বুধবার, ১৪ জুলাই, ২০২১

তথাগত চট্টোপাধ্যায়

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ৯৮



বই


প্ল্যাটফর্মের পুরনো বইয়ের দোকানে অনেকদিন বাদে এল সন্দীপ। দু’নম্বর প্ল্যাটফর্মের সামনের দিকে একটা চায়ের দোকানের পাশেই।

ট্রেন আসতে এখনও অনেক দেরী। আগের ট্রেন অল্পের জন্য হাতছাড়া হয়েছে তার। পরের গাড়ি আসার আগে এখনও মিনিট দশেকের মত সময় হাতে আছে।  দুপুরবেলা দু’নম্বর প্ল্যাটফর্মের সামনের দিকে চড়া রোদ এসে পড়ে। ছাতা ছাড়া দাঁড়ানোই যায় না। মাথার ওপর শেড নেই। কিন্তু এখন বিকেলের মরা রোদের তেজ নেই তেমন। সন্দীপ স্বচ্ছন্দে দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল।

দোকান জুড়ে পুরনো বইয়ের জগৎ। সন্দীপ বই ঘাঁটতে থাকে। কাঠের তাকে হরেক কিসিমের ম্যাগাজিন এবং বাংলা ইংরেজি বইয়ের সম্ভার। একটা একটা করে বই দেখতে দেখতে সন্দীপের চোখ আটকে যায় একটি বইয়ের দিকে। কোথায় যেন দেখেছিল সে এই বইটা? সামনে ঝুঁকে হাত বাড়িয়ে সন্দীপ টেনে আনে বইটা – ‘দিগন্তের আলো’। লেখক অনিমেষ মজুমদার।

বইয়ের প্রচ্ছদ বেশ ধূসর। মলাটের পাতলা বোর্ডের কোণাগুলিও সামান্য ছেঁড়া। প্রথম পাতা ওলটানোর পরই চমকে গেল সন্দীপ। নীল কালিতে কৌণিক অবস্থানে লেখা দু’লাইন।

        “প্রিয় সন্দীপ,

                প্রিয় ভালোবাসা”।

                        দেবলীনা

                                ২৮/০১/২০১৪

সন্দীপ চকিতে ফিরে যায় সাত বছর আগে। বইমেলায় সেদিন দেবলীনাকে পাশে নিয়ে সে খুব ঘুরছিল। দেবলীনা বলেছিল, আমি কিন্তু সব স্টলে ঢুকব সন্দীপ। তোমাকেও যেতে হবে।

সন্দীপ বলেছিল, যাঃ, তাই কি হয়? এত স্টল, এত মানুষের ভিড়! হাতে অত সময়ই বা কোথায়? একদিনে হবে না।

কথা বলতে বলতে ওরা পৌঁছে গেছিল লিটিল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়নে। কবি অনিমেষ মজুমদার সেদিন তাঁর কবিতা সংকলন ‘দিগন্তের আলো’ প্রকাশ করছেন। লিটিল ম্যাগাজিনে লেখা কবি। ক’জনই বা চেনেন। তবুও অনুষ্ঠানের জন্য একটা ছোট জমায়েত। অল্প কিছু কবিতা অনুরাগীদের ভিড়। দেবলীনা  সন্দীপের হাত ধরে প্রায় জোর করেই ঢুকে পড়েছিল সেই বৃত্তে।

সন্দীপ কবিতা পড়ে না। অনেকের মত তারও দুর্বোধ্য মনে হয় আধুনিক কবিতার ভাষা। বরং গল্পের দিকেই তার টান বেশী।

দেবলীনা জানত সে কথা। কিন্তু সদ্য প্রকাশিত ‘দিগন্তের আলো’ বইটি হঠাৎই কিনে উপহার দিয়েছিল সন্দীপকে। খস্‌ খস্‌ করে দু’কলম লিখেও দিয়েছিল সে।

-নেবেন বাবু বইটা? হাফ্‌ দামে দিয়ে দেব।  

স্তম্ভিত সন্দীপের সংবিৎ ফেরে। কিন্তু কিছুই বলে না। দোকানীর দিকে এক ঝলক তাকিয়ে আবার বইয়ের পাতা ওলটাতে থাকে। কমদামী কাগজে ছাপা। কেমন যেন বিবর্ণ হয়ে গেছে পাতাগুলো।

যেমন বিবর্ণ হয়ে গেছিল দেবলীনার সঙ্গে তার সম্পর্ক। অথচ সন্দীপ কিন্তু কোনও ত্রুটি রাখেনি সম্পর্ক মেরামতের।

সম্পর্ক ছিঁড়ে যাওয়ার পর প্রাক্তন প্রেমিকার কোনও স্মৃতিই আর বাড়িতে রাখেনি সন্দীপ। ‘দিগন্তের আলো’ বইটিও পুরনো খবরের কাগজের সঙ্গে বিক্রি করে দিয়েছিল একদিন।

প্ল্যাটফর্মে গমগমে গলায় ঘোষণা হচ্ছিল গাড়ি আসার খবর। তৎপর হয় সন্দীপ।  এবার গাড়ি মিস্‌ করলে বাড়ি পৌঁছতে অনেক দেরী হয়ে যাবে। দোকানের  লোকটি আবার বলল, নিয়ে নিন বাবু বইটা! কুড়ি টাকায় দিয়ে দেব।  

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন