ধারাবাহিক উপন্যাস
রূটম্যান
(৩)
বার কয়েক ফোনটা যখন বাজছিল তখন হরেন ঘুমাচ্ছিল। ওর মা ওকে ডেকে তুলেছে। হরেন ফোনটা কানে দিতেই ওপার থেকে সেই মোটা গলার লোকটা বলল- কেয়া শো গয়ে থে?
-জি
হাঁ। হরেন ঘুম জড়ানো গলায় বলে।
লোকটি
একটু চুপ করে থেকে বলে- শুনো বহত মাল আয়েগা ইসবার। পুরা তিন পাঞ্জাব বাক্স। ইয়ে ইদকে
পহেলে ভেজনা জরুরি হ্যাঁয়। উধারকা হালচাল ক্যাঁইসি হ্যাঁয়? ঠিকঠাক হ্যাঁয় না?
হরেন
কি বলবে ঠিক বুঝতে পারে না। এ সময় হরি কাছে থাকলে ভালো হত। ও দিব্বি বানিয়ে বানিয়ে
গল্প বলতে পারে। নিজে মিথ্যে কথা বলতে গেলে ওর গলা শুকিয়ে যায়। তাই বার কয়েক ঢোক গিলে
বলল- ইয়ে- মানে ভেজ দিজিয়ে। লেকিন কব ভেজেঙ্গে?
-কাল
ভেজেঙ্গে। চেকিং কা বাড়ে মে বাতা দেনা। লোকটি ফোন রেখে দেয়।
হরেন
কিছুক্ষণ চুপ করে শুয়ে থাকে। মাথাটা ঝিমঝিম করে। ঘুমের ঘোরে বলে তো দিল বাক্স পাঠাতে।
এখন কী হবে কে জানে। বাইরে রোদের তেজটা একটু কমে আসায় হরেন হরির বাড়ি গিয়ে সব বলে।
এবং এটাও বলে যে বাক্স কাল আসবে। একটা দুটো নয় একেবারে তিনটে। তার মানে এক একজনের পকেটে
আসবে তিরিশ হাজার করে। মানে হিসেব মতো তো তাই হয়।
পুলিশ
অফিসারটি বেশ করিতকর্মা ছিলেন। তিনি সেদিন শুধু হরির মুখের কথাকে বিশ্বাস না করে যা
খোঁজ খবর নেওয়ার নিয়েছিলেন। তাই আজ নাকা চেকিং-এর সামনে দিয়ে যখন হুস করে দুটো বাইক
ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল তা অফিসারের নজর এড়ায়নি। তিনিও ওদেরই মনে মনে খুঁজছিলেন। কিন্তু
প্রায় ঘন্টা খানেকের মধ্যেই ওরা ফিরে আসায় নাকা চেকিং-এ ওদের আটকানো হয়। নিয়ে যাওয়া
হয় অফিসে। বেশ মিষ্টি মিষ্টি কথা বলা হয়। তারপর ওদের মুখোমুখি বসে অফিসারটি বলেন- তোমাদের
পেশেন্ট কেমন আছে এখন?
হরি
হাসতে হাসতে বলে- আজ বেশ ভালো দেখে এলাম স্যার।
-কবে
ছাড়বে হাসপাতাল থেকে? অফিসারটি জানতে চায়।
-সেভাবে
কোন নির্দিষ্ট তারিখ অবশ্য বলেনি। তবে ওনাদের কথা শুনে তো মনে হল দিন দশেকের মধ্যেই
ছেড়ে দেবে। হরি ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে রেখে বলে।
-তা
বেশ ভালো। এবার বল তো এভাবে কতদিন ধরে তোমরা হাসপাতালে ডিউটি দিচ্ছিলে?
-কেন
স্যার! যখন থেকে আমাদের আত্মীয় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন প্রায় তার পরের দিন থেকেই আমাদের
প্রায়ই যেতে হয়। আসলে দিনে যায় অন্য আত্মীয়েরা। আর যেহেতু আমাদের বাইক আছে তাই আমরা
রাতেই যাই।
-কিন্তু
সুবল দাস বলে তো হাসপাতালের কোন ওয়ার্ডেই কোন পেশেন্ট ভর্তি নেই!
-কি
যে বলেন স্যার।ঐ নামে কাউকে পেলেন না! তা হ্যাঁরে হরেন, সুবলদাদুর আর কোন নাম আছে নাকি?
মানে ওরা কি নামে ভর্তি করেছে তা জানিস?
হরির
সাথে থেকে থেকে হরেনও বেশ চালাক হয়ে গেছে। ও তাড়াতাড়ি বলে- তুই সুবলদাদু বললি কেন হরি।
সে তো মেজদাদুর নাম। বড়দাদুর নাম তো শ্রীমন্ত।
মোটা
গোঁফের আড়ালে এতক্ষণ ধরে অফিসারটি হাসছিলেন। তিনি ঐ অবস্থাতেই বললেন- এবার সঠিক নামটা
তাহলে তোমাদের মনে পড়েছে। খুব ভালো। এখন দেখতে হবে শ্রীমন্ত দাস নামে কতজন পেশেন্ট
হাসপাতালে রয়েছেন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই একজন পুলিশ হাতে একটা মোটা জাবেদার ফোটো কপি এনে অফিসারের টেবিলে দিয়ে বলল- না স্যার, এর মধ্যে তো পেলাম না ।
-আমি
জানতাম শ্রীমন্ত দাসের নাম পাওয়া যাবে না। ঠিক আছে ভালোই হল। কালকে বরং এদের চালান
করে দেব। আজ শ্রীঘরে আমাদের অতিথি হয়ে থাকুক। অফিসারটি এবার শব্দ করেই হাসেন।
-তার
মানে কি স্যার! হরি-হরেন দুজনেই প্রায় একসাথেই বলে ওঠে।
-মানেটা
তো খুবই সহজ। তা তোমাদের বাইকের সব কাগজ আছে তো?
-হ্যাঁ
আছে স্যার। হরি বলে।
হরি-হরেন
দুজনেই ওদের আর সি বুক বের করে অফিসারের টেবিলে রাখলে তিনি বলেন- ঠিক আছে দেখছি। আর
এবার তোমাদের ড্রাইভিং লাইসেন্সটা দেখাও।
-ওটা
তো স্যার আমরা এখনও হাতে পাইনি। হরেন প্রায় কাঁপতে কাঁপতে বলে।
-বাঃ!
বেশ বেশ। এই কে আছ ঐ বাইক দুটো আমাদের মাল গুদামে রেখে দাও। তাহলে তোমরা এতদিন ধরে
বিনা ড্রাইভিং লাইসেন্সে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছ! এর শাস্তি কি জানো? এই দু’জনকে গারদে
ঢুকিয়ে দাও। কালকে বরং কোর্টে চালান করে দেওয়া যাবে।
অফিসার
থামতেই হরি বলে- আমরা কি একবার বাড়িতে কথা বলতে পারি? আসলে এত রাতেও বাড়িতে না ফিরলে
সব্বাই চিন্তা করবে স্যার।
অফিসার
ওদের কথাকে পাত্তা না দিয়ে আবার নাকা চেকিং-এ চলে গেলেন।
হরি-হর
দু’জনেই সকালে
পুলিশ ভ্যানে করে সোজা আদালতে চলে গেল এবং আবার প্রায় সন্ধ্যার মুখে ফিরেও এল। ওদের
তিন দিন পিসি হয়েছে। এই তিনটি দিন ওদের পুলিশ কাস্টডিতে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে একেবারে
নাজেহাল করে দেওয়া হবে। আর সেই সব প্রশ্নের মারপ্যাঁচে বেচারা হরি-হর দু’জনে নিজেদের
কতটুকু সামলাতে পারবে, এখন শুধু সেটাই দেখার, ওদের মুখ দিয়ে অন্নপ্রাসনের ভাত উঠে আসে
কিনা!
সারাটা দিন চলে গেল অথচ কেউ ওদের সাথে একটাও কথা বলল না। পুলিশদের দেখে মনে হল যেন তারা কেউ ওদের চেনেই না। সেই অফিসারের সাথে বার দুয়েক দেখাও হল অথচ তিনিও একবারও ওদের ডেকে কিছুই জিজ্ঞাসা করলেন না। ব্যাপারটা বড়ই অদ্ভুত মনে হল হরি-হরের কাছে। ওদের যদি কিছু জিজ্ঞাসাই না করবে তাহলে তো ওদের জেলেই দিতে পারত। তারপর ওদের উকিল এসে বেল নিয়ে নিলে ওরাও দিব্বি বাড়ি চলে যেতে পারত। এতক্ষণে বাড়ির বিছানায় এক পেট ভালো খাবার খেয়ে একটা কষে ঘুম দেওয়া যেত। কিন্তু তা নয় এই মাত্র একটা কম্বলের উপর শুয়ে আর একটা গায়ে দিয়ে সারারাত কাটাতে হবে। হরি ফিস ফিস করে বলল- বুঝলি হরেন, আমরা দু’জনেই গরিব হলেও এত খারাপ খাবার বাড়িতে খাই না। শুনেছি জেলের খাবার নাকি এর থেকে একটু ভালো।
হরেন
মাথা নেড়ে বলল- হয়তো তাই। হরি আমি ভাবছি অন্য একটি কথা।
হরি
হরেনের দিকে তাকালে হরেন আবার বলে- একটা কাজ করা যাক। আমাদের দুজনকে তো দুটো করে কম্বল
দিয়েছে। এবার আমরা বরং তিনটে কম্বল পেতে ফেলি। আর একটা কম্বল লম্বা করে ভাঁজ করে বালিশ
বানিয়ে মাথায় দেব। কিরে হবে না?
-তুই
এতক্ষণ ধরে তাহলে শোয়ার কথাই ভাবছিলি নাকি? হরি জিজ্ঞাসা করে।
-পরে
বলছি। এখন রাতের খাওয়া যখন হয়ে গেছে তখন আমরা বরং শুয়ে পড়ি চল। বেশি জোরে বলা যাবে
না। তখন না হয় আমার কথাটা বলব।
দুজনেই
মুখোমুখি শুয়ে পড়ে। হরেন বলে- শোন হরি, জানিনা আমাদের কপালে কি আছে। তাই বলছিলাম যে
আমাদের দুজনের ষাট হাজার টাকা, মোবাইল আর ঘড়ি তো মাল গুদামে জমা রয়েছে। ঐ টাকার ব্যাপারে
খুব চিন্তা হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত ওরা দেবে তো? ওর থেকে কিছু যদি ঝেড়ে দেয় আর পরে বলে
তোমরা যা জমা দিয়েছ তাই ওখানে রয়েছে। তখন কী হবে?
-আমি
ঠিক জানিনা রে। তবে এমনটা হতেও পারে। তখন আমাদের কিছু করার থাকবে কিনা জানি না। হরি
হাই তোলে ।
-আমার
মাথায় একটা প্ল্যান এসেছে। আগে শোন। তার পর ঘুমাস। কালকে আমাদের বাড়ির লোকের সাথে কথা
বলতে দেবে বলেছে। আমরা যদি অফিসারকে বলি যে আমাদের বাড়ির লোক এলে তাদের কাছে আমাদের
যা জমা আছে সব যেন দিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে আর কোন চিন্তা থাকবে না বুঝলি। তারপর আমাদের
যা হবার হবে।
-ঠিক
আছে এর পরে দেখা হলে না হয় বলব। আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। এবার ঘুমিয়ে পড়। এই বলে হরি পাশ
ফিরে ঘুমিয়ে পড়ে।
এখন রাত কটা বাজে তা জানার উপায় নেই। চোখ বন্ধ করতেই সারা রাজ্যের ঘুম যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল। অবশ্য ঘুমের আর দোষ কোথায়। বাড়ির কথা ভাবতে ভাবতেই শরীর-মন অবশ হয়ে পড়েছে। অথচ হঠাৎ ভাবনার মাঝ থেকে ভুস করে ভেসে উঠল মালতীর মুখ। মালতী এর আগে কখনও আগ বাড়িয়ে হরির সাথে কথা বলেনি। রাস্তার এপার ওপার বাড়ি হলেও যেহেতু মালতীদের বাড়িতে হরির সমবয়সি কেউ নেই তাই কোন অছিলায় মালতীর বাড়ি যাওয়ার কথাও নয়। তবে ওর মা-বোন মালতীদের বাড়ি যায়। হরি আজ একেবারে সরাসরি মালতীর দিকে তাকাতে পারছে না। ওর চোখের পাতা ভেজা। মনের মধ্যে যে অব্যক্ত যন্ত্রণাটা বহু কষ্টে মালতী চেপে রেখেছে তাতেই চোখের পাতা ভিজে যাচ্ছে। একটা অস্ফুট শব্দ হরির কানে এল।
-তোমরা
এমন কি করলে যে পুলিশে ধরল? খুব মেরেছে বুঝি? মালতী জানতে চায়।
-না,
না। আমাদের গায়ে হাতও দেয়নি। তাছাড়া আমরা কি চোর-ডাকাত নাকি যে দুটো চড়-থাপ্পড় মারবে।
তাছাড়া এখন আর আগের মতো থানায় কারোর গায়ে হাত ছোঁয়ায় না। বরং আমাদের রুটি-সবজি খেতে
দিয়েছে। বুঝতে পারছি এই তরকারি হল বাগডোগরার মোড়ের বিশুর দোকানের।
-কিন্তু
তোমরা গিয়েছিলেই বা কোথায়? মালতী আবার পুরনো কথা তোলে।
-ঐ
যে যেমন রাতের ডিউটিতে যাই। আজও তেমনি গিয়েছিলাম। নগদ ষাট হাজার টাকাও পেলাম। আর ঐ
টাকা আসার সময় পুলিশ আমাদের পকেট সার্চ করে পেয়ে গেল। ব্যস, ভাবল এত টাকা নিশ্চয়ই আমরা
কোথাও থেকে চুরি করেছি। যতই বলছি এই টাকা আমাদের মেহনতের টাকা, আমাদের চাকরীর টাকা,
কিন্তু ওরা আমাদের কথা বিশ্বাসই করতে চাইল না। তুমি এসব নিয়ে আদৌ কোন চিন্তা করবে না।
আসলে আমাদের রুটম্যানের চাকরীতে একটু রিস্ক তো রয়েছেই। এটুকু তো সহ্য করতেই হবে।
-শুনলাম
কাকীমা নাকি খুব কান্নাকাটি করছে। মালতী বলল।
-হ্যাঁ,
মাকে নিয়েই তো আমার চিন্তা। তুমি মাঝে মাঝে গিয়ে মাকে একটু স্বান্ত্বনা দিও।
-ঠিক
আছে। আমি যাই। মালতী মুখ ঘুরিয়ে ওদের বাড়িতে চলে গেল।
মালতীকে
বাই বলতে গিয়েও হরির তা বলা হল না! কে যেন কাঁধে হাত রেখেছে। একটু ঝাঁকুনি দিয়ে চলেছে।
হরি বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে পেছন ফিরতেই দেখে একজন পুলিশ ওকে আর হরেনকে ঝাঁকুনি দিয়ে বলছে-
এই তোমাদের সাহেব ডাকছে। তাড়াতাড়ি উঠে পড় ।
হরি-হরেন
দুজনেই উঠে বসে ভ্যাবলার মতো চারদিকে তাকায়। থানার গারদে কোন জানলা নেই। তাই সারা দিন-রাত
আলো জ্বলে। কাজেই বোঝা যাচ্ছে না এখন দিন, না রাত। দুজনের চোখেই জড়িয়ে রয়েছে ঘুমের
গভীর আদিখ্যেতা। কিন্তু এখন পুলিশই বা এল কেন! হরি আড়মোড়া ভেঙে বলে- কি ব্যাপার বলুন
তো! এভাবে কেউ ঘুম ভাঙায় নাকি!এখন বাজে কটা?
-রাত
আড়াইটে। স্যার বসে আছেন তোমাদের জন্য। পুলিশটি দু’পা পিছিয়ে আসে।
-ঠিক
আছে আপনি ওনাকে বলুন না আর একটু পরে যাচ্ছি। এটা কি একটা দেখা করার সময় হল নাকি! বরং
সকালেই ওনার সাথে দেখা করব।
-এই
নবাব পুত্তুররা। স্যার কি তোদের চাকর নাকি রে? তোদের কথাতেই সব হবে নাকি? ভালোয় ভালোয়
না উঠলে পাছায় দাগ করে দেব, বুঝলি।
পুলিশের ধাতানি খেয়ে ওরা দুজনেই তরাক করে লাফিয়ে ওঠে। পুলিশের পিছে পিছে গিয়ে হাজির হয় স্যারের চেম্বারে। স্যার তখন এক মনে সিগারেট টেনে চলেছেন। সারা থানাই তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন! আলোগুলো যেন বড় বেশি ঝকঝক করছে। পুলিশ অফিসার ইশারা করলেন সামনের চেয়ারে বসার জন্য। সিগারেটে শেষ টান দিয়ে উনি বললেন- তোমরা তো দেখছি একেবারে হরি-হর আত্মা। একই মালিকের কাছেই চাকরী কর। তা কি যেন নাম বলেছিলে চাকরীটার?
-অ্যাঁজ্ঞে
রুটম্যানের চাকরী স্যার। হরি কোনমতে হাইটাকে চেপে বলে।
-হ্যাঁ,
মনে পড়েছে। বেশ খাসা নাম। শুনে কতকটা স্টোনম্যানের মতো মনে হচ্ছে। সবই গভীর রাতের কাজ।
এক মুহূর্তের মধ্যেই কাজ শেষ! তা তোমাদের অফিস থেকে কি বাইক দিয়েছে নাকি?
-আঁজ্ঞে
না স্যার। আমরা কিনেছি। হরি কোনমতে ঢোক গিলে বলে।
-তা
বাবা রুটম্যানেরা তোমাদের মাস মাইনে কত?
হরির
ঘুম এবার পালিয়ে গিয়েছে। সে বুঝতে পারছে অফিসারের কথা এবার ক্রমশই মনের গভীরে ঢোকার
চেষ্টা করছে। তারা কতক্ষণই বা দরজা বন্ধ রাখতে পারবে কে জানে। বড়ই পলকা দরজা। যে কোন
মুহূর্তেই হয়তো তা ভেঙে যেতে পারে। তাহলে কি সে একটুও প্রতিরোধ করবে না! আপাতত এ অতি
নিরীহ প্রশ্ন! দেখাই যাক না উনি কতটা দৌড়াতে পারেন।
-ঐভাবে
ঠিক বাঁধাধরা নেই স্যার। তবে বিশ তো বটেই। হরি আলতো করে কথাটা বলে।
-বাব্বা!
এ তো বেশ ভালো মাইনে! ঐ যে কনস্টেবলকে দেখলে ওর মাইনেও অত নয়। বাঃ! তোমাদের তো তোফা
চাকরি।
এ
কথার কোন উত্তর হয় না। তাই হরি-হর দু’জনেই মাথা নিচু
করে থাকে।
-তা
এবার বল তো তোমাদের অফিসটা কোথায়? এ আবার কেমন অফিস যা কেবল রাতেই খোলা থাকে! এবার
বুঝতে পারছ তো তোমাদের সব চালাকি আমরা ধরে ফেলেছি। অফিসার এবার হাসেন।
ওরা
একবার অফিসারের মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আবার মাথা নিচু করে। এতক্ষণ ধরে চোখের
পাতায় ঘুমবুড়ি লেপ্টে ছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে তা উবে গেছে। ওরা বুঝতে পারছে পুলিশের
চোখে সবই ধরা পড়ে গেছে। আর রক্ষা নেই। এখন যদি কাঁদতে কাঁদতে পা জড়িয়ে ধরা যায় তাহলেও
বোধ হয় ছাড়া পাওয়া যাবে না।
-এবার
বল তোমাদের এসব কাজের কিংপিনটা কে? অফিসার জানতে চাইলেন।
-ঠিক
বুঝলাম না স্যার। হরির শুকনো গলা দিয়ে একটা ফ্যাঁসফ্যাসে আওয়াজ বের হল।
-বুঝলে
না? তোমাদের এসব কাজের পেছনে আসলে কে আছে?
-জানিনা
স্যার।
-জানিনা
বললে তো ছাড় পাবে না। হাতে নগদ টাকা পাচ্ছ আর বলছ নাম জান না! আর এটা আমাকে বিশ্বাস
করতে হবে! অফিসারের গলার আওয়াজ ক্রমশই কর্কশ শোনায়।
-বিশ্বাস
করুন স্যার। আমাদের যে টাকা দেয় সে গাড়ির মধ্যে বসে থাকে। তার মুখ আমরা আজো দেখিনি।
তবে গলা শুনেছি। হরি জানেনা সে আর কতটুকু বলতে পারবে। আর না পারলেই সাহেব ভাবতে পারে
যে সে ইচ্ছে করেই কিছু বলছে না। ব্যস! তখনই শুরু হবে পুলিশের মার! হরি কোনদিনই মার
খায়নি বা কাউকে মারেওনি। এসবে ওর খুব ভয়।
-কি
ব্যাপার চুপ করে আছ যে? আমাদের কি এতটাই বুদ্ধু পেয়েছ! তোমরা নিজের হাতে নগদ টাকা নিচ্ছ
অথচ তাকে দেখা তো দূরের ব্যাপার তার নামটাও বলতে পারছ না! এটা কি আমাকে বিশ্বাস করতে
হবে!এবার অফিসার রীতিমত হুঙ্কার দিয়ে ওঠেন।
-স্যার,
আমরা মিথ্যা কথা বলছি না স্যার। স্যার আমরা তো জানিই না কবে বাক্স আসবে।
-বাক্স
মানে! অফিসার বিস্মিত হয়ে জানতে চাইলেন।
-না
স্যার, ঐ ট্রাককে আমরা বাক্স বলে থাকি। কখনও ছোট বাক্স আব্র কখনও বড় বাক্স।
-খবরটা
কোথা থেকে আসে? যে খবর দেয় তার নাম বল।
-লোকটা
হিন্দিতে কথা বলে স্যার। নাম জানতে চাইলে বলে না স্যার। খিস্তি দেয়। কিন্তু অবলারা
যে বিহার থেকেই খরিদ করা হয় তা আমরা জানি। এবার হরিরা সোজা হয়ে বসে।
-আরে
দাঁড়াও দাঁড়াও! অবলা বলছ কাদের! মেয়ে পাচার হয় নাকি? অফিসারের চোখ বড় হয়।
-না
স্যার। আমরা গরুকে অবলা বলে থাকি। তাছাড়া নারী পাচার চক্রের মতো বাজে কাজ আমরা করিনা
স্যার। এমন একটা কথা বলতে পেরে হরির একটু ভালো লাগল।
অফিসার
একটা ধমক দিয়ে বলেন- থাম। যে কোন পাচারই বে-আইনি কাজ। তা অবলা জীব হোক বা নারী হোক।
এবার বল তোমরা কবে থেকে এমন কাজের সাথে যুক্ত রয়েছ? যা বলবে সত্য বলবে। মিথ্যে বলার
চেষ্টা করলে কিন্তু আমরা পেট থেকে আসলটা টেনে আনব। তখন কিন্তু শাস্তি আরো কঠোর হবে।
অফিসার আর একটা সিগারেট ধরান।
-এখনও
একটাও মিথ্যা বলিনি স্যার বিশ্বাস করুন। আমি স্যার দু’হাজার সতেরো
থেকে এই লাইনে আছি। আমাকে যে এই লাইনে এনেছিল সে মারা যাওয়ায় আমি পরে হরেনকে নেই। আমরা
জানি এই বাক্সে অবলারা যায়। শুনেছি কোচবিহার ও আসামে যায়। তার পরে কি হয় তা আমাদের
জানা নেই স্যার।
-যে
তোমাদের সাথে কথা বলে তার ফোন নম্বরটা বল। অফিসার একটা কাগজ টেনে নেয়।
হরির
ইশারায় হরেন বলে- স্যার মোবাইল তো আপনার কাছে। অফিসার তার ড্রয়ার খুলে ওদের মোবাইল
দিলে হরেন নম্বরটি বলে।
অফিসার
সেই নম্বরটি লিখে নিয়ে বলেন- তোমরা নিশ্চয়ই ওর গলার আওয়াজ চেন?
-আমি
চিনি না স্যার। হরেনের সাথেই কথা হয়। ও অবশ্যই চিনতে পারবে। হরি বলে।
-ঠিক
আছে, এখন তোমরা যাও। তবে সময় মতো আবার ডাকব। আর ভালো কথা। সাধারণত তোমাদের কাছে কখন
ফোন আসত?
-অমন
কোন নির্দিষ্ট সময় নেই স্যার। তবে দিনের বেলায় ফোনে কথা হত। আসলে ওদের যখন মাল কেনা
হয়ে যেত তখনই আমাদের ফোন করত। এই তো স্যার করোনার অতিমারিতে আমরা ছয় মাসে একটাও কাজ
পাইনি স্যার। এই সবে শুরু হয়েছে। হরি এখন অনেকটাই অস্বস্তি কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। অফিসারকে
আর আগের মতো ভয় করছে না।
হরি
আর হরেন উঠে দাঁড়ায়। হরি ব্যাজার মুখে বলে- স্যার আমাদের একটা কথা বলার আছে।
-ঠিক
আছে বল।
-বলছিলাম
আমাদের বাড়ির লোক কালকে হয়তো উকিল ঠিক করে আমাদের সাথে দেখা করতে আসবে। ওরা এলে যদি
আমাদের টাকা আর মোবাইল-ঘড়িগুলো ওদের দিয়ে দেন তাহলে উপকার হয়।
-কেন
তোমাদের মালবাবু কোন রসিদ দেয়নি? অফিসার জানতে চাইলেন।
-হ্যাঁ,
তা অবশ্য দিয়েছেন। কিন্তু টাকাগুলো হাতে পেলে সংসারের কাজে লাগত স্যার। বুঝতেই পারছেন
আমরা বেজায় গরিব স্যার। তাই লেখাপড়াটাও হয়নি স্যার। হরির গলা কান্নায় ভেঙে পড়ে।
-আর
কিছু করা যাবে না। একবার জমা পড়ে গেলে তা একেবারে ছাড়া পাওয়ার সময় ঐ রসিদ দেখে মিলিয়ে
নেবে। রসিদে দেখবে দুটো পালসার বাইক, ষাট হাজার টাকা, দুটো ঘড়ি আর দুটো মোবাইলের কথা
লেখা রয়েছে। তবে তোমরা বরং একটা কাজ করতে পার। ঐ রসিদটা কাল বাড়ির লোক এলে তাদের দিয়ে
দিতে পার। বলবে যেন সাবধানে রাখে। ওটা দেখেই পরে তোমাদের জিনিস দিয়ে দেওয়া হবে। এখন
যাও।
ওরা ফিরে এল বটে কিন্তু আর ঘুম হল না। বাকি সময়টুকু এপাশ ওপাশ করেই কেটে গেল। হঠাৎ হরেন বলে- হরি থানায় আমাদের মারবে না তো?
-আমি
কীভাবে বলব বল! বাপের জন্মে এই প্রথম থানার ভিতরে এসে রাত কাটাচ্ছি। হরি বলে।
-আমি
ভাবছি যমুনাদের কথা। শুনলে ওরা কি আর আমাদের ভালোবাসবে হরি?
-থানায়
শুয়ে তোর এখন ভালোবাসার কথা মনে পড়ছে হরেন! ছাড়া কীভাবে পাব সেটাই ভাব।
-সেটা
কি আর আমাদের হাতেরে হরি। ধরা যখন পড়েই গেছি তখন জেলের ভাত হয়তো খেতেই হবে। তুই কি
বলিস?
-জানিনা।
ভালো উকিল আনতে পারলে হয়তো ছাড়া পাব। কিন্তু অত টাকা কোথায় পাব?
-তাহলে
কি আমরা আর ছাড়া পাব না বলছিস? হরেন বলে।
-জানিনা।
এখন আর ভ্যাজ ভ্যাজ করিস না তো। আমাকে একটু ভাবতে দে। হরি রেগে বলে।
-সে
তুই যতই রাগ কর না হরি আমার কিন্তু মনে হচ্ছে আম-ছালা দুটোই গেল।
-তোর
গেল মানে! শুধু নিজের কথাটাই ভাবছিস হরেন। প্রায় এক বছর ধরে তুই আমার সাথে কাজ করছিস।
আমার লাভে কি তোর লাভ হয়নি? আজকের বিপদ কি শুধু তোর একারই! কেন, তা আমার নয়? আর আম-ছালা
বলতে ঠিক কি বলতে চাইছিস বলতো? হরি জানতে চায়।
-দেখ
হরি, একবার ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখ আজ আমরা থানায় রয়েছি। জানিনা এর পরে আমরা জেলে যাব,
নাকি বাড়িতে। বাড়িতে গেলেও ইনকামের এই পথটি চিরদিনের মতোই বন্ধ হয়ে গেল। সেই সাথে আমার
আর যমুনাকে পাওয়া হল না। বল আমি কি মিথ্যে বলছি? হরেন ওর মনের কথা বলে ফেলে।
-আচ্ছা
তুই এর আগেও যমুনার কথা বলেছিস। আমাকে একটা কথা বলতো হরেন। যমুনা কি কখনও তোকে মুখ
ফুটে বা ইঙ্গিতে বলেছে যে সে তোকে ভালোবাসে? মালতী কিন্তু আমাকেও বলেনি। তাই এর পরে
যখন আমরা থানা থেকে অথবা জেল খেটে পাড়ায় ঢুকবো তখন কি পাড়ার লোকেরা বা তোর যমুনা ও
মালতীমালা নিয়ে আমাদের বরণ করে নেবে? লোকের আর জানতে বাকি নেই যে আমাদের এই রুটম্যানের
চাকরিটা আসলে কি! জেনে রাখিস এর পরে যমুনাতো দূরের কথা কোন বাড়ি থেকেই আর আমাদের জন্য
মেয়ে দেবে না। কারণ আজীবন আমাদের অতীতের সিলমোহরটা বয়ে বেড়াতে হবে। তাই বরং ভাব আমরা
কীভাবে আমাদের মুখ লুকাবো। এবার আমি ঘুমাব। ডাকবি না। হরি সত্যিই ঘুমিয়ে পড়ে।
থানায়
যে ছেলেটা চা দিয়ে যায় তার ডাকেই হরির ঘুম ভাঙলো। বাইরে তাকিয়ে হরি বুঝতে পারল যে বেলা
হয়ে গেছে। ছেলেটি হরিদের হাতে চায়ের গেলাস আর বিস্কুট দিতেই হরি বলে- তা হ্যাঁরে ভাই,
তোর এই চা কত ফুটের?
একটা
তরল জিনিসের মাপ কি ফুট-গজে করা যায় নাকি! তাই ছেলেটি ভ্যাবলার মতো হরির দিকে তাকিয়ে
থাকল। হরি বুঝতে পারল যে ব্যাপারটা ওর মাথায় ঢোকেনি। একটা লম্বা সিপ দিয়ে হরি হাসতে
হাসতে বলল- আমি জানি তুই বুঝবি না। আমি বলছিলাম এটা কি একেবারে তৈরি করে আমাদের জন্য
নিয়ে এসেছিস, নাকি বেশ ক’বার ফুটিয়ে
এনেছিস?
-আমি
আবার ফোটাতে যাব কেন! এটা মোড়ের দোকানের চা। এখন খাও। আমি পরে এসে গেলাস নিয়ে যাব।
ছেলেটি চলে গেলে ওরা দু”জনেই হাসতে
থাকে।
তিন দিনের পিসি শেষ হলে হরি-হরেনকে আবার আদালতে নিয়ে যাওয়া হল। দশটার মধ্যেই আলু সেদ্ধ আর ডাল-ভাত খাইয়ে দেওয়া হয়েছে। এটাই দস্তুর। জেলে থাকলেও হাজিরার দিন সকালেই কয়েদিদের এই খাবার দেওয়া হয়। সবাই জানে যারা হাজিরা দিতে যাচ্ছে তাদের ফিরতে ফিরতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যাবে। হয় তারা ছাড়া পাবে নতুবা আবার হাজিরার অন্য দিন ধার্য হবে। এতসব ওদের জানার কথা নয়। কিন্তু হাজিরার দিন কেন যে থানার অফিসার ওদের আরো দু’দিন থানায় রাখার আর্জি জানালো তা হরিরা ঠিক বুঝতে পারল না! কারণ ওদের যা বলার ছিল তা তো এই দু’দিনের জেরায় বলেই দিয়েছে। কিছুই তো গোপন করেনি! এখন পেটে বোমা মারলেও নতুন কিছুই বেরিয়ে আসবে না। তাই সন্ধার একটু আগেই তারা আবার সেই থানার খুপরিতেই ফিরে এল।
পুলিশ অফিসারেরা জানে কীভাবে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে হয়। এই সামান্য বুদ্ধিমত্তা না থাকলে তো মুড়ি-মুড়কির আলাদা দর হবে না। তাই প্রবাদে রয়েছে ‘বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা আর পুলিশে ছুঁলে ছত্ত্রিশ ঘা’! ওরা ইচ্ছে করলে নিরীহ মানুষকে পর্যন্ত বিভিন্ন ধারার ফাঁদে ফেলে নাকানিচোবানি খাওয়াতে পারে। তাই আবার কেন ওদের থানায় ফিরিয়ে আনা হল তা হরি-হরেন বুঝতে না পারলেও অফিসারের মাথায় একটা ছক তৈরি হয়ে রয়েছে। বেশি দেরি করা যাবে না। কাজেই হরিদের আবার ডাক পড়ল রাত আটটায়। ঠিক তার একটু আগেই ওরা রাতের খাওয়া শেষ করে শুয়ে পড়বে ভাবছিল। কনস্টেবল ওদের নিয়ে হাজির হল অফিসারের টেবিলে। ওদের বসতে বলে কোন ভনিতা না করেই অফিসার বলল- তোমাদের কাছ থেকে যা যা জানার তা আমার জানা হয়ে গেছে। তবু তোমাদের জন্য আরো দু’দিন থানায় থাকার অনুমতি চেয়ে নিয়েছি। তোমাদের দিয়ে আর একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করাবো বলেই তোমাদের জন্য আবার পিসি চেয়েছি।
(ক্রমশ)
খুব ভালো। অপেক্ষায় রইলাম।
উত্তরমুছুনVery nice, next kobe?
উত্তরমুছুনভালো লাগছে। উপভোগ করছি।
উত্তরমুছুন