্ত্রীর বুদ্ধিটাই বেশ খোলে। স্ত্রী চট করে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তাহলে কি সে একবার স্ত্রীকে ফোন করে তার পরামর্শ চাইবে। কিন্তু তাহলে স্ত্রীর সাথে অনেক্ষণ ভ্যাজর ভ্যাজর করতে হবে। শেষে দেখা গেল হয়তো স্ত্রীর মাথাটাও আর কাজ করল না। তখন হিতে বিপরীত হয়ে যেতে পারে। তার থেকে বরং সিদ্ধান্তটা সে নিজেই নিক। তার পর যা হয় দেখা যাবে। সে ফিরে এসে চেয়ারে বসে।

-অব ইয়ে বাতাও কি ইতনে বয়েলকো কিধার লে যাতে থে? অফিসার জানতে চান ।

-দেখিয়ে সাব, ইস বার হামারা ধান্দা থা এক গাড়ি তুফানগঞ্জমে চিলাখানা তক অর দুসরা গাড়ি যায়েগা মারুগঞ্জ তক। ব্যস!উধার সে হামলোগ ঘর ওয়াপ্স যায়েগা ।

-ইস তক ঠিক হ্যাঁয়। লেকিন উধার কিসকো উপর ইতনে বয়েলকা জমিদারি সোঁপতে হ্যাঁয় ।

-সাব, উধার গাড়ি পৌছনেকা পহলেই আদমি আ যাতা। বয়েল গিনতি করকে রূপিয়া দেকে লে যাতা হ্যাঁয়। ব্যস! হামারা কাম খতম হো যাতা। লোকটি মুচকি হাসে।

-উ আদমি কিধার কা হ্যাঁয়? ইস পারকা, কেয়া উস পারকা? অফিসার জানতে চায়।

-নহি সাব, ইয়ে আদমি লোকাল বর্ডারবালে হ্যাঁয়। কেয়া করেগা সাব। গাওমে সবকো পাস জমিনকা কাম নহি হ্যাঁয়। বাঁচনে কে লিয়ে কুছ ধান্দাতো করনেহি পড়েগা। লোকটি বার কয়েক মাথা দোলায়।

-অব তুমহারা মালিক ইয়াকুবকা বারে মে কুছ বাতাও। রহতে কিধার, ইসকে আলাবা অর কেয়া ধান্দা করতে থে,উসকা অফিস কিধার হ্যাঁয়। অফিসার এবার এতক্ষণ ধরে যে অধস্তন কর্মচারীটি লিখছিল তার উদ্দেশে চলে যেতে বললেন। এখন পর্যন্ত যথেষ্ট লেখা হয়েছে।

-সাব আপকো বিশোয়াস হোগা কি নহি উতো মুঝে মালুম নহি। লেকিন ম্যায় সাচ বাতাতা হু কি আজ তক ইয়াকুব ভাইকো সাথ মেরা মুলাকাত ভি নহি হুয়া। মোবাইলমে এক-দো বা্র বাত হুয়া।

-কিঁউ এইসা হুয়া? উ আপকো কভি বুলায়া নহি?

-নহি সাব। ম্যায় অর মালিক ইসকে বিচ মে অর দো আদমি হ্যাঁয়। ডাইরেক্ট ইয়াকুবভাইকো সাথ বাত করনেকা কই জরুরত নহি হোতি।

-শুনিয়ে সাজাদ, ম্যায় আপকো সাথ বাত করতে করতে ইয়ে ভি সোচা কি আপকা বাত মানলে তো মেরা ক্যায়া ফয়দা। হর মাহিনা মুঝে ভি উপরবালেকো পঁচাশ হাজার দেনে পরতা। উসি লিয়ে আপকো অর পঁচিশ বাঢ়া দেনে পড়েগা। তব ম্যায় আপকো প্রপোজাল একসেপ্ট করেগা।

লোকটি মনে মনে বেশ একটা যুৎসই কাচা খিস্তি দিয়ে অফিসারের সতিপনায় পেচ্ছাব করে বলল- ঠিক হ্যাঁয়। অব মুঝে কেয়া করনে হোগা ?

-এক মিনিট রুকিয়ে। অফিসার বাইরে এসে স্ত্রীকে ফোন করে বাইরের নাইট বাল্বটি জ্বালাতে বলে। এবার হাতের ইশারায় বাইরে ডেকে লোকটিকে বলে-আপকা রুপিয়া কিধার হ্যাঁয়?

