কালিমাটির ঝুরোগল্প ৯৯ |
শূন্যপুর ৭
গ্রামে সাড়া পড়ে গেল। ফোনে ফোনে ছবি। ছবির মতো ছবি। কী তেজ! 'দেখে যেতে পারলনি', দাদা নিবাস বলে। কখন কী হয়ে যায় কিছু বলা যায় না। শরীর এখনও ছাড়েনি। কাটাছেঁড়া চলছে।
শ্রীবাসের খোঁজ ওরা পেয়েছিল 'শিল্পতীর্থ'-র মালিকের থেকে। লাফানো-ঝাঁপানো নেই। পার্ট মুখস্থ নেই। হাত নেড়ে বা বনেটে দিনমান বসে কড়কড়ে পাঁচশ। অ্যামেচার অ্যাক্টর আর কী চায়! তবে কস্টুম, মেকাপ দেবে না শালারা। 'টাকা পাঠায় না কি ওই খাতে? টাকা জল বৈ কিছু নয় ওদের কাছে।' শ্রীবাস আক্ষেপ করেছিল।
নিবাস বলেছিল, 'জল চুঁয়ে আসে বড় থেকে মেজোয়, মেজো থেকে সেজোয়, ন-রাঙা-ফুল ঘুরে আসতে আসতে শুকায় যায়।'
স্মৃতিতে আবছা সাদা-কালো টিভির দ্বারা সিং। তার পাশে দাঁড়াতে পারবে না হালের কোনো রঙিন পবনপুত্র। প্রস্থেটিক হনু দেখে শ্রীবাস দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল। তারপর দুই ঠোঁটের মাঝের বিন্দুটাকে কেন্দ্র ধরে নিখুঁত বৃত্ত এঁকেছিল চিবুক আর নাকের নিচটুকু জুড়ে। আলতায় জল মিশিয়ে হালকা লাল বুলিয়েছিল গোলে। যেন বিস্ফারিত হনু। জরি দেওয়া পেল্লাই মুকুট, গদা আর ল্যাজ ভাড়ায় আনতে খরচ পড়েছিল একশ মতো। শো-এর দিন কমলা বারমুডা পরেছিল, গলায় ভাঁজ করে ঝুলিয়েছিল নামাবলি। কাঁচা পথ পেরিয়ে গ্রাম সড়ক যোজনার রাস্তা, সেইখানে দাঁড়িয়েছিল গাড়ি। পুরো পথ বাচ্চাগুলো শ্রীবাসের পিছনে হৈ হৈ করে গেল। বনেটে বসতেই জয়ধ্বনি, 'তিহু লোক উজাগর'।
সে এক দিন! তলোয়ারের ফলা উঁচিয়ে রামনাম। শ্রীবাস সঙ্গতকার। কখনও এক হাঁটু গেড়ে নমস্কারের পোজ, কখনও আবার আলগোছে কনুই-তে ভর রেখে শুয়ে। রব উঠছিল 'জয় হনুমান জ্ঞানগুণসাগর।' খিচিক খিচিক ছবি।
কস্টুমওয়ালার ভাড়া মিটিয়ে চারশ থাকে। শ্রীবাস মুরগি কিনেছিল। হল্লা হয়েছিল রাতভর। কে তখন জানত, কদিন পর খবরটা আসবে!
তের লাখ মানুষকে রাতারাতি যেই 'নেই' বলে দিল ওরা, শ্রীবাস থম মেরে গিয়েছিল। নাগরিক-বেনাগরিক ইত্যাকার জটিল বিষয়ে কোনো জ্ঞান ছিল না জ্ঞানগুণসাগরের। দাদাকে চেয়েছিল জমিজমার কাগজ। কাগজ কোথা পাওয়া যায়? ওপারের জমি বদলাবদলি করেছিল ঠাকুরদা এপারের এক মুসলমানের সাথে।
যে ঘরে লোহার সিন্দুক, সে ঘরে দোর দিয়ে সারাদিন কাগজ খুঁজেছিল শ্রীবাস। নাওয়া-খাওয়া নাই। রাতে ধাক্কাধাক্কিতে দরজা খুলে ভাতটুকু নিয়ে আবার দোর দিয়েছিল। যেন অতলান্ত কোনো খনিতে প্রবেশ করছে, কয়লা হাঁটকে হীরা তাকে পেতেই হবে।
দুইদিন এইমত কাটে। চিরকেলে খ্যাপাকে নিয়ে নিবাস মাথা ঘামায়নি। গাছে খেজুর, গোঁপে তেল। ভিন রাজ্যে আইন হল, তুই ডরাস কেন? সান্ত্বনা খুঁজতে ভাই গেল কারিয়াকর্তার বাড়ি।
পরদিন জানলা দিয়ে পা দুখানা ঝুলতে দেখা গেল। কারিয়াকর্তা এলেন, আরও যত মেজো-সেজো-ন-রাঙা-ফুল। খিচিক খিচিক।
শেষপর্যন্ত অবশ্য জ্ঞানগুণসাগর ছবিগুলোই ছাপল। ছবির মতো ছবি। কী তেজ! ম্যাসকট নিজে মরে গেলে স্টোরিতে মোচড় আসে। লোকাল ক্যামেরাওয়ালা লোকাল রিপোর্টারকে বলছিল, কাজে লাগুক না লাগুক, ছবি তুলে রাখা জরুরি। ভাগ্যিস ছিল। কখন কী হয়ে যায় কিছু বলা যায় না।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন