আমার জীবনে উত্তম-সুচিত্রা
(তিন)
উত্তম-সুচিত্রা
মহানায়ক-মহানায়িকার
যুগলবন্দী প্রথম দেখি ১৯৭৬-এর পর, লেক টাউনের জয়া প্রেক্ষাগৃহেঃ শাপমোচন! ভক্তকূল
আমাকে ছিঁড়ে খেলেও বলব, ছবির গল্প বেশ দুর্বল, এবং অন্তত একটি সংলাপ পেটে খিল
ধরিয়ে দিয়েছিল (শুধু আমার নয়, হলে দর্শকদের মধ্যেও হাসির রোল উঠেছিল)। নায়কের বেহালাবাদন শুনে মুগ্ধ নায়িকা তাঁকে বলেন, “তুমি
তোমার ঐ দুই হাত দিয়ে আমায় বেঁধেছ!” নায়ক নায়িকাকে বলেন, “আমি তোমার কাছে একটা
জিনিসই চাইব।” আপ্লুত নায়িকা প্রবল আশায় উত্তর দেন, “বলো, বলো!” অপ্রত্যাশিত জবাব,
“দশটা টাকা!” (যাতে বস্তিবাসী গঙ্গাপদ বসু ও তাঁর নাতনী ঐ টাকায় ভাড়া মিটিয়ে উৎখাত
হওয়া থেকে বাঁচেন)। হতভম্ব নায়িকা কিছুক্ষণ
বাক্যহারা থাকার পর ফেটে পড়েন, “তুমি মানুষ নও, পাষাণ! আমি দেবো না তোমায় টাকা,
দেবো না, দেবো না!” আর যে অভিশপ্ত তানপুরা এত সর্বনাশের কারণ, সেটা আছড়ে ফেলে
ভাঙার কথা কারুর মনে হলো না দু-ঘণ্টার ওপর! অবশেষে নায়িকা, পরিবারের বাইরে হওয়ার
সুবাদে, এই সহজ সত্যটা উপলব্ধি করে প্রয়োজনীয় কাজটি করলেন! অবশ্য, তখনও আমি
উত্তম-সুচিত্রা ভক্ত হয়ে উঠিনি। ছবিটির মূল আকর্ষণ আমার কাছে তখনো সেই হেমন্ত
মুখোপাধ্যায়!
অবশেষে
১৯৮২ সালে মহানায়িকার প্রেমে পড়ি শ্রদ্ধানন্দ পার্কের পাশে অরুণায় হারানো সুর
দেখে। আজও আমি তাঁর মুগ্ধ ভক্ত! যদিও সংখ্যাগরিষ্ঠের মতে এই ছবিতে উত্তমই অভিনয়ে
মহানায়িকাকে টেক্কা দিয়েছেন, আমার তো মনে হয় উত্তম ইচ্ছে করেই, বিশেষ করে
দ্বিতীয়ার্ধে, একটু চেপে অভিনয় করেছেন, সুচিত্রাকে আবেগ-প্রকাশের পূর্ণ সুযোগ ছেড়ে
দিয়ে, আর প্রথমার্ধে ব্যাপারটা ঠিক উল্টো। এটাই অভিনেতা-পরিচালকের মধ্যে ‘টিম
ওয়ার্কের’ নিদর্শন। মূল কাহিনির (James Hilton-এর উপন্যাস Random
Harvest এবং সেটির ওপর আধারিত ১৯৪২ সালের Ronald Coleman ও Greer
Garson অভিনীত ছবিটি) তুলনায় ‘হারানো সুর’-এর চিত্রনাট্যও দুর্বল
লাগে আমার, যদিও ‘শাপমোচন’-এর মতো নয়। তবে অভিনয়, আবহ-সঙ্গীত এবং গান মিলে সব
ত্রুটি ঢেকে দিয়েছে। ‘তুমি যে আমার’ গানটি ছবিটি দেখার আগে প্রথম শুনি
উত্তমকুমারের প্রয়াণের পর HMV-র
‘মহানায়ক উত্তমকুমার’ নামক ডিস্কে। শুনে যেন কি-রকম অদ্ভুত লেগেছিল, মনে হয়েছিল
গীতা দত্ত যেন যাকে বলে ‘এদরে-এদরে’ কথাগুলো উচ্চারণ করছেন। অনেক, অনেক পরে, তরুণ
মজুমদার তাঁর ‘ভালোবাসার অনেক নাম’ ছবিতে যে একাধিক পুরনো দিনের বাংলা ও হিন্দি
গান নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক হাস্যরস সৃষ্টি করেছেন, তার মধ্যে ‘তুমি যে আমার’ একটি। অজয়
করের স্মৃতিচারণায় পড়েছি যে ‘হারানো সুর’-এর আগে সুচিত্রা খ্যাতি লাভ করেছিলেন
‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য’ ছবিতে বিষ্ণুপ্রিয়া-রূপে, কিন্তু সে অভিনয় অজয়বাবুর মনে
তেমন দাগ কাটে নি। তাঁর নিজের ‘গৃহপ্রবেশ’ ছবিতে সুচিত্রার অভিনয় নিয়েও অজয়বাবু
কিছু বলেন নি। ‘তুমি যে আমার’এর চিত্রায়নের আগে সুচিত্রা পরিচালককে নাকি প্রশ্ন
করেন কিরকম অভিব্যক্তি দিতে হবে। উত্তরে অজয়বাবু বলেন যে একজন যুবতী সদ্য প্রেমে
পড়ে যেমন করে সেইরকম একটা কিছু, আর কি! এরপর একটু ভেবে নিয়ে মহানায়িকা যা শট দেন,
তাতে পরিচালক বাক্যহারা হয়ে পড়েন! ১৯৮২ সালে ছবিটি দেখে বুঝতে পারি কেন ঐ দৃশ্যটি
এবং তার সঙ্গের গানটি অনেকের মতো আমার কাছেও মধুর, মার্জিত প্রেমের এক চিরকালীন
দলিল এবং সংজ্ঞা! অথচ হেমন্ত যখন গানটি প্রথম উত্তমকুমার এবং অজয় করকে শোনান,
দুজনেই নাকি মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে, দ্বিধাগ্রস্তভাবে বলেছিলেন, “বেশ!” তারপর হেমন্ত
জানান যে গানের রেকর্ডিং হবে কলকাতায় নয়, বোম্বেতে, কারণ এই গানের জন্যে যে
প্রযুক্তির প্রয়োজন তা কলকাতায় নেই, এবং সর্বোপরি, গাইবেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় নন,
গীতা দত্ত, কারণ হেমন্তবাবুর মতে আর কারুর পক্ষে এই গানের প্রতি সুবিচার করা সম্ভব
নয়। হেমন্তবাবু চলে যাবার পর, প্রযোজক-পরিচালকদ্বয় উপস্থিত দোর্দ্যণ্ডপ্রতাপ
চলচ্চিত্র-সম্পাদক অর্ধেন্দু চট্টোপাধ্যায়কে নাকি বলেন, “যাক গে, অসুবিধে হ’লে
একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত দিয়ে দেওয়া যাবে ’খন!” দ্বিতীয় গান হিসেবে নাকি
রবীন্দ্রসঙ্গীতই বাছা হয়েছিলঃ ‘আমার এ পথ, তোমার পথের থেকে অনেক দূরে গেছে বেঁকে’।
পরে ঐ গানের অনুপ্রেরণাতেই গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার লেখেন ‘আজ দু’জনার দু’টি পথ ওগো
দু’টি দিকে গেছে বেঁকে’। ছবির প্রোজেকশান চলাকালীন নাকি পরিচালক অজয় করের মনে হয়
গানটি নিস্প্রয়োজন, আর ছবিকে অকারণ দীর্ঘায়িত করছে। তাঁর কথা অনুযায়ী সম্পাদক
অর্ধেন্দুবাবু নাকি তাঁর কাঁচি নিয়ে প্রোজেকশান রুমে উঠতে উদ্যত হয়েছিলেন,
অজয়বাবুর ভাষায় গানটি ‘কাইট্যা’ দিতে! কিন্তু ছবির নাম ‘হারানো সুর’ এবং সুরকার সুরের জহুরী হেমন্ত! পরলোক থেকে শেষ
হাসি এখনো হাসেন আমার জীবনদেবতা!১৯৮২
থেকে ১৯৮৪-র মধ্যে মা’কে নিয়ে ভবানীপুরে ডবল-শো দেখার গল্প আগেই করেছি। প্রথমে
ম্যাটিনীতে ভারতী প্রেক্ষাগৃহে দেখেছিলাম ‘সপ্তপদী’,
তাও বলেছি। প্রথম দর্শনে মেমসাহেব-রূপিনী সুচিত্রার অভিনয়ে একটু
‘অতি-অভিনয়ে’র ছোঁয়া পেয়েছিলাম। দ্বিতীয়ার্ধে কিন্তু তিনি উত্তমের শান্ত-সৌম্য
কৃষ্ণেন্দুর সঙ্গে সমানে-সমানে পাল্লা দিয়েছেন!
এরপর,
বিদেশ থেকে ফিরে প্রেসিডেন্সী কলেজে অধ্যাপনাকালে আমার হবু-শাশুড়ীকে নিয়ে স্বয়ং
রবীন্দ্রনাথের নাম দেওয়া অধুনালুপ্ত রূপবাণীতে দেখি ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’ এবং নন্দনে তাঁকে নিয়েই ‘ওরা
থাকে ওধারে’। এরপর প্রতি বছর উত্তমকুমারের প্রয়াণমাসে নন্দনে দেখেছি পরপর
‘সাগরিকা’, ‘চাওয়া-পাওয়া’, ‘সূর্যতোরণ’, ‘পথে হ’ল দেরী’ এবং ‘আলো আমার আলো’।
এখানে
একটু ক্ষোভ ব্যক্ত ক’রব। কয়েক বছর আগে হঠাৎ সাদাকালোয় তোলা ‘পথের পাঁচালী’-কে রঙিন
ছবিতে রূপান্তর করার জন্য কয়েকজন উঠে-পড়ে লাগলেন। এই ধরনের অর্থহীন অপচেষ্টা না ক’রে,
উত্তমকুমারের কথা অনুযায়ী (‘আমার আমি’ দ্রষ্টব্য) বাংলায়
প্রথম রঙিন ছবি ‘পথে হ’ল দেরী’ – যা আমরা সবাই দুর্ভাগ্যক্রমে সাদাকালোয় দেখতে
বাধ্য হচ্ছি – আবার রঙে ফিরিয়ে দেওয়া উচিৎ
নয় কি? বিশেষ ক’রে মহানায়িকার মেক-আপ সাদাকালোয় খুবই চড়া লাগে, কারণ তাঁর রূপসজ্জা
করাই হয়েছিলো ‘গেভাকালার’-এ চিত্রায়নকে মনে রেখে! আর তিনি যে ভিন্ন-ভিন্ন রঙের শাড়ি পরেছিলেন, সে রঙের খেলা থেকেও
আমরা বঞ্চিত!
বাকি
উত্তম-সুচিত্রা, বা একা উত্তম, একা সুচিত্রা, সবই দেখেছি ছোট পর্দায়, হয়
দূরদর্শনে, নয়তো VHS ক্যাসেট ভাড়া করে!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন