প্রতিবেশী সাহিত্য
কেরলার কবি সন্তোষ আলেক্স-এর
কবিতা
(অনুবাদ : জয়া চৌধুরী)
কবি পরিচিতি : কেরলার কবি সন্তোষ আলেক্স কেরালার তিরুবল্লা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৫০। তিনি হিন্দি ও মালয়ালম ভাষায় লেখেন ও অনুবাদ করেন। পন্ডিত নারায়ণ দেব পুরষ্কার, ভারতীয় ভাষা পরিষদের দ্বিবাগীশ পুরষ্কার, তালসেরি রাঘবন পুরষ্কার সহ বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত। মালয়ালম ভাষায় কাব্যগ্রন্থ দুটি, হিন্দি ভাষায় দুটি, কেদারনাথ সিং-এর কবিতা সম্বন্ধীয় প্রবন্ধ সংকলন ইত্যাদি মৌলিক বই সহ অসংখ্য অনুবাদ গ্রন্থের রচয়িতা। আলোচ্য কবিতাটি তাঁর হিন্দি কাব্যগ্রন্থ ‘पिता मेरे’-র অনুবাদ।
বাবা
বিশাখাপত্তনমে
চাকরি পাবার পর
বাবার বন্ধুর বাড়ি মহীপালমে
একমাস থাকলাম
তাঁর ঠিকানায় আসত
বাবার চিঠি
চিঠি বলতে
হঠাৎ পড়ল মনে
মেয়েকে লেখা নেহরুর চিঠি
একান্ত শ্রীবাস্তবের
মায়ের চিঠি
আমার চাকরিটা
নির্দেশপত্রের মাধ্যমেই এসেছিল
একমাসের মধ্যেই
অফিসের কাছে
একটা বাড়ি ভাড়া করলাম
বাবুদাদা আর নৌবীদাদা
কাছেই থাকত বলে
সবাই একসাথে অফিসে যেতাম
বাড়ি থেকে আসা চিঠিতে
ভাইবোনের ভালবাসা
বাবার আশীর্বাদ
মায়ের নির্দেশ থাকত
মহীপালমে এসেছি
অনেকদিন হয়ে গেল
জেভিয়ার কাকার ছেলে স্ট্যানলী
সমুদ্রতীরে বেড়াতে আসছে
তাই আমার জন্য চিঠি আর ম্যাগাজিন
নিয়ে এল
বাবা আর
জেভিয়ার কাকাকে চিঠিই
জুড়ে রেখেছিল
সমুদ্রতীরের রেস্টোর্যান্টে
স্ট্যানলীর সঙ্গে দেখা হল
চা খেলাম
কুশল জিজ্ঞেস করলাম
ওকে বিদায় জানিয়ে ঘরে ফিরলাম
চিঠি খুলে পড়লাম
আমার পেনশন বন্ধ করে দিয়েছে
মায়ের শরীর খারাপ হয়েছে
পলেস্তারা খসে গেছে
এই বছরও ফসল
নষ্ট হয়ে গেছে
নিজের খেয়াল রাখিস বাবা
সম্ভব হলে একবার গ্রামে আসিস
তারপর কয়েকমাস
আমি কোন চিঠি লিখিনি
বাবা সিগারেট বা মদ কিছুই
খেতেন না
পুরো মাইনে
মায়ের হাতে তুলে দেয়া সত্ত্বেও
হিসেব নিকেশ গোলমাল
হয়ে যেত মায়ের
আমরা তিনজন
পোষ্ট গ্র্যাজুয়েশন করছিলাম
ট্রেনের ভাড়া,
বইপত্র, মাইনে
সমীকরণ ঠিক মিলত না
তাই বাড়িতে ডে কেয়ার
শুরু করে দিলাম
কলেজ শেষ হলে
বিকেলে বাড়ি পৌঁছে
বাচ্চাদের আধো আধো বুলি শুনে
যাত্রার ধকল দূর হত
মা সবকটা বাচ্চাকে
একভাবে খেয়াল রাখতেন
কাছ থেকে চিনতেন সবাইকে
বাবার কম মাইনেয়
মা সংসার চালাতেন
বাবারও দেখাশোনা করতেন পুরোপুরি
ডে কেয়ারের বাচ্চাদের
জন্মদিন এলে
বারণ করলেও
মিষ্টি নিয়ে আসতেন
রসগোল্লা নিয়ে এলে
তাদের বাবা মা
এক আধটা নিয়েই নিতেন
স্কুল থেকে ফিরে
বাচ্চাদের ব্যাগ গুছিয়ে দিতে
মায়ের সঙ্গে হাত লাগাতেন বাবাও
বাচ্চাদের পালন করতে করতে
দিন মাস কেটে গেল
বাবা মা আরো একবার
আমাদের ছোটবেলা যাপন করে নিল ফের
রাতে
ডাইনিং টেবিলে
সবাই যখন খেতে বসতাম
বাবা ভাইকে বলতেন
ছোটবেলায় তুইও
জর্জের মত ছিলি
সারাক্ষণ ভ্যাঁ করতিস
প্যান্টে হিসু করে ফেলতিস
সবাই আমরা হো হো করে হাসতাম
সঙ্গে বাবাও
এভাবে আরো একটা দিন কেটে যেত
১৯৮০র কাছাকাছি
ভারতে মধ্যবিত্তদের ঘরে
টেলিভিশন চলে এল
আমাদের কলোনিতে
রোসম্মা মিসের ঘরেই কেবল
টেলিভিশন ছিল
প্রথম দিকে কেবল দূরদর্শন
চ্যানেলই ছিল
চিত্রহার
সুরভি
স্পাইডারম্যান
দেখে আমরা বড় হয়েছি
ধীরে ধীরে
ধারাবাহিক শুরু হল
রামানন্দ সাগরের রামায়ণ
সবাইকে বাড়িতেই বসিয়ে রাখত
১৯৮৩ সালে
ফুটবল বিশ্বকাপ চলাকালীন
বাবা টিভি কিনলেন
ওঁর পছন্দের খেলা ছিল ফুটবল
আমারও
ভাই পছন্দ করত ক্রিকেট
বোন ব্যাডমিন্টন
বাবা
ব্রাজিলের ফ্যান ছিলেন
আমি আর্জেন্টিনার
বিশ্বকাপ শুরু হলে
অনেক রাত জেগে
আমরা খেলা দেখতাম
স্কুলে পড়বার সময়
বাবা ফুটবল খেলতেন
চাকরি পাবার পরে ছেড়ে দেন
একবার
স্কুলের কর্মচারীদের মধ্যে
ম্যাচ হলে দুটো গোল করেন
বলের উপর ওঁর নিয়ন্ত্রণ
আর মাপসই পাস করবার ব্যাপারটা
সেদিন বুঝলাম
১৯শে জুন ১৯৮৩
ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার মধ্যে
ফাইনালে মুখোমুখি দেখা
ফরোয়ার্ডে বল নিয়ে
এগোলেই
‘দে দে পাস দে’ বলে উঠে দাঁড়াতেন
চেয়ার ছেড়ে
গোল খেয়ে গেলে মুষড়ে পড়ে
‘আরেহঃ’ বলে বসে পড়তেন
বিরতির সময়
চা বানাতেন
আর নিয়ে এসে আমাকেও দিতেন
এক গোলে ব্রাজিল
আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে দেয়
জিওনি একমাত্র গোলটি দিয়েছিল
ম্যাচ ততটা নয়
যতখানি বাবার উৎসাহ আর ধারণা
দেখছিলাম
এভাবে আমি
বাবাকে যুবক হয়ে যেতে
দেখলাম ফের
বিশাখাপত্তনম থেকে
ফোনে বাবার সাথে
প্রায়শই কথাবার্তা হত
আমার কথাগুলো
মন দিয়ে শুনতেন
তার পর উত্তর দিতেন
শোনাও একটি কথা
এমনটা বাবার কাছেই
শিখেছি আমি
বিয়ে করবার পরেও
ফোনে কথা বলতেন
অভ্যাস বজায় ছিল
তফাত কেবল এটুকুই
বিয়ের আগে আমার সাথে
বলতেন বেশি
বিয়ের পরে পুত্রবধূর সাথে
অনুবাদের কাজ জারী রেখেছিলাম
শুরুটা ছিল গল্প দিয়ে
তারপর কবিতাগুচ্ছ এবং
নাটক অনুবাদ করলাম
বেশ ক’বছর কেটে গেলে কোনো
একটা অনুবাদ ফেলোশিপের ফলাফল এল
ই-মেইলের মাধ্যমে
আমি নির্বাচিত হইনি
সেদিন রাত্রিবেলা
বাবার সাথে কথা বললাম
আমার মন চাঙ্গা করে দিলেন
অনেক কথা বোঝালেন
মনে হল আমার বন্ধু তিনি
বড়দাদা
শুভ কামনাকারী
গুরু
আমার বাবা
ফোনে কথা বলা
তখনও জারি ছিল
বিয়ের আগে
আমার সাথে বেশি বলতেন
বিয়ের পরে বউমার সাথে
এখন
সব ঠিকঠাক আছে তো বলেই বাবা
নাতিদের আধোবুলি
শুনতে বেশি সময় কাটাতেন
এভাবে দেখলাম বাবাকে
আরেকবার শিশু হয়ে যেতে
ইংরিজিতে বক্তৃতা প্রতিযোগিতায়
বোন পুরস্কার পেত
প্রায়ই
আমাদের তিনজন ভাইবোনের মধ্যে
ওর ইংরিজি উচ্চারণ সবচেয়ে ভাল ছিল
দাদু ইংরিজি ভাষার
অধ্যাপক ও
প্রধানশিক্ষক ছিলেন সেন্ট জেমস স্কুলে
বোনও ইংরিজি ভাষা বিভাগেই যোগদান
করলে
সবচেয়ে খুশী হয়েছিলেন বাবা
স্কুলের লাইব্রেরী থেকে
ওর জন্য
বই নিয়ে আসতেন
মা বারণ করলেও
কলেজ থেকে বোনের ফিরতে দেরী হলে
চৌমাথায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন তিনি
ইংরিজি মিডিয়াম স্কুলেই
বোনের
চাকরি হয়ে গেলে
হাউসিং কলোনিতে
মিষ্টি বিলি করেছিলেন
ফোন করে
আত্মীয়দের সংবাদ জানিয়েছিলেন
বাবা
বোনকে বড্ড
ভালবাসতেন
সেই দিনটা মনে আছে
যেদিন গির্জাঘরে
বাবার কর্তব্য করে
খুব গর্বের সাথে
বোনের হাত ধরে
বিদায় জানিয়েছিলেন মেয়েকে
সন্ধ্যায় সকলে চলে গেলে
একলা ঘরে বড় কেঁদেছিলেন বাবা
বাবার পক্ষে
কান্না এত সহজ ছিল না
বাবা চেঁচাবেন
গুম হয়ে থাকবেন
কাঁদবেন না
বাবার কান্না
ওঁর দুর্বলতা নয়
বরং শক্তি
এজন্যই বাবার স্থান
কেবল বাবারই থাকে
বাবার আঙুল আঁকড়ে
নদী তটে পৌঁছে
কতবারই না
ভেজা বালির উপরে বাড়িঘর বানিয়েছি
চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে
বাবাকে দেখতে ডেকেছি
তিনি দেখবার আগেই
ঢেউ এসে ঘর ভাসিয়ে নিয়ে গেছে
বিকেলে ফিরবার পর
কাঁধে চড়ে
নিজের ভয় দূর করেছি আমি
কলেজের ক্রিকেট টিমে
নির্বাচিত হলে
বাবা ছোটভাইকে কিনে দিলেন
নাইকের জুতো
সময় হলে
ছেলেমেয়েদের
বিয়ে দিলেন
মা বলে বাবা এখন
দেয়ালে আঁকা আমাদের
শিশুকালের অক্ষরের উপর
হাত বোলান
যখনই শপিং সেন্টারে যেতেন
তখনই লটারির টিকিট কিনে আনতেন
বাবাকে দেখে
লটারি বিক্রেতা বিকলাঙ্গ যুবকের
চোখ উঠত চকচক করে
পোষ্টম্যান
অটোওয়ালা
সহকর্মী
আত্মীয়স্বজন
স্কুলের ছাত্র
এসবের ভীড়ে
বাবা কোথাও থাকতেন না
তবুও এদের কোন ঘটনা ঘটলে
সবার আগে গিয়ে হাজির হতেন
বিয়ের পর
বাবা হওয়ার পরে
বুঝেছি যুবক বয়সে
বাবার সাথে যত ঝগড়া করেছি
সব অকারণ বুঝি
ঈশ্বরের সান্নিধ্য পাবার জন্য
প্রতিটি যাত্রার পরে
বাড়ি ফেরার তাড়া থাকে আমার
আমার জন্য
তিনি দু পায়ে হাঁটেন
ঈশ্বরের নাম বাবা
আমরা তিন ভাইবোন
খেলতাম ঘর-ঘর
মারামারি করতাম
ঝগড়াঝাঁটি
রেগে উঠতাম রাগ ভাঙাতাম
এভাবেই বড় হয়ে গেলাম
ভাইয়ের শেষ কথাকটা
মনে আছে আমার
আমাকে খুঁজিস না সময় হলে
ফিরে আসব আমি
একথা বলে চলে যাবার সময়
বারান্দায় বসেছিলেন বাবা
ও হাসত
গাইত
কাঁদত
প্রয়োজনের বেশি
ভালবাসত আমায়
বাবা
বারান্দায় বসে বসে
রাস্তা দিয়ে কোন যুবককে যেতে দেখলেই
উঠে চলে যেত তার কাছে
এ রাস্তা সে রাস্তা নয়
যেখানে মা আমাদের
ছোটখাট কাজ করতে
পাঠাত
এখন সেখানে কুকুরও শুয়ে থাকত না
মাছির উৎপাতে
ওদের লেজও নাড়াত না
রাতের খাওয়া মিটলে
মা
আনমনে ওর জন্যও
সাজাত থালা
অনেক বছর কেটে গেছে
আজো বারান্দায়
বসে থাকেন বাবা
উঠোনে ঝুঁকে থাকা নিমগাছ
তুলসীতলা
জবরু কুকুর
দুধিয়া বিড়াল
সবাই চুপচাপ
হাওয়া বইলে
শুকনো পাতা উড়ে
বাবার পায়ের কাছে পড়ে
হায় যদি ভাই
কোন গাছের ডাল ভরা
উঠোনে এসে
হাজির হত
তাহলে আবার তুলসীতলায়
প্রদীপ জ্বলত
জবরু কুকুর
দুধিয়া বিড়াল
তার পায়ে পায়ে ঘুরত
অপেক্ষা শেষ হত বাবার
গ্রামের পথে
লাঠি হাতে
ধীরে ধীরে পথ হাঁটতেন বাবা
বিকেলবেলা
অশ্বত্থ গাছের নিচে
যৌবনের গল্প বলতে বলতে ও শুনতে শুনতে
হো হো করে হাসতাম আমরা সব বয়সীরা
একদিন হঠাৎ
শরীর খারাপ হল বাবার
বিছানা পেতে দিল জমাদার
রিক্সাওয়ালা কিনে আনল ওষুধ
পড়শী সেঁকে আনল রুটি
ভাঙা বেড়ার ঘরে
থাকতেন বাবা একলাই
বাবাকে শহরে নিয়ে এলে
কয়েক মাস কেটে গেল
অ্যাপার্টমেন্টের পার্কিং এরিয়ায়
স্কেট বোর্ডে চড়তে চড়তে
ধাক্কা দিল বাচ্চারা
সব ছোটরা একজায়গায় জড়ো হয়ে গেল
চৌকিদার দৌড়ে এল
বাচ্চার মা বাবা ক্ষমা চাইল
হাসপাতাল থেকে
বাড়ি ফিরে এলেন বাবা
ফোনে কথা হল সবার সঙ্গে
স্কুলের চাকরি করে যখন অসুখে পড়লেন
গোটা এলাকার লোক চলে এল
দেখা করতে
বাড়িতে নার্স রাখার ব্যবস্থা করা
হল
উনি বিছানা পাতলেন
ওষুধ দিলেন
রুটি খাইয়ে
ফিরে গেলেন অ্যাপার্টমেন্টে
বি-ব্লকে
অনেক রাতে
বাড়ি পৌঁছল ওঁর পুত্র-পুত্রবধূ
শো-কেসে চোখ পড়ল বাবার
ওখানে শাঁখ, ঝিনুক কত কী
তাদের চিৎকারের শব্দের সাথে
বুড়ো বাবার কান্নার আওয়াজ কোথাও মিলে
গিয়েছিল
আপনি কখনও
যারা ছাতা মেরামত করেন তাদের
কথা ভেবেছেন কি
পাশে অনেক ছাতা রাখা থাকে তবুও
বাড়ি ফেরে ভিজতে ভিজতে
চলাফেরা করার সময় বাবার কাছে
বরাবর ছাতা থাকত
বর্ষাকালে
সবার কাছে ছাতা থাকত
বাড়িতে ভাইয়ের ছাতা ছিল না বটে
বাবার কাছে ছিল
সবচেয়ে পুরনো ছাতা
বাজারে যদিও
রঙিন ছাতা এসে গিয়েছিল
বাবা আজও তা
বদলাননি
এই ছাতার তলাতেই
বাবা-মা
একসাথে ঘুরে বেড়িয়েছেন
রোদে ছায়ায়
উদ্যানে সিনেমাহলে
অটোয়, বাসে
এটা নিয়েই বাবা
আমাদের নিয়ে যেতেন স্কুলে
বাজারে, টিউশন সেন্টারে
এর রঙ চটে গিয়েছিল
হাতল ভাঙা ছিল
অনেক জায়গায় তালি দেয়া
বাবা বড় যত্নে
রাখতেন এটাকে যেন
আজই সদ্য কেনা হয়েছে
তাঁর কাছে এ কেবল
সামান্য ছাতা ছিল না
জীবনের পথে থাকা
একমাত্র সাথী
যা না বলেও বহু কথা বলত
বারান্দায় বসে থাকার জন্য
একটা জায়গা স্থির ছিল বাবার
সেখানে বসে দৈনিক পত্রিকা পড়তেন
কখনও আমায় ইশারা করে চশমা চাইতেন
কখনও মার কাছে চাইতেন চা
একদিনের কথা
বাবা সেদিন স্নানঘরে পিছলে পড়ে গেলেন
অনেকদিন পরে তাঁর সাথে
অনেকক্ষণ বসলাম
হাঁটু ও হাতের উপর
হাত বুলিয়ে দিলাম
বাবাকে কখনও আমি
এমন অবস্থায় দেখিনি
যে দুটি হাত প্রথমবার আমায় কোলে তুলেছিল
পিঠ চাপড়েছিল আমার
হাতে হাত মিলিয়েছিলেন
দিয়েছিলেন আশীর্বাদ
সে দুটি হাত তখন প্রার্থনারত
কিছুক্ষণের জন্য
ওঁর সাথে বসেছিলাম
মা দৌড়ে এলেন রান্নাঘর থেকে
কিছু হয়নি, আমি সামলে নেব
একথা বলে পাঠিয়ে দিলাম মাকে রান্নাঘরে
চোখ ভেজা ছিল
আমার চোখে টপ করে জল পড়ল
ঠোঁট কেঁপে উঠল ওঁর
আমার ঠোঁট থেকে সে শব্দ
প্রার্থনা হয়ে বের হল
দ্বিতীয় দিন বিকেলে
আমাকে দেখা করতে বললেন
ডায়রি কিনে দেরী করে ফিরলাম
ঘরে শুয়েছিলেন তিনি
বালিশের পাশে ডায়রি রাখতে বললেন
শ্বাস আটকে যাচ্ছিল তাঁর
আই সি ইউর কাচ দিয়ে
দেখলাম ওঁকে
একপাশ ফিরে শুয়ে আছেন তিনি
ঠিক কী সেই কথা
যা উনি আমায় বলতে চাইছিলেন
তিনি এখনও শুয়ে আছেন
বিছানায় লীন হয়ে গেছেন
কার্ডিয়াক মনিটরে রিডিং দেখা যাচ্ছিল
উঠছে নামছে
আই সি ইউর বাইরে
বেঞ্চিতে বসে আছে মা এবং বোন
নার্স বলে উঠলেন
রোগীর জলখাবার দিন
আমি ভেতরে গেলাম
ধীরে ধীরে তিনি উঠলেন
আমাকে বললেন
বাবা, আমাকে বাড়ি যেতে হবে
বললাম, “দু দিন পরে যাবে”
ছোটদের মত জিদ করছিলেন
জলখাবার খাবেন না
চায় ভিজিয়ে
দু টুকরো ডবল রুটি খাওয়ালাম
তিন নম্বর খাবার আগেই বারণ করলেন
সামান্য জল খেয়ে শুয়ে পড়লেন
আর কখনও উঠে বসলেন না!
আজও বারান্দায় বসে থাকতে থাকতে
আনমনে
উঠে যাই চশমা নিয়ে আসতে
দেখি
চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে মা
বাবা
আসলে কী কথা আমাকে
বলতে চেয়েছিলেন আপনি?
আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছেন বাবা
এক সপ্তাহ হল
আত্মীয় বন্ধুরা ফিরে গিয়েছেন
আমরা চারজনই স্রেফ রয়ে গেছিলাম
মায়ের আগ্রহে সাহস করে
বাবার স্যুটকেস খুললাম
আমার বইয়ের কপি
পুরস্কারের ক্লিপিং
আমার ছোটবেলার ছবি
পেলাম সেখানে
সব বাবার মতই
ব্যাকুল হতেন
হাসতে হাসতে
কাশতে কাশতে
কখনও বা
চুটকিও শোনাতেন
বাবা এখন আর নেই
দুঃখ এজন্য নয়
দুঃখ একারণেই যে
জীবদ্দশায় তিনি কখনও
নিজের জন্য বাঁচেননি
দুর্দশায়
আহ্লাদে
পরিবার জুড়ে রেখেছেন
আমাদের ভাল শিক্ষা দিয়েছেন
সংসারের হাল আমাদের
টের পেতে দেননি
তিনি আধা ঘুমিয়েছেন
আধা জেগেছেন
আর আমরা বড় হয়ে গিয়েছি
আনন্দ এই যে
পরিবারের সদস্যদের
চিন্তায়, নিঃশ্বাসে
আজও
বেঁচে আছেন তিনি
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন