ধারাবাহিক
উপন্যাস
দিগন্তসেনা
(৪)
যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য উপত্যকা সেনকে যথেষ্ট পরিমাণে অস্ত্রশস্ত্র ও সেনা বিদ্যালয়গুলোতে সেনাদের যথাযথ ভাবে আধুনিক সমর কৌশল শেখানোর ওপর যাতে জোর দেওয়া হয় সেই আদেশ প্রেরণের সময় কর্নেল শ্যামাঙ্গীর মনে পড়ে গেল বহুদিন আগের একাটা কথা। সেবারের আরাধনার দিনগুলোর পরে পরেই ভাঁটির বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল। গণসংবাদালয়ের একটি ছেলের সঙ্গে যাতায়াতের সময় আলাপ যে হয়েছিল ভাঁটির সেকথা আগেই জানা গিয়েছিল। এখন ওরা বিয়ে করে ঘরসংসার করতে চায়। তিনদিন ধরে মানময়ীর বাড়ি থেকে তুমুল হইচই আর কলকাকলিতে ভাঁটির বিয়ে সম্পন্ন হল। কনকাঞ্জলি বিভিন্ন আত্মীয়স্বজনের থেকে দয়া ভিক্ষা করে যতটা পেরেছে ততটা সোনাদানা খাট বিছানা তো দিয়েইছে। তার ওপরে বাদবাকি সবটাই মানময়ী আর অনঙ্গের সাহায্যে মিটে গেল। বিয়ে করে ভাঁটি শ্বশুরঘরে চলে গেল শুধু নয়, হাতে যেন একেবারে স্বর্গ পেল। পেছনের দিকে ফিরে যেন একবার তাকানোরও সময় পেল না। সবাই লগ্নলতা, উপমা আর শ্যামাঙ্গীর দিকে তাকিয়ে নানা কথা বলে বোঝাতে চেষ্টা করল যে ওদেরও একদিন না একদিন এভাবেই শ্বশুরঘরে যেতে হবে। কেউ কোন কথা বলল না । শুধু শ্যামাঙ্গী কিরকম একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বাঁকা হাসি হেসে তরতর করে সোজা সেই জায়গা ছেড়ে চলে গেল। ভেতরে ভেতরে কিন্তু মেয়েটা আরও আহত, আরও ক্ষতবিক্ষত হতে থাকল ওর আসন্ন ভবিষ্যতের কথা ভেবে। অনঙ্গ মানময়ীকে বলল শ্যামাঙ্গীকে আদবকায়দা আর কাজকর্ম শেখানোর অপর জোর দিতে। কেননা হাজার হোক মেয়েমানুষ হয়ে যখন জন্মেছে পরের ঘরে তো যেতেই হবে। কথাটা যে অসত্য নয় মানময়ী নিজেও তা বোঝে। আত্মীয়স্বজনও কমবেশি খোঁজ খবর নিতে শুরুকরেছে শ্যামাঙ্গীর বিয়েটা ওরা কবে দেবে। কিন্তু শ্যামাঙ্গীর মনের মধ্যে চলল এক তুমুল উথালপাথাল পর্ব। গোটা ব্যাপারটাকেই ওর মনে হতে লাগল এক বিরামহীন অপমানের দাসত্ব যার হাত থেকে মেয়ে জন্মে যাওয়া কারুরই কোন নিষ্কৃতি নেই। ভাঁটির জন্য কনকাঞ্জলি সকলের দোরে দোরে গিয়ে ভিক্ষের আঁচল পেতে দাঁড়ানোর মধ্যে যে চূড়ান্ত অপমান ভাঁটির অস্তিত্বের সঙ্গেই মিশে আছে সেটা ভাঁটি বুঝেছে নাকি না বুঝেই গোটা ব্যাপারটার শিকার হয়েছে তা শুধু শ্যামাঙ্গীর কাছেই চূড়ান্ত এক ধোঁয়াশা আর হতাশা। তার ওপরে নিজের বাড়ি নিজের ঘরদোর, বাবা মা, পরিবার সব ছেড়ীই সদর্পে চলে যাওয়া আর সেই সঙ্গে বর্তে যাওয়ার যে ছাপ ও ভাঁটির চলনে বলনে ও চোখে মুখে দেখতে পেয়েছে তার মধ্যেকার লুকোনো অপমান আর অজ্ঞানতার ভার ওকে এমনই হতবিহবল করে তুলল যে ও নিজের মধ্যে নিজেই যেন একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেল। মাথার ভেতরটা কিরকম একটা করে উঠে যেন গভীর অতলে কোথাও তলিয়ে যেতে যেতে মুখের ভেতরটা একেবারে বিস্বাদ হয়ে উঠল। ও কোন রকমে সকলের নজর এড়িয়ে ছাদে উঠে গেল, দাঁড়াল গিয়ে চিলেকোঠার বাইরের দিকের দেওয়ালে পিঠে ঠেস দিয়ে, দাঁড়িয়েই মুখটা ওপরের দিকে তুলে দুচোখ ভরে আকাশটাকে দেখতে থাকল। আর শেষে গিয়ে ধ্রুবতারার ওপর চোখটা আটকে গেল। মানময়ী সারাবাড়ির কোথাও ওকে খুঁজে না পেয়ে শেষে ছাদে উঠে আসতে বাধ্য হল সকলের চোখ এড়িয়েই অবশ্য। আর এসেই ওকে দেখতে পেয়ে যেন শরীরে বল পেল। তবে ওর ভাবভঙ্গি, আকাশের দিকে চেয়ে থাকা দেখে কোন কিছু বুঝতে পারল তো নাই-ই, বরং আরও হতভম্ব হয়ে গিয়ে পায়ে পায়ে ওর দিকে এগিয়ে গিয়ে একেবারে ওর গা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে ওর বাঁ কাধের ওপর একটা হাত রাখল। স্পর্শটা পাওয়া মাত্রই শ্যামাঙ্গী চিনতে পারল আর মানময়ীর কাঁধের ওপর মুখ রেখে তাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরল গভীর বিস্ময় আর হতবিহবলতা থেকে করা মানময়ীর কোন প্রশ্নেরই কোন রকম উত্তর না দিয়েই। বেশ কিছুক্ষণ পর মানময়ী ওকে নিয়ে নিচে নেমে এসে গুরুমার ঘরে ঢূকল। কিছুক্ষণ পর শ্যামাঙ্গী ওখান থেকে বেরিয়ে সোজা নিজের ঘরে ঢুকল। লগ্নলতা আর উপমা ওকে কোথায় ছিল জিজ্ঞেস করাতে ও বলল, ‘কাজ ছিল। তোরা এখানে কী করছিস?’ ওরা তখন বলল যে ওরা ছেলেদের বাড়ির উৎসবে কী পরে যাবে, কী সাজগোজ করবে সেটা নিয়ে কথা বলার জন্যই ওর ঘরে এসেছিল। তখন মজা করার জন্য ও বলল, ও-ও তো ওদের কাছে গিয়েছিল। না পেয়ে ফিরে এল। শোনামাত্রই ওরা হো হো করে হেসে উঠল যেটাকে শ্যামাঙ্গীর অপরিণত দুটি মনের বিকারগ্রস্ততা ছাড়া আর কিছুই মনে হল না।
কাজকর্ম শেখা আর সাংসারিক দায়িত্ব পালনের শিক্ষানবিশী হিসেবে শ্যামাঙ্গীকে সকলের খাওয়াদাওয়ার সময় গিয়ে সবাইকে খেতে দেওয়া এবং তাদের আরও কি কি লাগবে তার তদারকি করা ছাড়া সকালবেলা উঠে একটাই সুইচ টিপে সকলের ঘরের জানলা দরজা খোলা এবং রাতে সে সুইচটাই টিপে সেই সব জানলাগুলো আবার বন্ধ করে দেওয়া, এইরকম কিছু কাজ দিয়ে শুরু করানো হল। কিন্তু অনঙ্গ যখনই সম্রাটের ভবিষ্যতের কথা ভেবে তার একটা সম্ভাব্য চাকরির ব্যবস্থা করল এবং তাকে আরও খানিকটা পড়াশোনা করানোর জন্য, যা কিনা তার চাকরিরই পক্ষে সাঙ্ঘাতিক গুরুত্বপুর্ণ, তার জন্য শ্যামাঙ্গীর দ্বারস্থ হল, তখন শ্যামাঙ্গী সানন্দে সেটাতে রাজি হয়ে গেল এই ভেবে যে এতে হয়ত সম্রাট শুধরে যাবে, ওকে কেন্দ্র করে তৈরী হওয়া বাড়ির অশান্তি আর হতাশাজনক পরিস্থিতিও বদলে যাবে। সেই সঙ্গে সাংসারিক তদারকির নামে অপরিমেয় দাসত্বের যন্ত্রণা হাত থেকে শুধু রেহাই পেয়ে যাবে তাইই নয়, এর ফলে হাতে খানিকটা সময়ও পাওয়া যাবে হয়ত বিবাহের জন্য বলিপ্রদত্ত ওই আসন্ন ভবিষ্যতটার হাত থেকে। সম্রাটের ঔদ্ধত্ব আগের থেকে অনেকটাই কমেছে। কমেছে নিজেদের পৌরুষ জাহির করার এক উচ্চাঙ্গের কৌশল ও কৌলিন্য অনঙ্গ আর সম্রাটের। তার ফলে আপাতত ওরা দুজনেই শ্যামাঙ্গীর খাঁচায় বন্দী। আনুগত্যের নজির দেখাবার জন্য অনেক সময়ই তারা এমন অনেক কাজই করে ফেলে যাতে বাড়ি শুধ্বু লোক হাঁ করে দেখে আর তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে। এইসব মজার দিনগুলোতে একদিন মানময়ীর বাপের বাড়ি থেকে একজন দূর সম্পর্কের আত্মীয় এসে সব ব্যাপারটা দেখে সে একেবারে তাজ্জব বনে জায়। আর ফিরে গিয়ে সবার কাছে রাষ্ট্র করে বলে বেড়ায়, মেয়েসন্তানকে মানময়ী এতখানি মাথায় তুলে একেবারেই উচিত কাজ করছে না। হাজার হোক ছেলে থাকতে মেয়েকে নিয়ে এতটা মাতামাতি করে সমাজের নিয়ম না মানা শুধু নয়, সেটা ঘোর অপমানজনক ও অমঙ্গলজনকও বটে।
উপমা দেখল শুধু পড়াশোনা ভাল করে করার সূত্রেই শ্যামাঙ্গীর সামাজিক অবস্থান আর পরিস্থিতি শুধু পাল্টে যাচ্ছে তাই নয়, সকলের কাছে সে দিনে দিনে সম্মানের পাত্রও হয়ে দাঁড়াচ্ছে। উপমা তাই নিজেই ঠিক করল সে পড়াশোনার জন্য আরও বেশি সময় ব্যয় করবে। সপ্তাহ দুই পরে লগ্নলতা এসে সব দেখে শুনে ওই একই সিদ্ধান্তে পৌছাল। তাছাড়া তার বাবা-মার জীবনে যা ঘটেছে তা যে তার জীবনেও ঘটবে না, তারই বা নিশ্চয়তা কিসের। এর পর পরই উপমা আর লগ্নলতা দুজনে শ্যামাঙ্গীর সঙ্গে একদিন একা ঘরে চুপিসারে এইসব বিষয় নিয়ে কথা বলে। শ্যামাঙ্গী তার নিজের অভিজ্ঞতা আর অনুভুতির কথা খানিকটা ওদের বললেও সবটা কিন্তু বলে না। আর বাড়িতে বাবা মা দেখে মেয়েদের বিয়ে বা সাংসারিক কাজকর্ম নিয়ে কথা তুললেই ওরা আর আগের মত উৎসাহ দেখায় না। সকলেই যে যার পড়াশোনায় বেশ খানিকটা সময়ই শুধু দিচ্ছে না, সেইসঙ্গে তরতর করে মেধার শীর্ষে পৌঁছে যাবার নানা নমুনাও দিব্যি দেখিয়ে দিচ্ছে। আস্তে আস্তে ব্যাপারটা আর বাড়ির মধ্যে সীমাবদ্ধ রইল না। শ্যামাঙ্গীর শৈশবে যে জায়গাটা কয়েকটা বাড়ি নিয়ে তৈরী স্রেফ একটা গ্রাম ছিল, সেই নিহিত পাতালপুরী একটু একটু করে উন্নত আর আধুনিক শহরতলি হিসেবে নিজেকে মেলে ধরছে। বিশেষ করে বিমা কোম্পানি আর জামাকাপড় তৈরির ব্যবসাগুলো এখানে জাঁকিয়ে বসাতে আর সেই সঙ্গে প্রচুর লোকজনের বসবাসের সূত্রে এটা প্রায় কমবেশি শহুরে আদবকায়দায় কেতাদুরস্ত এক অঞ্চল হিসেবে নিজেকে একটু একটু করে মেলে ধরতে শুরু করেছে। মানুষের জীবনযাপন আর পোশাকআশাক, এমন কি চলনবলন অনেকখানি পালটে গেলেও মেয়েদের দেখার আর বিচার করার বিষয়গুলো খুব কিছু একটা পালটায়নি। আর জ্ঞানার্জনের প্রতি বেশির ভাগ মানুষেরই অক্ষমতাজনিত কারণে একটা শ্রদ্ধামিশ্রিত সম্ভ্রম কাজ করে। তাই অনঙ্গ মানময়ীর সংসারের ছায়া গোটা জনপদের ওপরেই পড়ল। মেয়েরা বেশীরভাগই সব কিছু ছেড়েছুড়ে দিয়ে পড়াশুনোয় মন দিল। আর তারই ফলে নানারকম সব ঘটনা ঘটতে লাগল। শ্যামাঙ্গী কিন্তু কোথাও কোন কিছু না বলে গাম্ভীর্যের সঙ্গে তার নিজের কাজগুলো শুধু করেই গেল না, একটু একটু করে দায়িত্ব আর কর্তব্যের শীর্ষ বিন্দুগুলো অবলীলায় ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখাতে লাগল। অনঙ্গ আর মানময়ী জদিও বা ভাবল মেয়েটাকে এবার বিয়ে দেওয়া দরকার, কিন্তু সত্যি যদি বিয়ে হয়ে যায় তাহলে সম্রাটের পড়াশোনা, চাকরিবাকরি আর ভবিষ্যতের কি হবে! এভাবেই শ্যামাঙ্গী আরও খানিকটা সময় পেয়ে গেল।
মহাসঙ্গীত সম্মেলনের সময় যতই এগিয়ে আস্তে থাকল, ততই ব্যবস্থাপনার জায়গায় নানা গাফিলতি দেখা জেতে লাগল। গুরুজী একদিন তো বলেই বসলেন, এখানে মহাসঙ্গীত সম্মেলন করাটা হয়ত আর সম্ভব হয়ে উঠবে না। সকলেরই মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। সম্রাটকেও যথেষ্ট ম্রিয়মান দেখা গেল। অবশেষে গুরুজী এবং গুরুমা যেদিন সবাইকে জানিয়ে দিলেন যে ওটা হবে না, ঠিক সেই সময় শ্যামাঙ্গী এসে ওঁদের বলল সে একবার চেষ্টা করে দেখতে চায়। সকলে যেন একেবারে আকাশ থেকে পড়ল। অনঙ্গ আর মানময়ীর ধারণা, ও চাইলে ওটা হতেও পারে। প্রতিবেশী লোকজনেরও তাইই বিশ্বাস। গুরুজী ওকে সম্মতি দিলেন। তবে শ্যামাঙ্গী ওদের বলল, ওর পক্ষে একা এই কাজ করা কোনমতেই সম্ভব নয়। ওকে সাহায্য করার জন্য আরও অনেক লোকজন দরকার এবং ওর যখন যেটা দরকার তখন সেটা দিতে হবে। সকলেই সোল্লাসে রাজি হয়ে গেল। এভাবেই শুরু হয়ে গেল মহাযজ্ঞের প্রস্তুতি। মনে মনে সকলেই রূদ্ধশ্বাসে আসল সময়টার জন্য অপেক্ষা করতে শুরু করল। আসল দিনটা আসতেই শ্যামাঙ্গী সকাল থেকে তীর্থসরোবর অঞ্চলে বাঁশ, কাঠ আর কাপড় দিয়ে পেরেক ঠুকে ঠুকে বানানো মঞ্চের ওপরে উঠে যান্ত্রিক ধ্বনিবিবর্ধনের সহযোগিতায় এক এক করে নাম ডাকতেই প্রতিবার নিজেদের পালা অনুযায়ী মেয়েরা সকলেই উঠে গান করে একে একে মঞ্চ থেকে এত সুন্দর আর সুশৃঙ্খল ভাবে নেমে আসতে লাগল যে দর্শক হিসেবে বসে থাকা অগণিত মানুষের মনে হতে লাগল গোটা ঘটনাটা যেন স্রেফ একাটা সুইচ টিপে শুরু ও শেষ করা হচ্ছে। পুরো ব্যাপারটা এইভাবে তিন দিন চলল। শেষে গুরুজী আর গুরুমা রায় দিলেন, প্রথম হয়েছে প্যাপিরাস, দ্বিতীয় উপমা আর তৃতীয় হয়েছে কলকাকলি। গুরুজী পুরস্কার হিসেবে ঘোষণা করলেন, এরা তিনজন বিনা খরচায় আগামী পাঁচ বছর গুরুজীর কাছে সঙ্গীত শিক্ষার সু্যোগ পাবে। সেই সঙ্গে তাদের ‘দুপুরের ইচ্ছে’ নামক স্মারক প্রদান করা হল। এই পর্বের শেষে গণস্বয়ম্বর সভায় সামান্য বিরতির পর সকলে মিলিত হল। ছেলেরা মেয়েদের আর মেয়েরা ছেলেদের নিজস্ব মানসিক গড়ন অনুযায়ী সঙ্গী পছন্দ করে নিতেই মঞ্চে উঠে একেকটা জুটি দাঁড়াল আর তাদের নাম ঘোষণা করল শ্যামাঙ্গী। ঠিক হল তাদের বাবা-মায়েরা পরে আয়োজন করে তাদের বিয়ে দিয়ে দেবে। হরিণের ঢেউ নামে একটা সংগঠন এগিয়ে এল প্যাপিরাস, উপমা আর কনকাঞ্জলির আগামী পাঁচ বছরের যাবতীয় খরচ বহন করতে। পুরো পর্বটা চুকে গেলে সবাই আবার যে যার জীবনের নিজস্ব ছন্দে ফিরে গেল। সকলের মুখে একটাই কথা যে শ্যামাঙ্গী যেন দশটা ছেলের কাজ একাই করেছে!
চারপাশের সহজ সুন্দর পরিবেশে শ্বাস নিতে নিতে সকলেই ভুলে যায় তাদের একে অপরের সঙ্গে বিদ্বেষ, প্রতিহিংসা, ক্ষমতালিপ্সা, লোভ সব। তারই মধ্যে এলাকায় ঢুকে পড়ে আর্য গোত্রীয় কিছু মানুষ একেবারে দল বেঁধে। তারা তাদের এখানে আসার কারণ হিসেবে জানায় যে তারা এখানে জমিতে বাড়িঘরদোর বানিয়ে বসবাস করতে চায়। ইতিমধ্যে নানা সামাজিক তথা রাজনৈতিক দল নড়ে চড়ে বসে। উদারপন্থী দল, রক্ষণশীল সমাজ দল ও মধ্যমেধা চৌকনা দলের লোকজন অনঙ্গের বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ে। দরজা খুলতেই তারা জানায় তারা এসেছে ওর মায়ে শ্যামাঙ্গীর কাছে যাতে সে ওদের দলে যোগ দেয়। কেননা তাহলে তারা পরবর্তী নির্বাচনে ক্ষমতাদখলের সঙ্গে সঙ্গে জনসংযোগ আর সংবাদ প্রেরণের ব্যাপারেও দক্ষ হয়ে উঠবে শুধু নয়, পরবর্তী সময়ের নেত্রী হিসেবে ও ওদের দল থেকে জিতেও আসতে পারবে। অনঙ্গ মানময়ীকে ডাকল। মানময়ী সব শুনে শ্যামাঙ্গীকে ডাকতে দুর্গাকে পাঠাল। কিছুক্ষণ পর উপমা এসে মানময়ীকে দূর থেকে ডাকল। মানময়ী ওর কাছে যেতেই উপমা তাকে বলল যে শ্যামাঙ্গী বলল ওদের বলতে যে শ্যামাঙ্গী বাড়ি নেই। দলগুলোর লোকজন সকলেই বলল যে শ্যামাঙ্গী বাড়ি ফিরে এসে যেন ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। সবাই চলে গেলে অনঙ্গ ঘরে ঢুকে সব কথা বলল। সম্রাট এসে হন্তদন্ত হয়ে সবাইকে বোঝাতে লাগল, তারা সকলেই যেন শ্যামাঙ্গীকে বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজী করায় কোন একটা দলে যোগ দেওয়ার জন্য। কেননা তাহলে টাকাপয়সা, ক্ষমতা সব কিছুতেই ওদের পারিবারিক মর্যাদা এত বেড়ে যাবে, আত্মীয়স্বজন, পাড়াপড়শি এতই ওদের হাতের তালুতে রেখে চলবে যে পর পর কয়েক প্রজন্ম স্রেফ কিছু না-করেই শুধু খেয়ে ঘুমিয়ে অন্যদের সেবা শ্রদ্ধা, সম্ভ্রমে ওরা দিব্যি জীবন কাটিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু শ্যামাঙ্গী এককথায় সব কিছুকে নস্যাৎ করে দিয়ে বলে, ‘না’। মানময়ী আর অনঙ্গ সঙ্গে সঙ্গেই বুঝে গেল এই ‘না’ কোনদিনই কোনকিছুর বিনিময়েই হয়ে উঠবে না ‘হ্যাঁ’। সম্রাট ওর কাছে পড়তে বসে নিজে পড়ার বদলে ওকে বোঝাতে লাগল যে ও যেন এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়। শ্যামাঙ্গী অনেক চেষ্টা করেও যখন দেখল ও ওই একই বিষয় নিয়ে পড়ে আছে, তখন হাই তুলতে তুলতে বলল, ‘খুব ঘুম পাচ্ছে’ বলে ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
ঘুমোতে ঘুমোতেই এক সময় ওর মনে হল ভূমিকম্প শুরু হয়ে গেছে আর ও তারই দোলায় দুলতে দুলতে চোখ খুলেই দেখতে পেল, ভাঁটি এসে ওর গোটা ঘুমন্ত শরীরটাকে দুহাত দিয়ে এতই ঝাঁকাচ্ছে যাতে করে খাটসমেত ভেঙে মেঝে ভেদ করে নিচের তলায় এখন যারা আছে তাদের ওপর পড়বে। তাড়াতাড়ি উঠে বসে হাই তুলতে তুলতে কিছুটা আতঙ্কিত হয়ে বলল, ‘কী হয়েছে? সবাই সব জায়গায় ঠিক আছে তো?’ ওর সমস্ত প্রশ্নকে নস্যাৎ করে দিয়ে ভাঁটি জানতে চাইল, ওই লোকগুলোর প্রস্তাবে ও রাজী হল না কেন। ও কিছু বলবার আগেই উপমা এসে জানাল, গুরুজী গুরুমা ডাকছেন। শ্যামাঙ্গী উঠে চোখেমুখে জল দিয়ে ওঁদের ঘরে গেল শুধু এইজন্যেই যে ওঁদের হয়ত কোন শারীরিক সমস্যা হয়েছে। কিন্তু গিয়ে শুনল, গুরুজী গুরুমা দুজনেই বলছেন, রাজনৈতিক দলে যোগ দেওয়ার পর ও যেন তীর্থসরোবর অঞ্চলে একটা স্থায়ী মঞ্চ তৈরি করে আর সেখানে মহাসঙ্গীত সম্মেলন প্রতি বছর চালিয়ে যাবার ব্যবস্থা করে। ও গুরুজীকে আশ্বাস দিল এই বলে যে সঙ্গীতের ব্যাপারটা সকলের সহযোগিতা পেলে ও এমনিই চালিয়ে যেতে পারবে। নিচে নামতেই প্রতিবেশি একজন এসে বলল শ্যামাঙ্গী যেন ওই সব দলে যোগ দিয়ে ওদের ভুলে না যায়, এখানকার মানুষজন, উন্নয়ন দেখটা ওর সবচেয়ে বড় কর্তব্য। বারুদ এসে বলল ওকে, ওর ব্যবসাটা যাতে বাড়ানো এবং নিজের নামে করে নেওয়ার ব্যাপারে শ্যামাঙ্গী যেন ওকে একটু সাহায্য করে। ও সকলকেই আসছি বলে বেরিয়ে গেল। রাস্তা দিয়ে যাবার সময় যখন যখন যে যে দলের লোকের সঙ্গে দেখা হল, তারা সবিস্তারে তাদের বক্তব্য ওকে জানাল। সবার সব কথা শুনে ওদের আশ্বাস দিয়ে ও বলল যে ও নিশ্চয় ভেবে দেখবে। শুধু তাই নয়, ভাবনাচিন্তার পর ও নিজেই জানিয়ে দেবে ওদের সব কিছু। কিছুদিন বাদে সকলেই জানতে পারল ওর আসল সিদ্ধান্ত। কেউ হাত কামড়াতে, কেউ মাথা আর বুক চাপড়াতে শুরু করে দিল হতাশায়। পরিস্থিতি এমন দাঁড়াল যে গোটা অঞ্চলটাই বিষণ্ণতার শিকার হল। তারপরেও কিছু লোকজন দল বেঁধে এসে বিষণ্ণতার শিকার হওয়া মানুষগুলোর জন্য ওকে এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে যেতে বলল। ও তাদের দিকে অবাক হয়ে তাকাল তারপর বলল, ‘সেজন্য তো ডাক্তার আছে। সেখানেই ওদের চিকিৎসা চলতে পারে। তারপর ওরা সুস্থ হয়ে যাবে’।
নিহিত পাতালপুরীর অনতিদূরে বিস্তৃত পার্বত্য অঞ্চল জুড়ে নতুন আসা গথিক আর্যদের দলটা বসবাস করতে শুরু করে একেবারে ঘরদোর বানিয়ে, নিজস্ব জমিতে চাষবাস জমিয়ে নিয়ে। ওদের মতে ওদের গোটা সমাজটা কয়েকটা ভাগে বিভক্ত - অভিজাত সম্প্রদায়, অতিথি পাখপাখালি সম্প্রদায়, চিত্তবিনোদক ময়ূর সম্প্রদায় এবং বেনেবিড়াল সম্প্রদায়। ওরা সংস্কৃত ভাষায় নিজেদের মধ্যে কথা বললেও দোকানপাট আর কাজকর্ম চালাবার সময় হিন্দি ভাষায় এবং বিজাতীয় লোকেদের সঙ্গে ইংরেজি ভাষায় কথা বলে। দ্রাবিড় সম্প্রদায়ের লোকজনকে ওরা অদ্ভুত বলে মনে করে আর নাবিক সম্প্রদায়কে ওরা সবসময় ওদের হুকুম তামিল করার জন্য আজ্ঞাবহ দাস মনে করে। পদার্থ পুরোপুরি গলে জল হয়ে গেলে ওরা তাকে বায়ু বলে চিহ্নিত করে তা থেকে কিছুটা নিয়ে নানা গাছগাছড়া মিশিয়ে বিভিন্ন জীবনদায়ী ওসুধ তৈরী করে প্রতাপের সঙ্গে নিজেদের মেধাবান ও বিদ্যাবান বলে প্রচার করে রীতিমত দামামা বাজিয়ে। যে কোন স্বয়ম্বর সভায় পুরুষরা যদি কোন নারীকে পছন্দ করে, তবে সেই মুহূর্ত থেকে সেই নারী তার স্ত্রী বলে বিবেচিত হয়। যদি একাধিক পুরুষ কোন একজন নারীকে পছন্দ করে তবে সেই নারী তাদের প্রত্যেকের স্ত্রী বলে গণ্য হয়। অনঙ্গ সব শুনে একেবারে তাজ্জব বনে গিয়ে শুধু এই কথাই ওদের বলে সতর্ক করে আসে যে ওরা যেন ওদের এসব নিয়মকানুন নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখে। ওদের কোন নিয়মই অনঙ্গ বা তার সমাজের মানুষজনের ওপর কখনও কোনক্রমে খাটাবার চেষ্টা না করে। যদি সেরকম কোনকিছু কোনদিনও ঘটে তাহলে এই মাটিতে জ্যান্ত পুতে রেখে দেবে। অনঙ্গ ফিরে এলে তার মুখে সবাই সব কথা শুনে একেবারে তাজ্জব বনে যায় আর বেজায় চিন্তিত হয়ে পড়ে। শ্যামাঙ্গী বাড়ি ফিরতেই অনঙ্গ তড়িঘড়ি করে সব কথা ওকে জানায়। সমস্ত শুনে শ্যামাঙ্গীও জানায় বিপদ আসন্ন। সম্রাট তড়িঘড়ি করে নিচে নেমে এসে সব শুনে হতভম্ব হয়ে গেল। উপমাকে মানময়ী বাড়ি থেকে বেরানো বন্ধ বলে জানিয়ে দিল। দুজ্ঞা তাড়াতাড়ি খাটের তলায় গিয়ে লুকিয়ে পড়ল। গুরুজী গুরুমা খুব চিন্তিত হয়ে পড়লেন। মানময়ীর দেখাদেখি প্রতিবেশীরা সকলেই খুব সতর্ক হয়ে গেল। আশেপাশের বৃহত্তর এলাকা জুড়ে এই সতর্কতা জারি থাকল।
কঠোর নিরাপত্তায় প্রথমে প্যাপিরাস ও কলকাকলিকে এবাড়িতে আনা হল ওদের শিক্ষা ও সঙ্গীত শিক্ষার জন্য। তারপর মানময়ী নিজেই ওদের বাবা-মাদের বলল যে ওরা চাইলে মেয়েরা এখানেই থেকে যেতে পারে আর বাবা-মায়েরা যে কেউ যখন খুশি এখানে এসে ওদের সঙ্গে দেখা করে যেতে পারে। এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে ওদের বাড়ি থেকে ওদের জামাকাপড় ও জিনিসপত্র এখানে পৌঁছে দেওয়া হল। এবাড়িতে থাকার ব্যবস্থার জন্য মানময়ী দুজ্ঞাকে ডাকলে ও খাটের তলা থেকে বেরিয়ে এসে সব ব্যবস্থা করে দিল। এরই মধ্যে মানময়ীর দাদা বৌদি পাপ্পা, পুপু ও পপিকে নিয়ে কদিনের জন্য এল। কদিন বাদে দাদা বৌদি চলে গেলেও ছেলেমেয়েরা এখানেই থেকে গেল। সুলক্ষী লগ্নলতা একদিন এসে সবার সঙ্গে আলাপ করে অভিভূত হয়ে গেল। ওদেরও ইচ্ছে ওরা এখানেই থাকে। কিন্তু অনঙ্গর ভয়ে কেউ কিছু মুখ ফুটে বলতে পারছে না। ভ্রাম্যমান পৃথিবীর পরিদর্শক হবার জন্য শ্যামাঙ্গী বিশেষ ভাবে পড়াশোনা ও চর্চা করতে শুরু করল। প্রাচীন যুগ থেকে এই পর্যন্ত সময়ের মধ্যে মানুষের জীবনযাপন, সমাজব্যবস্থা, মানসিক গড়ন ও সেগুলোর পরিবর্তন থেকে শুরু করে মানুষের ব্রেন সব কিছুই তার পড়াশোনার আওতায় পড়ে। সেগুলো সে নানা জায়গা থেকে বইপত্র যোগাড় করে পড়ে যেতে থাকে। ইতিমধ্যে সুদাম পড়াশোনার শেষে আর চাকরীতে যোগ দেবার আগে অলঙকৃতা নামে একটি মেয়ের প্রেমে পড়ে। কথাটা শ্যামাঙ্গীর কানে যায় এবং শ্যামাঙ্গী খুব খুশি হয়ে সুদামকে বুদ্ধি দেয় বিয়ের ব্যাপারটা ফেলে না রেখে এখনই একেবারে বিয়ে করে বৌকে নিয়ে চাকরীতে যোগদান করাটাই সবচেয়ে বিচক্ষণতার পরিচয়। সুদামের তরফ থেকে শ্যামাঙ্গীই বাবামার কাছে গিয়ে সব জানিয়ে বিয়ের ব্যাবস্থা করতে বলে। ফলে তাড়াহুড়োতে কদিনের মধ্যেই ধুধাম করে ওদের বিয়ে হয়ে যায়। বাড়িতে এই বিয়ের সূত্র ধরে যে বিশাল পরিমাণ আত্মীয় স্বজনের সমাগম হয় তাতে করে তাদের সকলের মনেই একটা প্রশ্ন বারবার উঁকি দেয়, শ্যামাঙ্গী সকলের চেয়ে বয়েসে বড় হওয়া সত্ত্বেও তাকে কেন বিয়ে দেওয়া হচ্ছে না। যখন তারা শোনে যে শ্যামাঙ্গী এখনই বিয়ে করতে না চেয়ে বরং আরও পড়াশোনা করতে চায়, তখন সকলেই খুব চিন্তিত হয়ে পড়ে এমনভাবে যেন খুব চেনা কিন্তু ঘোরালো একটা অঙ্কের হিসেব মিলছে না। অথচ অঙ্কটাও খুব সোজা আর উত্তরটাও খুব সোজা এবং হিসেবটাও মেলা উচিত ছিল। সকলেই বলতে থাকে মেয়েমানুষ বিয়ে করবেনা তা আবার হয় নাকি! মানময়ীর এক আত্মীয় তো মুখের ওপর বলেই বসে, ‘এই বয়সে বিয়ে করতে চাওয়াটাই তো স্বাভাবিক। বিয়ে করতে পেলে কি ছেলে কি মেয়ে সকলেই বর্তে যায়। ও যখন তার বাইরে, তখন ওর জীবনে নিশ্চয়ই কোন ঘটনা আছে, যেটা সকলের থেকে চাপা দিয়ে রাখা হচ্ছে’।
(ক্রমশ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন