সোমবার, ১৪ জুন, ২০২১

অমলেন্দু চক্রবর্তী

 

সমকালীন ছোটগল্প


অর্কেস্ট্রা

 

এখন উচক্কা ছিঁচকে মস্তান মাফিয়া সব। সব্বার যেন এখানেই আবির্ভাব। জায়গটা আগে তো এমন ছিল না! এখানেই বেড়ে উঠছে দুলাল। গায়ক দুলাল।  এই অঞ্চলে কিশোরকুমারের গান গায় অর্কেস্ট্রায়। মহিলা কন্ঠে মালবিকা হাজারি। মালবিকা শুধু আশার গান করে। লতার মত কোকিলকন্ঠি হল দেবী ঠাকুর। ইনি হলেন রাঁচির বাসিন্দা। ডোলা নেপালী লেদার ইনস্ট্রুমেন্টস ট্রিপিল কঙ্গো বাজায়। ড্রামসেট-জার্জসেট বাবলা, স্প্যানিস ঘনশ্যা্‌ম, অতুল কিবোর্ডে। আসর জমাবার জন্য ধুন বাজতে শুরু করে। আলোর খেলা চলতে থাকে। মস্তিতে সব।  ঝুম-বরাবর ঢোলকে মিলন বিশ্বকর্মা, পাড়ার ছেলে, বহু জায়গায় হায়ার করে  নিয়ে যাওয়া হয়।

-এখন আপনাদের সামনে গাইতে আসছেন দুলাল সরকার। দুলাল মঞ্চের বাইরে থেকেই কর্ডলেস মাউথপিসে গান গাইতে গাইতে ঝুমঝুম ঝুমঝম ঝুমরু…

গাড়িটা তীরের বেগে ছুটে চলেছে গন্তব্যের দিকে। রাত একটা। নিস্তদ্ধ পথ।  অনুষ্ঠানের শেষে বাজনদারেরা বেশি ক্লান্ত, তাদের চোখে ঢুলুনি।

-মালা ভেবে দেখেছ?

-ভেবে দেখার কিচ্ছু নেই।

-কেন?

-এটা আবার লাইফ নাকি!

-আর্টিস্টদের জীবন এই রকমই।

-নাহ এমন নুন আনতে পান্তা ফুরানোর জীবন আমার হতে পারে না!

-শিল্পীদের জীবন তো এমনই হয়!

-শিল্পকলা আমার কাছে টাইম পাস ছাড়া আর কিছুই নয়। জীবন হতে পারে না। দুলাল গাড়ির পরিবেশ মেপে নিয়ে মালার হাত নিজের হাতে তুলে নেয়।

-আই লভ ইউ মালা।

-হাত ছাড়ো দুলাল, বাস্তবতা থেকে মুখ ঘুরিও না। হিন্দিতে একটা কথা আছে জানো ‘ঔকাৎ’ ওটি ভুল না। আর আমার জন্য তোমার ঐ ঔকাৎ অচল। আমার কোন ইচ্ছেই নেই এভাবে।

-আমি কি এতটাই তোমার অযোগ্য, মালা বল প্লীজ!

-জীবনে অভাব অভিযোগ ঢুকলে সমস্ত আই লভ ইউ পিছন দিকের জানলা গলে পগার পার। এমন কেলিয়ে পরো না তো, প্লীজ প্লীজ! হাত ছাড়ো!  

ডোলা দুলালের উদ্দেশ্যে বলে, দুলাল মালা এখন আমাদের টিমের রেসপন্সবিলিটিতে আছে। পেয়ার নিবেদন করবি বাড়িতে গিয়ে।

মেজাজ খিঁচিয়ে যায় দুলালের। হাত ছুঁড়ে দেয় তারই কোলে। গাড়ির বাইরে নিকষ কালো অন্ধকার। তার মুখটার মত। মালা তাকে প্রত্যাখান করছে। কিন্ত কেন?  ভাবা যায়! অদ্ভুত একটা কষ্ট  তার বুকের ভিতর মোচড় খাচ্ছে। মনে হচ্ছে, সব কিছুই কি এমন অর্থহীন জীবনে প্রতিষ্ঠা না পাওয়ার জন্য?  

বাবলার গার্লফ্রেন্ডের বাবা। একজন কবি। বাবলা সরকারি চাকরি করে, আর সংগীত তার সাধনা। চুয়া বাবার আদর্শের একমাত্র কন্যাসন্তান। লাইব্রেরি, বই, সাংস্কৃতির অনুষ্ঠান আর অবৈতনিক প্রাইভেট টিউটর। টিভি চ্যানেলগুলির চাট চাটনির মোহড়া ওর মোটেই ভালো লাগে না। সে কারণে ও দেখেও না, আর দেখা পছন্দও করে না আজকের দিনে অন্তত এনরয়েড সবার কাছে। চুয়া বলে,  ও বড়লোকি বিলাসিতা ছাড়া কিছই নয়! এই টু জি মোবাইলে যখন কাজ চলে যাচ্ছে, তখন শুধু শুধু…

ডোলার কাশিটা ক্রমশ বাড়ছে। কন্ট্রাক্টারির চাকরির পর গানবাজনা ভালোই চলছিল। হঠাৎ যে এরকম হবে, ভাবেনি! কিসের ইঙ্গিত কে জানে! তারপর শুরু হল টানাহেঁচড়া, ভেলোর ধানবাদ আবার ধানবাদ ভেলোর। কর্কট রোগ আক্রান্ত  ডোলার জন্য জনে জনে চাঁদা তোলা হতে লাগল। চিকিৎসা ওষুধ যন্ত্রণা। বাদ্যযন্ত্র আর না। একদিন ডোলার প্রাণবায়ু স্তদ্ধ হয়ে গেল। আরো কিছুদিন প্রক্সি দিয়ে চল, অচল হতে লেগেছে। দেবী আর আসে না। মালবিকা গান ছেড়ে দিয়েছে। চুয়া বাবলার জীবন সঙ্গিনী হয়ে এখন পরিবার।

দুলালকে শেষ দেখা গেছিল দামোদর ঘাটে। ডোলার চিতার পাশে হেরে যাওয়া এক শিল্পী, মাদকাসক্ত উৎশৃঙ্খল আপাদমস্তক। সে নদের ওপার গাছের ভিড়ে  হারিয়ে গেছিল। দোয়েল কোয়েল মাছরাঙা কাঠঠোকরা আর কাঠবেড়ালির ভিতু  ছুটে বেড়ানো। আঁশফল মহুয়া পলাশের ভিড়ভাট্টার হাতছানি। ধীর পায়ে সেদিকে চলে গেল। তারপর ওর আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। নাকি তার খোঁজ করার কেউ দরকার মনে করেনি? এমনিই হয়ত কিছু একটা হবে। দুলালের জায়গায় আরেক কিশোরকুমার জুটেছিল বটে। তবে তার সুরা না হলে সুর বেরোয় না। বাবলারা ওকে টলারেট করতে পারেনি। গাওয়ার চেয়ে বেশি দিখাওয়া করে।  মেয়েরা নাকে রুমাল দিয়ে থাকে। মালবিকাও একদিন দল ছেড়ে দিল। অর্কেস্ট্রা পার্টিটাও ক্রমশ গুটিয়ে আসতে লাগল।  


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন