সমকালীন ছোটগল্প |
বাঘ
বেওয়াদের গল্প
উর্মিলা রানীর
স্বামীকে যে বাঘে খেয়েছে সে দোষ একান্তই তার। কি দোষ যেন করেছিল উর্মিলা? লোকে তো
বলে বাদায় একটা বেটা মানুষ কাঠ কাটতে, কি মউ কুড়াতে বা হিতাল গোলপাতা আনতে গিয়ে
মরলে সে দোষ সে বেটাছেলের না, তাকে মারল যে বাঘ তারও না বা বনের দেবী বনবিবি, তার
ছোটভাই শাহ জংলি বা দক্ষিণ রায় - কারোর না। দোষ বাওয়ালি ঘরের বউটার। যেমন? যেমন
বাড়ির পুরুষেরা যখন বাদায় যাবে, তখন ঘরে রন্ধন হবে সকালে আর রাতে। দিনের বেলা চুলা
জ্বালানো যাবে না, মাথায় কাঁকই দিয়ে চুল আঁচড়ানো যাবে না, গায়ে সাবান মাখা যাবে
না, ঘর ঝাঁট দেওয়া যাবে না, কাপড় ধোয়া যাবে না, হিন্দু ঘরের বউ হলে স্বামী যতদিন
বাদা থেকে না ফেরে, কপালে কি সিঁথিতে সিঁদুরও দেওয়া যাবে না।
উর্মিলা সব শর্তই মেনেছিল। সিঁথিতে সিঁদুর দেয়নি, গায়ে সাবান মাখেনি, ঘর ঝাঁট দেয়নি, চুল আঁচড়ায়নি — তবে তার কিনা বড় শুচিবায়ুর বাতিক! শেষ যেবার তার স্বামী পরেশ বিশ্বাস বাদায় গেল, আট দিনের মাথায় কেন জানি না উর্মিলা শাশুড়িকে লুকিয়ে ঘর আর উঠানটা একটু ঝাঁট দিয়ে ফেলল। শাশুড়ি গেছিল পাড়া বেড়াতে। তা, সেই সন্ধ্যাতেই খবর এলো স্বামীর লাশ বাদায় পড়ে আছে। এমনিতেই স্বামীর ছিল চান্দেশ্বর যাওয়ার বাতিক। অথচ এক জীবনে সবাই যে চান্দেশ্বর যেতে পারে না তা যদি পরেশ বিশ্বাস বুঝত! বড় ছেলেটা মাথায় লম্বা হওয়া শুরু হতেই প্রীতম বিশ্বাস গলায় তুলসির কণ্ঠী নিল আর কথায় কথায় সেই এক ঘোর!
‘ছেলেটা বড় হতিচে। এবার মা বনবিবি আমাকে দয়া করি চান্দেশ্বর তুলি নিলিই হয়! তা সে পুণ্যি কি করিচি?’
‘ঢঙের কথা শোন!
মেয়ে দুটো এখনো ছোট ছোট। ওদের বড় করতি, বিয়ি দিতি হবে না? না, উনি যাবেন চান্দেশ্বর!’
‘সত্যি সত্যি কি
চান্দেশ্বর যাওয়ার কপাল করিচি? যে বাওয়ালি জীবনে একটি অধর্ম করে না, মন্দ কাজ করে
না কি মিথ্যা কথা বলে না - বনবিবি তাকে দয়া করি তুলি নেন! বনের কোন গহনে সে তখন
হারিয়ে যায় আর কেউ হদিস পায় নাক! আমি দেখা যাবে বড় মামা এসে ঘাড় মটকাবে কি কামট
কামড় দিয়িছে!’
‘থামো দিকি যত
রাজ্যির বাজে কথা!’
সেই ছিল শেষ কথা। ছেলে প্রীতমের সঙ্গে এক দুপুরে গরম ভাত খেয়ে বের হয়েছিল পরেশ বিশ্বাস। ছেলেই দলের আর সবার সঙ্গে বাপের মড়া বয়ে নিয়ে এলো সন্ধ্যার খানিকটা পরে। আঠারো বছরের ছেলে বাপের মুখে আগুন দিয়ে পরের দিনই আবার বাদায় গেল। নইলে সংসারে সবার পেট চলবে কি করে? ছোট দুটো বোন আছে না? সে ছেলের বয়স এখন আঠাশ, বিয়ে করে ঘরে বউ এনেছে। মেয়ে দুটোরও বিয়ে হয়ে গেছে অন্য গ্রামে।
‘ভাতারখাগি- ঢলানে
মাগী- তুই যদি সিধা রাস্তায় থাকিবি তবে তোর সোয়ামিকে বড় মামার সাধ্যি আচে তুলে
নেয়? মাছ খাবার নোলা কেমন বেরোয়ে গেল দেখিলি?’
উর্মিলা রানীদের বাসা যেখানে শেষ সেখান থেকে মুসলমান পাড়ার শুরু। সখিনাকে তার শাশুড়ি শহর বানু বকছে। উর্মিলা রানীর তবু বয়স হয়েছে খানিকটা। সখিনার এমন কিছু বয়স নয়। তার কোনো ছেলে নেই-তিনটাই মেয়ে। উর্মিলা এ গাঁয়ে বিয়ে করে বউ হয়ে আসার বারো বছর পর সখিনা এসেছে বউ হয়ে। উর্মিলার স্বামী মরেছে বছর দশেক আর সখিনার বরকে বাঘে নিল গত চৈত্রে। তখন সে তৃতীয়বারের মতো পোয়াতি। মাঝে মাঝেই ভয়ানক খিদে পেত তার। এদিকে স্বামী বাদায় গেলে দিনের বেলা চুলা জ্বালাতে নেই। সখিনা এক দুপুরে খুব খিদে পেলে চুলায় আগুন ধরিয়ে কয়েকটি পুঁটিমাছ ভেজে একথালা বাসি পান্তা বাড়তি খেয়ে ফেলেছিল। শ্বশুর-শাশুড়ি ছিল দুপুরবেলার ঘুমে অচেতন। তবে মাছ ভাজার গন্ধে শাশুড়ি জেগে গেছিল আর ভয়ে মড়া কান্না শুরু করেছিল, ‘চুলো জ্বালালি বউ? এবার একটা অঘটন না ঘটিই যায় না। ছেলেটা বাদায় আমার। বনবিবি আর কি তাকে দয়া করবি? বাঘের হাত থেকে আর কি তাকে বাঁচাবি?’
‘আবাগীর বেটি- তোর
খিদে পেয়িচিল তো বাসি ভাত পোড়া মরিচ দিয়ি খালিই হতো। চুলো জ্বালাতি গেলি কেন দিনির
বেলা? বাঘ তোর সোয়ামিকে নেবে না তো কি অন্যের সোয়ামিকে নেবে?’
এই শুরু হলো শহর বানুর কীর্তন! ছেলে মরার পর এক চৈত্র গিয়ে ফিরে চৈত্র আসলেও শহর বানুর পুত্রশোক এবং পুত্রশোকের জলজ্যান্ত কারণ পুত্রবধূর প্রতি মেজাজ কিছুমাত্র কমেনি। সে শোক এবং মেজাজ যখন তখন চড়ে যায়। আর চেঁচাতেও পারে শহর বানু খনখনে গলায়। আসল কথা অন্য। সখিনাকে ওর শ্বশুরবাড়ির লোকরা আর রাখতে চাচ্ছে না। এমনিতেই বাঘ বেওয়াদের কে-ই বা ঘরে রাখতে চায়? সখিনা সবার হাতে-পায়ে ধরে থাকার চেষ্টা করছে বটে তবে এভাবে আর কদিন পারবে? বাঘ বেওয়াদের কে-ই বা ভালো চোখে দ্যাখে? তিনটা মেয়েকে নিয়ে সরকার থেকে আইলার পর যে উঁচু বাঁধ করে দিয়েছে এই পানখালী গ্রামের শেষতম কিনারে, সেখানেই উঠতে হবে সখিনাকে। পলিথিন আর শক্ত বাঁশের খুঁটি দিয়ে বানানো ঘরে কিছু বেওয়া নারী তাদের বাচ্চা-কাচ্চাসহ তো সেখানে উঠেই গেছে। বিধবা কি বেওয়া মেয়েদের বাপের বাড়িই কি নেয়? নেহাত উর্মিলা রানীর বয়স হয়েছে আর শ্বশুর-শাশুড়ি বেঁচে নেই, দেবর-ভাশুররা একে একে সব গেছে ওপারে আর ছেলেটারও বয়স হয়েছে, কেউ মা’কে বাঘ বিধবা বলে গায়ে পড়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে এলে ছেলেটাই উল্টা এক চোট শুনিয়ে দেয়। কিন্তু বাকি বাঘ বিধবা-মুসলমানরা যাদের বলে বাঘ বেওয়া- তাদের কি হাল? বাঘ বিধবা মানেই তো অলক্ষ্মী, ডাকিনী, শয়তান, নষ্ট মেয়ে মানুষ। নষ্ট মেয়ে মানুষ না হলে, সতি-লক্ষ্মী না হলে সোয়ামি কারও বাঘের পেটে যায় না! কিন্তু এটা ভগবানের কেমন বিচার? গত দশ কি বারো বছরে তাদের বুড়িগোয়ালিনীতেই গ্রামে গ্রামে কতগুলো পুরুষ বাঘের পেটে গেল তার হিসাব কে রাখে? উর্মিলা রানীর বয়স হওয়ার পর হাতের শাঁখা ভেঙেছে। তার মেজ দাদার দু-দুটো মেয়ে অমলা আর ফুলবাসী তো কাঁচা বয়সের বিধবা! গাবুরার ওদিকটায় বড় মামা যখন তখন এই গিরস্থ বাড়ির পুকুরের পাশে কি রান্নাঘর পর্যন্ত চলে আসে। কত নিয়ম মানা যায়? বাদায় না গিয়েও তো মানুষ মরে। বড় মামার আসার কোনো ঠিক আছে? সারা বছর কি মানুষ ঘর না লেপে-পুঁছে, চুল না আঁচড়ে, গায়ে সাবান না মেখে কি কাপড় না ধুয়ে থাকবে? সাতক্ষীরার বাওয়ালি গ্রামগুলোয় যত পুরুষ মারা যায়, তাদের সবাই অলক্ষ্মী? সবাই নষ্ট মেয়েমানুষ?
‘মাসী!’
চারুবালার দিকে
তাকালে মনটা ভয়ানক খারাপ হয়ে যায় উর্মিলার। তার ছোট মেয়ের চেয়েও বয়সে ছোট। বিয়ের
এক বছরের মাথায় হাতের শাঁখা ভাঙল। স্বামী গেছিল মধু কুড়াতে। যাত্রা শুরুর আগে যা
যা নিয়ম-কানুন সেই পূজা-অর্চনা, নৌকার গলুইয়ে ফুলের মালা, সিঁদুর ছুঁইয়ে, বনবিবির
নাম করেই সবাই বের হয়েছিল। আগের রাতে বনবিবির পালাও হয়েছিল। দুখে আর ধনাইয়ের গান
গাওয়া হয়েছিল। যাত্রা করার সময় মুখোশও পরে নিয়েছিল সবাই। বাঘ কিনা বাওয়ালি, জেলে
কি মউয়ালদের পাছার দিকটায় হামলে পড়ে, বোধ করি মানুষের পাছার মাংস বাঘের মুখেও রোচে
ভালো। সে জন্যই বাদায় যাওয়ার সময় বাওয়ালি, মউয়াল কি জেলেরা সব পিঠের দিকে একটা
মুখোশ পরে নেয়। যেন বাঘ পিঠের দিকে ঘাড়ে লাগানো মানুষের মুখোশ দেখে বুক না পিঠ
চিনতে না পারে! বাঘ তো পেছনে থেকেই সবটা সময় হামলে পড়ে মানুষের ওপর!
‘বাপের বাড়ি থেকে
বড়দা না এসিচিল? কি কয়িচে? ফিরতি পারবি না?’
‘নাগো মাসী-বাপের
বাড়ি শ্বশুরবাড়ি সব জায়গায় আমিই পাপী। আমার স্বামীকে বাঘে খেয়েচে আমার দোষেই। ’
চারুবালা সাদা থানে
চোখ মোছে।
‘তোর বড় ভাশুর কি
তোকে রাত-বিরেতে এখনো জ্বালায়?’
‘জ্বালায় না
বদমাশটা? তা নিয়ি আবার জায়েরা আমার সঙ্গে সারাটা সময় ট্যারা-ব্যাঁকা কতা কয়। বিধবা
বলি সংসারের সব দাসীগিরি আমিই করি। আমার আর বাঁচতি ইচ্ছে করে না মাসী। হাতে রাম দা
নিয়ি ঘুমোই। মাসী-প্রফুল্ল চেয়ারম্যান কাকা নাকি সম্পর্কে তোমার দেওর?’
‘ও হয় একরকম। ’
‘তাকে বলো না মাসী
আমাকে একটা ভিজিএফ কার্ড দিতি আর আমাকে ঐ আইলার বাঁধের ওপর একটি পলিথিনের ঘরে
জায়গা দিতি। ভিজিএফ কার্ড নাকি বয়স না হলি পাওয়া যায় না। কিন্তু আমি ত’ বিধবা
মাসী!’
‘কার্ডে যা চাল পাই,
তাতে কি আর সংসার চলে? প্রীতমের বাবা স্বর্গগত হবার পর থিকি ত’ কাঁকড়া ধরি, রেণু
পোনা ধরি- জাল দিয়ি মাছ ধরি সংসার চালাই। ছেলের ঘরে বউ আসার পর থিকি ত’ আমি নিজের
খরচ নিজিই চালাই। দুই মেয়ের বিয়িতেও কর্তা নগদ কিছু রাখিছিলেন আর আমার দশ বছরের
গতর খাটিয়ে মাছ ধরার টাকা দিয়ি যা করার করিছি। শ্বশুরবাড়িতে দাসী না হয়ি থিকি
নিজিই বরং মাছ ধর্, রেণু পোনা ধর্- আইলার বাঁধের ওপর মুসলমান মেয়ে তোরই বয়িসী আর
বেওয়া ত’ কয়েকজন উঠিছে- কই কি তুই বাঘ বিধবা, বাঘ বেওয়া -ক্ষমা-ঘেন্না বাদ দিয়ি
বাঁধের ওপর ওঠ্। আমি কবো নে প্রফুল্লকে!’
(২)
বনের হরিণ সব খোদার মেহের।
হামেশা পালন করে বনবিবি তরে।
বেহেশতের হুর এসে কোলে কাঁখে নিয়া।
: বনবিবির জহুরনামা
বাঁধের ওপর পলিথিন ছাওয়া ঘরে বসে গুনগুন করে বন বিবির পুঁথি গাইছিল পারুল বেওয়া।
‘তুমি মনে কতিছে
নিরঞ্জন বৈদ্যর নাতনি চারুবালা না? তুমি এই বাঁধের ওপর আসি কি করো? গায়ে সাদা থান
দেখতিছি?’
‘জী- দাদি-আমি গেল
পউষে বিধবা হয়িছি!’
‘হা কপাল! তা’
শ্বশুরবাড়ি থেকে তাড়ায়ে দিয়িছে? বাপের বাড়িতেও ঠাঁই হলো না? তোমার ঠাকুর্দ্দা আমার
খেলার সাথি ছিলো বুঝিছো? আমি আজ ত্রিশ বছরের ওপর বিধবা। বিধবা হবার পর শ্বশুরের
ভিটি থিকি দিলো তাড়ায়ে। জিদ ছিল আমার। কারো কাছে হাত পাতিনি। নদীতি কাঁকড়া ধরিছি,
রেণু ধরিছি। এখন শরীরে বল পাই না। ভিক্ষে করি। আর মন সুখে থাক দুঃখে থাক বনবিবির
পালা গাই। ছেলে-মেয়ে আচে?’
‘না, বেশিদিন হয় নি
বিয়ি। ’
‘বলি নতুন জীবন
শুরু হবে একানে। এই আমি আর এক বাঘ বিধবা। দু’টো ছোট ছেলে আর একটি মেয়ের মুখি ভাত
দিতি সারাদিনই গাঙ্গে থাকি রে মণি! গাবুরা কও, বুড়িগোয়ালিনী কি শ্যামনগঞ্জ- হাজারে
হাজারে নারী আমরা সবই বাঘবিধবা- সবার ঘেন্না আর দূর ছাইয়ের মানুষ! তবু জীবনের শেষ
দিন পর্যন্ত ঐ বনবিবি, শাহ জংলি, দক্ষিণ রায় কি পাঁচপীর, ঐ দুখে আর ধনাইয়ের পালা
গেয়ে মরতি হবে!’
অমলা বালা মাসীকে
ত’ বোধ করি আগে দেখেছে কোথাও চারু বালা?
‘আমার ত’ ঘরে ছেল
না চাল। দু’বছর আগির কথা। মহাজনের কাছ থেকে টাকা দাদন নিয়ি সোমবার মানুষটা গেল
বাদায়। মঙ্গল আর বুধবার বাদায় থাকার পর বেস্পতিবার শুনলাম তারে বাঘে ধুরিছে। লোকে
কয় আমি বেশ্যা- আমার স্বামী নেই। তবু জীবন ত’ চলতিছে। আমার মাও ছেল বাঘবিধবা। তারও
ছিল ঘেন্নার জীবন। আমিও বাঘবেওয়া। আমার মেয়েকে আর বিয়িই দেব না। দিলিও বাদার
মানুষির সাথে না!’
নাসরীন বেগম চোখ
মোছে।
‘আমার তেনি ছেলেন
মউয়াল। মধু কুড়াতে গেলি ত’ মশাল জ্বালতে হয়। ধনু পোড়ানো নাগে। ধনু পোড়ার গন্ধ আর
আগুনির ধোয়া দেখলিই বড় মামা বুঝি যায় যে ধারেই কোথাও মনিষ্যির মাংস। ’
সূর্যদাসী এমনভাবে
নাক টানে যেন বাঘের হয়ে সে নিজেই মনিষ্যির মাংসের ঘ্রাণ পাচ্ছে।
‘গরিব মানুষের
প্যাটে সব সময় খিদে নাগতি নি। আমাগো খিদে মরে গে। বিকেলে এট্টা মাছের ঘিরে যেয়ে
থালাবাসন মাজে পাঁচ টাকা পাবুনি, তা দে মুড়ি কেম্বা চিঁড়ে কিনে খাইয়ে রাত কেটে
যাবেনে। নদীতি কাঁকড়া শিকার করতি গিয়ি পেছন থেকে বাঘে এসে আমার সোয়ামীকে ধরলো।
আইলার পর থিকি আজ কতগুলো বচ্ছর হাতে ভাল কাজ নেই, খাবার নেই!’ সোনামণি দিদি কত
শুকিয়ে গ্যাছে এ কয় বছরে!
‘মঞ্জিলা, রহিমা,
ফজিলা, নূর নাহার ত’ এলাকা ছাড়িছে। ঢাকা গেয়িছে। সেই বাদা থিকি নদীতি ভেইসে আসা
গোলপাতা কুড়িয়ে বিক্রি করি কি দোকানে দোকানে কি বাড়িতি বাড়িতে পানি টানি দিয়ি
শরীরটা আর বয় না!’
হাই তুলে বললো
দিপালী।
‘বলি সবাই মিলি কি
শোক মাতমই করবি? আজ না বনবিবির পূজো? সাঁঝ পড়ি আসতিছে। ভুল-চুক যাই করি মায়ের থানে
ত’ যেতিই হবি!’ পারুল বেওয়া নড়ে-চড়ে বসে। বাঁধের ওপর ত্রিশ-চল্লিশটা পলিথিন ছাওয়া
বাঘ বিধবাদের কুঁড়েতে পারুল বেওয়াই সবচেয়ে বেশি বয়েসী। তার কথা সবাই মানে।
‘যাব না ঐ বনবিবির
থানে। বিনা দোষে আমাদের সোয়ামীকে কেড়ি নিয়িচে!’ সূর্যদাসী কেমন চেঁচিয়ে ওঠে।
‘চুপ-চুপ! এ কথা
বলাও পাপ! চলো দিখি- সবাই গাটা তোল! বনবিবির থানে মণ্ডল মশায় হয়তো এতক্ষণে পাঁচালি
পাঠ শুরু করি দিয়িছে?’
‘বরিজহাটিতে ধোনাই মোনাই নামে দুই ভাই বাস করতো। একদিন তারা সপ্তডিঙ্গা সাজিয়ে সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ করতে গেল। তাদের সঙ্গে এক দুঃখিনী মায়ের এক পুত্র দুঃখেও গিয়েছিল। তারা গড়খালি নদীতে পৌঁছালে দক্ষিণ রায় নরবলি দাবি করলেন এবং দুঃখেকে বেছে নিলেন। ধোনাই ও মোনাই অসহায় অবস্থায় দুঃখেকে রেখে গেল। দুঃখের মা বনবিবির সাহায্য প্রার্থনা করলেন। এক অসহায় মায়ের করুণ ক্রন্দনে তিনি সাড়া দিলেন। তখন আরব দেশের বেরাহিম সাহেবের স্ত্রী গুলাল বিবি যিনি সতিনের কথায় স্বামী কর্তৃক ত্যাজ্য হন, এক জাহাজে ভাসতে ভাসতে এসে এই বাদায় যে কন্যা বনবিবি আর পুত্র শাহ জঙ্গলির জন্ম দিয়েছিলেন, সেই বন বিবি তার ভাইকে নিয়ে এসে দুঃখেকে বাঁচালেন আর আঠারো ভাটির ওপর তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করলেন।’
‘কহে মা বনবিবি কোথা রইলে এই সময়, জলদি করে এসে দেখ তোমার দুঃখে মারা যায়।
কড়ার দিয়েছো মাগো যদি না পালিবে ভাটি মধ্যে তোমার কলঙ্ক রয়ে যাবে।’
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন