সমকালীন ছোটগল্প |
মায়ারাণী
(গত সংখ্যার
পর)
(২)
আশ্বিন মাস, নীল মেঘের দল আকাশে। সমস্ত শস্যক্ষেত্রগুলো ধানের ভারে নত হয়ে আছে। মেঘনার তীরে তীরে মাছের হাট বসেছে। রুই, কাতলা, বোয়াল, আড় মাছ, রুপচান্দা, কিন্তু নাহ্ এদিকে আজ গোপীবল্লভের চোখ দিলে চলবে না।
তিনি বাজার করতে বেরিয়েছেন। কাপড় চোপড় কিনবেন আর মিষ্টি। মিষ্টি
নেবেন ভোলার আদিনাথ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার থেকে। এতদিন গাঁ বাজারে ভালো মিষ্টি পাওয়া যেত না।
যবে থেকে এই আদিনাথ মিষ্টান্ন ভান্ডারের প্রতিষ্ঠা হয়েছে, ঢাকা বা কলকাতার মতো মিষ্টি পাওয়া যাচ্ছে। নানারকমের সন্দেশ, কাঁচাগোল্লা, ল্যাংচা, চমচম ইত্যাদি।
সেদিন দৌলত খাঁ’র প্রাচীন জমিদার কালা রায়ের বাড়িতে রোগী দেখতে
গিয়েছিলেন। জমিদারী এখন পড়তি, কালা রায়ের বংশধররা
ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছেন। এখানেও আছেন দু তিনজন।
গিয়ে দেখেন রোগী নয় রোগিণী। বর্তমান জমিদারের ছোটকন্যা। বিবাহ
হয়েছে কলকাতার দিকের আর এক পড়তি জমিদারের বাড়িতে। সেই জমিদার পুত্রটি লম্পট, বাঈজি
দোষ আছে। কলকাতায় তার হরেক আড্ডা, নেশাগ্রস্ত, এসবই বলছিলেন জমিদার মশাই-এর বর্তমান
বংশধর। তারই কন্যা।
বড়ো শখ করে কলকাতায় বিবাহ দিয়েছিলেন। পাল্টি ঘর। এখন বুঝতে পারছেন। রোগী দেখা শেষ গোপীবল্লভের।
সূতিকা রোগ। শীর্ণ মোমবাতির শিখার মতো প্রাণটি ধুকপুক করছে।
পালস্ দেখেই বুঝেছেন আর কিছু করার নেই, এ মরবে, আজ, কাল বা পরশু।
তবুও নানারকম ঔষধ, পথ্যের কথা বললেন। ডাক্তার কখনো রোগীর মৃত্যুর কথা বলতে পারেন না।
অসুস্থ মেয়েটি বা বধূটি একটি বিরাট পালঙ্কের এককোণে শুয়ে আছে।
মায়ার বয়সী হবে। রেজাই দিয়ে শরীরটি ঢাকা। চোখদুটো অতিকষ্টে খুলেছিল একবার। পালঙ্কের খুঁটি ধরে ঘোমটা টানা এক মহিলা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে
কাঁদছিলেন। বোধহয় ইনিই মা। দুটো ল্যাম্প জ্বলছিল ঘরে, জানালা দিয়ে একটু বাতাস।
রোগী দেখে তিনি যখন বসার ঘরে বসে প্রেসক্রিপশন লিখছিলেন, থালায়
করে প্রচুর মিষ্টি আসে ভেতর থেকে, সঙ্গে দুধ।
তার মোটেই ইচ্ছে করছিল না খাবার, কিন্তু মেয়েটির বাবা এতোবার অনুরোধ করছিলেন, দু একটি খেতে হলো।
খেয়ে বুঝলেন এ জিনিস তিনি ভোলায় আগে খান নাই।
আশ্চর্য, মেয়ে যার মারা যাবে, সে বাড়িতে এত মিষ্টি!
উনিই বললেন, কলকাতা থেকে কন্যার শ্বশুর আর জামাই এসেছিলেন, তাদের
জন্য ভোলার আদিনাথ মিষ্টান্ন ভান্ডার থেকে আনিয়েছেন।
গোপীবল্লভ আর কিছু খেলেনও না, ভিজিটও নিলেন না। বাবা বটে! অবহেলায়
মেয়েকে মৃত্যুপথে ঠেলে দিয়েছে, আর কিনা জামাইকে মিষ্টি খাওয়াচ্ছেন। তিনি হলে ঘাড় ধাক্কা
দিয়ে বের করে দিতেন।
একটি হ্যাজাকবাতি দিয়ে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল জমিদারবাড়ির সরকারমশাই ডাক্তারবাবুকে। ধানক্ষেতের বুকে জমিদারবাড়িটি। আলপথ দিয়ে যেতে হয়।
তখনই মিষ্টির দোকানটির যাবতীয় খোঁজ খবর নেন সরকার মশাই-এর কাছ
থেকে।
ওনার একটি শখ, নিজে যখন কিছু ভালো খাবেন কোথাও, বাড়ির সকলকে, বাচ্চাদের
আর স্ত্রীকেও সেটা খাওয়াতে হবে। আর অল্প করে কিনলে তো হবে না। বাড়িতে অনেক মানুষ, ঝাঁকা
ভর্তি করে নিতে হয়। একদিনই খাক, তবে আয়েশ করে।
সেবার ডিসেম্বরে কলকাতায় গিয়েছিলেন, ঠিক কলকাতায় নয়, যশোর রোড, হাবড়ায়। সেখানে জমি কিনেছেন। জঙ্গলে ভর্তি এখন। তবুও, কিসের যেন আঁচ পান হয়তো পাকিস্তানে (তখনও বাংলাদেশ হয়নি) লক্ষ্মীরাণীর পক্ষে তার অবর্তমানে থাকাটা খুব কষ্ট হবে। ভারতে একটা জায়গা থাক। যদি কোনোদিন…।
আসার সময় কলকাতা গিয়েছিলেন। কলকাতার বাজার আলো করে আছে শীতের কমলালেবুতে।
একখানা খেয়ে মোহিত হয়ে গেলেন। যেমন সুমিষ্ট তেমনি রসালো। বাচ্চাদের মুখ মনে পড়ল। সঙ্গে
সঙ্গে তিন পেটি কিনে নিয়ে ট্রেনে করে, লঞ্চে ভেসে, গরুর গাড়ি চরে, হেঁটে, বহু পরিশ্রমে বাড়িতে এনে ফেললেন। খুব আনন্দ করে খেয়েছিল সবাই। তাতেই তার
তৃপ্তি।
রামদুলাল মাড়োয়ারির দোকানে যাবেন। রেডিমেড কাপড় চোপড়ের সঙ্গে নবদ্বীপের ফুলিয়া থেকে তারা এখন তাঁতের শাড়ি আনছে। যেমন ভালো রঙ, তেমনি মজবুত, আর ডিজাইনও মনকাড়া। শুনেছেন তিনি সাবিনার কাছ থেকে।
রামদুলাল মাড়োয়ারির দোকান গঞ্জের হাঁটের পাশে। পুরনো দোকান, আপাদমস্তক কাঠ দিয়ে তৈরী ।
গোপীবল্লভ ঢুকতেই রামদুলাল সাদর সম্ভাষণ জানালেন।
গোপীবল্লভের প্রাণপ্রিয় কন্যা মায়ারাণী সতের বৎসরের তরুণী এখন।
একে একে পুত্র কন্যা মিলিয়ে তার ঘরে এসেছে এগারোটি সন্তান। পাঁচ মেয়ে, ছয় ছেলে। সকলে
পড়াশোনা করছে। বড় ছেলে, তারপরের মেয়েটি পড়ায় খুব ভালো। বড় যত্নে তিনি সন্তানদের মানুষ
করতে চান। পড়াশোনায় যাতে কোন গাফিলতি না হয়।
কিন্তু মায়া পড়ে না। সে সুন্দর করে সেজে থাকে। একদমই অন্যমনস্ক। অথচ তিনি বাড়িতে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই মায়া যেখানেই থাকুক ছুটে আসবে। জল, গামছা এগিয়ে দেবে। এতো যে রাগী মানুষ তিনি, অথচ ওর সঙ্গে রাগ করতে পারেন না।
মায়া আসলে খুব ভালোবাসে বাবাকে। তিনিও। একমাত্র এই মেয়েটিকেই তিনি
বকতে পারেন না। সব দুর্বলতা মায়ার জন্য।
সামনেই মায়ারাণীর ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা। হয়তো পাশ করে যাবে।
তারপরই বিয়ে দিয়ে দেবেন। আবছামতো এক পাত্রের সন্ধান পেয়েছেন। ছেলেটি এম এ পড়ে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। সংস্কৃতে। বর্তমান
কুমিল্লার ছেলে। কুমিল্লা শহর অঞ্চলে নয়, গ্রামে বাড়ি। মায়ার বর তিনি পদ্মার পার থেকে
নিয়ে আসবেন। কোন বড়লোক ছেলে নয়। আদ্যোপান্ত সৎ একটি ছেলে চাই তার। পড়াশোনায় ভালো শুনেছেন।
নিশ্চয়ই অচিরেই অধ্যাপক হবে।
নাহ্ আস্তে আস্তে তাকে গহনা পত্রের দোকানেও যেতে হবে।
মায়াকে কলেজ পড়াবেন না। সুন্দরী কন্যা, রাস্তাঘাটে বের হওয়ার অনুমতি
দেন নি। পরীক্ষা দিতে যেতে হবে বরিশালে। সেখানে জ্ঞাতি ভাইয়ের বাড়ি। নিজে নিয়ে যাবেন।
পরীক্ষা শেষ হলে আবার সঙ্গে করে নিয়ে আসবেন। ওই বাড়িতে বয়োজ্যেষ্ঠ মহিলারা আছেন। কয়েকদিন
মায়া থাকবে সেখানে।
রামদুলালবাবু শাড়ি বের করছেন। তাঁতের শাড়ি জরিপার, কিছু সিল্কের শাড়ি। হালকার মধ্যে ফুলছাপ দেওয়া। এই শাড়িগুলো চেনেন গোপীবল্লভ। প্রায়ই কলকাতা যান, কলকাতার কলেজে পড়া মেয়েরা এসব শাড়ি পরে, চোখে সানগ্লাস দেয়। ছোট্ট ভ্যানিটি ব্যাগ। চিকন বেল্টের ঘড়ি হাতে।
অনেকগুলো শাড়ি কিনলেন। লক্ষ্মীর জন্য ফুলিয়া তাঁত, জামদানি, সবসময়
পরার মিলের কাপড়। ছেলেদের জন্য শার্টের কাপড়, প্যান্টের কাপড়। মেয়েদের সবার জন্য
ভাল শাড়ি, বাড়িতে পরার জামা তৈরি করার ছিট কাপড়। সবশেষে মায়ার জন্য দুটো সিল্কের শাড়ি
আর সুতির কাপড় বাড়িতে পরার জন্য।
দোকান থেকে বেরিয়ে প্রচুর মিষ্টি কিনলেন, সেই মিষ্টির দোকান থেকে।
তারপর বাড়ি।
পরীক্ষা এসে গেলো। তিনদিন আগে থেকে ব্যাগ গোছানো হচ্ছে। লক্ষ্মীরাণী কয়েক রকম লাড্ডু, সন্দেশ বানিয়েছেন, মেয়ের সঙ্গে দেবেন, কুটুমবাড়ি যাবে মেয়ে প্রথমবারের মতো। এই প্রথম মায়া স্টিমারে উঠল। পাড়ি দিলো মেঘনার অথৈ জলে। দেখলো মেঘনার বুকে কেমন আছড়ে পড়েছে টালমাটাল আকাশের মেঘ।
বাবা আগলে রাখছেন মেয়েকে, লঞ্চে কত নমুনার লোক। আর সেসময় বড় মেয়েরা বাইরে কমই বেরোত।
তবুও হালকা ফুলছাপ সিল্কের শাড়ি, মসৃণ ত্বক, ঘনকালো চুলের দীর্ঘ
বেণী, নিটোল হাতে সরু বেল্টের ছোট্ট সোনালি ডায়ালের একটি ঘড়ি, মাঝে মাঝেই রোদ পড়ে ঝিলিক
দিয়ে উঠছে আর বড় বড় চোখের এই মেয়েটিই যেন আজকের
আকর্ষণ। গোপীবল্লভ কারো সাথে আলাপ করতে চাইছেন না। কারণ তিনি ভালো করে জানেন আজকে আলাপ
জমাবার কারণ অন্য।
মায়ারাণী আর গোপীবল্লভ পৌঁছুলেন বরিশাল, আত্মীয় বাড়িতে। একটি
বড় ঘরে গোপীবল্লভকে থাকতে দেওয়া হলো। মায়াকে এ বাড়িতেই আরেকটি মেয়ে পরীক্ষা দেবে, ওর
সাথে একঘরে।
মায়ার মন খুব উচাটন। কী জানি কী হয়। খাওয়া দাওয়ার দারুণ আয়োজন।
আসল কথা, এ বাড়িতে আরো দুটো ছেলে এসেছে গ্রাম থেকে, এরাও এখানে থেকে পরীক্ষা দেবে। এই যে সময়কাল তখন কুটুম্বিতার অভাব
নেই। বাড়িতে তিনটি বউ আছে। মায়া, গোপীবল্লভ সহ মোট চারজন অতিথি, এছাড়াও কেউ হঠাৎ এলে
দুপুরে বা রাতে, খেয়ে যেতে হবে, বউগুলানের আর বিশ্রাম নাই, মাছ আসছে, কাটছে, রান্না
করছে, খেতে দিচ্ছে। হইচই লেগেই আছে সারাক্ষণ।
যেদিন পরীক্ষা, খুব ঘটা করে অনেককিছু রান্না করা হলো। মায়া কিছুই মুখে তুলতে পারছে না, কদিন পর তারও বিয়ে হবে হয়তো। এভাবেই কোমর বেঁধে সংসার করতে হবে। ভাবতেই শিউরে ওঠে সে। বাপের বাড়ি তার বিশাল আদর। মায়া শুধু বাবার টুকটাক কাজ করবে, এখন ওকে দিয়ে কোন কাজ করানো যাবে না, দুদিনের অতিথি, কয়েকদিন পরই তো বাপের ঘর ছেড়ে চলে যাবে কোথায় কে জানে।
গোপীবল্লভ ঠিক ভেবেছিলেন না ভুল ভেবেছিলেন আজ তা বিচারের ঊর্ধ্বে, তবে বাপের ঘরে মায়ারাণী সোনার জীবন কাটিয়ে পা দিয়েছিলেন রুক্ষ চড়াই উৎরাইএ।
পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি আসা হলো বাপ বেটিতে। দু একটি করে বিয়ের সম্বন্ধ আসছে তার। গোপীবল্লভ প্রথমেই জিজ্ঞেস করেন ছেলের পড়াশোনা কি? মাথায় ঢুকে আছে, ছেলে হবে সৎ, উচ্চশিক্ষিত, তেমন টাকাপয়সা না থাকলেও হবে, অথচ তিনি মেয়ের মনস্তত্ত্ব বুঝতে পারলেন না। তিনি বুঝতে চাইলেন না মেয়েকে তিনি অতি আদরে বড় করেছেন, একটি সম্পন্ন গৃহস্থ বাড়ির সব রকম আরাম আয়েসে সে বেড়ে উঠেছে। কোনদিন অভাব দেখেনি, তার জন্মের পর থেকেই দেখে এসেছে বাড়বাড়ন্ত।
তার কাছে উচ্চশিক্ষিত গরীব সৎ ছেলের ঘর কি সেইরকম সুখদায়ক হবে।
বাস্তব এসে কি ছিঁড়ে খাবে না সমস্ত শৌখিনতাকে?
কিন্তু তার মনে গেঁথে গেছে জমিদার বাড়ির সেই মেয়েটির মুখ। ছেলেকে
সৎ হতে হবে, পয়সা না থাকলেও চলবে।
গহনা গড়াতে দিয়েছেন ভোলার সবচেয়ে ভালো কারিগরের কাছে। সবকিছু তৈরি
করে রাখছেন। তখন ১৯৫৯ সাল।
একটি ব্যবসায়ী বাড়ি থেকে আলাপ এসেছে। বরিশালের বিখ্যাত লোক। প্রচুর
আয়। ছেলেটি বি এ পাশ, সুদর্শন, কোন চারিত্রিক দোষ শোনা যায় না। চাকরিবাকরি না করে পিতৃব্যবসায়
হাত লাগিয়েছে। মায়ারাণীর কথা তারা শুনেছেন। খুব আগ্রহী। অবশেষে তাদের আগ্রহের বাড়াবাড়িতে
এবং লক্ষ্মীরাণীর খুব ইচ্ছেয় তিনি তাদেরকে মেয়ে দেখার অনুমতি দিলেন।
নীচে ডাক্তারখানা সংলগ্ন বড় ঘরে, মেয়ে দেখার বন্দোবস্ত হলো। সবার
জন্য খাওয়াদাওয়ার বিপুল আয়োজন। গোপীবল্লভ এসব বিষয়ে খুব সচেতন। ভদ্রতার কমতি নেই।
কিন্তু মনে মনে গোপীবল্লভের ঘুরছে, সংস্কৃতে এম এ, রাজশাহীতে পড়ছে
একটি ছেলে, সৎ আর ভবিষ্যতের তরুণ অধ্যাপক।
কি ভাগ্য হবে তার মেয়ের এমন জীবনসাথী পেলে!
কন্যা দেখা সুসম্পন্ন হলো। পাত্রপক্ষ পারলে আজই দিনক্ষণ ঠিক করে
যায়।
গোপীবল্লভ হঠাৎ বললেন, মেয়ে তো মাত্রই ইন্টার মিডিয়েট দিলো, রেজাল্ট
বেরোবার পর ভাবা যাবে। তিনি নিজেই যোগাযোগ করবেন।
একটু বিনীত হয়েই বললেন, যদিও বিনয় তার পোষায় না একদম।
মায়ারাণী ইন্টারমিডিয়েট পাশ করলো। দিন প্রবাহিত হতে লাগলো। আপাতত
মায়ার আর কোন পড়াশোনার কথা ভাবছেন না গোপীবল্লভ। তবে খুব অন্যমনস্ক তিনি। শরীরটাও জানান দিচ্ছে, অতিরিক্ত পরিশ্রম হয়ে
গেছে, কিছু বিশ্রামের দরকার এখন। আজকাল দূর গ্রামে যান না খুব একটা আর। বাড়িতেই বেশি রোগী দেখেন। দেশের অবস্থা
ভালো নয়। গ্রামে গ্রামে হিন্দু মুসলমানে বিরোধ শুরু হয়েছে।
মাঝেমাঝেই একে অপরের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া, মারামারি, এক দুটো
খুন, এসব শোনা যায়। অশনি সংকেত। আগুন জমছে
দেশের ভেতর।
প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে খবর আসে, হিন্দুর বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে বাড়িছাড়া
করছে মুসলমানরা। বর্ডার পেরিয়ে বহু মানুষ এর মধ্যেই ভারতে যেতে শুরু করেছেন চোরাপথে।
কেউ কেউ অল্পদামে ভিটেমাটি বিক্রি করে দিয়ে নগদ টাকা, সোনাদানা নিয়ে ভারতে চলে যাচ্ছে।
ছেলেদের পড়াশোনার অজুহাতে পাঠিয়ে দিয়ে বা মেয়ে থাকলে ওদেশে বিয়ে দিয়ে একটু জোর বাড়াতে
চাইছেন নিজেদের।
ডিসপেনসারির চেয়ারে বসে একমনে ভাবছিলেন তিনি। কি করবেন মেয়েকে,
বরিশালে পাঠাবেন বিয়ে দিয়ে?
চন্দ্রদ্বীপ, কীর্তনখোলার অববাহিকা, ধনেজনে পরিপুষ্ট একটি পরিবার।
সেই পরিবারের বড় বধূ হবে তার প্রাণপ্রিয়া কন্যাটি। বেশী দূর নয়, তিনি আসতে যেতে দেখতে
পারবেন। মেয়েকেও
আনানো যাবে, ইচ্ছে হলে।
বিকেল ঘনিয়ে সন্ধ্যা নামছে। সামনে পেছনে দুটো পুকুর, খোলা হাওয়া
বইছে। নাড়কেল গাছের পাতাগুলো দুলছে। উঠোনে লক্ষ্মীরাণী বিকেলের কাজ গুছিয়ে রাখছে। পাকঘরে
রান্না বসিয়েছে। কানাইকে নানা আদেশ দিচ্ছে। তুলসীতলা ধুয়ে মুছে সন্ধ্যাবাতির আয়োজন
হচ্ছে। ছোট ছেলেমেয়েগুলো খেলছে উঠোনে। মায়া দোতালার বারান্দায় বসে কি একটা সেলাই করছে।
এখান থেকে একটা পাশ দেখা যাচ্ছে, কানের পাশে দু একটি চুল। মীরা, বিজন জোরে জোরে পড়ছে,
আগামীতে তারা ইন্টারমিডিয়েট দেবে। কি সুন্দর পরিপূর্ণ একটি ছবি। কিন্তু মায়া চলে যাবে
কয়েকদিন পর এই পূর্ণাঙ্গ ছবিটি থেকে। ভাবলেই ওনার মনে এক গভীর বিষাদ বাসা বাঁধে। তার
জেদী মেয়েটি কি সুখী হবে বরের সঙ্গে?
সাবিনার সঙ্গে আলাপ করতে হবে, কাকে নেবেন আদরের মেয়ের জামাই করে।
লক্ষ্মীর মতামতও দরকার।
শুধু যার মতামত সবচেয়ে বেশি দরকার তার কথা ভাবলেন না একবারও।
সাবিনা একবাক্যে বলল, এম এ পাশ পাত্রের সঙ্গে বিয়া দাও, পড়াশোনার গরিমা আলাদা। লক্ষ্মীরাণীরও তাই মত।
মায়ার ব্যবসাদার পাত্রকেও মনে ধরেছিল। তবে ওরকম ঝক্কি ঝামেলার
সংসার কি সে সামলাতে পারবে? জানে না, কিছুই বুঝতে পারছে না।
গহনার দোকান থেকে খবর এসেছে, গহনা প্রস্তুত। নগদ টাকা নিয়ে গোপীবল্লভ চললেন গহনা আনতে। লক্ষ্মীরাণী বললেন, কানাইলালকে নাও সঙ্গে। না, ও বাড়িতে থাক। আমার ফিরতে ফিরতে রাত হবে।
তবে কি, ছেলেরা মেয়েরা তো এখন বড় হইছে।
আমি একাই যাবো।
অলঙ্কার খুব বেশি নয়, আবার সামান্যও নয়। ব্যাগে ভরে, টাকা মিটিয়ে,
ভাবলেন গঞ্জের বাজারে একবার ঢুঁ দিই।
কুপির আলোয় অজস্র ইলিশ বাজারে। ডিমভরা পাকা ইলিশ যাকে বলে। জোড়া
ইলিশ কিনলেন।
নাহ্ এবার বাড়ি ফেরা যাক।
হেঁটেই ফিরতে হবে। গঞ্জ বাজারের আলো ছাড়িয়ে নির্জন গ্রামপথে প্রবেশ
করলেন। অমাবস্যা ঘনিয়ে এসেছে। অন্ধকার খুব বেশি লাগছে। রাস্তার দুপাশে বড় বড় খেজুর
গাছ, জংলি গাছ, ঝোপঝাড়, দিগন্ত জুড়ে জোনাক বাতি জ্বলছে আর নিভছে। কুবো পাখির ডাক।
ভয়ানক নির্জন লাগছে সব। অন্যদিন পথচারীরা থাকে, গাঁয়ের লোকজন।
তিনি বেশি পাত্তা দেন না, তারাই গাঁয়ে পরে নানান কথা কয়।
বেশিরভাগই রোগশোকের কথাবার্তা। ক্লান্ত দেহে তার আর ভালো লাগে
না সেসব।
আজ এইসমস্ত অবাঞ্ছিত লোকদের অভাবই বেশি অনুভব করছেন।
পেছনে যেন কার পায়ের শব্দ। তাকালেন। না তো কেউ নেই। আবার শব্দ।
আবারো ভালো করে তিন ব্যাটারির টর্চ মারলেন চারদিকে, নাহ্ কোথাও কেউ নেই।
এইরকম চার পাঁচবার হবার পর, সাহসী গোপীবল্লভ ঘামতে লাগলেন। ভয়
হলো। হঠাৎ মনে হলো, হাতের ইলিশগুলো নড়ে উঠল। মরা ইলিশ নড়ে কেন্?
থমকে দাঁড়ালেন। একমুহূর্তের চিন্তা। তারপর হাতের ইলিশদুটো ছুঁড়ে
ফেলে দিলেন পেছনে। আর তাকালেন না ফিরে। হনহন করে হাঁটতে লাগলেন। নাহ্ আর কোন উপদ্রব
হলো না। নিরাপদেই বাড়ি পৌঁছলেন।
ল্যাম্পের আলোয় তিনি আর লক্ষ্মীরাণী মনোযোগ দিয়ে অলঙ্কার দেখলেন।
মায়ারাণী সহ সমস্ত ছেলেমেয়েরা তখন ঘুমে।
গোপীবল্লভের চোখের কোণদুটো বার বার ভিজে উঠতে লাগল। লক্ষ্মীরাণী
সযতনে লাল ভেলভেট দিয়ে মুড়ে সিন্দুকের গোপন ঘরে তুলে রাখলেন।
সিন্দুকের তিন দরজা। এখানেই রাখছেন বিবাহের সামগ্রী, কাঁসারির
কাছ থেকে কেনা বাসন কোসন। ভালো শাড়ি। বিছানাপত্র। বাকি সব নগদে দেবেন। বরিশাল থেকে
কুমিল্লা বহু দূরে। জিনিসপত্র নিয়ে যাওয়াটাই সমস্যা। এটাই কারণ।
গোপীবল্লভ ভাবছেন, আগামী পরশুই কুমিল্লা যাবেন। ছেলেটির ঠিকানা জোগাড় করেছেন, খোঁজখবর নিয়েছেন, যেতে হবে চাঁদপুর, মদনের গাঁও, পদ্মা পেরিয়ে। এই ছেলেটিই হবে তার মেয়ের জামাই। ঠিক করে ফেলেছেন মনে মনে।
ছেলের বাড়ি মাটির ঘর। বাবা টোলের পণ্ডিত। ছেলেরা দুইভাই, দুইবোন। বোনদের বিবাহ হয়েছে। একজন ইতিমধ্যেই ভারতের নবদ্বীপ অঞ্চলের বাসিন্দা। ভাইটি ছোট। এখনও পড়ে।
ছেলে কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজে সংস্কৃতের অধ্যাপক হিসেবে যোগদান
করেছে। রাজশাহি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংস্কৃতে প্রথমবিভাগে প্রথম হয়েছে সে। রাধাগোবিন্দ
মজুমদার তার নাম।
খাওয়া দাওয়া অতি সাধারণ। চারদিকে সুস্পষ্ট দৈন্য। তথাপি তিনি আর
কিছু চিন্তা করতে পারছিলেন না।
সবাইকে মেয়ে দেখার আমন্ত্রণ এবং দিনক্ষণ ঠিক করার ব্যাপারে ভাবতে
বলে গোপীবল্লভ চলে এলেন।
মেয়ে দেখার কিছু নেই। পছন্দ তো হবেই।
তবুও অধ্যাপক পাত্র মায়ারাণীকে ইংরেজী বানান জিজ্ঞেস করলেন, টেনস
ইত্যাদি। এই নিয়ে ভাইবোন মহলে তুমুল হাসাহাসি হল, অবশ্যই গোপীবল্লভের পশ্চাতে।
ভুড়িভোজ শেষে, দিন ঠিক হলো আষাঢ়ে। বৈশাখে ছেলের জন্মমাস। জৈষ্ঠ্যে
জ্যেষ্ঠা পুত্র, জেষ্ঠ্যা কন্যা নৈব চ, নৈব চ।
পাত্র বরযাত্রী এবং অভিভাবক নিয়ে তিনদিন আগে আসবে এবং এখানেই অবস্থান
করবে। ঝড়জলের দিন। মেঘনা ও পদ্মা দুটোই ফুঁসছে, আর ছোট নদীগুলোই কি কম নাকি?
শেষে যদি কন্যা লগ্নভ্রষ্টা হয়! কোনো অবস্থাতেই গোপীবল্লভ দুর্ঘটনা
হতে দেবেন না।
বিয়ের দিন ঘনিয়ে এলো। সেদিন বারো আষাঢ়।
তিনদিন আগেই বরপক্ষ এসে গেছে।
নীচে ডাক্তারখানার সঙ্গে দুখানা বড় বড় ঘরে সকলের থাকার ব্যবস্থা
হয়েছে। প্রায় সকলেই পুরুষ, এরমধ্যে পাত্র, পাত্রের বাবা, ভাই, কাকা, জ্যাঠা রয়েছেন।
দুজন মহিলা। তাদেরকে উপরে মেয়েদের সঙ্গে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বৃষ্টির জন্য বড়ই ব্যাঘাত হচ্ছে বার বার। নীচের উঠোনে কুঞ্জ। পাশের বাগান পরিষ্কার করে লোক খাওয়ানোর মন্ডপ।
ডাক্তারবাবুর মেয়ে বলে কথা। নিমন্ত্রণে বিনা নিমন্ত্রণে বহু লোক
এসেছেন। সরু চালের ভাত। রুইমাছের মাথা দিয়ে মুগডাল। কারিগরদের তৈরি ছানা দিয়ে ছানার
কোপ্তা। কাতলের কালিয়া। ইলিশমাছের ডিম দিয়ে তরকারি। ইলিশ ভাপা। পাকা আমের চাটনি। শেষপাতে
মিষ্টান্ন, সন্দেশ, লুচি।
সবশেষে আঁচানোর পর পান সুপুরি।
গাঁয়ে গঞ্জে হিন্দু বাড়িতে তখনো মাংসের চল হয়নি।
মায়ারাণীর কপালে চন্দনের আলপনা। পায়ে আলতা। লাল কুমকুমের ফোঁটা।
খোঁপায় খইের মালা। সোনার গহনা। লাল বেনারসি। মাথায় দীর্ঘ ঘোমটা। তাকে সাজিয়ে দিয়েছেন
মদনমোহনের আখড়ার বৈষ্ণবী। বহুদিন পূর্বেই এই বৈষ্ণবী বলেছিলেন তিনি মায়াকে বধূসাজে
সাজাবেন।
আজ তার সেই ইচ্ছে পূরণ হলো। হয়তো তার নিজের জীবনের শখ মায়ারাণীকে
সাজিয়ে পূর্ণ করলেন।
আখড়ার বৈষ্ণব বৈষ্ণবীরা স্বপাকে অথবা ভোগ খায়, তাই আগেরদিনই আতপ
চাল, মুগডাল, মশলাপাতি, তাজা সব্জি, ফল, দুধ,
দধি, ঘি, মিষ্টি গোপীবল্লভ স্বয়ং মদনমোহনের নামে রেখে এসেছেন। পূজারী গোঁসাই
মেয়েজামাই এর নামে ভোগ দেবেন, প্রসাদ খাবেন আখড়ার সবাই।
তিনি মনে প্রাণে ভক্ত নন, তবে মায়ারাণীর মঙ্গলের জন্য সব পারেন।
রাত্রি তিনটা নাগাদ কন্যাদান সমাপ্ত হলো। মায়ারাণী গোত্রান্তরিতা
হলেন। বৃষ্টিও তখন ধরে এসেছে। পরের দিন ঝকঝকে রোদ উঠল।
সূর্য প্রণাম, বাসী বিবাহ সমস্তই একে একে শেষ হলো। এবার বিদায়ের
পালা।
গোপীবল্লভ বড়ই ভেঙে পড়লেন। কন্যাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, মনে রেখো
মা, “সুখে দুখে স্বামী সব”। তুমিই তাকে আলো দেখিয়ে নিয়ে যাবে সারাজীবন। মায়ারাণীর চোখের জল কিছুতেই বাঁধ মানছে না। উনিশ
বছরের এই পরিচিত, সুখী জীবন ছেড়ে সম্পূর্ণ অপরিচিত এক তরুণের সঙ্গে সে কোথায় যাচ্ছে,
জানে না।
প্রিয় ভাইবোনেরা, মা, বাবা কাউকেই সে আর দেখতে পারবে না হয়ত বহুদিন।
শুনেছে পদ্মা পেরিয়ে যেতে হয়, চাঁদপুর, মদনের গাঁও। তবে শীঘ্রই
বর, তাকে নিজস্ব কর্মস্থল কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের কোয়ার্টারে নিয়ে আসবে। বড় দাদাভাই
বহু কচলিয়ে এই কথা মুখচোরা গম্ভীর অধ্যাপকের পেট থেকে বের করে, মায়ারাণীর আসন্ন মদনের
গাঁ জনিত কান্না কমানোর চেষ্টা করেছে। এই খবরটিই মায়ার মনে আনন্দের একমাত্র ক্ষীণ ধারা
হয়ে জেগে রইল। আহা, স্বামীর সঙ্গে একান্তে বসবাস। ক্ষুদ্র একখানা সংসার। বরিশালের সেই
ব্যবসায়ী পরিবারের মতো হাঁপ ধরা নয়। নিজের মতো করে দুটো রান্নাবান্না করা, ঘর গোছানো,
সে খুব পারবে। মা লক্ষ্মীরানী অতি সুন্দর হস্তাক্ষরে
কয়েকটি প্রধান প্রধান রান্নার পদের পদ্ধতি লিখে গোপনে মায়ারাণীকে সমর্পন করেছেন। যদিও
রসিক, বড় ছেলে, মাকে বলেছে, ছেলেটি বড়ই পেটরোগা। আমাদের মত খাওয়ার অভ্যেস নেই। চেহারা
দেখে তো মনে হয় বঙ্গদেশের পেটের অসুখের উজ্জ্বল প্রতিনিধিকেই বাবা খুঁজে খুঁজে ধরে
এনেছেন। লক্ষ্মীরাণী এই মারেন তো সেই মারেন। মায়ার মুখ আরো শুকিয়ে যায়।
দুই শালী একটু বড়ো, বাকিরা নিতান্তই ছোট। তার মধ্যে বড় শালী মীরা
সামান্য কথাবার্তা চালাবার চেষ্টা করেছিল বটে তবে গোপীবল্লভের কড়া ধমক, কোন তামাসা
করা চলবে না, এতে ভাবি জামাইবাবুকে তিনদিন ধরে হাতের কাছে পেয়েও কোনরূপ রসালাপ করা
গেলো না। সবই পরবর্তী কালের জন্য তুলে রাখতে হলো।
লঞ্চ, স্টীমার এবং হাঁটাপথ অতিক্রম করে মায়ারাণী পতিগৃহে পৌঁছুলেন। এই প্রথম পদ্মানদী দেখলেন। রাস্তায় তিনি ছিলেন বড়ই চুপচাপ। ছোটবোন শিপ্রা এসেছে সঙ্গে। দুদিন পর বড় দাদা এসে শিপ্রাকে নিয়ে যাবে।
অতি সাধারণভাবে বধূবরণ করে নববধূকে ঘরে তুললেন শাশুড়ি মনমোহিনী
দেবী। গ্রামের লোক দেখতে আসছে তাকে। সকলেই অমন গায়ের রঙ আর মসৃণতায় মুগ্ধ। একখানি বধূ
বলল, ও মা! এ যে দেখছি ননীর শরীর, কামকাজ করবো
নি।
একজন অতি বৃদ্ধা মহিলাকে ধরে ধরে নিয়ে আসলেন এক গ্রাম্যবধূ। ইনি
দূরসম্পর্কের আত্মীয়া। সম্পর্কে প্রপৌত্রবধূ হোন মায়ারাণী। একটি সোনার আংটি দিয়ে মুখ
দেখলেন।
হঠাৎ করে এই দরিদ্র অজ পাড়াগাঁয়ে সোনার আংটি উপহার পেয়ে মায়া খুব
অবাক হলেন।
পরদিন, উঠোন ঝাঁট, কলসী দিয়ে পুকুর থেকে জল আনা, ইত্যাদি নানা কাজের সূচনা তাকে দিয়ে করিয়ে আজীবন সংসারে ঢুকিয়ে দেওয়ার সমস্ত নিয়মকানুন পালিত হলো। মায়া আরেকজনের সাহায্যে অতি কষ্টে জল ভরা কলসী কাঁখে নিয়েছিলেন, বস্তুত ভারী কলস দিয়ে জল আনার অভিজ্ঞতা তার ছিল না, তবে তিনি শিখে নিলেন সেদিন।
চতুর্থ মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান ততটা আড়ম্বর না হলেও মোটামুটি ভালোভাবেই
সম্পন্ন হলো।
সেই অতিবৃদ্ধা বিদায় নেবার সময়, মায়ারাণীর কাছে এসে মুখদেখার সময়
দেওয়া আংটিটি ফেরত চাইলেন। মায়ারাণী বড়ই বিস্মিত হলেন এবং তাড়াতাড়ি সেই আংটি ওনার হাতে
তুলে দিলেন। বৃদ্ধা লাঠি ঠকঠক করতে করতে চলে গেলেন। পরে শুনেছিলেন, গ্রামে এই রীতি চালু আছে। সোনা দিয়ে
মুখ দেখতে হয়, তাই বলে দেওয়ার ক্ষমতা কই? সেজন্য
একটিই আংটি দিয়ে বহু নববধূর মুখ দর্শন হয়।
মায়ারাণী দু একদিনেই বুঝলেন, এ সংসারে রুচির অভাব। আলগা সব। কোনমতে সংসার চলছে এবং শাশুড়িমাতা অলসপ্রকৃতির। তাকেই হাল ধরতে হবে এবং বাধা দেবার ইচ্ছাও কারো নেই।
যে ভদ্রলোকটির সঙ্গে তার বিবাহ হয়েছে, তার সঙ্গে ঝগড়া বিবাদ করা
যাবে, রাগ দেখানো যাবে, তথাপি মায়াকে সে আগলে রাগবে। একবিন্দুও চালাকি নাই তার মধ্যে।
কর্তব্যপরায়ণ, কিন্তু কর্তৃত্বপরায়ণ নয়। দারিদ্র্যের কাছে অসহায় হয়ে আছে।
তবে দাদার কথাই ঠিক। পেটের অসুখে ভোগা রোগী। অর্থাভাবে খুবই অল্প
টাকায় রামলালা ছাত্রনিবাসে থেকে নিজে টিউশনি করে পড়াশোনা করতে হয়েছে। মোটা চালের ভাত,
খেসারির ডাল আর কুমরোর ঘ্যাঁটই ছিল দিনের পর দিন খাদ্য। এসব খেয়ে খেয়েই সেই যে পেটের
অসুখে ধরেছে, বোধহয় সারা জীবনই মায়ারাণীকে সামলে চলতে হবে।
কিছুদিন কাটলো একপ্রকার। স্বামীর ছুটি শেষ। মায়ারাণীকে কয়েকদিনের
জন্য বরিশাল পাঠানো হবে, সেখান থেকে কুমিল্লার কোয়ার্টার।
বিবাহের পর এই প্রথমবারের মতো বাবার বাড়ি যাওয়া, স্বামীর সঙ্গে। ভাই বোনেরা মুখিয়ে আছে জামাইবাবুর সঙ্গে রঙ্গ রসিকতা করার জন্য। তাদের পরিকল্পনার অন্ত নেই। কেউ দোতলা থেকে মাথার ওপর জল ঢেলে দেয়, কেউ জুতো লুকোয়, দাদারা কথায় কথায় ঠাট্টা করবার বিন্দুমাত্র অবকাশ ছাড়ে না। সুরসিকা সুন্দরী, মেধাবী বড়শালি মীরা নানা প্রকারে দাদাবাবুকে হাসানোর চেষ্টা করছে। বেরসিক সংস্কৃতের গম্ভীর অধ্যাপক বড়ই মুশকিলে পড়লেন। তিনি পালাতে পারলে বাঁচেন।
আহারে বসে বিপুল আয়োজনে আরো সংকুচিত হয়ে অতি অল্প খেলেন। প্রচুর
আদরযত্ন, আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে নেমতন্ন ইত্যাদি সমাপ্তি করে মায়ারাণী সেবারের মতো পিতৃগৃহ
থেকে স্বামীর সঙ্গে কুমিল্লা যাত্রা করল সম্পূর্ণ একা। সাদা রঙের ছোট কোয়ার্টার, দুখানা ঘর,
একটি রান্নাঘর, টানা বারান্দা, পেছনে স্নানের ঘর, শৌচালয়। সামনে একটি ছোট্ট উঠোন। পাশাপাশি
কয়েকটি কোয়ার্টারে আরো কয়েকজন অধ্যাপক থাকেন পরিবার নিয়ে। এখানেই মায়ারাণীর প্রথম নিজস্ব সংসার।
রায় বাহাদুর আনন্দচন্দ্র রায় ১৮৯৯ সালে মহারাণী ভিক্টোরিয়ার নামে এই কলেজটি বহু ব্যয়ে প্রতিষ্ঠা করেন। কলেজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট তাকে রায় বাহাদুর উপাধি দিয়েছিল। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত এই কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। চাকরি জীবনের শুরুতেই এরকম একটি প্রতিষ্ঠিত কলেজে পড়ানোর সু্যোগ পেয়ে খুব আনন্দিত।
মায়ারাণী সংসার পাতলেন। কিন্তু বুঝলেন এই পেটরোগা স্বামীকে দীর্ঘজীবী
করতে হলে তাকে পথ বের করতে হবে। অতএব পোলাও কোর্মা ইত্যাদি খাবারের পদ্ধতি লিখিত খাতাটি
ট্রাঙ্কে অন্যান্য বাসনের সঙ্গে পড়ে রইল। সারাজীবনে কখনো এই খাতাটির প্রয়োজন মায়ার পড়ে নাই, তিনি তার সংসারে আসলেই কি
কখনো সত্যিকারের জর্দা পোলাও, মাছের কালিয়া, রেওয়াজি পাঁঠার মাংস, কোর্মা, ভুনা খিচুরি
ইত্যাদি রাঁধবার অবকাশ পেয়েছিলেন?
রাধাগোবিন্দ শৈশব থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কোনোদিন মাংস চেখেও দেখেননি। মায়ারাণী কম তেল মশলায় তাজা মাছের হালকা ঝোল করে স্বামীকে খাওয়াতে শুরু করলেন। বস্তুত তার স্বামী দীর্ঘজীবীই হয়েছিলেন, সারাজীবনের প্রায় পুরোটাই পত্নীর তত্ত্বাবধানে থাকলেও তার চাইতে সাত বছরের ছোট মায়াই আগে ইহলোক ত্যাগ করেছিলেন, পরের বছর তিনি। একটি অম্লমধুর দাম্পত্য তারা যাপন করে গিয়েছিলেন।
যুবক অবস্থায়, বিশেষ করে কুমিল্লার কোয়ার্টারে বসবাস করার সময় তিনিও মায়ারাণী সম্বন্ধে খুব সচেতন ছিলেন। কলেজের বহু ছাত্রই অধ্যাপকের চেয়ে বয়সে বড় এবং অনেকেই বিবাহিত ছিল। তারা ঠারে ঠোরে মায়াকে দেখবার চেষ্টা করতো। তীক্ষ্ণ শিস্ দিত। তিনি খুব বিরক্ত হতেন, হাতের কাছে পেলে ধমকেও দিতেন, তার সুন্দরী বধূ বলে কথা।
রাধাগোবিন্দের মন বড়ো বিচলিত, কয়েকদিন ধরে। গ্রামাঞ্চলে দাঙ্গার খবর আসছে। হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা, গ্রামের পর গ্রাম আল্লাহ্ ওয়াকবরের নামে হিন্দুদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। হিন্দু মেয়ে, বৌদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করা হচ্ছে। তখন সাল ১৯৬৩।
কলেজে তখন ভারতের পত্রিকা আসত। এমনই একটি পত্রিকায় তার চোখে পড়ে একটি বিজ্ঞাপন। ত্রিপুরার কৈলাসহর নামক একটি জায়গায় রামকৃষ্ণ মিশনের উদ্যোগে একটি কলেজ খোলা হয়েছে। তারা সংস্কৃতের অধ্যাপক চেয়েছেন। বেতন দেড়শত টাকা। থাকার জন্য কোয়ার্টার দেওয়া হবে। আগ্রহী ব্যক্তিরা তাদের সম্পূর্ণ বায়োডাটা পাঠাতে পারেন। মনোনীত হলে জানানো হবে টেলিগ্রাম করে।
রাধাগোবিন্দ সুন্দর হস্তাক্ষরে সম্পূর্ণ বায়োডাটা সেই সঙ্গে ফরোয়ার্ডিং
লেটার লিখে আবেদন করলেন। নিজের এবং স্ত্রীর পাসপোর্ট তৈরি করার কাজে মন দিলেন।
তিনি বুঝতে পারলেন বঙ্গদেশ আর তাদের নয়। প্রথমে নিজে থিতু হলে
সামনের বছর নাগাদ মাতা পিতা এবং ছোট ভাইকেও নিয়ে যাবেন। ওকে ওখানেই পড়াবেন না হয়।
উত্তর আসবে এবং মনোনীত হবেন এ তার জানাই ছিল যেন।
মায়ারাণীর বাবা এলেন কুমিল্লায়, প্রথম মেয়ের সংসারে, সেই মেয়ে
চলে যাবে অন্যদেশে, যেখানে ইচ্ছে করলেই যাওয়া যায় না। আর কি আসতে পারবে! বাবাকে প্রাণের সুখে রান্না করে খাওয়ালেন মায়া। মনে হচ্ছিল
আঁকড়ে ধরে রাখে, কিন্তু সে কি সম্ভব!
গোপীবল্লভ মেয়েকে কিছু টাকা দিলেন যাবার সময়। আরেক দেশে গিয়ে সংসার
পাতবে, জিনিসপত্র কিনতে হবে, খাট, আলনা, আলমারি ইত্যাদি। বর্ডার দিয়ে তো বোধহয় কিছুই
নিতে দেবে না!
গোপীবল্লভ শর্মা চলে যাচ্ছেন, কুমিল্লার কোয়ার্টারের গেইটে মায়ারাণী
ততক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন যতক্ষণ না পর্যন্ত বাবাকে আর দেখা না যায়। তার দুচোখ জলে ভেসে
যাচ্ছিল। এই ছিল বাবার সঙ্গে মায়ারাণীর শেষ সাক্ষাৎ।
বাঁধাছাঁদা শেষ হলো। গতকাল শ্বশুরমশাই আর দেওর রাধেশ্যাম এসে দেখা করে গেছে। তিনখানা বড় বড় ট্রাঙ্কে বিবাহে প্রাপ্ত উপহারসামগ্রী, শাড়ি কাপড়, কাঁসার বাসনকোসন আর হাতের ছোটব্যাগে নিজের অলঙ্কার আর নগদ টাকা। রাধাগোবিন্দ একট্রাঙ্ক ভর্তি নিজের বইপত্র, সামান্য কিছু জামাকাপড় ইত্যাদি নিলেন, ব্যস।
কুমিল্লা একসময় ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যেরই অংশ ছিল। ১৭৩৩ সালে বাংলার নবাব সুজাউদ্দীন খাঁ ত্রিপুরা আক্রমণ করে এর সমতল অঞ্চলকে সুবে বাংলার অন্তর্ভুক্ত করেন, ১৭৬৪ সালে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কুমিল্লা দখল করে, তার আগেই নোয়াখালী জেলা কুমিল্লা থেকে পৃথক হয়ে গিয়েছিল। ১৭৯০ সালে কোম্পানির শাসনের সময় ত্রিপুরা নামক জেলার সৃষ্টি।
তখন সাল ১৯৬৪, রাধাগোবিন্দ ও মায়ারানী তাদের সামান্য অস্থাবর জিনিসপত্র ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে চেকপোস্টে এলেন। সমস্ত কিছু চেকিং শুরু হলো। মূল্যবান বাসনপত্র এবং গহনার একটি বিরাট অংশই চেকপোস্টের অফিসাররা নিজেদের কাছে বিনা বাক্যব্যয়ে রেখে দিলেন। মায়ারাণীর চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল পড়ছিল, তার বাপমায়ের দেওয়া শেষ চিহ্ন সমূহ।
অবশেষে তারা সীমান্ত অতিক্রম করার অনুমতি পেলেন। তখন দ্বিপ্রহর।
প্রখর সূর্য আকাশে। ভিটেমাটিহীন কুড়ি বছরের এক তরুণী বধূ আর সাতাশ বছরের এক যুবক অধ্যাপক,
দেড়শত টাকা বেতনের একটি চাকরিকে ভরসা করে সম্পূর্ণ অপরিচিত জায়গায় চলেছেন। বাকি জীবন তারা সেখানেই কাটাবেন হয়তো।
কোথায় রইল মায়ারাণীর সেই ভোলার দোতলা বাড়ি, উঠোন, পুকুর, স্নেহময় পিতা, প্রিয় ভাইবোনেরা! ঝাপসা চোখে মায়ারাণী দেখছিলেন, বেতুয়া খালের ওপর দিয়ে মেঘনা থেকে আসা সুবাতাস বইছে, লক্ষ্মীরাণী নীচের উঠোনে পাকঘরের কাজ শেষ করে গাছপালার পরিচর্যা করছেন, সাবিনা পিসী বারান্দায় বসে পান খাওয়া লাল টুসটুসে ঠোঁটে গাঁয়ের গল্প খুলে বসেছেন, উপরের ঘরে ছোটভাই স্বপন ইন্টারমিডিয়েটের পড়া মুখস্থ করছে, মীরা স্নান শেষে চুল খুলে বারান্দায় বসে আছে, তার ফর্সা পায়ে রোদ পড়েছে, হাতে একখানি বই, পূরবী। শিখা, শিপ্রা, বংশী, পিন্টু, দীপক, মনু সবগুলো ছোট ভাইবোন খেলায় মত্ত, চিৎকারে টেঁকা দায়, পালা করে এক একটি ভাই বোন নজর রাখছে, বাবার ছাতাখানি দূর থেকে দেখামাত্র তারা সকলে চুপ হয়ে যাবে, সবার তখন পড়ার খুব ধুম।
আর গোপীবল্লভ ডাক্তারি সেরে বাড়ির পথ ধরেছেন, তার তামাটে কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, দৃষ্টি সূদূরে...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন