কালিমাটির ঝুরোগল্প ১০০ |
বাস্টার্ড
রুকাই যেদিন তার জন্মপরিচয় জানতে পারল,
সেদিনই সে জানতে পারল, আসলে তার কোনো জন্মপরিচয় নেই। এতদিন যাদের সে মা-বাবা বলে জেনেছে,
মা-বাবা সম্বোধন করেছে, তারা তার জন্মদাতা মা-বাবা নয়। এমনকি এই মা-বাবা জানেও না,
প্রকৃত মা-বাবা কারা। তার বয়স যেদিন চোদ্দবছর পূর্ণ হলো, সেদিনই জন্মদিনের পারিবারিক অনুষ্ঠানের পর একান্তে
রুকাইকে তার জন্ম সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য জানানো হয়েছিল। তবে পরিচয়টা জেনে যে রুকাই
খুবই অবাক হয়েছিল বা পায়ের তলার মাটি সরে গেছিল অথবা চোখের সামনে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছিল,
তা কিন্তু নয়। বরং পরিচয়টা জেনে সে বুঝে উঠতে পারছিল না, এই অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতিতে
তার কেমন আচরণ করা শোভনীয় হবে! সে এখন কান্নাকাটি করলে কি তা স্বাভাবিক আচরণ বলে মনে
হবে? অথবা বর্তমান মা-বাবার বুকে মাথা গুঁজে তোমারাই আমার মা-বাবা বললে তা সঠিক ও মানানসই
হবে?
রুকাই তার জন্মবৃত্তান্ত বিশদেই সেদিন
জেনেছিল। যে মায়ের গর্ভ থেকে বেরিয়ে এসে পৃথিবীর আলো দেখেছিল, সেই মা নামের মহিলাকে
তার জন্মের পরে পরে শুধু রুকাই নয়, নার্সিংহোমের কেউই আর দেখতে পায়নি। তারপর যা হয়
আর কী! নার্সিংহোম থেকে রুকাইকে রেখে আসা হয়েছিল একটি শিশু অনাথালয়ে। তবে সেখানে বেশিদিন থাকতে হয়নি। নিঃসন্তান হালদার
দম্পতি ছ’মাসের রুকাইকে দত্তক নিয়েছিলেন আইনসম্মতভাবেই।
অকৃত্রিম সন্তানস্নেহে এবং গভীর মমতায়
রুকাইকে তার নিজের প্রবণতা অনুযায়ী বড় করে তুলেছিলেন তাঁরা। অভিজাত ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে
পড়াশোনা, রবীন্দ্রভবনে উপযুক্ত শিক্ষক-শিক্ষিকার কাছে গান ও নাচের তালিম ইত্যাদি সব
ঠিকই ছিল। তবে নিতান্তই অন্তর্মুখীন ও শান্ত স্বভাবের মেয়ে রুকাই এক ধরনের দ্বিধায়
ও সংশয়ে মাঝে মাঝেই খুব বিপন্ন বোধ করত। বিশেষত কারও কারও পরোক্ষ উক্তি ও মন্তব্য,
তাকে বিচলিত করত। সে নিজেও মনে মনে গোপনে খুঁজে বেড়াত কিছু জটিল ও অমীমাংসিত জিজ্ঞাসার
উত্তর। কোনো সহপাঠিনী যখন বেমওকা কৌতূহলী হতো, হ্যাঁ রে রুকাই, তোর মা-বাবা তো কুচকুচে
কালো, তাহলে তুই এত ফর্সা হলি কীভাবে? আবার কোনো সিনিয়র দাদা বিস্ময় প্রকাশ করে বলত,
তুই দেখতে কী সুন্দর রে রুকাই! তোর মুখও এত সুন্দর, দেখলেই আমার...। রুকাই খুব লজ্জা পেত। অস্বস্তি বোধ
করত। চোখ নামিয়ে রাখত মাটির দিকে। কিন্তু এতেও
রেহাই নেই। সিনিয়ার দাদা বলত, তোর মা-বাবা দুজনেই তো বদখত দেখতে, তাহলে তুই এত সুন্দরী
হলি কেমন করে?
গভীর রাতে মা-বাবা ঘুমিয়ে পড়লে রুকাই
নিজের ঘরে আয়নার সামনে নগ্ন হতো। নিজেকে অপলকে দেখত। সত্যিই তো, এই দুধে-আলতা গায়ের
রঙ, টানটান শরীরের গড়ন, তুলিতে আঁকা মুখশ্রী,
কার কাছ থেকে পেয়েছে? এই মা-বাবার সঙ্গে কিছুই
তো মেলে না! তাহলে!
চোদ্দবছর উত্তীর্ণ রুকাই তার জন্মদিনের
গভীর রাতেও আয়নার সামনে নগ্ন হয়। এই মা-বাবাকে
সে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে প্রথম থেকেই। কিন্তু তার আসল পরিচিতি কী? ‘বাস্টার্ড’
শব্দটা কিলবিল করে ওঠে তার চেতনায় ও মননে।
ভালো লাগলো। গল্পের শেষের লাইনটা একদম ওভার বাউন্ডারীর মতো !
উত্তরমুছুন