ধারাবাহিক
উপন্যাস
হে নেপথ্যচারিনী
(১)
জাগৃতি
সাদার্ন অ্যাভিনিউ-এ আমার ফ্ল্যাটে সোফার উপর বসে মুক্ত কাচের জানলার দিকে তাকিয়ে আপনমনে হাসছে আশুদা। আমি আপাতত তার অযোগ্য অনুচর। অনুচর না বলে ছায়াসঙ্গী বলাটাই বোধহয় ভালো। আর জি কর থেকে আপাতত বদলি নিয়ে আমার কর্মনিবাস এখন আমারই নিজের কলেজে। কলিকাতা ন্যাশানাল মেডিকাল কলেজ। বাইশ বছর আগে ছেড়ে আসা সেই কলেজস্মৃতি আজ ফিকে হতে গিয়েও থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে যেন কোথাও। সেই হারুর বাগান, কলেজ অডিটোরিয়াম, জিএলটি, এএলটি, পিএলটি। যদিও প্রযুক্তির সাজগোজে তার সেই পুরনো দিনের রূপ খুঁজে পাওয়া কঠিন। আমার ময়নাতদন্তর বিভাগ কলেজ বিল্ডিংয়ের চারতলায়। আপাতত আমিই কর্মরত বিভাগীয় প্রধান। এতদিন আর জি করে সেই দায়িত্ব এড়ানো গেছিল নানান অছিলায়। সেটুকু করা গিয়েছিল বলেই দিব্বি গায়ে হাওয়া লাগিয়ে সাহেববাঁধ ব্রহ্মদ্রি পর্বত ঘুরে বেরিয়েছি আশুদার সঙ্গে। এখন সেসব আর উপায় নেই। নিয়ম করে আঙুল বসিয়ে হাজিরা কায়েম করতে হয়। ছুটি নিতে হলে মাসখানেক আগে কর্তৃপক্ষর দপ্তরে দরখাস্ত দাখিল করতে হয়। তবে একটি সামান্য ছাড় আছে আমার। এই অতিমারী পর্ব স্তিমিত হবার পর মাঝেমাঝে ভারচ্যুয়াল বা আপাতবিশ্বে উঁকি মেরে শরীর নিয়ে কলেজে ক্লাস নেওয়ার ব্যাপারটা খানিক এড়ানো যাচ্ছে বটে। অতিমারীর প্রকোপে ছেলেমেয়েদের অনেক ক্লাস মাঝেমাঝেই অনলাইনে হয়ে চলেছে এখনও। কিন্তু রক্তমাংসের ময়নাতদন্ত তো আর অফলাইনে হবে না। তাই অধম অর্কপ্রভ সান্যালকে ক্লাস নিতে না হলেও শবদেহ কাটাছেঁড়া করতে দৌড়োতেই হচ্ছে নিয়ম করে। ময়নাতদন্তঘরে ঢুকলেই মাঝেমাঝে দেখা মিলে যাচ্ছে প্রাক্তন হাবড়া থানার ওসি অনুপম দত্তর হাতের লেখার সঙ্গে। এখন সে লালবাজারে কর্মরত। আমাদের সাহেববাঁধ অভিযানের পর তার সামান্য কর্মোন্নতি ঘটেছে। আমাদের এক্তিয়ারে সনাক্তিকরণের পর পুলিশি তদন্তে জমা পড়া অনেক শব অনুপম দত্তর অনুমোদনে সরাসরি আমার কাছেই চলে আসছে। যদিও সেই অনুমোদনে জোছনার স্নিগ্ধ ছায়াশরীরের মতোই কোথাও যেন অস্ফূট আবেদন মূর্ত হয়ে উঠছে। সে আবেদন আমার জন্য নয়। আশুদার জন্য। বৃন্দনের ছৌমুখোশের মতোই আবার মৃতদেহের মৃত্যুচিহ্নগুলোর আড়ালে আশুদা আসল মুখগুলোকে চিনে ফেলুক, এমনটাই হয়তো তাঁর আর্তি।
অবশ্য সে আর্তিতে আমারও সায় একেবারেই থাকে না একথা খুব জোর দিয়ে বলতে পারি না। আশুদা আপাতত আমার ফ্ল্যাটেই মোটামুটি পাকাপাকিভাবে নিবাসী। ঋক তার মাকে নিয়ে বাঙ্গালোরে অ্যানিমেশন শিখছে। ঋকের সুস্থ হয়ে ওঠা আশুদার জীবনে যেন এক নতুন মোড়। একজন মেধাবী চিকিৎসাবিজ্ঞানের ছাত্র কিছু দায়িত্বজ্ঞানহীন অশিক্ষিত মানুষের জিঘাংসার শিকার হয়ে কীভাবে কিছু মানুষের জীবনের চলন পালটে দিতে পারে তা স্বচক্ষে দেখেছি আমি। কিছুদিন আগেও তো আশুদার স্ত্রী মন্দিরাবৌদি কেমন পাষাণপ্রতিমা হয়ে গিয়েছিলেন। সাহেববাঁধের ওই ঘটনাগুলোর পর আস্তে আস্তে ঋকের স্বাভাবিকত্বে ফিরে আসা বৌদির চোখেমুখেও যেন স্বাভাবিকতা এনে দিয়েছে। আর আশুদা? ঋক না থাকলে বিদেশে ঘুরে বেড়ানো বিখ্যাত গবেষক ফরেন্সিক সায়কিয়াট্রিস্ট ডাঃ আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কী আর আমাদের আশুদা হয়ে উঠতে পারত! বিচিত্র মানুষের মন। কী তার গতিপথ, ভাবতে ভাবতে মাঝপথে থমকে যেতে হয়। ঋকের অসুস্থতার কক্ষপথে যেন আমাদের তিনজনের জীবনই সৌরমণ্ডলের মাধ্যাকর্ষণে আবদ্ধ ছিল এতোদিন। এখন ঋক সুস্থ। হাসপাতালে রোগীর ঘরের লোকের তাকে মেরে ফেলার সেই মানসিক আঘাত থেকে সে এখন অনেকটাই মুক্ত। তবে তার এই সুস্থতার নিজস্ব মাশুল আছে। সে তার বাবা আর মাকে জানান দিয়েছে আগেই। আর সে ডাক্তারি করবে না। অ্যানিমেশন শিখবে। আশুদা বাধা দেয়নি। মন্দিরাবৌদিও নয়। এ বিষয়টি নিয়ে মাঝখানে ভেবেছি অনেক। সমাজ কী একজন ভ্যবিষ্যতের বিস্ময়কর চিকিৎসাবিজ্ঞানীকে এভাবেই অকালে হারালো? ভাবতে ভাবতেই নিজস্ব যুক্তির দুর্গ প্রস্তুত হয়। আশুদা হলে যাকে বলত, আন্বীক্ষিকা। সেই বিখ্যাত চিত্রপরিচালক তারকোভস্কির কথার বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে আজকাল আমার মনে হয়, সমীক্ষণের ওই ঘন্টাকৃতির রেখাচিহ্নর ভিতর যেসব মধ্যমেধার মানুষ রয়েছে, তারাই হলো সভ্যতার হাত পা শরীর। আর পরিসংখ্যানের ওই 'পি' ভ্যাল্যুর বাইরে থাকা মানুষগুলো আসলে সভ্যতার জীবনীশক্তি। আমার মতো মধ্যমেধা দিয়ে ডিপার্টমেন্ট চালানো যায়। কিন্তু সেই ডিপার্টমেন্টকে রবিঠাকুরের পাঠভবন তৈরি করতে গেলে প্রয়োজন ওই 'নরমাল কার্ভ'-এর বাইরে থাকা মানুষদের। ঋক তাই আমার মতে ঠিক করেছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ও অনেক বিস্ময়কর আশ্চর্যজনক সম্পদ নিয়ে একদিন আবার আশুদার কাছে কলকাতায় ফিরে আসবে।
ঋক বাঙ্গালোরে চলে যাবার পর থেকে আশুদা কলকাতাতেই। ইদানিং আবার আশুদা থিয়েটার চর্চায় মন দিয়েছে। তবে মঞ্চে নাটক দেখার অভ্যাস আপাতত আমাদের অতিমারী ও লকডাউনের কল্যাণে ছাড়তে হয়েছে। আশুদার কর্মকাণ্ড অবশ্য এখানে থেমে নেই। নাট্যসম্রাজ্ঞী কুসুমকুমারী দাসীর রহস্যমৃত্যু অনুসন্ধান করতে গিয়ে প্রথম থেকেই বুঝেছিলাম। থিয়েটার আশুদার রক্তে আছে। আর এখন ঋকের ঘটনার সুবিচার চেয়ে ঘনঘন বেনিয়াপুকুর থানায় হাজিরা দেবার অবশেসন থেকেও আশুদা নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে অনেকটাই। তাই এই সাতসকালে সোফার উপর বসে রবীন্দ্রসরোবরের টলমল জলরাশির উপর চকচক করে ওটা রৌদ্রকণা দেখে আশুদার এই অপ্রতুল হাসি আমাকে তেমন বিস্মিত করল না। মনে মনে বুঝলাম, আবার কোনও নতুন তথ্যর সন্ধান পেয়েছে সে। আশুদা আমার দিকে তাকিয়ে সেকথা আন্দাজ করেই বলল, "রঙ, আভা আর বর্ণ। কী তফাত বল দেখি?"
আশুদা
আপাতত থিয়েটারের আলো নিয়ে পড়াশোনা করছে জানি। কিন্তু আশুদার এ-প্রশ্নর উত্তর যে আমার
অজানা। তাই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আমার বিশেষ উপায় ছিল না। সেটুকু দেখে আশুদা
স্বভাবসূলভ মুচকি হেসে বলল, থিয়েটারের রঙ ঠিক আমাদের মনের রঙের মতো। কোনও পক্ষপাত মনে
রেখে তা মাপতে গেছ তো মরেছো। রঙকে মাপতে হবে মনের ব্যবচ্ছেদের ঢঙে।
-রঙ
আবার মাপা যায় নাকি?
-যায়
তো। আলবাত যায়। এ জগতের সবকিছুই একদিন দেখবি মাপা যাবে সংখ্যা দিয়ে।
-তুমি
আরটিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্সের কথা বলছ?
-না।
ওটা তো একটা গোদা বিষয় হলো। ইনটেলিজেন্সের আবার প্রাকৃতিক অতিপ্রাকৃতিক হয় নাকি। বুদ্ধিমত্তা
হলো মহাজাগতিক। রঙ, বর্ণ আর আভা। এরা সব আলাদা। একজন শিশু প্রথম রঙের বর্ণ বা 'হিউ'
চিনতে পারে। তারপর রঙের প্রাবল্য। তারপর রঙের আভা।
আমার সাতসকালে আশুদার কথাবার্তা বেমালুম মাথার উপর বেরিয়ে যাচ্ছিল। বসার ঘরের সোফার উপর গা এলিয়ে বসে আছে আশুদা। সামনে সেন্টার টেবিলটা একসময় ডাইনিং টেবিল ছিল। এখন তার ওপর একটা বড়সড় প্রমাণ সাইজের ফুটবলের মতো গোলক রাখা আছে। গোলকের উপরের দিকটা সাদা। নিচেটা কালো। গেল কয়েকদিন বড়বাজারের এক কারিগরকে দিয়ে এটি বানিয়ে এনেছে আশুদা। সেদিকে আঙুল দেখিয়ে আশুদা বলল।
-ওই
দ্যাখ। ওটা হল রঙের গোলক। আর ওর মাঝে থাকা দণ্ডটি রঙের গাছ। গোলকের বিষুবরেখাটা খেয়াল
কর ভালো করে। দেখবি ওখানে দশটা ভাগ আছে। ওই দশভাগ হলো রঙের বর্ণ বা 'হিউ' মাপার একক।
আর ওই গোলকের অক্ষদণ্ডটিতেও দশটি ভাগ। ওটা দিয়ে রঙের প্রাবল্য মাপা যায়।
-বুঝলাম।
কিন্তু যাই বলো আর তাই বলো আশুদা। এই রঙের গোলকের মতোই একদিন মানুষের মনকেও মেপে ফেলবে
তুমি, তোমার এই দাবিটি আমি মানতে পারলাম না।
আশুদা
খানিক ভেবে বলল, এর আগে কী বুদ্ধি মাপার চেষ্টা হয়নি?
হয়েছে
তো! বিলক্ষণ জানি সে কথা। বিনে কামাত থেকে ড্যানিয়েল গোলম্যান। বুদ্ধি, অনুভব, সমাজচেতনা,
সব কিছুকে একটা 'ক্যুশিয়েন্ট'-এ লিপিবদ্ধ করেছে মনোবিজ্ঞানীরা। সে নাহয় হলো। কিন্তু
চেতনাকে মাপবার স্থুল ক্রম গ্লাসগোতে তৈরি হয়েছে, সেকথাও জানি। জেনেই প্রত্যাখ্যান
করি। কম্পাঙ্ক দিয়ে কী উস্তাদ আমির খানের দরদ মাপা যায়? আশুদা সেকথা বুঝতে পেরে বলে।
-প্রাচীন
ভারতীয় যোগদর্শন, ভাষাপরিচ্ছেদ বা ন্যায়দর্শন পড়লে তুই এইকথা কখনোই বলতে পারতিস না।
যেমন ভারতীয় দর্শন বলে জাগৃতির কথা, সুষুপ্তির কথা।
-বেশ।
কিন্তু রঙকে মাপা যায় বুঝি?
-আলবাত
যায়। বল দেখি সাধারণ সবুজ আর মরকত সবুজের ভিতর কী পার্থক্য?
মনে
মনে ভাবতে থাকি। 'মরকত সবুজ' হলো 'এমেরাল্ড গ্রিন'। একসময় কিঞ্চিত ছবি আঁকার নেশা ছিল।
সেই সুবাদে এই সবুজ রঙটি আমার পরিচিত। রঙ তুলি দিলে এঁকে দেব। কিন্তু শব্দ দিয়ে তাদের
পার্থক্য আশুদাকে বোঝাই কী করে? আশুদা বলে চলে।
-খুব
সহজ। যে কোনও রঙের একটি নিজস্ব কম্পাঙ্ক থাকে। পাশ্চাত্যভাষায় যাকে বলে 'ওয়েভ লেন্থ'।
সেই কম্পাঙ্ক তোর রেটিনার কোষকে একটি নির্দিষ্ট সংকেত দেয়। সেই সংকেত মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট
অঞ্চলে গিয়ে পৌছোলে তুই মরকত সবুজ আর সাধারণ সবুজের পার্থক্য বুঝতে পারিস। সাধারণ সবুজের
কম্পাঙ্ক রঙের পাঠ্যবই অনুসারে ০.৫১১ থেকে ০. ৫৪৩ মাইক্রনের-এর ভিতর। আর মরকত সবুজের
কম্পাঙ্ক হল ০.৫২৪ মাইক্রন। এভাবেই সবুজের প্রতিটি রকমফের আলাদা করে চিহ্নিত করা সম্ভব।
বুঝলেন অর্কবাবু?
আমি
ঘাড় নেড়ে বেরিয়ে পড়ি। আজ কলেজে দিল্লি থেকে কর্তাব্যক্তিরা আসছেন। সুতরাং ঘড়ি ধরে বিভাগে
পৌছোতে হবে। তাই আশুদার রঙগবেষণা ও আলোচনার অকালে ইতি টেনে বেরিয়ে পড়লাম গাড়ি নিয়ে।
বাকিটুকু রাতে ফিরে মীমাংসা করব ঠিক হলো। জলখাবার ও দ্বিপ্রাহরিক খাওয়াদাওয়া বীণা বলে
একটি মধ্যবয়সী বৌ করে দিয়ে যান।
আমার প্রাক্তন চালক দেশে চলে গেছে অনেকদিন। ইদানিং নিজেই গাড়ি চালিয়ে বেরিয়ে পড়ি পুরনো দিনগুলোর মতো। রঙের আলোচনায় আশুদাকে সকালে একটা কথা বলতে বেমালুম ভুলে গেছি। আসলে সম্প্রতি আমার বিভাগে একটা সমস্যা হচ্ছে আমার। আর আমার সব সমস্যার সমাধান তো ওই আশুদাই। সমস্যাটি বিভাগে নতুন যোগ দেওয়া একটি ছেলেকে নিয়ে। ছেলেটির নাম অদ্রি পালচৌধুরী। আমাদেরই বিভাগে 'ক্লিনিক্যাল টিউটার' হিসেবে জয়েন করেছে মাস দুয়েক হলো। খাতায় কলমে যোগ দিলেও কলেজে তার দেখা মেলা ভার। হাজিরা দিয়েছে মেরেকেটে দিনচারেক। প্রথমে ভাবতাম হয়তো কোনও ভাবে ছেলেটির শরীর অসুস্থ। গেল পড়শু অবশ্য যা ঘটেছে তাতে আমার ধারণা কিঞ্চিত বদলে গিয়েছে। অবশ্য ঘটনাটা প্রথম আমার নজরে আনল রঘুপতি। রঘুপতি আমাদের কলেজের ডোম। বিগত তেইশ বছর এখানেই আছে। দিল্লির পরীক্ষকদলের এই সফরের তৈয়ারি করছিলাম তখন। ফাইলপত্তর গোছগাছ করছিলাম। হঠাৎ রঘুপতি ব্যস্তসমস্ত হয়ে আমার ঘরে এসে বল, শিগগির একবার মর্গে আসুন স্যার। একজন অজানা লোক আচানক আজিব বরতাও করছে। কিছু বললে গালি দিচ্ছে।
রঘুপতি বিহারী। পাটনায় দেশ। ঘনঘন তার বাংলাভাষায় পাটনাই হিন্দি ঢুকে আসে। মর্গে দুটো দেহের ময়নাতদন্ত বাকি ছিল। ভেবেছিলাম ফাইলপত্তর গুছিয়ে ওইদিকে যাব। ওই দুটি দেহই পথদুর্ঘটনার। বাই অ্যাকসিডেন্ট। এক দম্পতি পার্কসার্কাস ফ্লাইওভারে রানওভার হয়ে গেছে শুনেছিলাম। রঘুপতির আর্তিতে তড়িঘড়ি মর্গে গিয়ে চমকে গেলাম। একটি মাঝবয়সী ছেলে, বয়স মেরেকেটে তিরিশ বত্রিশ, মাঝারি গড়ন, কোঁকড়ানো চুল হাঁটু মুড়ে মর্গের মেঝেতে শায়িত স্ত্রীলোকের মৃতদেহটির গলা টিপে ধরে বিড়বিড় করছে। গার্ডরা তাকে আটকাতে গেলে এমন করে তাকাচ্ছে যেন এখনই গিলে খাবে। ফলত স্বভাবতই কেউ আর ওইদিক পানে এগুচ্ছে না ভয়ে। আমি গিয়ে চোখাচোখি হতেই খানিক স্মৃতির অতলে ডুব দিয়ে চিনতে পারলাম ছেলেটিকে। ডাঃ অদ্রি পালচৌধুরী। আমার ডিপার্টমেন্টে মাসদুয়েক আগে জয়েন করার দিন দেখেছিলাম একঝলক। তারপর অনেক খুঁজেও আর তাকে পাওয়া যায়নি। এমনকি গেল মাসের মাইনেটিও সে নিতে আসেনি। সাধারণত এইসব ক্ষেত্রে কর্মচারীর চাকরি টিকে থাকা কঠিন। কিন্তু অতিমারী জমানায় বহু কৃতী মানুষকে বেকার হতে দেখেছি, সংসার ছারখার হতে দেখেছি। তাই ভেবেছিলাম ভিজিট হবার পর তলব করব। কিন্তু তার আগেই এই কাণ্ড!
রঘুপতি
আমাকে পাশে পেয়ে যেন একটু মনের ভিতর বল পেয়েছিল। তৎপর হয়ে অদ্রিকে আটকাতে যেতে আমি
বাধা দিলাম। অদ্রি মৃতদেহর গলা টিপে ধরে কিছু একটা বলছে। কী বলছে শোনা দরকার। এই তালিম
আমার আশুদার কাছেই পাওয়া। মনের ভিতর ঢুকতে গেলে তীক্ষ্ণ স্ক্যালপেলের প্রয়োজন। অদ্রির
মুখ থেকে বেরিয়ে আসা শব্দগুলি সেই ছুরিকাপ্রাপ্তির গুরুত্বপূর্ণ সূত্র হতে পারে। মনোযোগ
দিয়ে শুনতে চেষ্টা করছিলাম অদ্রি কী বলছে। শুনলাম ছেলেটি উত্তেজিত হয়ে বিড়বিড় করছে
ঘনঘন।
-বল
আমাকে জ্বালাতন করছিস কেন? আমার ক্ষতি করবি কেন তুই? কী করেছি আমি?
এইসব অনেকটা মানুষ সন্দেহপ্রবণ মনোবিকার হলে করে। কিন্তু সেদিন রঘুপতি সেটুকু মানতে নারাজ। তার দোসর দারোয়ান সারফারাজ। দুজনেরই একমত। এ কাজ ইবলিশের। ওঝা ডাকতে হবে। গুণিন ডাকতে হবে। কুসংস্কারের অভাব আমার দেশে নেই। আর আমার বিভাগে আসা মৃতদেহগুলির বেশির ভাগই যেহেতু অস্বাভাবিক মৃত্যু, তাই আমাদের মর্গ ঘিরেও যে এইসব ভূতপ্রেতশয়তান ইবলিশের কথাবার্তা লোকমুখে ঘুরঘুর করে, সেকথা মনে মনে জানতাম। কিন্তু প্রকাশ্যে পাত্তা দিলাম না। একবার এই ভূতের ব্যামো মাথায় চাপলে ডিপার্টমেন্টে কাজ করার লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না। ছেলেটি ততক্ষণে হাঁপাচ্ছিল। বলেছিলাম ক্লান্ত হলে আমার ঘরে আনতে একবার। তারপর ফিরে গিয়েছিলাম নিজস্ব ঘরে। ফাইলের পাহাড়ে কখন ভুলেই গেছি অদ্রির কথা। রঘুপতি সারফারাজকেও মনে করাতে ভুলে গেছি। একবার শুধু ওই দেহদুটির ময়নাতদন্ত করার সময় জিজ্ঞেস করাতে ওরা দুজনেই বলল, অদ্রিকে মনসুর গাজির কাছে পাঠানো হয়েছে। এই গাজি সাহেব এ অঞ্চলির বিখ্যাত গুণিন। আর ও ব্যাপারটা খতিয়ে দেখা হয়নি।
হাসপাতালে আজ অবশ্য পৌঁছোনো মাত্র কাজের পাহাড় ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার ওপর। আশুদার সেই রঙের গোলক শিবের ডমরু হয়ে নাচছিল মাথায়। এই দিল্লির দলটা এসে আমাদের কলেজের উপর যা রিপোর্ট দেবে, তার ভিত্তিতে বেশ কয়েকটি অনুমোদন পাবে কলেজ। আমার মতোই উৎকন্ঠায় ভুগছিলেন দশরথ চক্রবর্তী। ওনার বিভাগ ফিজিওলজি। সারারাত জেগেছেন চোখ দেখেই বোঝা যায়। রিটায়ারমেন্ট সামনেই। আমাকে দেখে শুকনো হাসলেন। প্রিন্সিপাল শাশ্বতী ম্যাডাম আমাদের নিয়ে কলেজের বড় হলঘরে বসেছিলেন। বেলা তিনটে নাগাদ খবর এল। ভিজিট আজ হবে না। কেন হবে না, কবে হবে, কিছুই জানা নেই। শুনে দশরথবাবু ফিসফিস করে বললেন, বুঝলে ভায়া, এসব রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লাগল বলে।
মুখে
তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধর কথা বললেও দশরথবাবুর মুখেচোখে বেশ স্বস্থির হাসি। আমিও সাময়িক বিরতি
নিয়ে নিজের কক্ষে এসে দেখি একটি অল্পবয়সী সুন্দরী আমার দপ্তরের চেয়ারে বসে আমার জন্যই
অপেক্ষা করছেন। কী ব্যাপার জিজ্ঞেস করতেই ইতস্তত হেসে তিনি প্রতিনমস্কার জানালেন। তারপর
বললেন-
-দুঃখিত।
আপনাকে ব্যস্ততার ভিতর বিরক্ত করলাম। আমার নাম সুচন্দ্রা। আমি অত্রির স্ত্রী।
ব্যস্ততায়
গত পরশুর সেই ঘটনার কথা ভুলে বসেছিলাম। এই মুহূর্ত আবার যেন ফিরিয়ে আনল সেই চিন্তা।
-বলুন।
-আসলে
অত্রির ব্যাপারে আপনার সঙ্গে কিছু কথা ছিল। আমার যে আপনার সাহায্যর বিশেষ প্রয়োজন।
যদি আমাকে একটু সময় দিতেন।
-বলুন!
কীভাবে সাহায্য করতে পারি!
-আসলে
আমি জানি অত্রি নিয়মিত হাসপাতালে আসছে না। ঘরেও থাকছে না। ও ভালো নেই। আমি লোকমুখে
শুনেছি ও কী কাণ্ড বাঁধিয়েছে গত পরশু। অথচ ঘুম থেকে উঠে ও একদম অন্য মানুষ, জানেন?
দিন গড়ানোর সাথে সাথে অবনতি ঘটতে থাকে। সবচেয়ে ভয়াবহ হয় রাতগুলো।
-আপনি
ওকে বিশেষজ্ঞর কাছে নিয়ে যাচ্ছেন না কেন? মনোরোগ বিশেষজ্ঞ।
-গিয়েছিলাম।
ফল হয়নি। ও ওষুধ বন্ধ করে দিল। আমাদের বিয়ে হয়েছে বছরখানেক। বিয়ের পরপর সব ঠিক ছিল।
হঠাৎ একরাতে ঘনিষ্ঠ হতে গিয়ে আমার গলা টিপে ধরে বলল, কে তুই? বল কে তুই?
সুচন্দ্রার
দুই গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। আমি মনে মনে ভাবতে থাকি আমার করণীয় এক্ষেত্রে কী হতে পারে।
নিজেকে সামলে নিয়ে সুচন্দ্রা বলে-
-আমাদের
বাড়ি থেকে দেখাদেখি করে বিয়ে। আগে জানতাম না এমন হবে। এখন প্রতিদিন এমন ঘটছে। ও কিছু
একটা বলতে চাইছে। কিন্তু বলতে পারছে না। এখন আপনিই পারেন আমাকে সাহায্য করতে।
-কিন্তু
কীভাবে?
-আপনার
সিনিয়র আশুদা। তাঁর অনেক কাণ্ডকারখানার কথা জেনেছি আমি। যদি সহকর্মী না ভেবে নিজের
ছোটভাই ভেবে একবার অদ্রির কথা ওনাকে বলেন! যদি একটু জানতে পারেন অদ্রি কী বলতে চাইছে,
আমি আমার দিক থেকে প্রাণপণ চেষ্টা করব।
সুচন্দ্রার
চোখেমুখে ক্লান্তি, উৎকন্ঠা। ভালোবাসায় ধ্বস্ত মানুষের অবস্থা অনেকটি বনগুল্মে ঢাকা
প্রাচীন ভগ্ন যুদ্ধবিমানের মতো হয়। চলার শক্তি থাকে না, ওড়ার উপায় থাকে না। কিন্তু
এক অনিশ্চিত আকর্ষণের শক্তি থাকে ভিতর ভিতর। সুচন্দ্রার অনুরোধে সায় দিয়ে ফেললাম আশুদার
অনুমতি না নিয়েই।
ঘরে ফিরে দেখি আশুদা টেবিলে রাখা রঙের গোলকটিকে নিয়ে কীসব পরীক্ষা চালিয়ে চলেছে। টেবিলের এককোণে দুপুরবেলার খাবারদাবার যেমনকার তেমন পড়ে রয়েছে। আশুদা তার মানে সারাদিন কিছু খায়নি। কাজ মাথায় চেপে বসলে আশুদা এমনটাই করবে জানি। আমাকে ফিরতে দেখে সে বলল, ভাষাপরিচ্ছেদঃ সাতচল্লিশতম শ্লোকে কী বলছে জানিস? বলছে "আত্মেন্দ্রিয়াদ্যধিষ্ঠাতা করণং হি সকর্ত্তৃকম।"এর অর্থ হল যেখানেই আত্মত্ব আছে সেখানে আত্মা আছে। আত্মত্ব বিহীন আত্মা অসম্ভব। বুঝলি?
আমি
ঘাড় নাড়লাম। কিছুই বুঝলাম না। সব খুব জটিল লাগলো। আশুদা রঙগোলকের ভিতর একটা ছোট বাল্ব
লাগিয়েছে। ওটা হবে আলোর উৎস। সেই বাল্বের ঔজ্জল্য পাল্টানো যায় রেগুলেটর দিয়ে। সেই
আলো বাড়ানো কমানোর ফাঁকে আশুদা বলল, শিশু কেন রঙের 'হিউ' চিনে নেয় প্রথম জানিস? কারণ
এই পচনশীল সমাজে একমাত্র শিশুরাই নিষ্পাপ। 'হিউ' হলো শিশুদের প্রথম স্বীকারোক্তি। এই
কারণেই এই শব্দের আরেক অর্থ 'চিৎকার'। চিৎকার না করলে তোমার আমিত্ব আমিত্ব হয়ে উঠবে
কীকরে! রঙ আর চেতনা, দুটোই এই টেবিলে বসে আমি মেপে দেখাব তোকে।
আমি
ক্লান্ত চোখে মাথা নাড়ি। আপাতত অদ্রির ব্যাপারটা বলতেই হবে আশুদাকে। কিন্তু মন সায়
দিচ্ছিল না। কাল ছুটি আমার। ঠিক করলাম কাল সকালেই ব্যাপারটা জানাব ওঁকে। আজ না হয় থাক।
ভাবতে ভাবতেই অদ্রির পত্নী সুচন্দ্রার অসহায় চোখদুটো আমার সামনে ভেসে উঠল একঝলক। আশুদার
এই রঙের গোলকের সঙ্গে অদ্রির ঘটনার গোলক সামঞ্জস্যে মিলবে কিনা কে জানে? তবু মন বলছে
অদ্রির মনের ভিতর কোনও গভীর রহস্য লুকিয়ে আছে। একমাত্র আশুদাই পারবে সেই রহস্যের জট
খুলতে। দেখা যাক। আপাতত বিধির বিধান কী লিখেছে ওদের ললাটে!
(ক্রমশ)
অসাধারণ । পরের পর্বের জন্যে মুকিয়ে রই
উত্তরমুছুন