-মেরে সাথ মে। লোকটি ওর পেটে হাত দিয়ে দেখায়।

-ইতনে রুপিয়া সাথমে লেকে ঘুমতে হো। তাজ্জবকি বাত! এক কাম করো। হামারা থানেমে ক্যামেরা হ্যাঁয়। আপ ইয়ে গুদাম ঘরমে ঘুস যাও। উধার ক্যামেরা নহি হ্যাঁয়। উধার গুনতি করকে রুপিয়া আলগ করো। বাকি রুপিয়া ফির আপকো পেটমে সেট করকে আও।

লোকটি অফিসারের কথা মতো তাই করে। এবং কাজ শেষ করে চলেও আসে। এবার মাঠের উল্টোদিকে যে বাড়িতে আলো জ্বলছে সেই বাড়িটি দেখিয়ে দিয়ে অফিসার বলেন-উ যো বিল্ডিংমে বাতি দেখাই দেতি হ্যাঁয়, উসকো আচ্ছা করকে দেখ লিজিয়ে।আপকো জানেকা পহলে উ লাইট বন্ধ হো যায়েগি। আপ বেল বাজানেকে বাদ যিসনে ডোর খুলেগা উসকো রুপিয়া দেকে ফির ইধার আ যানা। ম্যায় ইধারই ওয়েট করতা।

লোকটি অফিসারের কথা মতো সেই বাড়ির উদ্দেশে চলে যেতেই অফিসার ফোন করে স্ত্রীকে বাইরের লাইট নিভিয়ে দিতে বলে। এবং ব্যাগটি পাওয়ার পরে যেন তাকে জানিয়ে দেয় তাও বলে দেয়।

মাঠটি থানা সংলগ্ন। এখানকার ছেলেরাই বিকালে বল পেটায়। মাঝে মাঝে সুদীপও খেলে। ও আগামী বছর উচ্চ মাধ্যমিক দেবে। তার পরে ইচ্ছে আছে ওকে ইঞ্জিনিয়ারিং এবং মেডিক্যাল এই দুটো জয়েন্টের পরীক্ষাতেই বসানোর। শোনা যায় দুটোতেই প্রচুর খরচ। বিশেষ করে মেডিক্যালে যদি সরকারি কলেজে পায় তাতেও বেশ কয়েক লক্ষ টাকা লাগে। আর বেসরকারিতে তো টাকা প্রায় এক কোটিতে পৌছে যাবে। এই সামান্য পুলিশের চাকরীতে এসব ভাবাটা দিবা স্বপ্নের মতোই মনে হয়। তাই বেশ কিছুদিন থেকেই যতটা পারা যায় ব্যাংক ব্যালেন্স বাড়ানোর জন্যই মাঝে মাঝে এতটা নিচে নামতে হয়। মাঝে মাঝে এসব করতে গিয়ে ঘেন্না হলেও ভবিষ্যতের কথা ভেবে হাতটাও যেন স্বাভাবিক ভাবেই পকেট থেকে বেরিয়ে আসে। তখন আর হাতের উপর তার নিয়ন্ত্রণ থাকে না।

স্ত্রীর ফোন আসার একটু পরেই লোকটিও ফিরে আসে। অফিসার ওর দিকে তাকিয়ে বলেন- কাম হো গিয়া?

-জি সাব। অব কেয়া করেগা? লোকটি জানতে চায় ।

-দেখ অব তিন বাজতা। পনের মিনিটকে অন্দর সাথিও কে সাথ তুম ইধারসে নিকল যাও। দের মত করনা।

লোকটি অদ্ভুত গতিতে থানা থেকে বেরিয়ে সোজা বাকিদের নিয়ে ট্রাকে উঠে পড়ে। অফিসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আর একটা সিগারেটে আগুন ধরিয়ে বড় অলস ভাবে মৃদু টান দেন। রাস্তা থেকে গাড়ির ব্যাক লাইটের আলোটি ধীরে ধীরে একটা ছোট বিন্দু হয়ে গেলে তিনি আবার নিজের চেয়ারে এসে বসেন। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে বসে থাকার পর ড্রয়ার খুলে সজাদের জবানবন্দির কাগজটা বের করেন। আগা গোড়া একবার চোখ বুলিয়ে আলোর সামনে তুলে ধরে কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ফেলেন। এখন এর আর কোন মূল্যই নেই তার কাছে। বরং রেখে দেওয়াটাই বড় রিস্কের ব্যাপার হয়ে যাবে। ছেঁড়া কাগজের টুকরোগুলো নিজের পকেটে ঢুকিয়ে নিয়ে তিনি বেশ নিশ্চিন্ত মনে ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে পা বাড়ালেন।

জেলের বিশাল বিশাল ঘরের মেঝেতে শুয়ে আর দুর্গন্ধময় বাথরুমের গন্ধ শুকতে শুকতে হরি-হরের বেশ কয়েক মাস হয়ে গেছে। কবে তারা ছাড়া পাবে সে ব্যাপারে উকিল তেমন কিছুই বলতে পারছে না। মাসের নির্দিষ্ট দিনে বেশ ক’বার  মা-বাবা ওদের দেখতে এসেছিল। এখন সেটাও প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে ওদের ভয় হয়। এভাবেই কি ওরা ধীরে ধীরে একদিন বাড়ির সবার স্মৃতি থেকে হারিয়ে যাবে! এভাবেই কি একে একে যৎসামান্য জমিটুকু বিক্রি হতে হতে ওরা ক্রমশই নিঃস্ব হয়ে যাবে! কি এমন অন্যায় করেছিল ওরা! ওরা কাউকে খুন করেনি, রাহাজানি করেনি! এমনকি কাউকে ঠকায়নি! শুধু একটা মাত্র খবর আদান প্রদান করত। কিন্তু এটাই তো রুটম্যানের কাজ। এটাও তো একটা কাজ। অথচ তারই মাসুল গুনতে হচ্ছে এই চার দেয়ালের মধ্যে কুখ্যাত সব চোর-ডাকাত আর পাতা খোরদের সাথে! যাদের মুখে সব সময় খিস্তি লেগেই থাকে। কিন্তু নিজেদের পেটে একটু আধটু বিদ্যা তো রয়েছে। আর তাই ওদের উদ্দেশে চারদিকের বিদ্রুপের মধ্যেও ওরা নিজেদের একেবারে গুটিয়ে রেখেছে। ইচ্ছে করেই কারোর সাথে মিশতে চায় না। মাঝে মাঝে ভীষণ রাগ হয় ঐ পুলিস অফিসারটির উপরে। উনি বলেছিলেন যে ওদের বিরুদ্ধে এমন সহজ ধারা দেওয়া হয়েছে যাতে কয়েক মাসের মধ্যেই ওরা খালাস হয়ে যাবে। কিন্তু ভালো মানুষের আড়ালে যে একটা লোভী-হিংস্র মানুষ লুকিয়ে ছিল তা জানতে পারলে ওরা অন্তত ফোনে কথা বলে আর অবলা পাঠাতে বলত না। কারণ সেটা যে পুলিসের একটা ফাঁদ ছিল তা ওরা বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু ওদের শেষ পর্যন্ত যে কি হল তা আর জানা হল না। তার আগেই ওদের জেসি অর্থাৎ জেল কাস্টডি হয়ে গেল।

রাতে ঘরে লন্ঠন কমানো থাকলেও চট করে ঘুম আসতে চাইত না। এমনিতেই গ্রামের লোকেরা কেরোসিনের অভাবে কখনই ঘরে লন্ঠন জ্বালিয়ে ঘুমায় না। বরং ইদানীং হাতের কাছে একটা টর্চ রাখে। অথচ এই কয়েক মাস ধরে ওরা একটা তীব্র আলোর মধ্যে ঘুমিয়ে পড়তে শিখেছে। সকলে ঘুমিয়ে গেলেও ওরা পাশ ফিরে বা চোখের উপরে হাত রেখে শুয়ে থেকেছে। চট করে ঘুম না এলেও এক সময় সত্যিই ঘুমিয়ে পড়েছে। অথচ আজ হরির ঘুম আসছে না। ও পাশ ফিরে তাকাতেই দেখে হরেনও ওর দিকে চোখ মেলে তাকিয়ে রয়েছে। হরি হাসে। হরেন বলে-এবার থেকে আর দিনে ঘুমাব না। তাহলে রাতে আর ঘুম আসতে চায় না।

-অনেকেই তো তাস খেলে দেখি। যদিও আমরা তা পারি না। তাই শুয়ে থাকতে থাকতেই চোখে ঘুম জড়িয়ে যায়। আগে তো কোনদিনই দিনে বাড়িতে ঘুমাতাম না। হরি বলে।

-হ্যাঁরে হরি, ওদিককার খবর কী? মাঝে তো কাকা-কাকী এসেছিল। কাকীকে কিছু জিজ্ঞাসা করিসনি সবাই কে কেমন আছে? হরেন ফৎ করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে।

- তোর বাড়ির সবাই যে সুস্থ আছে তাতো আমি আগেই বলেছি। তবে মানসিক দিক দিয়ে তোর বাবা-মা বা আমার বাবা-মা এরা সবাই ভেঙে পড়েছে।

-সে তো তুই আগেই বলেছিস। আমি জানতে চাইছি তুই কি মালতী-যমুনাদের কথা কিছু জিজ্ঞাসা করিসনি?

-ওদের কথা জিজ্ঞাসা করে আর কি হবে! আমাদের পিঠে তো একটা সিল দেগে গেছে। সারা জীবনের জন্য। আমরা ছাড়া পেলেও সবাই তো জানেই যে আমরা জেল খাটা আসামী। তাছাড়া তোকে একটা কথা বলিনি। তাহল- । হরি বুঝতে পারে না কথাটা হরেনকে বলাটা উচিত হবে কিনা।

-থামলি কেন? বলার থাকলে বলেই ফেল। হরেন এবার উঠে বসে।

-বলার নয় বলেই এতদিন তোকে বলিনি। কিন্তু হঠাৎ মুখ ফসকে একটু বেরিয়ে গেছে।

-তাহলে দেরি না করে বাকিটা বলেই ফেল।

-না, বলছিলাম কি সেদিন মা বলছিল যে মালতী আবার স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে। আর যমুনার বিয়ে হয়ে গেছে। তুই দুঃখ পাবি বলেই আমি আগ বাড়িয়ে বলিনি। হরি হরেনের চোখে চোখ রাখে।

-যমুনা আর কিছুদিন অপেক্ষা করতে পারল না! কতই বা বয়স হয়েছিল ওর!

-মা বলছিল এই বিয়েতে ওর আপত্তি ছিল। কিন্তু আমরা জেলে যাওয়ায় ওর বাবা তাড়াতাড়ি কোন এক চা বাগানের ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। তাছাড়া এবার ভেবে দেখ হরেন্‌, আমাদের মালতী বা যমুনা কেন বিয়ে করবে বল। আমাদের আর রইলটা কি? আমরা তো এর পরে জেল খাটা বেকার ছাড়া আর কিছু নই। জানি আমাদের আর কেউ কাজও দেবে না। এতদিন বাবাকে যতটুকু সাহায্য করছিলাম এবার সেটাও বন্ধ হয়ে গেল। এখন আমাদের মুখ আর কেউ দেখতে চাইবে না। বরং আড়ালে আমাদের গালাগাল দেবে। হয়তো বলবে-‘ঐ দেখ জেলখাটা রুটম্যান হেঁটে অন্যের জমিতে খাটতে চলেছে। বাইক চালানোর আর মুরোদ নেই’। এমন কথাই হয়তো সবাই আলোচনা করবে।

হরেন শুয়ে পড়ে। কোন কথা না বলে একেবারে নির্বাক হয়ে যায়। আঘাতটা যে এভাবে আসবে তা সে কল্পনাও করতে পারেনি। তাই হরির কথার কো্ন উত্তর দিতে ইচ্ছে করে না। হরি আবার পাশ ফিরে শোয়। কেউ কারোর চোখ দেখতে পায় না। অথচ ওরা কেউই বুঝতে পারে না যে এমন ঠান্ডার মরসুমে হঠাৎ করে দুজনের চোখে বাঁধ ভাঙা প্লাবন এল কোথা থেকে! সেই জল নিঃশব্দে মাথার নিচে ভাঁজ করা কম্বলটাকে ভিজিয়ে দেয়। ওরাও আর সেই জল ইচ্ছে করেই মোছে না।

 

(ক্রমশ)


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন