বিবাহ ও বিবাহ বিচ্ছেদ : নারীর ভূমিকা
“My advice to you is to get married. If you find a good wife, you’ll be happy; if not, you’ll become a philosopher.”
—
Socrates
হিন্দু সনাতন ধর্মে ‘বিবাহ’ বলতে আমরা একজন পুরুষ ও একজন নারীর সামাজিক, শারীরিক ও মানসিক মেলবন্ধনকে বুঝি ৷ দুটি পরিবারের মধ্যে নতুন যোগসূত্র স্থাপন করে ‘বিবাহ’ নামক শব্দটি। একটি বিবাহকে টিকিয়ে রাখতে গেলে সবচেয়ে বেশি নারীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। প্রকৃতি নারীকে রূপ দিয়েছে সেভাবেই যাতে সুখ, দুঃখ, বিষাদ সকল জিনিসকে প্রতিরোধ করতে পারে অনায়াসে। এখানে নারী না-বলে মেয়ে বলি, কারণ কঠিন বাস্তবে দাঁড়িয়ে একজন মেয়েকে টিকিয়ে রাখতে হয় তার পরম প্রাপ্তির ‘বিবাহ’কে।
একটু প্রাচীনকাল নিয়ে আলোচনা করা যাক। যখন মেয়েরা স্বাধীন ছিল না কিংবা নিজেদের স্বাধীন বলে ভাবতে পারত না, তখন থেকে মেয়েদের লড়াইটা ছিল কঠিন বাস্তবের সাথে। যে সময় পুরুষরা নিজেদের শারীরিক ও মানসিক চাহিদার জন্য কোঠি বা নিষিদ্ধ পল্লীতে যেত, বহু চোখের জলের বিনিময়ে প্রাণপণ ভাবে নিজের স্বামীকে নিজের হস্তগত করে রাখতে হত। বিমল মিত্রের উপন্যাস ‘সাহেব বিবি গোলাম’ পড়লে বা সিনেমাটা দেখলে বুঝতে পারি মেয়েদের জীবনের কঠিন লড়াইয়ের কাহিনী।
ধীরে ধীরে সমাজের অগ্রগতি নারীর জীবনযাত্রায় অনেক পরিববর্তন এনেছে। যুদ্ধটা চারদেওয়াল ছেড়ে বাইরের রোদ্দুর দেখতে শুরু করেছে। ঘরে, বাইরে, সন্তান প্রতিপালনে সেই নারীকে সর্বংসহা হতে হয়। যে পরিচয়ে, বাবা-মা'র সাথে তার বেড়ে ওঠা, তাকে ছেড়ে এসে সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশে মানিয়ে তুলতে হয় একটা মেয়েকেই। একটি মেয়ে স্বপ্ন দেখে সুন্দর একটি পরিবারের। জন্মসূত্রে বা জিনগত ব্যাখ্যায় যার সাথে কোনো পরিচিতি নেই, তাকে কেন্দ্র করে শুরু হয় যাপনের দোলাচল। নিজে পছন্দ করে বিয়ে করলে আলাদা কথা। তবু নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে হয় তাকেই। টুকরো টুকরো ভালোবাসাকে জোড়া লাগিয়ে বড় ছাদকে জোড়া লাগানোর অদম্য চেষ্টা করে যেতে হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সফল হলেও অসফলতার পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে ক্রমশ। ঘূণধরা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অবিশ্বাস, অপরিচর্যা যখন বাসা বাঁধতে শুরু করে, একটু একটু শুরু হয় ছিদ্র গড়ে ওঠা। পরে সেই ছিদ্র দিয়ে বন্যার প্লাবন ভেঙেচুরে একাকার করে দেয়। একটু একটু করে বড় হওয়া গাছের রেচনক্রিয়া শুরু হয়।
বিচ্ছেদ শব্দটা তিন অক্ষরের হলেও ভাঙনের গানের মতোই লম্বা। একটি মেয়ের যে সংসার, পরিজনকে নিয়ে পথ চলা শুরু; সেই সংসার তাকে বিতাড়িত করে। ভেঙে চুরমার হয়ে যায় কল্পনার আতসকাঁচ। আর এই বিবাহবিচ্ছেদে সবথেকে যদি কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে, সে হল সন্তান। (যাদের সন্তান জন্মায়নি, তাদের ক্ষেত্রে বিষয়টা আলাদা।) বাবা-মা'র ছত্রছায়ায় যে সন্তানের বড় হওয়ার কথা, তাকে বেছে নিতে হয় যে-কোনো একটি হাত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই ভাঙনকে আটকানোর ক্ষমতা থাকে না। সংসার রক্ষা, সন্তান প্রতিপালন করা, তাকে সমস্ত প্রতিকূলতার থেকে রক্ষা করে এইসব করতে করতে চাপা পড়ে যায় একটি মেয়ের ব্যক্তিসত্ত্বা ।
“I didn’t marry you because you were perfect. I didn’t even marry you because I loved you. I married you because you gave me a promise. That promise made up for your faults. And the promise I gave you made up for mine. Two imperfect people got married and it was the promise that made the marriage. And when our children were growing up, it wasn’t a house that protected them; and it wasn’t our love that protected them – it was that promise.”
—
Thornton Wilder
যে বিবাহ একজন সন্তানকে সুরক্ষা দেয় সেই বিবাহের কারণে এক সন্তান অসামাজিক হয়ে ওঠে। আমাদের তথাকথিত সমাজে এই বিচ্ছেদের শতকরা ১০০ শতাংশ দায় বা দায়িত্ব দুটোই মেয়েদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। অথচ এ সমীকরণে তাদের বুকে যে রক্তক্ষরণ হয় তার খবর অনেকের জানা হয়ে ওঠে না। সমাজের ঊর্ধ্বস্তরে যারা আছে তারা অনেকই বলে থাকে মেয়েরা যত বেশি স্বাধীন হচ্ছে তত বেশি অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছে, যার প্রতিফলন ঘটছে পরিবারে। আসলে বিচ্ছেদ অতীতেও ছিল, বর্তমানেও আছে। এখন একটু বেড়েছে।
দিন, মাস, বছরের উপান্তে সময় ক্রমশ ছোট হয়ে যাচ্ছে। ছোট হচ্ছে চিন্তার পরিসর। ডিভোর্স শব্দের সাথে পরিচিতি বেড়েছে। কর্পোরেট কালচারে এসেও মেয়েরা নিরাপদ নয়। ডিভোর্সী একটি মেয়েকে একা থাকার মূল্য দিতে হয় প্রতিমুহূর্তে। তা অফিস হোক বা বাড়ির চার দেওয়াল হোক। প্রতি মুহূর্তে তাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো হয় সে অসহায়।
ডিভোর্স বা বিচ্ছেদ কেন হয়, তার গভীরে একটু ঢোকা দরকার। অনেক কারণে ডিভোর্স হয়ে থাকে৷
(১) স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মধ্যে বন্ধুত্ব থাকাটা খুব জরুরি।
“It is not a lack of love, but a lack of friendship that makes unhappy marriages.”
—
Friedrich Nietzsche
বন্ধুত্ব অর্থাৎ বোঝাপড়ার অভাবে ঘটছে সম্পর্কর মধ্যে ভাঙন।
(২) শ্রদ্ধা, সম্মান, আত্মবিশ্বাস থাকাটা জরুরি সম্পর্কের মধ্যে। এই ক্ষেত্রে নারীর থেকেও পুরুষের ভূমিকা বেশি বলে মনে করি।
(৩) অহংকার বা ইগো অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিবাহবিচ্ছেদের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
(৪) বাহ্যিক সৌন্দর্যের বশবর্তী হয়ে বহু মেয়ে বিয়ের পিঁড়িতে পা দিয়ে থাকে, যার পরিণতি বিচ্ছেদ।
(৫) ভবিষ্যতের আর্থিক সচ্ছলতার কথা ভেবে অনেক মেয়ে বিয়ের মতো কঠিন সিদ্বান্ত নিয়ে থাকে, যার পরিণতি হিসাবে পড়ে থাকে শুধুই হতাশা।
(৬) বর্তমানে প্রেমের বিয়ে প্রচুর পরিমাণে বেড়ে গেছে, যার বশবর্তী হয়ে বিচ্ছেদ হচ্ছে। আদালতের পরিসংখ্যান নিলে দেখা যাবে প্রতিদিন কী বিপুল পরিমাণে সংসার ভেঙে খানখান হচ্ছে।
(৭) সেক্স বা যৌন চাহিদা বিচ্ছেদের বড় কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে বর্তমানে। একটি মেয়ের সেক্স কম থাকলে বা সন্তান ধারণে অক্ষম হলে তাকে বিভিন্ন নির্যাতন (শারীরিক, মানসিক) সহ্য করতে হয়। কিন্তু একজন পুরুষ যদি অক্ষম হয়, সেই কথা বা তার চিত্র চিরকাল পর্দার আড়ালে চলে যায়।
তবে
বর্তমানে মেয়েদের ভূমিকা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। মেয়েরা সেই মধ্যযুগীয় পর্দাপ্রথা
ছেড়ে বেরিয়ে আসছে।
(৮) সবশেষে ভালোবাসা। যেটার প্রকৃত রূপ একজন নারীর থেকে আসে, সেটা থাকা খুব জরুরি। ভালোবাসার সংজ্ঞা ভীষণভাবে বদলে যাচ্ছে।
“Love is patient, love is kind. It does not envy, it does not boast, it is not proud. It is not rude, it is not self-seeking, it is not easily agered, it keeps no record of wrongs. Love does not delight in evil but rejoices with the truth. It always protects, always trusts, always hopes, always perseveres. Love never fails
একটা বিচ্ছেদ কিংবা একটা ভাঙনে শুধু যে কান্নার আওয়াজ আসে তা ঠিক নয়, চারিদিকে এটা এখন এক সামাজিক ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই বিচ্ছেদ নয় - গঠন, বিবর্তন আর আবর্তন দরকার এই সমাজের। নারীকে পণ্য না-ভেবে সৃষ্টির প্রধান কারিগর হিসেবে দেখতে শুরু করুক এ সমাজ। সমাজের সর্বোত্তম ক্ষেত্রে যোগ্যতার ভিত্তিতে স্থান পেয়েও আজও নারী অন্ধকার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে। সেই অন্ধকার কেটে যাক, সুস্থ সমাজ গড়ে উঠুক। সন্তান জন্ম নিক সঠিক পরিবেশে।
“This relationship is the vessel wherein is nurtured the life force of both individuals, whereby they create the future of the human race in body and thought.”
—
L. Ron Hubbard
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন